কাফনের মাপ

আমার মৃত্যু হতে পারত নিভৃতে। এমন কি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথাও ছিল না আমার। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন বড় এক হাসপাতালে এসে জুটেছি। আর সেই রকম আলৌকিকভাবেই খবর ছড়িয়ে গেল, আমি মারা যাচ্ছি। কোনো চিকিৎসায়ই আর আরোগ্যলাভের সম্ভবনা নেই। বাপ মা মরা এতিম বালক আমি, এই জুনে বারো হওয়ার কথা ছিল। এপ্রিলে এসেই, জুন খুব দূর হয়ে গেল। বারো বছর, কম তো নয়, বেশ অনেক দিনই বেঁচেছি। তবু পুরো হাসপাতালে একটা বিষণ্ণভাব ভর করল। আর একদিন একজন জানতেও চাইল, আমার শেষ ইচ্ছা কী? আমি কলা খেতে খেতে আধাবেলা খুব চিন্তা করলাম। দুপুরে জানিয়ে দিলাম- প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে চাই, একা। এই খবর দেশের প্রেসিডেন্টের কান পর্যন্ত যাবে, কেউ হয়তো ভাবেই নাই। কিন্তু আমি জীবনের এগারো বছর নয় মাস কিছুই চাই নাই, তিনবেলা খাবারও না। কেউ কখনও জানতেও চায় নাই, কী চাই আমি। চারশো বছরের পুরনো এই অবিচারের শহর জানে, কোনোদিন কিছু চাই নাই আমি। এই শহরে অবশ্য কেউই কিছু চায় না, কপালের লিখনের মতো মেনে নেয় সব। তবু আমি শিশু থেকে বালক হয়েছি, চাইতে পারতাম একটা লাল সাইকেল। কিন্তু এখানে কীভাবে কিছু চাইতে হয়, জানে না কেউ।

গত তিনমাস ধরে জানি, আমার আয়ু মায়ের পেটের নয়মাসসহ সাড়ে বারো বছর। পরমায়ু বা পুনর্জন্ম নিয়ে আমি তেমন কিছু জানি না। একবার শহরের পশ্চিম দিকের এক মাজারে একজন ফকিরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে বলছিল, ‘পৃথিবীতে সব মানুষের জন্য সমান সুখ দুঃখ বরাদ্দ। দয়াল একজন খাঁটি সুবিচারক। যে বেশি কষ্ট পেয়ে মরে যাবে, সে আবার আসবে সুখের ভাগ বুঝে নিতে। যে প্রথম জীবনে অনেক সুখ ভোগ করে যাবে, সে আবার আসবে দুঃখের ভাগ পেতে।‘ আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, কী দিয়ে তোমার দয়াল সুখদুঃখ মাপে? সে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘দয়ালের দাড়িপাল্লায় কোনো খাঁদ নাই গো।‘

মনে হতে পারে বয়সের তুলনায় অনেক গুছিয়ে বলছি। আসলে বয়সের তুলনায় খানিক অ্যাডভান্স আমি, হয়তো আয়ু কম বলে, দ্রুত বড় হতে চেয়েছি। আর পথে পথে ঘুরেছি বলে, অনেক ধরণের মানুষের সাথে দেখা হয়েছে। যে যা বলেছে মন দিয়ে শুনে গেছি। গাইতে গাইতে গায়েন হওয়ার মতো কথা শুনতে শুনতে কথক হয়েছি।
একবার এক জাদুকর বলেছিল, ‘লম্বা আয়ু হবে তোমার, চাঁদের মতো বউ হবে।‘ সেদিন সন্ধ্যায় আকাশে মেঘ ছিল, শহরের পূর্ব দিকে রেল লাইনে বসেছিলাম আমরা, জাদুকরের কথা শুনে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছিলাম। সেদিন খুব হেসেছিলাম। জাদুকর হঠাৎ আমার ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে, চুলের ভেতর থেকে কিছু শিউলি ফুল এনে আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘এই তোমার বউ।‘ জাদুর শিউলি বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার আগে, আমি ঘ্রাণ নিয়েছিলাম। যদি অনেকদিন বাঁচতাম, আমার কি সত্যি একটা বউ হতো? চাঁদের মতো না হোক, ফুলের মতো না হোক, অন্তত পাখির মতো? আমার জন্য তার অনেক মায়া থাকত? দূরে ট্রেন আসতে দেখে উঠে পড়েছিলাম আমি আর জাদুকর। আমার বউ নিয়ে আর কথা হয় নি।

প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে চিঠি এল এপ্রিলের তিন তারিখে- কী পোশাকে দেখতে চাই তাকে? আমি জানিয়ে দিলাম, সাদা শাট, লাল টাই, ধুসর প্যান্ট। প্রেসিডেন্টকে টিভিতে দেখেছি আমি। সবসময় জাতীয় পোশাক পরে থাকে। একটুও ভাল লাগে না। কথা বলে একটুও না হেসে, তাকে দেখে আমার কতোবার মনে হয়েছে, সে কি কোনোদিন বৃষ্টির দিনে কাদায় মাখামাখি হয়ে বাতাবিলেবু দিয়ে ফুটবল খেলে নাই? তার নাকে এঁটে বসা চশমার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে, সে কী কোনোদিন পড়ে নাই সেই আশ্চর্য কবিতা- আমি হব সকালবেলার পাখি? কবে থেকে সে জানত, বড় হয়ে এইরকম বাজে একটা চাকরি তাকে করতে হবে?

সেদিনই এক দর্জি এসে আমার মাপ নিয়ে গেল। কাফনের আবার মাপ লাগে নাকি, এতদিন তো জানি নাই ! ভাবলাম, বড় মানুষেরা সব প্রায় একই মাপের হয় বলে, হয়তো ষ্ট্যাণ্ডার্ড কোনো মাপ আছে। আমি ছোট বলে হয়তো আমার কাফনের জন্য বিশেষ মাপ লাগবে। মাপ নেওয়ার সময় একবার মনে হল বলি, সাদা ছাড়া অন্য কোন রঙের কাপড় কি দেওয়া যাবে? আবার বললাম না। ছোট হলেও সব কথা যে বলতে হয়না, জানি আমি। আমার খুব ছাপসা মনে পড়ে, এই প্রেসিডেন্টের বাবা তখন প্রেসিডেন্ট ছিল, যখন আমার বাপ মা মরেছিল বোমায়। তাদের কাফনের কাপড় সাদাই ছিল।

আমার বাপ মা বোমা-কারিগর ছিল। নিজেদের বানানো বোমা ফেটে মরেছে তারা। আমি তাদের লাশ দেখি নি, বন্ধুদের সাথে আমি তখন পলিথিনের ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলাম। বাড়ি ফিরে দেখেছিলাম, লাশ কাফনে মোড়ানো। লাশ দুইটা লম্বায় ছোট ছিল, পরে শুনেছি পা উড়ে গিয়েছিল তাদের। বোমার ক্রেতারা গোপনে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিল আমার এক চাচার হাতে। তবু বাপমা মরার পর লাওয়ারিশ কুকুর হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু কুকুরদের ক্যান্সার হয় না হয়তো। বোমা-কারিগরের ঘরে জন্ম বলে হয়তো ক্যান্সার হয়েছে আমার। চকির তলায়ই থাকত কৌটা আর গুড়া। সেসব দিয়ে খেলেছি ছোটবেলায়। বোমার ক্রেতারাই কৃতজ্ঞতাসরূপ এই হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছে আমাকে, আমার তাই মনেহয়। ওরা আমার খোঁজ রেখেছে, বড় হয়ে বোমা কারিগর হব ভেবেছে। কিন্তু উত্তরাধিকার বহন করার মতো আয়ু নেই আমার।

এপ্রিলের পাঁচ তারিখে সে এল ! বাহান্ন বছর তিনমাস বয়সী সুপুরুষ প্রেসিডেন্ট ; লাল টাই তার গলায় জ্বলজ্বল করছে ! আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। সে নিজের হাতে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল আমার দিকে। খুলে জীবনে দ্বিতীয়বার অবাক হয়ে গেলাম ! সাদা শার্ট, লাল টাই আর ধুসর প্যান্টে আমি চার্লি চ্যাপলিন ! হাসপাতালের করিডর দিয়ে একই রঙের শার্ট প্যান্ট পরে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে এলাম আমরা- যেন দুই ভাই। ভাবছেন, আমার মতো পথের ছেলে চার্লি চ্যাপলিনকে কীভাবে চেনে? আমার এক টোকাই বন্ধু ছিল সে আমাকে চিনিয়েছিল। টিভিতে দেখেছিল ও, আমাকে ছবি দেখিয়েছিল। চ্যাপলিনকে তো আমাদেরই চেনার কথা, না?

আমার জন্য সামনের দরজা মেলে ধরল প্রেসিডেন্ট। নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে, নিজের ও আমার সিট বেল্ট বাঁধল। গাড়ি চলল শহরের বাইরে নদীর দিকে। এদিকে আমি আগেও এসেছি, বাসে চড়ে। বাস একটু উচু হয়, প্রেসিডেন্টের গাড়ি খানিক নিচু, ফলে চারপাশ একটু অন্যরকম দেখালো।

নির্জন নদীতীরে গাড়ি থেকে নামলাম দুইজন। সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাসে প্রেসিডেন্টের চুল উড়তে লাগলে, আমার নিজের চুলে হাত বোলালাম। উড়ছে না, খুব ছোট করে ছাঁটা। তবে আমাদের দুজনেরই লাল টাই উড়ছে। প্রেসিডেন্ট শার্টের ইন খুলে দিল, দেখাদেখি আমিও দিলাম।
প্রেসিডেন্ট আমার কাঁধে হাত রেখে বলল- ‘কিছু বলবে?’ আমি লাজুক হেসে বললাম, ‘ভালো প্রেসিডেন্ট হও, চাইলেই পারবে।‘ তার চোখ ভিজে উঠল, আমি দেখলাম। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘ভাল মানুষ হওয়া সহজ। ভাল মানুষ সকলের কাছেই ভাল। কিন্তু সকলের কাছে ভাল প্রেসিডেন্ট হওয়া খুব কঠিন। বিশ্বাস না হলে কিছুদিনের জন্য হয়ে দেখ। দেখবে?’ আমি হো হো করে হাসলাম। বললাম, ‘না, আমার সময় নেই।‘ প্রেসিডেন্টের মুখ কেমন মলিন হয়ে গেল।

আমি তার মন ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য কথা খুঁজলাম মনে মনে। খানিক পরে হঠাৎ বললাম, একটা মজার কথা শুনবে? তার মুখে বালকের হাসি খেলে গেল। আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুনব।‘ হাসতে হাসতে বললাম, ‘এই ড্রেসের মাপ নিতে এসেছিল যখন, আমি ভেবেছিলাম কাফনের মাপ নিতে এসেছে।‘ প্রেসিডেন্টও হাসতে হাসতে বলল, ‘ধুর বাজে, এটা কোনো মজার কথা হল?’

তার হাসির মাঝখানেই বললাম, ‘তুমি কি একটা কাজ করতে পারবে?’ আমার দিকে তাকালো সে, আবার কী অসম্ভব আবদার করে বসবো, তাই ভাবলো হয়তো। বললাম, ‘আজকের এই পোশাকেই যেন আমাকে কবর দেয়, বলে দেবে?’ এবার আর মন খারাপ করল না সে। আমার অবধারিত মৃত্যু মেনে নিয়েছে। বলল, ‘তোমার কি মরতে খারাপ লাগছে?’ আমি হেসে বললাম, না, বারো বছর অনেক লম্বা সময়।
সন্ধ্যার আগে আগে একটা সুন্দর মতো জায়গায় খেতে গেলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, প্রেসিডেন্টকে কেউ চিনতে পারছে না। আমার দিকে তবু কেউ কেউ তাকাচ্ছে, তার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। প্রেসিডেন্টকে এই পোশাকে এর আগে কোথাও দেখা যায় নি। গাড়িটাও সাধারণ, পতাকা নেই। এইসবই কারণ? নাকি আমিই কারণ? বাবা ছেলে বা দুই ভাই খেতে এসেছে, মজা করে আবার এক রকম জামা কাপড় পরেছে, এমন দেখাচ্ছে আমাদের? দেখে মনে হচ্ছে বালকের জন্মদিন আজ? নিঃসন্তান প্রেসিডেন্টকে একটি বালকের বাবা ধরে নেওয়া কিছুতেই যায় না।
খেয়ে বেরিয়ে সে বলল, ‘এবার কী করা যায়? কিছু কিনবে?’ আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম, ‘হাসপাতাল থেকে এসেছি, ওখানেই যেতে হবে, তারপর সিধা কবর, নাহলে একটা বউ কেনা যেত।‘ হো হো করে হাসল সে, ‘তোমার বুঝি খুব বউয়ের সখ?’ আমিও তার মতো হেসে বললাম, ‘চাঁদের মতো বউ।‘ চোখ টিপে দুষ্টু ছেলেদের মতো সে বলল, ‘বউয়েরা চাঁদের মতো হয় না, সূর্যের মতো হয়, কাছে গেলেই ছ্যাকা লাগে।‘ দুজনেই খুব হাসলাম।

আমাকে হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল সে। নিজের বিছানায় ফিরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম, ভালই ধকল গেছে, ক্লান্ত লাগছে। চোখ বুজে এসেছিল, ওয়ার্ডের টিভিতে খবর হচ্ছিল। শুনলাম, আর্মির হাতে ক্ষমতা দিয়ে পদত্যাগ করেছে প্রেসিডেন্ট ! আমি খুব মনে করতে চেষ্টা করলাম, কখন সে এটা ঠিক করেছে যে, আজই চাকরি ছেড়ে দেবে? নদীর পাড়ে?

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত