ওভারকোট

তখন সন্ধ্যা। ধানক্ষেতের প্রান্ত ধোঁয়া ধুলায় একাকার। কাছে পাইলচারা বিলের ধারে জ্বলে উঠছে মাছ পাহারার বাতি। কালিসন্ধ্যা তাতে আবার পাইলচারা বিল, এত বড় সেয়ানা তো হইনি আমরা। লালবাগহাট থেকে বাইসাইকেলে বাপের মতো মাল নিয়ে ঝুমুত ঝুমুত আওয়াজ করে বাড়ি ফিরব। বিলে আলাই মারব। মাছ মারতে গিয়ে বিষাক্ত সাপের শরীরে কোচ মারব। সেদিন এখনো আসেনি। তবু যে, এই ভূত প্রেত মশান ডাকাতদের আখড়ার পাশে ক্ষেতের নাড়ার উপরে বসে আছি দুই ভাই? কারণ, মা বলেছে, তোরা দুইজনে পাইলচারা থেকে ধানের ভাগ নিয়া আয়। আমরা যখন পাইলচারা এলাম তখন তো বিলে গোধূলির রঙিন আলো। সূর্য ডিমের কুসুমের মতো আভা ছড়াচ্ছে। বড় রাস্তা ওপারে। রাস্তার ওপরে হরেক রকম চলাচল। তাইতে ধুলায় ধুলাকার। তমিজ যাদু হাঁক দিয়ে বলে, দোনো ভাইয়ে মিলি আলচেন বাহে, ধানের ভাগে নিবার তখনে? আমরা বলি, হ যাদু। মনে মনে বলি, হামরা যে চালাক, হামাক ঠকবারে পাবান ন্যান। আমরা আইলের উপর বসি আর তমিজ যাদুর আঁটি ভাগাভাগি নিরখ করি। আঁটি গুনি, খেই হারাই আবার গুনি, সব আঁটি ভাগশেষ হলে তমিজ যাদু বলে, কোনটা নেমেন কন এলা। আমরা দেখি দুইভাগই সমান। তখন ভাগ দুইটা ঘুরে ঘুরে দেখি। দেখে ফোলা ফোলা ভাগটার দিকে আঙ্গুল তুলে বলি, এইটা। তখন তমিজ যাদুর লোকেরা একটা গরুর গাড়িতে আমাদের ভাগ ওঠাতে থাকে। এই ফাঁকেই সন্ধ্যা হয়। হিমহিম উত্তুরে বাতাস এসে এসে কাঁপিয়ে দিতে থাকে। আমি বলি, বিশুরে জাঁড় নাগে। বিশু বলে, মোকও। যাদুরা কাছে। তবু ভূত-প্রেতের ভয়ও লাগে। তখন আমরা যাদুদের কাছে ভিড়ি। গাড়িতে ধান চাপানো শেষ হলে বাঁশ দড়িতে আচ্ছা করে ধান বেঁধে আমাদেরকে ঘাড়ে তুলে ধানের গাড়ির উপরে তুলে দেয় তমিজ যাদু। বলে, বাঁশটা ভালো করি ধরি থাকমেন। আমরা বাঁশটা ভালোমতো ধরে থাকি। গাড়িতে গরু জুড়ে ধুর ধরে রওনা হয় গরুরগাড়ি। হ্যাক্কর দোক্কর দোলা বাড়ি। এই মনে হয় বিশু পড়ে। এই মনেহয় আমি পড়ি। দোলাবাড়ি শেষ হলে গাড়ি বড় রাস্তায় ওঠে। তখন আমরা শুয়ে পড়ি। আবার যখন নিচু গাছ আসে তখনো শুয়ে পড়ি। ধানের গরম আরগন্ধ তখন শরীরে লেগে যায়। বাড়ি ফিরলে সাথে সাথে মা বলে, যা গোসল করি আয়। গরম কাপড় পরি পড়া করবার বইস। হিম ঠাণ্ডার মধ্যে আমরা গোসল করতেও না পড়তেও না কিছু করতে ভালোবাসি না। মা তবু পিছু ছাড়ে না। তখন আমরা হাতমুখ ধুয়ে আসি। মা বলে, হয় নাই, গাও ধুয়া আয়। আমাদের তখন সম্মানে বাধা লাগে। ক্ষেতের কাজ করে ফিরে আমাদের তো মনে হয় আমরা বাঘ মারছি। মা বলবে, আয় বাবারা, আজ সন্ধ্যায় আর হাতমুখ ধোয়ার কাম নাই। খাইতে দেই। খায়াদায়া বুড়াবুড়ির সাথে গপসপ কর। তা না করে মা বলে, হয় নাই, গাও ধুয়া আয়। আমরা বলি, ব্যাপারির বেটি, গাও ধুবার পাবান নেই। মা তখন মারে। বলে, শয়তানেরা যা বাড়ি থাকি বাইর হয়া যা। আমরা তখন উঁ উঁ করে কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতে উঠানে গড়াগড়ি দেই। মা তখন আরো মারে। আর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে উঠানের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। আমরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যাই দাদির কাছে। বুড়াবুড়ি আবার রাত্রে রুটি খায়। দুধ আর ঝোলাগুড় দিয়ে মাখিয়ে গমের রুটি খায়। আমাদের কাঁদতে দেখে দাদা বলে, কী হইছে দাদা, আয় মোর কোলোত আয়। আমরা দুই ভাই দাদার দুই কোলে বসে পড়ি। তবুও কান্না থামে না। বলি যে, ব্যাপারির বেটি খালি ডাঙ্গায়, একনাও আদর করে না। ওই মাওয়ের মুখও দেখবার চাঁও না। দাদি তখন না রাগে মাকে বকতে থাকে। বউ-শাউড়িতে যদি ঝগড়া বাঁধে এইভয়ে আমরা চুপ থাকি। তখন দাদা একটা গল্প ধরে। আমরা কান্না থামিয়ে দাদার গল্প শুনি। দাদিও বকা বাদ্য বন্ধ করে গল্প শোনে আর রুটি ভাজে। রুটির গন্ধে আমাদের ক্ষুধা লাগে। দাদা বলে রুটিখেকো পশ্চিমাদের গল্প, যারা ছাতু খায় পানি খায় আর খায় রুটি। দাদা বলে পশ্চিয়া ভূত আড়াবাড়িত শুত। সেই সব দশাসই পশ্চিমারা শুধু মাইলকে মাইল মাটি কাটে। আর রুটি খায়। রুটি খেকো পশ্চিমাদের গল্প শুনতে শুনতে তৈরি হয়ে আসে দুধ ঝোলাগুড় আর রুটির মাখানো খাবার। বুড়ি আমাদেরকে তুলে খাওয়ায়। বুড়ির হাত ফাটা। খরখরে। তবু খুব ভাল লাগে সেই রুটি। খাওয়া শেষ হলে বুড়ি মুখ মুছিয়ে দেয়। আমরা দুই ভাই দাদাকে জড়িয়ে ধরে বলি, দাদা আরাকটা গল্প কন। দাদা বলে, আইজ না কাইল। আমরা বলি আইজে কন দাদা। তখন দাদা বলে, দিল্লী আগ্রা না হায়দ্রাবাদে ছিল দুই ভাই। একজনের নাম ছিল শওকত আলী আরেকজনের নাম…। আমরা বলি, দাদা খুব জাঁড়। তারপর দাদাকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে তার ওভারকোটের ভিতর ঢুকে পড়ি। ঢুকে গলা বের করি তার গলার পাশ দিয়ে। দাদা তখন বলে, মোক মারবু নাকি। হাত দিয়ে মাথা বের করেক। হাতা থেকে হাত বের করে দাদা। ডান হাতা দিয়ে বিশু, বাম হাতা দিয়ে আমি মাথা বের করি। দাদা বলে, একদম নড়াচড়া করিস না। চুপচাপ থাক। ওভারকোটের আর দাদার শরীরের গরমে চুপচাপ গল্প শুনতে থাকি আমরা। আরেকজনের নাম মোহাম্মদ আলী। বলি, দাদা এইটাতো গল্প না, সত্য কথা। এই কথা বলি, কারণ আমাদের বাবা শওকত আলী আর চাচা মোহাম্মদ আলী। বলি, একটা গল্প কন দাদা। দাদা বলে,ওই দুই ভাইয়ের নামও শওকত আলী আর মোহাম্মদ আলী। তখন ব্রিটিশ আমল। দুই ভাইয়ের খুব মিল। দুই ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল…। আমাদের চোখে ঘুম লেগে আসে। একসময় ঘুমিয়েই পড়ি আমরা। দাদা যখন দেখে আমরা আর হুঁ হাঁ করি না, তখন বলে, শয়তান দুইটা নিন আলচে। তখন দাদি বলে, বউ বউ ও বউ, ছাওয়া দুইটাক নিয়া যাও। খায়াদায়া শুতি পলচে। মা জননী, তখন কোলে করে এনে আমাদেরকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

সকাল হলে বিশুর ঘুম ভাঙ্গে সবার আগে। সে তখন আমার কান টানে, চুল টানে। এই সব ঝামেলার কারণে বিশুকে আমার একদম ভালো লাগে না। কিন্তু কী করি। আমরা এখনো অনেক ছোট। নিজেদের বন্ধু-বান্ধব বলতে কেউ নাই। ফলে ওই বিশুর সঙ্গেই ঘুরি। তার আদব-লেহাজ নাই। তবু ওর হাত ধরে ঘুরি। একসঙ্গে আড়াবাড়িতে হাগতে যাই আর সারাদিন মাছমারি। পাড়ার ছেলেপেলেরা আমাদেরকে খেলায় নেয় না। বলে, তোরা দুইভাই একলা খেল। আমরা দুই ভাই তখন রাস্তায় বসে কান্নাকাটি করি। কান্নাকাটি শেষ হলে আধভেজা বালুমাটি বের করি রাস্তার বালু সরিয়ে। সেই বালুতে একজন হাত দিয়ে থাকি আর অন্যজন হাতের উপর বালু চাপা দেই। এমনি করে বালুর ঘর তৈরি করি দুইজনে দুইটা। তারপর দু’জন ফলপাতা হাঁড়ির খোলা দিয়ে ঘর সাজাই। ঘাসপোকা ধরে এনে তাদেরকে নিজেদের ঘরের বাসিন্দা করি। নিজ নিজ বাড়িতে রান্নাবান্না করে একটা পোকাকে পাঠাই বিশুকে দাওয়াত করতে। বিশু বলে, জিটিকে বলবা, বিশু চাজি বাড়িত নাই। রাত্রে আসবে। বিশু তখন, সে বাড়িতে নাই এইটা দেখানোর জন্য আমতলা জামতলা কাঁঠাল তলা ঘোরে। কাঁঠাল গাছের ছালতুলে রং ছেনে আনে। আমিও রাত্রের জন্য রান্নার আয়োজন করি। বিশু এদিক সেদিক ঘুরে হেঞ্চাইয়ের ফল সংগ্রহ করে আমার বাসায় আসে। বলে, ভাই বাড়িতে আছেন? আমি বলি, আইসো, আছি। আমার হাতে হেঞ্চাইয়ের ফল ধরিয়ে দিয়ে বলে, ছেলেপেলেদের জন্য কলা আনলাম। আমি বলি, এই সবের কী দরকার ছিল, বসো বসো। এই করে করে তাকে আমি ফুল পাতা দিয়ে আপ্যায়ন করি। বিশু বলে, আপনি তো আবার পানখান না। পান হবে না বাসায়? আমি বলি, দাঁড়াও দেখি একটু পান জোগাড় করে আনি। পান জোগাড় করতে আমি কবরস্থানের পাশের ঝোপের দিকে দৌড়াই। সেইখানে গেলেই আমার গা ছমছম করে। এখানে দাদার বাপের কবর প্রথমে, সে কবরের উপর লতামাধবীর ঝোপ। তারপর বেলাল চাচাও দাদার মায়ের কবর, এই কবরের পাশে কামিনির ঝোপ। পাশে বেল গাছ। বেল পাতাই আমাদের পান। এইখানে একদিন দাদা বিশু আর আমাকে নিয়ে এসে বলেছিল, মুই মরলে এটেকোনা কব্বর দিবু। তোমরা দোনো ভাইয়ে মোক কবরত নামাইমেন। তাইতে আমার ভয় করে। এইখানে আসলেই দাদার জন্য বুক কেমন করে।

আজ বেলপাতার পান আনতে গিয়া দেখি কবরস্থানের মোড়ে অনেক লোক। সবাই মিলে ইন্দিরা সংস্কারে ব্যস্ত। অনেকদিন পড়ে ছিল এটা। কেউ গোসল করতে আসত না। শান বাঁধানো ইন্দিরা পাড়ে ছেলেরা মার্বেল খেলত। বহুদিন পড়ে থাকা ইন্দিরায় অনেক ময়লা জমেছে। পানিতে দুর্গন্ধ, ভিতরের দিকের দেওয়ালে বট-পাকুড়ের চারা হয়েছে, আরশ্যাওলা জমেছে। ছেলেরা পাকুড়ের চারা থেকে কুঁড়িপাতা তুলে বাঁশি বানিয়েছে। বাজাচ্ছে সেগুলো। বড়রা মাঝে মাঝে তাড়াচ্ছে তাদের। বালতি বালতি পানি তুলে ঘাসের উপর ফেলা হচ্ছে। সেই পানির সাথে বেরিয়ে আসছে সাবান কেস, পয়সা, বালতি, বালতি তোলার শিকল, দা, চাকু, বাঁশের কঞ্চি আরো কতকি। একজন বলে, এটে সোনার মোহরও থাকবার পারে। একজন বলে, কায় নাকি সোনার ঘড়া ভাসপ্যার দেখছিল। আরেকজন বলে, ইলা কিছু নোয়ায়, মুই নেজে পাঁচ সেরি একটা কালবাউশ মাছ দেখছিনু। আমি ভাবি, বাহা বাহা কী হয় দেখি তো। তাই ছেলেপুলেদের দলে ভিড়ে যাই। হাজা মজা পানির গন্ধে নাক ধরে বসে থাকি। আর ভাবি সোনার মোহর ভরা একটা ঘড়া যদি পাইতাম। কিন্তু দেখি যে, মোহর তো ওঠে না। প্রতিবারই পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা কি আধুলিও ওঠে। মনে পড়ে আইসক্রিম খাইতে গিয়া এই ইন্দিরায় একটা আধুলি হারিয়েছিলাম। আমার আধুলিটা এখন আমাকে ফেরত দেবে কে? আমি ছোট মানুষ, আমি কেমনে বলি এই আধুলিটাই আমার। এই ইন্দিরায় জমা ছিল। মহররমের মেলায় খাবার সময় রাস্তায় হারানো আধুলি তো নয়, এইখানে জমা ছিল এইটা।

ছোটদাদা হিসাবি লোক। ইন্দিরার জিনিসপত্র দেখেই বলে, এই বালতিটা হামার আর এই কাঁটাটাও। তখন লোকজন বলে, ধিরান মাস্টার, সউগগুলা তুলি। আরো মেলা কিছু পাওয়া যাইবে। কিন্তু ছোটদাদা কারো কথা না শুনে বালতি আর কাঁটা কব্জা করে চলে যায়। আমি ভাবি আমি যদি আমার আধুলিটা এইভাবে কব্জা করতে পারতাম। এখন কী যে করি। কিছু করতে পারি না। তাই বেলা হেলে ছায়া পড়া পর্যন্ত হাপুস নয়নে বসে থাকি। ক্ষুধা লাগলে বাড়ি ফিরি। বাড়ি ফিরে দেখি দাদা হুলুস্থূল কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আছে। আমি সেই যে পান আনতে গেলাম বিশুকে রেখে। বিশু পানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাস্তাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। অল্পের জন্য ওরগায়ের উপর দিয়ে একটা গরুর গাড়ি যায়নি। এইজন্য দাদা চেঁচামেচি করতে করতে সবাইকে বকতে বকতে বাড়ি মাথায় তুলেছে। বিশু কিন্তু ঘুমাচ্ছে। আমি তো জানি, আমার জন্য এই অবস্থা। তাই চুপচাপ গোসল করে খাওয়া-দাওয়া করে আমতলায় গিয়ে বসে থাকি।

কোনো কোনো সকালে আবার দাদা ভোররাতে মাকে বলে, ছাওয়া দুইটাকে তুলি দেও। ওমাক নিয়া জামাত পড়বার যাই। আমরা ধুড়পুড় করে উঠে দাদার সঙ্গে নামাজ পড়তে চলে যাই। দাদার ওভারকোটটার প্রতি বড়লোভ, তাই এটা সেই ছুতা করে ওভারকোটে ঢুকে পড়ি। ওভারকোটের ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করি, দাদা এইটা কোনটে থাকি কেনচেন। দাদাবলে, নিলামি মার্কেট থাকি। নিলামি মার্কেটে এত আরামের জিনিস পাওয়া যায় এইটা তো আমরা ভাবি নাই। ভাবি যে, বুড়া হইলে আমরাও নিলামি মার্কেট থেকে এরকম ওভারকোট কিনে পরব। সেই কোটের ভেতর নাতি-পুতিদের নিয়ে টাড়ি ঘুরে বেড়াব। লোকে বলবে, কিহে বুড়ার বেটা, এতগুলা ছেলেপুলে নিয়ে কোনটে যান? বলব, যাই আর কোনটে। বুড়াবয়সে আর কোনো কাম নাই। নাতিপুতিগুলাক ক্ষেতখামার টাড়ি বাড়ি শিখাই।

সেবার বর্ষার শেষে দাদা বলে, কই হে জিটি বিশু কোনটে তোরা। কোদাইল-পাসুন নিয়া হাঁট। কাঁটোলের বীচি গাড়ি। আমরা আর কী করি, দৌড়ে গিয়ে কোদাল নিয়ে দাদার পিছু নেই। দাদার হাতে কাঁঠালের বীচি। দাদা বলে, হামার ভিটাটা বালুয়া, কাঁটোল হয় না। আমরা দেখি তাইতো, আমাদের বাড়ি ভিটায় কাঁঠালের গাছ বলতে তো একটা। তার আবার কাঁঠালের নাই সাইজ। নাই মিষ্টি। একদিক পাকে তো আরেক দিক থাকে দর কাচা। দাদা বলে, এই বীচিটা খুব ভালো জাতের। কাঁটোল হয় ইয়া বড়। গাছটা বালুয়া মাটির। হামার এটে ভালো হইবে। কোদাইল দিয়া গর্তের মাটি সরা। মাটি সরিয়ে দেখি গর্তে আগেই গোবর সার দেয়া আছে। বৃষ্টির পানিতে গোবর সার জমে গেছে। দাদা গোবরের উপরে দোআঁশ মাটির একটা আস্তর ফেলে। বলে, মোর পিটিত উঠ একজন, ঘাড়ত উঠ একজন। আমরা বলি, কেন দাদা? তাইলে কাঁটোলও পিটাপিটি ধরবে। উট কেনে। আমরা দেখি দাদা বুড়া মানুষ, আমাদের ভার সইতে পারে না। তবুও দাদার পিঠে আর ঘাড়ে উঠি। দাদা বলে, বিছমিল্লাহ ক। আমরা বিছমিল্লাহ বলি। দোআঁশ মাটির ভেতর চারটা কাঁটালের বীচি পুঁতে দেয় দাদা। আমরা পিঠ থেকে নেমে গর্তটা মাটি দিয়ে ভরাট করি। দাদা বলে, মুই তো আইজ আঁছো কাইল নাই। তোমরা কিন্তু গাছটাত পানি দেমেন। আর যখন কাঁটোল খাইমেন তকন মোর কতা কইমেন। কাঁটোল খারাপ হইলে মরা মানুষটাকে ফির গাইল দিবান নেন। দাদা মৃত্যুর কথা বললে আমাদের খারাপ লাগে, আমরা বলি ইলা কথা কন না দাদা। সেই বর্ষা গিয়ে আশ্বিন মাসেই শীত পড়ল। অগ্রহায়ণে মহাশীত। শীত বাড়লে দাদার হাঁপানি বাড়ে। পানির টানধরে। বড় ওভারকোটে আর হয় না। আর কোট পরবে কি, দাদা বিছানা থেকেই উঠতে পারে না। আমরা দাদার বিছানার শিয়রে বসে থাকি কিন্তু কাশি উঠলে খুব বিরক্তি লাগে। মনে হয় এই কাঁশি দিতে দিতেই দাদা বুঝি মারা যায়। তখন বাইরে আসি। দাদা বলে আয় দাদারা, মোক ছাড়ি যাইস না। তোমাক দেকতে দেকতে মরি যাও। আমরা বলি, না দাদা। কিন্তু দাদা আর পৌষ মাসের শীত সহ্য করতে পারল না। একদিন সকালে, দাদা খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠল। দাদি ঘরের বাইরে এনে তাকে ওজু করাল। তারপর তাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে নামাজে বসিয়ে দিল। মা তখন ভাত নামিয়ে ডিম ভুনা করতে দিয়েছে। এই খেয়ে বাপ টাউনে যাবে মাল করতে। আমরা চুলার ধারে সপ বিছিয়ে পড়তে বসেছি। অমনি দাদি বলল, বিশুরে তোর বাপক ডাক। তোর দাদা বুঝি যায় যায়। ডিম ভুনা কোন চুলায় গেল। আমরা দেখি দাদা নিয়্যাত বাঁধা অবস্থায় বিছানায় ঢলে পড়েছে। বাপ বলে, যা জিটি, তোর ছোটদাদাক ডাকি নিয়া আয়। আমার বুক ধুক ধুক করে। একপা আকাশে, একপা পাতালে। আমি দৌড়ে যাই ছোটদাদার বাড়ি। বলি, দাদা হামার বাড়ি হাঁটো, দাদা মরি যাওচে। ছোটদাদা বলে মরবাননেয়, মুই গরুটা বান্দি যাওচো। আমি বলি, গরু পরে বান্দেন দাদা। দাদা মরি যাওচে। বলে আমি কেঁদে ফেলি। ছোটদাদাকে নিয়ে এসে দেখি, দাদা মারা গেছে। বাড়িতে কান্নার রোল।

দাদা মরার পর বাড়িটা ফাঁকা লাগে। চারা কাঁঠাল গাছটার দিকে তাকালে দাদার কথা মনে হয়। কামরাঙ্গা গাছটার দিকে তাকালে দাদার কথা মনে হয়। বড় খানকার দিকে তাকালে দাদার কথা মনে হয়। কাঁদতে কাঁদতে আমরা দুই ভাই বুঝি অন্ধ হয়ে যাব। এত কাঁদি বলে লোকে আমাদেরকে কবরস্থানের দিকে যেতে দেয় না। আমরা চুপি চুপি এক সকালে ঘরে যাই। দেখি, দাদার গন্ধ। বিছানায়-বালিশে তামাক, পান সুপারি, ঔষধ, পোশাক-আশাক সব মিলিয়ে দাদার গন্ধ। দাদার কাগজ-পত্রে দাদার গন্ধ। দাদার বিছানাটায় কেউ শোয় না। ঠাণ্ডা বিছানা। সেই বিছানায় আমরা গোপনে শুয়ে থাকি। আমাদের আরো ঠাণ্ডা লাগে। বিশু বলে ওই যে, বলে আলনার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায়। দেখি লম্বা কালো ওভারকোটটা আলনায় ঝুলে প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। কাউকে আর কিছু বলতে হয় না। দৌড়ে গিয়ে দুইজনে সেই ঝোলানো ওভারকোটে ঢুকে পড়ি। ভেতরটা দাদার গন্ধে ভরে আছে। ওভারকোটটাকে আস্ত দাদা মনে হয়। ওখানে ওভারকোট জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই আমাদের ওম লাগতে শুরু করে। দাদা দাদা বলে আমরা ডুকরে কেঁদে উঠি।

আমাদের সেই প্রিয় ওভারকোটটাও একদিন বাড়ি থেকে চলে গেল। মৃতের কোনো কিছুই আর বাড়িতে রাখতে নেই। রসুলুল্লাহও তার মৃত্যুর আগে ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী মৌখিকভাবে অন্যদের দান করে গিয়েছিলেন। একদিন ঠাণ্ডা কুঁকড়ানো এক ফকির এলে দাদি বলল, যা তো বিশু ওভারকোটটা ফকিরটাক দিয়া আয়। তোর দাদার জন্য দোয়া করার কইস। আমরা ফকিরের হাতে ওভারকোটটা তুলে দেই। ফকির প্রায় আধাঘণ্টা দাদার রুহের মাগফেরাতের জন্য হাত তুলে দোয়া করে। আমরা দাদিকে আর বলতে পারি না, দাদি ওভারকোটটা হামার জন্য আলনাত ঝুলি থোন, এইটা হামার দুই ভাইওক দিয়া দেন। ফকির সাইব ওভারকোটটা নিয়ে চলে যায়।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত