ঘোর

‘আচ্ছা, দেখা হলে কি তুমি এখনো বলতে পারবে, আমার পকেটে কী আছে?’
চ্যাটবক্সে মেসেজটা আসতেই নড়েচড়ে বসে নাবিলা। দশ বছর পরেও কি এটা তার বলতে পারা উচিত? সেসব অনেক পুরোনো ঘটনা। যেদিন দেখা হতো, পুলক আগে থেকেই জায়গামতো এসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। নাবিলাকে হারিয়ে দেবে—এমন গর্বের হাসির মধ্যে জানতে চাইত, ‘বলো তো আমার পকেটে কী? ’ নাবিলা চোখ বন্ধ করে শুরু করত। একেক দিন একেক রকম কিছু এনে তাকে পরীক্ষা করত পুলক। সে-ও বলে যেত গড়গড় করে, এই যেমন, ‘ডান পকেটে ওয়ালেট, দুটো চুইংগাম, একটা কাগজ, ছাপানো মনে হয়।’ সেদিন পুলক বাম পকেটের কথা না তুলে ডান পকেটে কাগজের খোঁজে হাতড়াতে গিয়ে পকেটটাই উল্টে বের করে এনেছিল। শেষে কোঁকড়ানো, প্রিন্ট ঝাপসা হয়ে যাওয়া কাগজটা পেল। প্রাইভেট টিউশনির বিজ্ঞাপন; রাস্তায় হয়তো কেউ ধরিয়ে দিয়েছিল, অন্যমনস্কভাবে সে পকেটে চালান করেছে, তারপর সেটাসহ প্যান্ট ধোয়া হয়ে গেছে। মোচড়ানো, দলাপাকানো কাগজটার অস্তিত্বের কথা পুলক নিজেও জানত না। তখন নাবিলা পারত ঠিকই, কিন্তু এখন চেষ্টা করলেই কি আর বলতে পারবে? চেয়ারে শরীরটা ছেড়ে দেয় সে, ঘাড় পেছনে এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবে, চেষ্টা করতে দোষ কী!
কতবার উদ্ভট নাম আর ছবিওলা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে ফেসবুকে, অ্যাকসেপ্ট করার মানেই হয় না, এমন। কখনো কাউকে আবার একটু বাজিয়ে দেখতেও ইচ্ছে হয়েছে নাবিলার। ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’কে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি বিবাহিত নাকি ব্যাচেলর?’ কোনো উত্তর নেই, প্রশ্ন বেশি ব্যক্তিগত হয়ে গেছে হয়তো, নাকি এ নিয়ে নাবিলাকে জানাতে ভরসা পায়নি! ‘আমিই মুনিয়া’কে বলেছিল, ‘এত জোর দিয়ে বলার কী দরকার পড়েছিল যে আপনিই মুনিয়া?’ সঙ্গে সঙ্গে ব্লক, কে জানে কোন গভীর বিশ্বাসে আঘাত পেয়েছিল মুনিয়া। কিন্তু পুলক যখন ‘রাস্তার ছেলে’ নামে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল, সে অ্যাকসেপ্ট করেছে। তার মানে পুলকের ব্যাপারে তার ইনটুইশন এখনো কাজ করে? পকেটের ফিরিস্তি শোনা শেষ হলে পুলক জিনিসগুলো লাইন করে রাখত, হেসে বলত, ‘আমার নিজস্ব জাদুকর তুমি। তুমিই আমার গোপন ম্যাজিক।’
‘কাউকে বলো না যেন!’
‘মাথা খারাপ! বলব কেন? লোকজনের লাইন লেগে যাবে না?’
চেয়ারে হেলানো মাথা ওঠায় নাবিলা। ম্যাজিকের চেষ্টাটা করেই দেখা যাক। মনিটরে তাকিয়ে দেখে, তিনটা মেসেজ চলে এসেছে এর মধ্যে। ‘কী হলো, নাবিলা?’ ‘বলবে না?’ ‘ট্রাই করো প্লিজ।’
ছোট নিশ্বাস ফেলে নাবিলা শুরু করে।
‘এখনো অনেক কফি খাও, বাটির মতো বিশাল কফির কাপটা তোমার ঠোঁটে।’
‘মাই গড, তোমার ক্ষমতা তো আরও বেড়েছে!’
‘তুমি ব্যস্ত একটা ঘরে, মানুষ কাগজপত্র নিয়ে হাঁটাচলা করছে।’
‘ইউ আর রাইট, আমি নিউজরুমে কাজ করি।’
‘বাঙ্গির মতো এমন কমলাটে-গোলাপি কাপড় তো তুমি আগে পরতে না!’
‘আজকাল পরি। তারপর? থেমো না, চালিয়ে যাও।’
‘আচ্ছা, তুমি কি এখনো আমাকে ভালোবাসো, পুলক?’
‘বাসি তো। বলো না আর কী দেখতে পাচ্ছ?’
‘এখন আর বলতে ভালো লাগছে না।’
নাবিলা অফলাইন হয়ে যায়। সে ভেবেছিল পুলক মুছে গেছে তার মন থেকে। কত কিছু মেলেনি দুজনের, সেসব নিয়ে জীবন পার করা যেত না, ছাড়াছাড়ি হতোই, আগে আর পরে। তবে এখন নাবিলা নিজের ওপরে বিরক্ত, ঘুরেফিরে একই সম্পর্কের মধ্যে জড়াবে কেন? রাগে ফেসবুক লগআউট করতে গিয়ে মনে হয় ছোট্ট একটা পরীক্ষা করা যাক। বহুদিনের ফেসবুক বন্ধু রিপনের সঙ্গে চ্যাটিং শুরু করে সে। দশ-পনেরো মিনিট নানান কথা বলে, চোখ বন্ধ করে মাথার ওপরে জোর দিয়েও রিপনের আশপাশের কিছুই দেখতে পায় না; ভাবে এমনিই কিছু আন্দাজ ছুড়ে দেওয়া যাক।
‘নীল শার্টে আজ তোমাকে দারুণ মানিয়েছে।’
‘মানে? আমি তো পরে আছি সাদা টি-শার্ট।’
‘তাই? ভাবলাম পরেছ তোমার প্রিয় রং, নীল। বাদ দাও, ভরদুপুরে কই যাও?’
‘যাই মানে? আজ তো বেরোইনি।’
হতাশ হয়ে ফেসবুক বন্ধ করে নাবিলা। কপালে তালু রেখে চুলের ভেতরে আঙুল ঢোকায়, অফিসের টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে ভাবে, পুলকের ভূত তার মাথা থেকে নামে না কেন? সব শেষ হয়ে গিয়েছিল, তারপর আরও দুজন এল-গেল, অথচ পুলক…এই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা অ্যাকসেপ্ট করাই উচিত হয়নি। বাড়ি ফিরেও বিরক্তিটা যায় না, তবে পুলককে ব্লক করতেও মন সায় দেয় না। নাবিলা এমনটা শুনেছিল বটে, ফেসবুক পুরোনো প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলিয়ে দিচ্ছে, জীবনের গতিপথ যাচ্ছে বদলে। কিন্তু পুলকের কথা সে কখনোই ভোলেনি, স্বপ্নেও তাকে দেখত প্রায়। এই তো কদিন আগেও, কোথায় কোন রাস্তার ধারে দুজনে দাঁড়িয়ে, নাবিলা একটা খাদে পড়ে গেল, অনেক কষ্টে উঠে এসে পুলককে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়েছিলে?’ নির্দোষ মুখে বলল পুলক, ‘কী বলো, আমি কেন ধাক্কা দিতে যাব তোমাকে?’ তারপর কথা না বাড়িয়ে নাবিলার জামাকাপড়ের ধুলো ঝেড়ে দিল পুলক। ঘুম ভাঙলে নাবিলার কেন যেন মনে হয়েছিল, খাদ থেকে উঠে এইমাত্র সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। কিন্তু যাই হোক, এখন শান্ত ছিমছাম জীবনে পুলকের ফিরে আসা এক যন্ত্রণা। পুলক তো নিশ্চয় বিয়ে করে সংসারী হয়ে গেছে, বিয়ে নিয়ে এখনো কিছু ভাবেনি নাবিলা, বাবা-মা চলে গেছে বিদেশে, ভাইয়ের কাছে। নাবিলা একা, বাড়ি আর চাকরির ব্যস্ততা নিয়ে বেশ আছে।
‘নাবিলা, কথা বলছ না কেন?’
ফোন হাতে আয়েশ করে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছিল নাবিলা। পুলকের সাতটা মেসেজ, শেষেরটা দেখা যাচ্ছে। কেন যেন কৌতূহলী আঙুলটা চলে যায় সেখানে। আর মেসেজ আসা শুরু হয় তখনই।
‘নাবু, প্লিজ আর হারিয়ে যেয়ো না। টেনশন হচ্ছে; ফোন নম্বরটা দাও অন্তত।’
‘কেন বলো তো, কেন আবার? ’
‘কী করব বলো, তোমাকে ভুলতে পারি না। প্রথম প্রেম…!’
প্রেম তো নাবিলারও সে-ই প্রথম; তবে প্রথম হোক বা শেষ, ওসব হালকা সেন্টিমেন্টে সে পাত্তা দেয় না। শুধু একটা জিনিস বিস্ময়ের, কেন সে পুলকের মুখের ওপরে ইনবক্সের দরজা ধড়াম করে আটকে দিতে পারছে না!
‘আমাকে অ্যাভয়েড করছ, নাবিলা?’
‘আজকাল শেভ করো না প্রতিদিন?’
‘দেখতে পাচ্ছ! হ্যাঁ, আজ শেভ করা হয়নি। রিয়েল এস্টেটের অফিসে থাকতে প্রতিদিন ক্লিন শেভ, এমনকি টাই পরারও অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। আর এখন পত্রিকা অফিসে এসে যেমন খুশি তেমন সাজো।’
‘মোটাও হয়েছ মনে হয়।’
‘আসো না একদিন কোথাও, দেখা হোক।’
‘কী দরকার খামোখা? ’
‘তোমার জন্য খামোখাই, দেখতে যে পাচ্ছ আমাকে। কিন্তু আমি তো আর তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।’
নাবিলা বেরিয়ে যায় ফেসবুক থেকে। যখন চেয়েছিল পুলক আসুক, দিনরাত তাকে দেখুক, তখন তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। আর এখন শুরু হয়েছে নতুন তামাশা। তবে এবারে মনে হয় নাছোড়বান্দা, ফেসবুক খুললেই মেসেজ।
‘দেখতেই তো পাচ্ছ, নাবিলা, পাগলের মতো তোমার মেসেজের অপেক্ষায় ফেসবুক খুলে বসে আছি।’
‘পাশে বাটিতে মুড়ি তো নরম হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে ফেল তাড়াতাড়ি।’
চামচে ভরে মুড়ি মুখে দিয়ে পুলক লেখে, ‘ইউ আর অ্যামেইজিং! মিলি, আমার বউ, দারুণ মুড়ি মাখায়, সামান্য কাসুন্দি দেয়, বুঝলে?’
‘খুব ভালোবাসো বউকে, না?’
‘বাসি তো।’
তারপর আরও কত যে কথা চলতে থাকে। কথার পিঠে কথার মালা, মালায় হাজারটাপুঁতি। অথচ নাবিলা জেনে যায়, তার প্রতি পুলকের সব আগ্রহ যেন অলৌকিকভাবে তাকে দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যেন ছেলেবেলার কোনো খেলনা নতুন করে ফিরে পাওয়া, নতুন কায়দায় খেলা।
‘বলো তো আমার হাতে কী?’
‘পেপার ক্লিপ।’
‘গুড। এবারে?’
‘সেল ফোন।’
‘আশ্চর্য, তুমি কি যার সঙ্গে চ্যাটে বসো তাকেই দেখতে পাও?’
‘নাহ্, শুধু তোমাকে।’
‘সব সময় দেখতে পাও আমাকে?’
‘না তো, শুধু যখন ইনবক্সে থাকো।’
‘জানো, এটা এমন একটা ব্যাপার যে ফেসবুকে জানালে বোমা ফাটার মতো ঘটনা ঘটবে।’
‘কী বলছ এসব! তুমি জানাবে কেন?’
‘না মানে, তোমার এই ক্ষমতার কথা সবার জানা উচিত, জানলে তুমি বিখ্যাত রাতারাতি, ফাঁকতালে আমিও…হা হা হা।’
‘অথচ আগে যখন পকেট থেকে একের পর এক জিনিসগুলো বের করে লাইন করে রাখতে, আমার অনুমানের সঙ্গে মেলাতে আর জড়িয়ে ধরে আমাকে বলতে, এই ক্ষমতা তোমার একান্ত।’
‘শোনো, আমি তো বহুদিন ধরে তোমাকে জানি, তোমার ক্ষমতা জানি, কিন্তু এখন সবার তা জানা উচিত। নইলে তোমার ক্ষমতার অপচয়।’
নাবিলার গাল বেয়ে অশ্রু গড়ায়, বহুদিন পরে শুধু পুলকের কারণে।
সে রাতে তার ঘুম হয় না, এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দেয়। ঘরের আবছা আলো চোখসহা হয়ে গেলে সব স্পষ্ট হয়, যেন দিন। তার পরেও সকালের উজ্জ্বলতা ঘর দখল করতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, পুলক যদি সত্যিই বলে দেয় সবাইকে? বেশি দূর ভাবা যায় না। অফিসে যাওয়ার পথে ফেসবুকে গিয়ে দেখে, পুলকের ওয়ালে লিংক, নিচে তিন ঘণ্টার মধ্যে হাজার চারেক লাইকস, অসংখ্য কমেন্টস, নাবিলার জলে ভরে আসা চোখের সামনে ক্রমাগত বাড়তেই থাকে তারা। কেউ বলে গাঁজাখুরি, কেউ কেউ নাবিলার প্রেমিক হতে চায়, কেউ নাবিলার ব্যক্তিগত জীবনের কথা জানতে চায়। লিংকে গিয়ে নাবিলা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, তাদের চ্যাট মেসেজের স্ক্রিনশট দেওয়া হয়েছে বর্ণনার প্রমাণস্বরূপ। নিজের ওয়ালে গিয়ে দেখে হাজার হাজার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, হাত থেকে ধপ করে ফোনটা পড়ে যায় কোলে, চোখ বুজে মনে মনে বলে, ‘কেন, পুলক, কেন? আজ বুঝি আমি আর তোমার একান্ত নই?’
পুলক যথারীতি বিখ্যাত। পুলক হয়তো এমনিতেও ভালো রিপোর্টার, আর এবারের রিপোর্ট শেয়ারবাজারের দর পরিবর্তনের লিস্টের মতো নিষ্প্রাণ নয়, যথেষ্ট সেনসেশনাল; সেখানে কাহিনি শুরু হয়েছে বারো বছর আগে থেকে, যে কাহিনির প্রধান চরিত্র নাবিলা আর সে নিজে। একজনের অস্বাভাবিক ক্ষমতা গোপন থেকে প্রকাশ্যে আনা এবং মানুষকে আনন্দ দেওয়াই এই রিপোর্টের উদ্দেশ্য। রিপোর্ট সফল হয়েছে, ততক্ষণে কত হাজার শেয়ার হয়েছে কে জানে! মানুষের ওয়ালে ওয়ালে ঘুরছে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী নাবিলার কাহিনি আর ছবি। ঢাকার উত্তর-দক্ষিণের নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যালোচনা, যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি ঠিক কখন হবে, তা নিয়ে আশা-নিরাশা, এমনকি এক প্রখ্যাত কবির বিয়ের গুজবের চেয়েও পুলকের চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট নিয়ে তখন আলোচনার তাণ্ডব বেশি। আজ অফিসের পথে দারুণ জ্যাম, নাবিলা মুঠোর মধ্যে ফোন ধরে রাখে শক্ত করে। পুলক তার ঠিকানা জানে না কিন্তু অফিসে বা অন্য কোথাও নাবিলাকে যারা চেনে, তারা তো দেখছে, তাদের মধ্যে কতজন এতক্ষণে জেনে গেছে হিসাব নেই। একটু পরেই হয়তো ফোন আসা শুরু হবে। মানুষ বিষয়টা বিশ্বাস করলে হয়তো অফিসে রিপোর্টার আর ক্যামেরার হিড়িক লেগে যাবে। এই অবস্থায় অফিস যাওয়া ঠিক নয় মনে করে গাড়ি উল্টো দিকে ঘোরাতে বলে নাবিলা। বাড়িতে কিংবা অন্য কোথাও আত্মগোপন করে থাকতে হবে কিছুদিন। ফেসবুকে হুট করে জমে ওঠা আলাপ মিইয়ে যেতেও সময় লাগে না। তারপর আবার বেরিয়ে এলেই হবে। কিন্তু এসব ভাবনার ভেতরে কেবল একটি বিষয় আঘাত করতে থাকে মাথায়, কেন এমন করল পুলক? এ জন্যই কি সে বলেছিল, ফেসবুকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে নাবিলাকে? তাকে পেলে প্রমাণসহ এমন একটা রিপোর্ট দাঁড় করাবে বলেই কি?
হুট করে কী যেন হয়ে যায় নাবিলার। ফেসবুকে গিয়ে সোজা উপস্থিত হয় পুলকের ইনবক্সে।
‘আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি? এমন করলে কেন?’
‘কী করলাম? রিপোর্টটা তোমার পছন্দ হয়নি?’
‘কী বলছ তুমি! এই রিপোর্ট করার আগে তুমি আমাকে একবারও বলার প্রয়োজন মনে করোনি?’
‘তোমাকে সারপ্রাইজড করতে চেয়েছি, নাবিলা। ভালো লাগেনি তোমার?’
‘তুমি পাগল হয়ে গেছ। আমি এখন কোথায় লুকাব?’
‘লুকাবে কেন! তুমি তো এখন স্টার, নাবিলা, তোমার যে ক্ষমতা এত দিন চেপে রেখেছ বা নিজেও জানতে না, আমি তা সবার সামনে আনলাম। এখন দেখো কত কী হয়!’
‘কী হবে পুলক?’
‘কত্ত কী, মেয়ে, তোমার কাছে প্রডিউসাররা লাইন দেবে, তোমাকে নিয়ে মজার মজার অনুষ্ঠান হবে, সেখানে তোমার ক্ষমতার প্রদর্শনী হবে, সেসব বিশাল ব্যাপারস্যাপার। অবশ্য তুমি মানবিক কাজেও লাগাতে পারো এটা। এই যেমন ধরো কারও জরুরি কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, জীবন-মরণ সমস্যা, তুমি বলে দিলে কোথায়, সে বেঁচে গেল। আবার মনে করো, বর্তমানের জটিল সমস্যা, গুম বা অপহরণ, তুমি ঠিকানা বলে দিলে, পুলিশ সোজা গিয়ে উদ্ধার করে আনল। আরও কত অসম্ভব কাজ হতে পারে, ভেবে দেখেছ?’
‘পুলক, কখনো কি বলিনি যে আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে কল্পনায় দেখতে পাই না?’
‘চেষ্টা করবে, প্র্যাকটিস করবে, নিজের ক্ষমতায় কনসেনট্রেট করবে, শুধু আমার ভেতরে সীমাবদ্ধ হয়ে থেকো না।’
‘জানি না সেই কবে থেকে, আমি শুধু তোমার ভেতরে থাকতে চেয়েছিলাম।’
নাবিলার আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। দুপুর থেকে এক আত্মীয়ের বাসার চিলেকোঠার ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল সে। সন্ধ্যার মুখে মনে হলো, দেখা যাক ফেসবুকের কী হাল। তাকে গরুখোঁজা হচ্ছে নিশ্চিত। খুলতেই হাজার হাজার মেসেজের ভিড়ে ভেসে ওঠে পুলকের মেসেজ।
‘নাবিলা, সোনা আমার, কথা বলো, কত মানুষ তোমার কথা জানতে চায়, তোমাকে দেখতে চায়, সাড়া দাও প্লিজ।’
‘আমাকে আর কেউ পাবে না। বাবা-মায়ের কাছে চলে যাব।’
‘এত অভিমান? আচ্ছা, নাহয় না বলেই রিপোর্ট করেছি, এখন মানুষের আগ্রহ দেখেও তো তুমি আমাকে মাফ করতে পারো, পারো না?’
‘না।’
‘ঠিক আছে, বলো তো এখানে আমার সঙ্গে কে আছেন? নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছ, আমাদের অনলাইন নিউজের সম্পাদক সাহেব, তিনি নিজে তোমার ক্ষমতা দেখবেন বলে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন।’
‘কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’
‘মানে? কী যে বলো, আচ্ছা আমি ক্লু দেই, মনে আছে বছর ছয়েক আগে একবার আমরা বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম? আমার গায়ের স্কাই-ব্লু টি-শার্ট ভিজে নীলচে হয়ে গেল, তুমি বললে ওই গাঢ় নীল রংটা আমাকে খুব মানাবে, মনে পড়েছে? আমি তেমন একটা শার্ট পরে আছি এখন, দেখো, একটু চেষ্টা করো, পারবে।’
‘আর যে দেখতে পাই না…’
‘কেন!’
‘ভালোবাসলে কত কিছু পারা যায়, পুলক! সব সম্ভব।’
‘ভালো কি বাসো না আর আমাকে?’
‘না।’
পুলকের অস্থির প্রশ্নের বিপরীতে একের পর এক শান্ত উত্তর আসতে থাকে নাবিলার। তবু হাল ছাড়ে না সে। সম্পাদক সাহেব বিরক্ত হয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে পুলকের টেবিলে জোরে একটা চাপড় মেরে যান তিনি। নাবিলার মেসেজ আসে, ‘অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাকটিভেট করে দিচ্ছি, আর কোনো উপায় নেই আমার।’
‘স্যরি, নাবিলা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর কখনো এমন করব না। ভুলে যাও। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো।’
‘দেখলাম তো, কিছুই আগের মতো হয় না। তুমি চাও আমি তোমাকে দেখতে পাই, সেটাই যে আর হচ্ছে না। ভালোবাসা যেখানে নেই সেখানে নেই কোনো অলৌকিকতা। আমার কোনো ক্ষমতা নেই, কখনো ছিল না।’
ফেসবুককে ‘আই উইল বি ব্যাক’ জানায় নাবিলা। বরাবরের জন্য পালাবে না সে। তার চোখ আর ঝাপসাও হয় না। চিলেকোঠার ঘরের জানালার ওপাশে এক চিলতে আকাশ, সেদিকে উড়ছে একাকী একটা চিল। পাখিটার ঢেউয়ের মতো গতিপথের দিকে তাকিয়ে নাবিলা ভাবে, এত দিন পরে পুরোপুরি মুক্ত হলো সে!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত