ভেলুয়া সুন্দরীর আখড়ায়- ০৩

লাকু রাশমনের ফালতু গল্পের সিরিজ থেকে…

ভেলুয়া সুন্দরীর আখড়ায়

[প্রাক-কথন: ঘটনাগুলোর কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই। কিন্তু বেজায় তাদের দাপট। ধান ভানতে যেমন শিবের গীত গাওয়া এই কথাগুলোও ঠিক তেমনি। গুরুত্ব নেই কিন্তু দায় আছে। মানুষটা খেয়ে পড়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কিন্তু অদ্ভুত মাথার ব্যামোতে ধরলো। কোনো ডাক্তার কবিরাজে কাজ হয় না। ভিমরি খাওয়া রোগ। এ বড় শঙ্কার কথা। এ রোগ কী ছোঁয়াচে! কী জানি বাপু। আমাদের না হলেই বাঁচি। তাই দূরে দূরে থাকি।
তবে শোনা যায়, সে রোগের বাই চাপে শনিগ্রহের ফেরে। শনিগ্রহ থেকে সরাসরি রোগের আকর তার মস্তিকে ভর করে আর পঁই পঁই করে এমন লেখা বের হয় যে, তাকে ধোলাই না দিলে রাতের ঘুম হারাম হবার যোগাড়। তাই পাড়ার মাতব্বররা তাকে ভেলুয়া সুন্দরীর আখড়ায় ভর্তি করে দিলেন। এরপর যা কাÐ ঘটলো! চেনা পৃথিবী গেল উল্টে। ভেলুয়া সুন্দরীর নাম ছড়িয়ে গেল সবখানে, সবখানে, সবখানে…]

ফালতু গল্প- ০৩। টিকিটিকির ল্যাজে হাতি বাঁধা

ঠায় বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছেন বেল্লাল হোসেন। বেয়াল্লিশ দিন হলো বাড়ির গৃহিনী পরপারে। যাবতীয় সামাজিক-ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ। ঝাড়া হাত পা। চাইলে এককাপ চা যখন তখন খাওয়া যায়। স্বাধীনভাবে চলাফেরাতে বাঁধা নেই কোনো। বাজার করা নেই, অফিস কামাইয়ে কৈয়িফৎ নেই, বিছানার চাদর টানটান করার কসরৎ নেই, কাজের বুয়ার ঘ্যানঘ্যান নেই, মশারি টাঙ্গানোর হুজ্জত নেই। নিশ্চিন্ত মনে ঘন্টার পর ঘন্টা ভাবা প্র্যাকটিস করা যায়। সবদিক থেকে দেখতে গেলে হোসেন সাহেব বড়ই শান্তিতে রয়েছেন কিন্তু আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এলে মুখটাকে করুন করে রাখতে হয়। আর কিছু নয় লজ্জা সংকোচ। মানুষ যদি দেখে স্ত্রীর মৃত্যুতে শোক নয় স্বতিতে দিন গুজরান করছেন তিনি তাহলে বড়ই শ্লাঘার বিষয় হয়। বিশেষ করে শ^শুর বাড়ির কেউ এলে তো আর রক্ষে নেই!

পঁয়তাল্লিশতম দিনে যা ঘটলো তাতে হোসেন সাহেবের ফুর্তির দিন শেষ হয়ে শহীদ দিবস শুরু হলো। সকাল সাড়ে আটটার সময় অফিসে ফোন করে দু’বার কাশি দিয়ে এডমিন অফিসারকে বললেন আজ তার বিবাহ বার্ষিকী, যার স্ত্রী মৃত তার বিবাহ বার্ষিকী কতটা হৃদয় বিদারক, বলাই বাহুল্য! মন ও শরীরটা বড়ই বেদনাহত, অফিস যেতে পারছেন না। ওদিক থেকে হা হা মানে হানিফ হাওলাদারের কোমল স্বর শুনে পিলে চমকে যাবার যোগাড়। এই মালেরও তাহলে শোকাগ্রস্থের প্রতি সহানুভূতি আছে। অফিস তো যেতেই হবে না বরং বেতনটাও এমাসে তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবার আশ^াস দিলেন। ফোনটা রেখেই হোসেন সাহেব অন্য দিকে কাত হয়ে কোল বালিশটা আঁকড়ে ধরে আরো একটা লম্বা ইনিংসের ঘুম দেবার তোড়জোড় শুরু করলেন। কিন্তু বিধিবাম! কলিং বেল বেজে উঠলো। একবার দু’বার তিন বার। নাহ্ এবার তাকে বিছানা ছেড়ে উঠতেই হলো। ভাবছেন পেপারওয়ালার কী আজ বিল দেবার দিন, না দুধওয়ালার? বিরক্ত মুখে দরোজা খুলতে মুখটা আপনা আপনি হাঁ হয়ে গেলো। হাঁ টা এতোই বড় ছিল যে কয়েকটা মাছি মুখের মধ্যে ঘুরেফিরে বাইরে বের হয়ে এলো! মিলির বড় খালু, অবসরপ্রাপ্ত লেফটানেন্ট মোফাখ্খার দেওয়ান মল্লিক। মিলি ও হোসেন সাহেব তাকে পটু খালু বলে ডাকে। সুটকেস, হোল্ডার, ট্র্যাঙ্ক, বেতের ঝুড়ি সব নিয়ে হাজির। হোসেন সাহেবের হতভম্ব চেহারা দেখে তিনি বোধহয় ভাবলেন ভীষণ শোকে পাথর হয়ে গেছে। কাঁধের উপর দশমণের একটা চাপড় মেরে তাকে চাঙ্গা করতে চাইলেন। আরে ইয়ংম্যান, এতো ভেঙ্গে পড়া কেন? আমাকে দেখ – তোমার খালাশ^াশুড়ি চলে গেলেন এই দশ বছর। প্রথম প্রথম আমারও কী কম খারাপ লাগতো! কিন্তু কী আর করা! মৃত্যুর সাথে তো আর লেফ রাইট চলে না। সব কিছু কেমন ম্যানেজ করে নিয়েছি। লাইফ ইজ গোয়িং অন। এখন দেখি সরো, ভিতরে আসতে দাও। বাসায় কাজের মানুষ টানুষ কী কেউ আছে? হোসেন সাহেব মাথা নেড়ে না বলাতে তিনি বলে উঠলেন, তাহলে তুমি বাইরে থেকে জিনিষপত্রগুলো একটু সাবধানে ঘরে এনে রাখ তো বাবা। দেখ ওর মধ্যে কিছু কাঁচের জিনিষ আছে, ভেঙ্গে না যায় আবার!

হোসেন সাহেবের মনে হলো মৃতা স্ত্রী বোধহয় ইচ্ছে করে তার খালুকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এতো সুখ কী আর সহ্য হয়! স্ত্রী মারা যেতে যতটা না কষ্ট হয়েছে এই খালু শ^শুড়ের আগমণে হোসেন সাহেবের চোখে পানি পর্যন্ত চলে এলো। বাইরে থেকে সুটকেস বেডিং পত্র আনার সময় কখন যে দুঃখে চোখ থেকে পানি পড়া শুরু করলো তা তিনি নিজেও জানেন না। তাই দেখে পটু খালু বুঝলেন স্ত্রীর শোকে মুহ্যমান হোসেনের করুন অবস্থা। তিনি হা হা করে উঠলেন- আরে তুমি এখনো কান্না কাটি করছ নাকী? আমার যখন বিয়ে হয় মিলি তখন ক্লাস ফোরে পড়তো। আমার সাইকেলের পিছনে ঘুরে বেড়াতে কী ভালোবাসতো! সেই সব দিনের কথা মনে হলে আমারও তো কত কষ্ট লাগে। আমি কী কাঁদি? যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো, আমি এখনটায় একটু বসি। একটু চা খাওয়াতে পারবে, চিনি দিও না আমার কাছে সুকনর আছে, নোনতা বিস্কুটও। একটু তাড়াতাড়ি করো, সারা রাত জার্নি করে টার্য়াড হয়ে গেছি।

এপর্যন্ত হোসেন সাহেব একটা কথাও খরচ করেন নি। আপদের বাড়ি যে কত মণ তা ঠাওর করে উঠতে পারছেন না। ভদ্রলোকের জিনিষপত্র কোনোমতে গেষ্টরুমে রেখে বাথরুমে ঢুকে পানির কল খুলে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ধাতস্ত করলেন। তারপর আয়নায় নিজেকে একবার দেখলেন, সারা মুখে বিরক্ত-হতাশা সব মিলে মিশে একাকার। আয়নায় এক থাবা পানি ছুঁড়ে মারলেন। মুখটা ঝাপসা হয়ে এলো। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ড্রইংরুমে আরাম চেয়ারে বসা খালুকে চ বর্গীয় একটা গালাগালি দিয়ে নিজেকে আপাতভাবে ঠান্ডা করলেন।

খালুকে বাড়িতে রেখে হোসেন সাহেব অফিসের কথা বলে বের হয়ে এলেন। এই সাধ সক্কাল বেলায় কোথায় যাওয়া যায়? বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে পরোটা ডিম ভাজা পেঁপে সেদ্ধ মায় দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাটাও করে আসতে হয়েছে। একবেলাতেই হোসেন সাহেবের হালুয়া টাইট। একটা লেকে পাড়ের বেঞ্চে বসে তিনি চিন্তা করতে বসলেন। কীভাবে খালুকে ভাগানো যায়? একটার পর একটা চিন্তা বাতিল করে দিচ্ছেন কারণ আর কিছু নয় খালু আর্মি পার্সন কথায় কথায় দশমণের থাপ্প্র আর বেচাইন কথা বার্তার ধাক্কা। শেষ পর্যন্ত একটা আইডিয়া পাওয়াতে হোসেন সাহেব ইউরেকা বলে নিজেই চিৎকার করে উঠলেন। আশপাশে বাদামওয়ালা, খুচরো মানুষজন তার দিকে ভ্রæ কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো। হোসেন সাহেব এমন ভাব করলেন যেন কিছু হয়নি। মোবাইল ফোনটা খামোকা বের করে বোতাম টিপতে লাগলেন।

মিঠেপুকুর পাড়ার বস্তির সামনে এসে হোসেন সাহেব একে তাকে জিগ্যেস করছেন তানজিলার ঘর কোনটা। কেউ বলতে পারছে না। একজন রোগা পটকা লোক, দাঁত ব্রাশ করতে করতে হোসেন সাহেবের দিকে এগিয়ে এসে তার কুতকুতে চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। একসময় মুখে জমে থাকা পেস্টসমেত একগাদা থু থু পাশে ফেলে হোসেন সাহেবকে বলেন- কেসটা কী? তানজিলায় কী করছে? হোসেন সাহেব খানিকটা হেসে বলেন- না না কিছু করে নাই। আমার বাড়িতে কাজ করতো, তা ওর মেমসাহেব মারা গেছে তাই ওরে খবরটা দিতে আসলাম। লোকটা খানিকটা বির্মষ হয়ে বললো- ও তা হেরে তো পাইবেন না। দ্যাশে চইলা গেছে। তা বাড়িতে কামের জন্য কী ছেরি লাগবে? আমার পরিচিত একজন আছে। আইজই দ্যাশ থেকে আইছে? হোসেন সাহেব এবার ভালো করে লোকটাকে দেখেন। যদিও তার চেহারাটা হাড়ে বজ্জাত কিন্তু তিনি ভাবছেন একটা রিস্ক নেবেন কিনা? হোসেন সাহেব বলেন- না মানে ছুটা বুয়ার দরকার নাই তবে একদিনের একটা কাজ করে দিতে পারবে। শ’পাঁচেক টাকা দিতে পারি। লোকটা কি বুঝলো পেস্টমাখানো ঠোঁট চেটে খানিকটা হাসলো। হোসেন সাহেব তাকে এককোনায় ডেকে খানিকক্ষণ নিচু গলায় কথা বলেন। মানিব্যাগ বের করে দুইশ টাকা লোকটাকে দিয়ে বস্তির মাথায় একটা চায়ের দোকানে বসে অপেক্ষা করতে থাকলেন।

মিনিট বিশের পর লোকটার সাথে শাড়ি পড়া একটা রোগা পটকা মেয়ে বের হয়ে এলো। পান খাওয়া তার ঠোঁট দেখলে ভিমড়ি খেতে হয়। এসেই বলে- এই মনা একট ’র চা দেতো, চিনি বেশি দিস। হ এবার কন কাম কী? হোসেন সাহেব লোকটাকে যা বলেছিল তাই আবার মেয়েটাকে বললো। মেয়েটা চা খেতে খেতে বলে- টেকা আগে তারপর কাম।

হোসেন সাহেব দূর থেকে নিজের বাড়িটা মেয়েটাকে দেখিয়ে দিয়ে রিক্সার হুড তুলে সেখান থেকে ভোঁ। এইসব যোগাড় করতে বেলা ৪টা বেজে গেছে। মেয়েটাকে দুই হাজার টাকা অগ্রীম দিতে হয়েছে আর লোকটাকে পাঁচ শো। তারপর তাদেরকে দুপুরে খাওয়ানো, একটা ভালো শাড়ি, হ্যান্ড ব্যাগ, সান্ডেল কিনে দেওয়া, দাঁত সাদা করার জন্য বেকিং সোডা, ব্্রাশ আরো কত কী কেনা? সব মিলিয়ে হাজার সাতেক টাকা ফুৎ করে বের হয়ে গেল এক খালুকে ভাগানোর জন্য। তাও হোসেন সাহেবের খেদ নাই।

এখনো বাড়ি যেতে পারছেন না। কারণ অফিস শেষ করে বাড়ি যেতে সাড়ে পাঁচটা বাজাতে হবে। ধানাই পানাই করে সময়টাকে পার করতে দিলেন তিনি। হোসেন সাহেব ভাবছেন কেল্লা ফতে। আহ্ আবার ফিরে আসছে সুদিন!!!

সন্ধ্যের আগে আগে হোসেন সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিতে ফ্লাটের বেল বাজালেন কিন্তু বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা ঠিকই পড়ছে। খালু এসে দরোজাটা খুলে দিলেন। তার মুখের দিকে চট করে এক ঝলক দেখে নিলেন হোসেন সাহেব। কিন্তু তেমন কিছু বুঝতে পারলেন না। মামুলি কথাবার্তা শেষ করে হোসেন সাহেব তার ঘরের দিকে এগুতে থাকলে খালু তাকে একটু বসতে বলেন, হোসেন সাহেব ভালো মুখ করে বসেন যেন কিছুই হয়নি। খালু বলে চলেন- যে পুরুষের একবার স্ত্রীর অভ্যাস হয় তার একা থাকা কঠিন। আমি জানি তুমি ভয়ানক লজ্জা আর ভয়ে আছো। তাই সক্কালবেলায় আমাকে দেখে তুমি ওরকম বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি বলি কী এতে তেমন দোষ নেই! আমি পাইনি তাই বলে যদি অন্য কেউ পায় তাহলে তো আমি রাগ করতে পারি না! এবার আমি ভেবেছিলাম সপ্তাহখানেক থাকবো কিন্তু যেহেতু একটা ব্যবস্থা হলো আর আত্মীয় স্বজনকে তো জানাতে হবে। তখন আমাকে তোমার প্রয়োজন, তাই ভাবছি মাস কয় থেকেই যাবো, একা একা আর ভালো লাগে না। কী বলো? বলে হা হা করে হাসতে থাকেন পটু খালা।

এমন সময় ঘোমটা টানা মেয়েটা দু’কাপ চা নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করে, তার পানের দাগওয়ালা দাঁত হাসতে হাসতে বের হয়ে আসে!!!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত