অবোধ্য

অন্ধ লোকটা অদ্ভুত সুন্দর চোখ জোড়া মেলে শোবার ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে উঠানে তার পাঁচ বছরের বাচ্চাটির খেলাধুলা দেখছে মনোযোগ দিয়ে। যদিও সে কখনও তার ছেলেকে চর্ম চক্ষুর দৃষ্টিতে দেখেনি। শুধু কন্ঠ শুনে, অন্য বাচ্চাদের সাথে চিৎকার ধ্বনি শুনে তিনি বুঝে নিচ্ছে এখন এই মুহুর্তে তার ছেলেটা উঠানের কোন প্রান্তে আছে। ঠিক এই বয়সে সেও এখানে খেলত। উত্তর দিকে ছয়টি আম গাছ আছে সারি করা। পূর্বে একটা বেল গাছ, দুটি নারকেল গাছ ছিল তখন। দক্ষিণে মৌসুমি কিছু ফুলের গাছ থাকত । ছয় বছর বয়সে যখন দুরারোগ্য চোখের অসুখ ধরা পড়ল তার, তখন তার বাবা একটা দোলনা বেঁধে দিয়েছিল মাঝের আমগাছের ডালে। তাতে বসে অন্য বাচ্চাদের খেলা দেখার চেষ্টা চালিয়ে যেতো সে। তারপর এমন হলো যে আট বছর বয়সের মধ্যে সে একা আর হেঁটে দোলনায় গিয়ে বসতে পারত না। কেউ বসিয়ে দিয়ে আসত আবার উঠিয়ে নিয়ে আসত হত। তবুও নিজের কাজ নিজে নিজে করতে চেষ্টা করে সে। জীবন থেমে থাকেনি। ব্রেইল পদ্ধতিতেই পড়াশোনা করেছে। সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছে। মা-বাবার সাথে বিভিন্ন সঙ্গীত অনুষ্ঠানে যেতে ভালোবাসতো। ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র পুত্র সে। একদিন মাকে জানালো সেও গান শিখবে। একাগ্র মনোনিবেশ এর কারণে গানে সাফল্য লাভ করলো। দেশ বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এক সময় তার মা বাবার সাথেই যেতো। জীবনের প্রতি তার সব রাগ ক্ষোভ ততোদিনে ফিঁকে হয়ে আসে। নিজের বাড়িতে গানের স্কুল খুললো তার বউয়ের ইচ্ছেতে।

বউ ডাক্তার, ছোটো বেলার বন্ধু। খুব ছোটোবেলার। যখন ওই উঠোনে তারা খেলতো একসাথে। বউকে আদরের সময় সেই পাঁচ ছয় বছরের মুখখানা স্পষ্ট মনে পড়ে। কোঁকড়া চুল গোলগাল মুখের ছোট্ট একটা ছিপছিপে মিষ্টি মেয়ে মুখ নামিয়ে তাকে চুমু খায়। আদর করে।

অবসর সময়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে লোকটি। দৃষ্টির আলো নেই তাই মনের আলো জ্বেলে আছে সব দিকে।

বউ ঘরে প্রবেশ মাত্রই সে টের পায়। মুখ ফেরায়। বলে, তুমি আজ এই সময়! এতো তাড়াতাড়ি?

বউটি বলে, এমনভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলে মনে হচ্ছিল পেছন থেকে তোমার চোখ চেপে ধরি।

লোকটার অপূর্ব সুন্দর মুখে স্নিগ্ধ আলোর মতো হাসি খেলে। বলে, ধরলে নাতো!

কী করে ধরব আগেই টের পেয়ে যাও যে সব। পাভেল শোনো, একটা খুব ভালো খবর আছে।

পাভেল, অন্ধ লোকটা, তার বউয়ে’র কন্ঠের উত্তেজনায় নিজেও খানিকটা অবাক এবং উত্তেজিত হয়। গাল দুটো হয়তো সেই কারণে লাল আভা ধারণ করে। ভেতরে ভেতরে ভালো খবর শুনতে সে-ও অধীর হয়ে ওঠে। কিন্তু কন্ঠে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ততা বজায় রেখে বলে, শান্ত হও লিলি তারপর বলো কী হয়েছে।

লিলির উত্তেজনা কমে না। বরং বাড়তেই থাকে। সে ছুটে এসে স্বামীর হাত ধরে নিজের গালের সাথে চেপে ধরে। অপলক দৃষ্টিতে দেখে একজন পুরুষ কতটা সুন্দর হতে পারে। তারপর আঙুল গুলোতে চুমু খেয়ে বলে, ডক্টর গুস্তাভ গতকাল বাংলাদেশে এসেছেন। তিন মাস থাকবেন, আমার ইচ্ছা ছিল এর মধ্যে তোমার কর্নিয়া অপারেশনটা করাতে পারলে ভালো হত। আর দেখো আল্লাহর কী ইচ্ছা একজোড়া কর্নিয়াও মিলে গেছে…

কথা শেষ করতে দেয় না পাভেল , লিলিকে থামিয়ে দিয়ে বলে, কেন লিলি? আমি তো এভাবে ভালো আছি। তুমিই বলো আমরা কী ভালো নেই? আমি চাই না আর কোনো বদল।

আসলে ভেতরে ভেতরে ভয় হয় পাভেলের। দুর্বোধ্য দিন গুলোকেই এখন সুগম মনে হয়। চোখের দেখায় ভুল থাকতে পারে কিন্তু মনের দেখায় কোনো ভুল থাকেনা। তাহলে চোখের জন্য হাহাকার করে আর কী হবে।

লিলি বলে, পাভেল তোমার ছেলেটাকেও কি তোমার একবার দেখতে ইচ্ছে হয় না? প্লিজ, কথা শোনো, আর না করো না। মা বৃদ্ধ হয়েছেন তারও ইচ্ছে তুমি অপারেশনটা করাও।

কথা, যুক্তি, অভিমান একে একে সব স্তিমিত হয়ে আসে। পাভেল রাজি হয় অপারেশন করাতে।

শহরের খ্যাতনামা চক্ষু হাসপাতালে নির্দিষ্ট দিন, নির্দিষ্ট সময়ে সাকসেসফুলি অপারেশন পর্বটি সম্পন্ন করেন ডক্টর গুস্তাভ।

অন্ধ লোকটা যার নাম পাভেল, বয়স আটত্রিশ, মিষ্টভাষী, সৎস্বভাব, সুদর্শন পুরুষটির সাথে যে একবার কথা বলেছে তার মনেই চিরকালের জন্য স্থান করে নিয়েছে।

চোখের ব্যান্ডেজ খোলার সময় পাভেল তিরতির করে কাঁপছিল। হিমশীতল ঘরেও বিন্দু বিন্দু ঘাম স্পষ্ট হচ্ছিল কপালে। ডক্টর গুস্তাভের হাতটা সে বারবার ছুঁয়ে দিয়ে কী বোঝাতে চাইছিল তা ডক্টর ঠিকই বুঝেছিল। হাসিমুখে সে বলল, পাভেল খুব শান্ত হও। ধীরে ধীরে চোখ মেলবে। এবং দেখবে তুমি যাদের দেখতে চাও তারা সবাই তোমার সামনে আছে।

পাভেল হালকা করে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। বলে, কিন্তু আপনারা আমার সন্তানটিকেই আমার সামনে আনার অনুমতি দেননি। সকাল থেকে লিলিও আসেনি। তারও নাকি আজ একটা সিরিয়াস অপারেশনের ডিউটি!

গুস্তাভ বলে, তোমার ওয়াইফ একজন ডক্টর, তার কাজের সময় কখনও কখনো কোনো নির্দিষ্ট রুটিন মানে না।তাছাড়া এখন থেকে গোটা পৃথিবীই তোমার সামনে।

ঘন পল্লব ঘেরা চোখের পাতা ধীরে ধীরে মেলে। কোমল দৃষ্টি নিয়ে চারদিক তাকায় পাভেল। বিছানার পাশে হুইল চেয়ারে বসে মুখে আঁচল চেপে কেঁপে কেঁপে উঠে কাঁদছে মা। একদম আগের মতো আছে মা! শুধু কপালের উপরে কিছু চুলে রুপালি ছোঁয়া। ডান পাশে দাঁড়ানো শাদা এপ্রোনে গুস্তাভকে ফেরেশতার মতো লাগছে। তার পাশে একজন গোলাগাল, লম্বা, মোটাসোটা এপ্রোন পরিহিতা সহকারী নারী ডাক্তার চোখ ভরা টলটলে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাভেল তার মায়ের এক হাত টেনে নিলো। তখনই কেবিনের দরজা খুলে প্রবেশ করল এক তরুণী কোলে একটি দেবশিশু। যার চোখ পাভেলের দিকে পড়তেই চিৎকার করে উঠল বাবা, বাবা বলে। আর মুখের দুপাশে ঝুলে থাকা কোঁকড়া চুল ওয়ালা সেই তরুণী শশব্যস্ত হয়ে শিশুটিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে করতে বলতে থাকলো, আস্তে বলো, আস্তে, আস্তে লামিম।

পাভেলের কী হয়ে গেল অজান্তে বলে উঠলো, লিলি তুমিও ছেলের সাথে আড়ালে গিয়ে থাকলে ব্যান্ডেজ খোলার সময়?

চকিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তিনজন। গুস্তাভ চোখের ইশারায় পাশের জনকে যেন বোঝাতে চাইলো, পরিচয় গোপন রাখার বুদ্ধিটি ভালো ছিল না। লামিমকে কোলে রাখা সেই তরুণী ফ্যাকাশে মুখে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।

সেকেন্ডের থেকেও কম সময়ে পাভেল বুঝলো শুরুতেই কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত