মেঘ চুরি

সে অনেক কাল আগের কথা। মেঘ নিয়ে আমার আগ্রহ তখন তুঙ্গে। এদের চঞ্চল চালচলনের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সুযোগের অপেক্ষায় বাদ দিয়েছি কত শত দিন ভাতঘুম। তারপর একদিন ঠিকই আকাশের চোখ ফাকি দিয়ে এক চিলতে মেঘ চুরি করে আনলাম।
ব্যাপারটা ঘটল বসন্তের লগ্ন হারা এক বিকালে। আমি আর সুদেষ্ণা দুজনেই আমাদের প্রিয় দেবদারু গাছতলায় শুয়ে আছি। বরাবরে মতো দুজনেই বড্ড ক্লান্ত। সুদেষ্ণার চুলে বিলি কাটছি। সুদেষ্ণাও আমার বুকে এক মনে আকিবুঁকি করছে। কেউ কোন কথা বলছি না। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে .  দুজনকেই ফিরতে হবে অনেক ক্রোশ পথ।
ওইদিন কিছুতেই ওকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। কবে সেই দিনটা আসবে? যেদিন এক সাথে থাকতে কোন বাধাঁ থাকবে না। পাল পার্বণ আসতে কত দেরী? সেদিনই অনুমতি পাওয়া যাবে। আমি সদ্য শেখা উইপোকার এক অপরিচিত সুর গুন গুন করছি।  শুনতে শুনতেই সুদেষ্ণা বললো, দেখ! দেখ! কি আর্শ্চয সুন্দর মেঘ! কখনো পঙ্খিরাজ ঘোড়া হয়ে যাচ্ছে কখনো বা সারস। ইশ! মেঘ যদি আমাকে আকতো? সুদেষ্ণার কথাটা কেমন যেন মনে ধরে গেল। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেঘের আঁকিবুঁকি খেলা দেখে সন্ধ্যা হবার কথাও ভুলে গেলাম দুজনে। “চাই , এক টুকরো মেঘ! বল দেবে না?” – সুদেষ্ণার ছেলেমানুষি না পাগলামি?
আমার বাল্যবন্ধু বাতাসের সাথে কথোপকথনে জানতে পারলাম ভর দুপুরে আকাশ একটু বিশ্রাম নেই। সেই সময় চাইলে আকাশের চোখ ফাকি দিয়ে মেঘটাকে চুরি করা সম্ভব। রাতে অসম্ভব পাহাড়া আকাশের। দুপুরের দিকেই সুযোগ। শুনেই আমার মধ্যে এক টুকরো মেঘের জন্য মনটা অস্থির হয়ে পড়লো। এক টুকরো মেঘ আমার বাড়ীর বাগানে সাজিয়ে রাখবো আমার র্সূযমূখী আর বাগান বিলাসের মত। ইচ্ছে হলেও মেঘের কোলে ঘুমিয়ে পড়বো। আবার ইচ্ছে হলেও মেঘ দিয়ে হাতি, ঘোড়া, র্মূতি বানিয়ে বানিয়ে খেলবো। সুদেষ্ণার একখানা র্মূতি যদি মেঘ দিয়ে বানিয়ে বাগানে সাজিয়ে রাখি সে যে কি ভীষন আর্শ্চয হবে!
এর পর থেকে প্রতি দুপুরে আমি ওৎ পেতে থাকি। আর আকাশের ঘুমানোর অপেক্ষা করতাম। আকাশ হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার দূরভিসন্ধি। কখনো দু চোখের পাতা এক করতো না। আমি দেবদারু গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতাম। মেঘেরাও অবাক হতো। আমার এমন অবাক করা তাকানো দেখে। হয়ত ভাবতো আমাদের মধ্যে কোন এক আত্মীয়তার বন্ধন আছে; কোনও এক অদৃশ্য শক্তি আমাদের দুজনকে পরস্পরের দিকে টেনে রেখেছে। আমাকে দেখে যতটা সম্ভব আনন্দ দেবার চেষ্টা করতো। একদিনতো হুবুহ আমার সাজ নিয়ে ফেললো। যেন আমি দীঘির জলে ছায়া দেখার মত আমাকেই দেখছি। এদের মধ্যে একটা বিশেষ মেঘকে মনে মনে বেছে নিলাম, বাকিদের থেকে কেমন একটু আলাদা থাকতে চাই। দেখলাম বড়ও না আবার ছোটও না, অনেকটা রাজহাসের মতো দেখতে শেষপ্রান্তে একখানা মাছের মতো লেজ। ওটাই সবচেয়ে আর্কষনীয়। কখনো কখনো লেজটা নড়ে উঠছে। আসলে নড়াচড়া জিনিসটা মেঘদের বোধহয় খুব প্রিয়। এরা একেবারেই স্থির থাকতে পারে না। এ কদিনের অভিজ্ঞতায় বেশ বুঝেছি। স্থিরতা কি এদের র্ধমে নেই?
ওদের এই অবিরল চঞ্চলতা- এটাই আমায় সেই প্রথম দিন থেকে আগ্রহী করে তুলেছিল সে তো আগেই বলেছি। এবার বরং কিভাবে মেঘটাকে আমার কাছে নিয়ে এলাম সেই গল্পই বলি। বরাবরের মতই আমি অশথের তলে দাড়িয়ে আকাশের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছি। হঠ্যাৎ করেই র্সূযটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। সুনসান নীরবতা। গাঢ় অন্ধকার।   র্সূযগ্রহন নাকি আজ? ভাবতেই আমার কানে কানে বাতাসটা বলে গেলো এখনই সুযোগ। আমি ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। শিষ দিতেই পঙ্খীরাজ হাজির। পিঠে থাবা দিয়ে মেঘের দিকে ইশারা করলাম। মূর্হতেই উড়াল দিলো পঙ্খিরাজ। মেঘের কাছাকাছি আসতেই দড়ি দিয়ে বেধে ফেললাম মেঘটাকে। মেঘটাতো ভয়ে আধখানা। আকাশ তখন র্সূয হারাবার বেদনায় বেসামাল। এত কিছু দেখার সময় কোথায় তার? আমি আস্তে আস্তে পঙ্খিরাজ ঘোড়ার পিছনে দড়িটা লাগিয়ে টানতে টানতে মেঘটাকে নিচে নিয়ে এলাম। অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য।
এক টুকরো মেঘের মালিক এখন আমি, সাজিয়ে রেখেছি আপাতত দেবদারু তলে। সুদেষ্ণাকে আপন করে পেলেই বাড়ীর বাগানে নিয়ে যাব। অবিকল সুদেষ্ণার মত সাজিয়েছি মেঘটাকে। আজ সুদেষ্ণার আসার কথা আছে। কি কান্ডটাই না আজ হবে! ওর চিৎকারে উড়ে যাবে এ জংগলের সব পাখি। আমি মুচকি মুচকি হাসবো। ভালবাসার মানুষকে এমনতর বিষ্ময় কে দিতে পারে বলো?

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত