কবুতরের বুক

একটা পাতাও বাকী নেই ঝরার মত, শীতের এখন অখণ্ড বিশ্রাম। মাঘ মাসের মাঝামাঝি, শীত যেনো এক পাখি, ডানা মেলার অপেক্ষারত, বিকেলের মনমরা রোদে ঠোঁট দিয়ে পালক পরিচ্ছন্নতায় মগ্ন, মাঝে মাঝে পাখা ঝাপটে শিরায় শিরায় সঞ্চালন করে উষ্ণতা, দীর্ঘ উড়ালের আগে কুয়াশার রাত্রিস্নানে ধুয়ে ফেলতে চায় সমস্ত ঝরা পাতার ক্ষয়ে যাওয়ার ঘ্রাণ।

সকাল ১১টা, রিসোর্টের বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চা পান করছে মিজান। বাংলোর চারদিকে অরণ্য, বারান্দার সামনেও ঝরে আছে পাতা, বারান্দায় কোনো পাতা নেই, পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে। মিজানের কাছে এই পরিচ্ছন্নতা বড় অশোভন লাগে, এই পরিচ্ছন্নতা ঘোষণা করছে- অরণ্যের অংশ হয়েও রিসোর্ট অরণ্য নয়, বাংলো এক বেমানান দখলদার মাত্র।

চারদিকে শুনশান নিরবতা, অরণ্যের স্বর ছাড়া আর কোনো সুর নেই, চা’য়ে চুমুক দেবার মৃদু শব্দও কানে লাগে। নিঃশব্দে চা পানের চেষ্টা করছে মিজান, কাপের যে পাশটায় চুমুক দিচ্ছে, ওই পাশে উপর থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত নেমে এসেছে চা’য়ের সরু রেখা, বহুবার চেষ্টা করেছে চুমুকের ফাঁক গলে চা যেন না বেরোয়, কৌশল বুঝেছে কিন্তু আয়ত্ব করতে পারেনি।

আইভোরি স্টোনের ঘোলা আভার সাদা কাপ, একপাশে দুটো সবুজ পাতা আর গোলাপি রঙের ফুলের নকশা, ঘোলা আভায় ধূসর অন্য পাশটায় সদ্য গড়িয়ে নামতে নামতে থমকে যাওয়া চা শুকিয়ে এসেছে- ঝড়াপাতা রঙ, কালচে খয়েরী। চায়ের রেখা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকায় মিজান, বাংলোর বারান্দা থেকে একটু দূরে পলাশ গাছ, গাছটার ছায়ায় একটা বনবিড়াল থমকে দাঁড়িয়ে আছে, পলকহীন তাকেই দেখছে। চোখাচোখি হতেই, ক’মুহুর্ত দু’জনেই স্থির, বনবিড়ালটা অনিচ্ছায় চোখ সরিয়ে নিলো, হাই তুললো, ধীর পায়ে চলতে শুরু করলো, পায়ের চাপে হাঁটার তালে খুব মৃদ শব্দ হচ্ছে মঅশ…মঅশ.. মঅশ.. মঅশ..। চায়ের কাপ পর্যবেক্ষণে ফের মন দেয় মিজান।

কাপে লেগে থাকা চায়ের দাগ জমাট বাধছে, ওই দাগে বারবার চোখ যায়, সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দেয় মিজান, বুঝতে চেষ্টা করে ঠিক কবে চুমুর ফাঁক গলে চুইয়ে পড়েছিল দুই ফোটা দূরত্ব, দিবা আর ওর মাঝে দাগ হয়ে ঢুকেছিলো সীমান্ত! দিবার কথা মনে পড়তেই মিজানের মন ও শরীর ঝমঝমিয়ে ওঠে, মাথার ভেতর জেগে ওঠে মালিবাগে দুই রুমের ফ্ল্যাট, ছুটির দুপুর, কলিংবেল বাজছে, বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই বিস্ময়, দিবা দাঁড়িয়ে আছে, অবাক করে দেওয়ার তৃপ্তিতে হাসছে।

‘দেখতে এলাম ছুটির দিনে তুমি কি রান্না করেছো?’ বলতে বলতে ঘরে ঢুকে দিবা। ছুটির দিনে মিজানকে আলসেমিতে পায়, সকালে বাজার করে বটে, কিন্তু আগে বেচে যাওয়া ফ্রিজে রাখা খাবারে দিনটা কাটিয়ে দেয়, শুধু বিকেলটাতে, যে ছুটির বিকেলগুলোতে দিবার সময় হয়, দু’জনে দেখা করে, কোনো রেস্টুরেন্টে বসে, প্রেম আর খাওয়া দুটোই চলে। আজ দিবার সাথে দেখা হবে না বলে সকালে বাজার করা হয়নি, ফ্রিজে যা ছিলো একটু আগে খেয়েছে, ঘুমাবার আয়োজন করছিল- তখনই বেজে উঠেছে কল বেল। এই প্রথম দিবা ঘরে এলো, কিন্তু ঘরে খাবার কিছুই নেই।

দিবা সোফায় বসে, নীলচে বেগুনি জামদানী শাড়িতে ওকে অন্য রকম সুন্দর লাগছে। ঈষৎ মোটা ঠোঁটে কায়দা করে পার্পল শেডের লিপিস্টিক মাখায় চেহারায় এক ধরণের গাম্ভীর্য এসেছে। নাকের ডগায় এক বিন্দু ঘাম, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম- আশ্বিনের গরমে পাঁচ তলায় সিড়ি বেয়ে উঠায় গাল দুটোতেও লালের ছোপ লেগেছে। রেশমের মত উজ্জ্বল চুল, খোলা, কাঁধ স্পর্শ করেছে। ওর হাসি বলেই চলছে, ‘কেমন সারপ্রাইজ দিলাম!.. কেমন সারপ্রাইজ দিলাম!…’ টানা টানা দুই চোখেও ছড়িয়ে পড়েছে হাসির সংক্রমণ।

‘দিবা, তুমি কি খাবে- তেহারি না কাচ্চি?’ বলে মিজান স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর শার্ট পরে বোতাম লাগায়, দিবা মাথা নাড়ে- ‘থাক, কিছু খাবো না’। তবুও মিজান দরজার দিকে পা বাড়ায়, দিবা উঠে দাঁড়ায়, পিছন থেকে এগিয়ে আসে, মিজানের হাত টেনে ধরে, সামান্য বিরক্তি নিয়ে বলে ‘বলেছি তো থাক। কি বলেছি না!’ মিজান ঘাড় ফিরিয়ে চোখে চোখ রাখে, ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি আর তখনই, না তখনই নয়, সময়ের পাল্লায় অপরিমাপযোগ্য দীর্ঘ মুহুর্ত ধরে ঘটনাটা ঘটে চলে, যখন ঘোর কাটে, তখনও মিজানের মুঠোয় থরথরিয়ে কাঁপছে কবুতরের এক জোড়া বুক– অনাবৃত, খোসা ছাড়ানো ভাজা বাদাম দানা রঙ।

‘স্যার, আজ লাঞ্চের মেনুতে সাদা ভাত, আলু ফুলকপি সিম মটরশুটি মিলিয়ে ভাজি, মুরগির মাংসের তরকারি, আলু বেগুন দিয়ে রুই মাছের তরকারি আর ডাল’, কোলাহলহীন এক ছুটির দুপুরের স্মৃতিবিম্ব টোপ গিলে ফেলা মাছের ঘাই ও ছটফটানো পর্যন্ত প্রসারিত হবার আগেই থমকে যায়, ওয়েটার যোগ করে, ‘স্যার, আপনার কি এই মেনুতে চলবে? বাবুর্চি কি অন্যকিছু রান্না করবে?’ মিজানের চোখে ভাসে তরকারির বাটিতে রুইমাছে মাথা, অসমাপ্ত ত্রিভুজ যেন, ছিপের টোপ গিলে ফেলার পর ঘাই আর কাতর ছটফটানি। অঅন্যমনস্ক মিজানের দিকে ওয়েটার হাসিমুখে তাকিয়ে আছে, সে জানে ভিআইপি গেস্টদের সাথে তাড়াহুড়ো করতে নেই।

দুই যুগ আগের কথা, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মিজানুর রহমান চৌধুরী তখন শুধুই ডাক্তার মিজান, প্র‍্যাক্টিস শুরুর দুই বছরের মাথায় সবেমাত্র অল্প বিস্তর নাম ছড়াতে শুরু করেছে। বিভিন্ন রোগের রোগী আসে- মৌসুমী জ্বর হতে কর্কটরোগ, মানসিক ভারসাম্যহীনতা হতে যৌন দুর্বলতা, কিছুই বাদ যায় না। একদিন চেম্বার বন্ধ করার ঠিক আগের মুহুর্তে অসুস্থ মা’কে নিয়ে এলো একুশ কি বাইশ বছর বয়সী এক ছিমছাম মেয়ে। রোগী দেখে, যতটূকু অভিজ্ঞতা, তাতে মিজান বুঝল অবস্থা গুরুতর, এমন রোগীকে সিনিয়র ডাক্তারের কাছে রেফার করে দেওয়াই উত্তম। তবু সে কিছু জরুরী পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলো, ওষুধও দিলো, দ্রুত পরীক্ষাগুলো করে রিপোর্টসহ দেখা করার পরামর্শও দিল।

রোগী বিদায় হওয়ার পর ডাক্তার মিজানের মনে জিজ্ঞাসা তৈরী হয় কেনো রোগীকে সিনিয়র কারো কাছে রেফার না করে নিজেই চিকিৎসা দিচ্ছি, রোগী অপেক্ষা রোগীর এটেন্ডেন্ট কি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, মেয়েটার কথায় বা চাহনিতে বা আচরণে বা সব মিলিয়ে এমন কিছু কি আছে যা এড়ানো যায়নি, অথবা গভীর দৃষ্টির মেয়েটাকে বারবার দেখার জন্যই মা’কে চিকিৎসা দেওয়া– উত্তর বেশী দিন খুঁজতে হয়নি, সিনিয়র ডাক্তারের কাছে মায়ের চিকিৎসার ভার তুলে দিয়ে নির্ভার হয়েছিল মিজান, মাঝের অল্প ক’দিনে দিবা নামের মেয়েটার সাথে সম্পর্ক গাঢ়ত্বের পথে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল, গড়িয়েছিল মালিবাগের ওই ছুটির দুপুর পর্যন্ত, তারপর আরও কিছুটা পথ।

নাম ছড়ানোর ব্যস্ততায় দিবার সাথে দূরত্ব বাড়ছে- এটা মিজান বুঝতে পারছিল, কিন্তু দু’জনের দূরত্বের মধ্যস্থিত শূন্য স্থানে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র একাউন্টেন্ট সীমান্ত এটে যাবে — এতটা ব্যবধান নির্মিত হয়ে গেছে, বুঝেনি। ব্যস্ততা আর সময়ের অভাবের মাঝেও এক একটা দিন, কবুতরের কম্পিত বুক আর টোপ গেলা অসমাপ্ত ত্রিভূজের মত রুইয়ের মাথার ঘাই ও ছটফটানি চলছিল, তাতে উত্তাপ ছিলো, প্রাণ ছিলো, শুধু প্রণয়ের দায়বদ্ধতা ছিল না। ডাক্তার মিজান থেকে প্রফেসর মিজানুর রহমান চৌধুরী হবার পথে সবার আগে দিবাকে হারিয়েছে, দিবা তাকে দায়মুক্ত করে দিয়েছিল।

ওয়েটারকে উত্তর না দিয়ে মিজান ডাকে, ‘অনিকা.. অনিকাআআআ.., মাই সুইট বেইবি…’, ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলো উনিশ বিশ বছরের এক মেয়ে, সদ্য ঘুম ভাঙা, লাবন্যে পূর্ণ মুখশ্রী, এক চিলতে হাসিতে মাঘীরোদের উষ্ণতা ছড়িয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে মিজানের চোখে চোখ রাখে, মিজান জানতে চায়, ‘নাস্তায় কি খাবে? লাঞ্চের মেনুতে আজ প্লেন রাইস, মিক্সড ভেজিটেবল, চিকেন অর রুই মাছের কারি- চলবে তোমার!’ একটু ভেবে ‘হ্যা’ সূচক মাথা নেড়ে ঘরে যেতে যেতে অনিকা বলে, ‘ব্রেকফাস্টে দু স্লাইস ব্রেড, জ্যাম আর এক মগ কফি দিতে বলো।’

প্রতি বছরই ক’টা ওষুধ কোম্পানি নামজাদা ডাক্তারদের দেশের বাইরে প্লেজার ট্রিপের অফার দেয়, ব্যবস্থা করে, কোনো রকম রাখঢাক না রেখেই বলে, ‘স্যার, ফ্যামিলি নিয়ে যাবেন না কোম্পানিয়ন দিবো!’ ডাক্তার মিজান এসব অফার পেত না, প্রফেসর মিজানুর চৌধুরী একাধিক অফার পায়। একেক বছর একেক কোম্পানির অফার গ্রহন করে, সবসময়ই পরিবারের কাউকে না কাউকে সঙ্গে নেয়- কখনো বউ, কখনো ছেলে, কখনো দুই মেয়ে। এবারই ব্যতিক্রম, প্লেজার ট্রিপ ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান কোম্পানিওনের ব্যবস্থা করেছে, সঙ্গে এসেছে সোসাইটি গার্ল অনিকা।

লাঞ্চ শেষ, মিজান বিছানার ডালায় হেলান দিয়ে আধশোয়া, বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে শুয়েছে অনিকা, গায়ে ফিনফিনে গাউন, অনিকার চুলে বিলি কাটছে মিজান,
– অনিকা, তুমি যে এখানে এসেছো, তোমার বাবা-মা জানেন?
– হ্যা, তারা জানে অফিসের ট্রেইনিংয়ে এসেছি। প্রতিমাসেই আমার একবার এমন ট্রেইনিং থাকে।

দুপুর গড়াচ্ছে বিকেলে, অরণ্যে ভর করেছে আলাস্য, ঘুঘু ডাকছে, ফালি ফালি রোদের টুকরোয় মাখামাখি অচেনা বিষাদ, ঘরে ঘন হয়ে এসেছে অনিকার শ্বাস, বায়ান্ন বছর বয়সী মিজানের মুঠোয় থরথরিয়ে কাঁপছে একজোড়া কবুতরের বুক- অনাবৃত, বাদাম রঙা। মিজানের শরীরে লেপ্টে যেতে যেতে অনিকা বলে, তুমি কি দিবাকে চেনো, বেইব! আমার মা হয়, সে বলে, প্রফেসর মিজানুর রহমান চৌধুরী মানে তুমি আমার বাবা হতে পারতে।’

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত