আবুল হাসান ও আতর আলী

আবুল হাসানের চোখে ঘুম নেই। আজ সন্ধ্যাবেলার দৃশ্যটুকু তিনি ভুলতেই পারছেন না। এক লাইন লিখছেন, কেটে ফেলছেন; আবারো লিখছেন, অসন্তুষ্টির সাথে দামী রেডিও বন্ড কাগজশুদ্ধই ছিঁড়ে ফেলছেন।

ছবিটা এখনো স্পষ্ট তার চোখে ভাসছে। কমলাপুর রেল স্টেশনের বাইরে ফুটপাতের চায়ের দোকানে একটা বগলা সিগারেট ধরিয়ে শহীদ কাদরীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। গ্রাম থেকে খাবারের সন্ধানে রাজধানীতে আসা হাজারো মানুষের একজন — একটি মা — তার হাড় জিরজিরে দুধের শিশুকে স্তন্যপান করাচ্ছিল উল্টো দিকের ফুটপাতে। হয়ত ময়মনসিংহের কাশিগঞ্জ কিংবা দাপুনিয়া থেকে এসেছে। মায়ের অবস্থাও বিশেষ ভালো না। আশেপাশে জংগল থাকলে তাকে মৃত ভেবে সন্ধ্যার অন্ধকারে শেয়াল এসে হয়তোবা টেনে নিয়ে যেত। এখানে জংগল নেই, কিন্তু শেয়াল আছে, দু পেয়ে। চকরা-বকরা মাফলার পরা, তীব্র আতরের ঘ্রাণ মাখা এক শেয়াল এসে মেয়েটির হাত ধরে টানছে। বলছে,”ভাত খাবি? আয় আমার সাথে।”

উত্তেজনায় বা অল্প পরিশ্রমে হাসান ইদানিং হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আজকাল সহজেই উত্তেজিত হয়ে যান। হলিফ্যামিলির ডাক্তার সাহেবের কাছে নিয়ে যাবার জন্য শওকত ওসমান ভাই ফাঁদ পেতে থাকেন। কিন্তু হাসানের ডেরা খুঁজে পাওয়া কি এতই সহজ! আজ রাতে ঘুমাবেন ফুলবাড়িয়ায় বুলবুলের বাসায় তো কাল ঘুমাবেন নারিন্দার মশাহীন সেই মসজিদে! কিন্তু আজ ঘুমানোর আগে একটা সওয়াবের কাজ করা বাকি আছে। হাসান চকিতে হাতের সিগারেট ফেলে রাস্তা পার হয়ে আতরগন্ধী কুতকুতে চোখের লোকটার মাফলার ধরে এমনভাবে হ্যাঁচকা টান দিলেন যে সেটা চকরা-বকরা একটা ফাঁসে রূপ নিলো। আশেপাশের জনতা ছুটে এলে হাসান তাদেরকে ঘটনাটা খুলে বলে, তাদের হাতেই বিচারের ভার ছেড়ে দিয়ে সরে এলেন। হাসানের বুকটা হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে।

রাতে হাসান যখন একটার পর একটা কাগজ ধ্বংস করছিলেন, নির্মল ততক্ষণে বুলবুলের হাতের লাল চায়ে চুমুক দিয়ে আস্ত একটা কবিতা লিখে ফেলেছেন। হাসান হয়ত সারারাত জেগে দুটো বা চারটা লাইন লিখবেন, আর নির্মল হয়ত লিখে ফেলবেন একাধিক কবিতা। নির্মল লিখেছেন,
” আমি চালের আড়তকে নারীর নগ্নতা বলে ভ্রম করি।

তখন রমণী মানে আমুণ্ডু মন্থনযোগ্য সর্বগ্রাসী নাগিনী ছিল না,
তখন রমণী মানে রক্তকাঁপানো সুখে বুকে- মুখে চুমু খাওয়া
অফুরন্ত বাসনা ছিল না, তখন রমণী মানে অন্যকিছু ছিল।”
নির্মল লেখার টেবিল থেকে উঠে ধ্যানস্থ হাসানকে ডেকে বললেন, “হাসান,আমার কবিতাটা পড়ছি, শোনো।”
শব্দের গহীন অরণ্যে ডুবে থাকা হাসান চমকে উঠলেন। আরাধ্য শব্দটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে নির্মলের উপর খুব বিরক্ত হলেন। বললেন,”পড়ে শোনাতে হবে না– ভারী তো আমার শম্ভু মিত্র হইছো! দাও,আমি পড়ি।” কবিতাটি হাতে নিয়ে উপর থেকে নিচে দ্রুত চোখ বুলিয়ে হাসান তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন,”বোগাস! সব শালা আতর আলী!”
নির্মল লক্ষ্য করেছেন হাসানের শরীর খারাপ। তাই আজ রাতে আর ঝগড়া করলেন না।

পরদিন সকালে পত্রিকা অফিসে যাবার জন্য জামাকাপড় পরছেন, এমন সময় সাবদার সিদ্দিকী এসে হাজির। হাসানের সাথে তার অম্ল মধুর সম্পর্ক। খুব একটা পাত্তা দেন না তাকে। পাত্তা দিলেই অবান্তর কথার ঝাঁপি খুলে বসবে, আজেবাজে সব কথা বলবে। কোথায় যে পায় দুনিয়ার সব ফালতু কথা — হাসান ভাবেন। পৃথিবীতে কবি গোলাম সাবদার সিদ্দিকীর একটাই পিস; আর মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত থেকে যখন নির্মলেন্দু গুণ ফিরে আসেন, তখন তার সাথে এই কবিকে মুক্ত ঢাকা নগরীতে ঢুকতে দেখা যায়। তার পরনের কুচকানো গোলাপী রঙের বেলবটম প্যান্ট আর বেগুনি – হলুদ চেক শার্ট দেখে হাসান বললেন, ” তোমার সাথে এক রিকশায় যাব কী করে হে?” এ কথা কানে যেতে নির্মলেন্দু কাঁথার নিচ থেকে মাথা বের করে মূর্তিমানকে দেখে নয়ন সার্থক করে নিলেন। নির্মলকে জেগে উঠতে দেখে সাবদার উল্লসিত হয়ে বলে উঠল,” ওই ব্যাটা কাপালিক! আমি আমার কবিতার বইয়ের নাম পাল্টেছি! ‘হে নারী হে ব্রম্মচারী’ নয়, এখন আমার বইয়ের নাম হবে ‘আমি সেই যীশু পশু শিশু!’ সুন্দর হইছে না?”
” আপদ!” বলে নির্মলেন্দু পাশ ফিরে শুলেন।

হাসান এখন গণবাংলা পত্রিকার সাহিত্য পাতা দেখেন। অফিসটা সাকুরা হোটেলের পিছনে। শেষ পর্যন্ত সাবদারের সাথে এক রিকশাতেই অফিসে এসেছেন। রিকশা থেকে নামতেই এক কবি যশোপ্রার্থী কিশোর সাবদারের সাথে নানা কথা বলতে বলতে গণবাংলাতেই ঢুকল। হাসান চেয়ারে বসতে না বসতেই ছেলেটা হাসানের মুখোমুখি। তার হাতে কিছু খাতাপত্র, তবে সবার উপরে দর্শনীয়ভাবে ধরা আছে হাসানেরই নতুন কবিতার বই ‘ যে তুমি হরণ করো’। হাসান নিরাসক্তভাবে দেখলেন। ছেলেটা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল,” আমার নাম ফারুক মঈনুদ্দিন। একটা কবিতা এনেছি!”
হাসান হাতে নিয়ে পড়লেন, ছেলেটা যা লিখেছে তা গত রাতে নির্মলেন্দুর লেখা কবিতারই যেনবা প্রতিধ্বনি! লিখেছে –
” সুস্বাদু খাবারের মোড়ককে আমি রমণীর ছলনা বলে ভুল করি!”
হাসান সত্যি সত্যি খুব উৎকন্ঠার সাথে সাবদারকে বললেন, ” পাগলা কবি, টের পাচ্ছ — দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে আসছে? আর তোমরা শিশু কবি, কিশোর কবি, তরুণ কবি, বুইড়া কবি — সবাই মেতে আছ রমণী নিয়ে! চাউলের আড়তে রমণী, খাবারের প্যাকেটে রমণী, ব্রম্মচারীর সাথেও রমণীকে মিলাও! আমি তো পাগল হয়ে যাব! এ দেশের সবাই কি আতর আলী হয়ে যাচ্ছে?”

ফারুক নীরবে সরে গেল। আল মাহমুদ তাকে কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দিলেও, আবুল হাসানের স্বীকৃতি পাওয়া যে বেশ কঠিন ব্যাপার সেটুকু সে বুঝে নিয়েছে।

৫ এপ্রিল ২০২২

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত