বেড়ালের স্পর্শ

কাইল থাকি মোর জ্বর হইছে। বেদম জ্বর। মাথায় জলপট্টি দিয়া রুবাইয়া মোর পাশোত সেই সকাল থাকি বসি বসি তসবি গুণে মোর মাথা-কাপালে ফুক দিতেছে, তাও মোর জ্বর নামে না। মুঁই জানো, ভালো করি-ই জানো, মোর মতোন এমন পাপি মাইনষের বেলায় ঝাড়-ফুকের মজেজা কাম করে না। কিন্তু এই রুবাইয়া হাল ছাড়ে না। ঘোমটা টানি বিড়বিড় করে। আমার মাথায় পানি ঢালে। ঠোঁটে ঠোঁট লাগায়া কয়, খুব গরম!

শরীরের তাপমাত্র মাপে রুবাইয়া ওর ঠোঁট দিয়া। ওর এমন পিরিতির জন্য মোর মরি যাইতে মন চায় না। কিন্তু কাইল থাকি মোর এই করুণ অবস্থায় তার জন্য এক ফোঁটা চাইল আনবার পারো নাই। রুবাইয়া তাও মোর পাশোত না খায়া শুকণা মুখে চায়া আছে, কিছু কয় না। মোক ছাড়ি যায়ও না। এই মাইয়াটার লাগি এমন একটা দরদ যে কেমন করিয়া মোর ভেতর পয়দা হইল, সেটা আইজ পর্যন্ত মুঁই ভালো করি কবার পারো না।

মাও নাই রুবাইয়ার, বাপ-ও মাস তিনেক হইল মরি গ্যেছে। দুই-দুইটা সিয়ান ভাই বিয়া করি আলাদা খায় আলাদা থাকে। বাপ-মাও বাঁচি থাকিতেই ভাইয়েরা বউ নিয়ে আলাদা হইছে।

একা রুবাইয়া গামের্ন্টেসে চাকরি করি বাপ-মাক এতোদিন পুষিছে। সেই কারণে বাপের কিছুটা গাফিলতি ছিল মাইয়াটাক বিয়া দিবার। কিন্তু কপাল খারাপ, কিছুদিন হইল বাপ-মা মারা গেলো। বিয়া আর হইল না। বিয়া না হইয়া ভালই হইছে। মোর কপালোত আবার জুটিছে রুবাইয়া।

একদিন, গামের্ন্টে যাবার সময় তার সাথে দেখা। সেই থাকি রুবাইয়া মোর এইঠে আসি ওঠে।

মুঁই মুগদাপাড়ার পিছনোত একটা বস্তিতে থাকো। দিনাজপুরে মোর বাড়ি। অভাবের কারণে ঢাকা আসি চাকরি করো। কোনোমতে দিন পার হয় মোর। কিন্তু রুবাইয়ার সাথে দেখা হবার পর মোর পুরানো প্রেম জাগি ওঠে। হলুদিয়া রঙ মাখা মোর গামছা ছিল একখান, আর ছিল পোড়াবাঁশের নলনলা সরু বাঁশি। বিকাল বেলা রুবাইয়াকে এক নজর দেখিবার আশায় গামছাখান মাথায় বাঁধিয়া বাঁশি বাঁজাতে বাঁজাইতে আড়াবাড়ির কাইঞ্চা দিয়া যাবার সময় দেখা পাও, রুবাইয়া সেই পুকুরের ধারে আড়াল করি কলাগাছ ধরি দাঁড়াই আছে। সেইখানেই রুবাইয়ার সাথে মোর প্রেম-পিড়িতির একটা মন দোনামোনা ছিল।
অয় খালি মোর চোখের দিকে চায়া থাকত। কেমন চিকচিক করি উঠত ওর চোখের তারা। মাইরি কইছি, চায়া থাকতে থাকতে ওর চোখের তারা দিয়া বেহেস্তি নহরকণা ফোঁটায় ফোঁটায় গড়াই পড়ত। খুব ইচ্ছা হইত, আমার ঠোঁট দিয়া সেই বেহেস্তি নহর শুষে নিয়া মোর দিল-পরাণটা ঠান্ডা করি আর তার মুখমন্ডলে চুমায়-চুমায় ভুলিয়া দিয়া ওকে মোর পরাণের সাথে জড়িয়ে নেই। পারি না। দিল-পরাণটা এতোটা আবেগময় হইলেও তাকে মুঁই ছুঁবার পারো নাই। এই ব্যাপারে সে বেশ কড়া। কাছে গেইলে কয়, ঐই, কী মতলব!

সেই রুবাইয়া তার কড়া অনুশাসন বিলিন দিয়া আমার পাশোত বসি ঠোঁটে ঠোঁট দিয়া জ্বর মাপিতেছে, এইটা কার কাছোত বেহেস্ত মনে হইবে না?

তাছাড়া, আমি যে উদাস হয়া তার জন্য একা একা কত যে দিন গুজার করিছি, সেই কথা আমার আল্লাহ ছাড়া কাহো কবার পারিবে না।

তাকে পায়া মনটা মোর কেমন করি নাচিয়া উঠিছে এই কথা মুঁই মন খুলি কাউকে কবার পারিম না। কিন্তু, ইদানিংকালে মনটা মোর মুষড়ে পড়িছে। মোর রুবাইয়ার উপর চোখ পড়িছে তেল চোর নোমান ব্যাপারির ছেলেটার।

তার বস্তিতেই ভাড়া থাকি বলে নোমান ব্যাপারি সয়াবিন তেলের জার সবার মতো হামার ঘরোতও লুকায়া রাখিছে। এই সুবাদে কিছু টাকাও দিছে নোমান ব্যাপারি।

হামার চকির নিচোত সোয়াবিন তেলের জারগুলা লুকায়া রাখিবার সময় কেমন করি তাকায়া থাকে নোমান ব্যাপারির ছেলেটা। রুবাইয়া কুঁকড়ে গিয়া মোর পাশোত বসি হাত শক্তিধরি তার রূপযৌবন রক্ষা করে।

আমাদের দয়া করি নোমান ব্যাপারির ছেলে খাবার দিয়া যায়। ভাবি ভাবি করি ডাক দিয়া তেলের জার আনা-নেয়া করে। মুঁই আর রুবাইয়া চায়া থাকি। মধ্যে মধ্যে খেয়াল করি, নোমান ব্যাপারির ব্যাটা টাকা দিবার অছিলায় রুবাইয়ার হাত ছুঁইয়া দেয়। রুবাইয়া অবশ্য টপ করি হাত সরায়া নেয়। হাত সরাইলেও, কপালোত কালো একটা রেখা পড়ে হামার। হামার কপালোত সামনে কি যে হইবে এই হিসাব মুঁই করিবার পারো না। কারণ, তেল চোরের ব্যাটাক ধাক্কা দিয়া সরাই দিবার বল-ক্ষমতা মোর শরীর-মনে এখন আর কাজ করে না। এই কারণে, কখনো সখনো মোর মরি যাইতে মন চায়। কিন্তুক এই রুবাইয়া! তার মায়া! তার জন্য এই মনপ্রাণ মরি যাইতে সায় দেয় না।

সায় না দিলেও মুঁই বোঝো, বাঁচি থাকিয়া মুঁই মরা হইতেছো। রুবাইয়াও হয়তো এই ভাবনায় ডুবি থাকে। দুইজনে চোখাচুখি হই, দুইজনে হাসি উঠি। আনন্দ পাইয়া রুবাইয়ারে কোলে টানিয়া বেড়ালের মতো গুটিসুটি হয়া লুকায়া থাকি। মনে মনে কামনা করি, খারাপ দিনগুলি যেন গুটিসুটি থাকা বেড়াল যুগলের স্পর্শ না করে কোনোদিন।

কিন্তু মোর মতোন অধমের কথা কি কারো কানোত সোন্দাইবে কখনো? কারো কানোত মোর ফরিয়াদ আহাজারি করিবে বলে মনে হয় না।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত