উসমান

– উসমানের কথা মনে আছে তোর?
– হ্যাঁ!
– ও মারা গেছে।
– বলিস কী?
– হ্যাঁ! দুই মাস হলো।
– কী হয়েছিল?
– ওর কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছিল।
– চিকিৎসা করায়নি?
– না। তুই তো জানিসই ওদের অবস্থা। কবিরাজ দেখিয়েছিল!

সায়েদার ফোনটি আমি রেখে দিই। আর কথা বলতে পারি না। গলা ধরে আসে আমার।

দুই
উসমান। আমার বন্ধু। আমার সহপাঠী।
ওর সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছিল আমার? ঠিক মনে নেই। সম্ভবত দশ-বারো বছর আগে হবে হয়তো। কোনো একটা কাজে গোলড়া বাসস্ট্যান্ডে গিয়েছি। দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার পাশেই।
– দোস্ত কেমন আছিস?
হ্যাংলা-পাতলা এক ছেলে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। মুখভর্তি দাড়ি, মাথায় টুপি, গায়ে সাদা জুব্বা।
– তুই উসমান না?
ও আমাকে ছাড়ে না। জড়িয়ে ধরেই রাখে। ওর শরীরে লেগে থাকা আতরের গন্ধে আমি মুগ্ধ হই।
– কত দিন পর দেখলাম তোকে। চল কিছু খাওয়াই।
উসমানই আমাকে পাশের টং দোকানে নিয়ে বসায়। আমরা চা-বিস্কুট খাই।
– কী করিস এখন?
পাশের মসজিদ দেখিয়ে উসমান বলে,
– মুয়াজ্জিন।

তারপর? ভুলে গেছি ওকে। আর মনেও পড়েনি কখনো। অথচ একটা সময় এক সঙ্গেই থাকতাম সারাটা দিন। ক্লাস, কোচিং, আড্ডা। সবখানেই।

তিন
– হ্যালো! শুনছিস?
ফের ফোন আসে সায়েদার। ও আজকেই আমার মোবাইল নম্বর পেয়েছে। আমি, উসমান আর সায়েদা। সেভেন আর এইটÑ এই দুই ক্লাস একসঙ্গে পড়েছি আমরা। আমি আর উসমান বসতাম সামনের বেঞ্চে পাশাপাশি। সায়েদা বসত তার পাশের বেঞ্চে। খুব সখ্য ছিল আমাদের।
– হ্যাঁ! মনটা খারাপ হয়ে গেল রে।
– সেদিন ওর মায়ের সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখেই সে কী কান্না।
– উসমান কি বিয়ে করেছিল?
– হ্যাঁ। ওর ছয় বছরের এক ছেলে আছে।
– ওরা এখন কোথায়?
– ওর বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে।
– ওর ছেলে? সঙ্গে নিয়ে গেছে।

বাবা নেই। মায়ের একমাত্র সন্তান। এখন সেও নেই। অভাগা মা। সে তো কান্না করবেই! আমার বুকের বা পাশটা চিনচিনে ব্যথা করে। সায়েদাকে আমি বলি,
– তুই ফোন রাখ। আমি আসছি এই শুক্রবারেই।

চার
বৈকুণ্ঠপুর গ্রামের সেই মেঠোপথ। আমি বাইক থামিয়েছি উসমানদের বাড়ির ঠিক পাশেই। দোচালা টিনের একটি ঘর। মনে করার চেষ্টা করছি। উসমানদের বাড়িতে আগে কি টিনের ঘর ছিল?

– তুমি কে বাবা?
বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক মহিলা ঘরের বারান্দা থেকে উঠে আসেন। আমি মনে করার চেষ্টা করি, ইনি কি উসমানের মা?
– আমি …
মহিলা আমার কাছে এসে আমার মুখের দিকে তাকান। চোখটা বড় করার চেষ্টা করেন। আমার হাতটা ধরে বারান্দায় নিয়ে বসান। বারান্দায় একটি চৌকি পাতা। চৌকির ওপর খেজুরগাছের পাতা দিয়ে বানানো পাটি বিছানো। পাশেই অনেকগুলো খেজুরগাছের শুকনো পাতা পড়ে আছে। সাথে কয়েকটা পাটিও। বুঝতে পারছি, তিনি পাটি বসে বসে পাটি তৈরি করছিলেন।
– তুমি কাজী সাবের বাড়িতে থাকতা না?

উসমানের মা আমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছে। বৈকুণ্ঠপুরে আমি লজিং থাকতাম। আমি মাথা নাড়াই। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
– আমার উসমান তো চইলা গেছে, আমার আগেই বাবা।
আমি লক্ষ করি, তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমি আর কোনো কথা বলতে পারি না।#

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত