সেক্স ইন দ্য সিটি

অফিসে হায়দারের বউ একজন সেলেব্রিটি। ছোটখাট বা অল্প কয়েকজন লোকের মধ্যে হলেও তার বিষয়ে জানে এবং তাকে কখনো সামনাসামনি দেখে নাই–একজন সেলেব্রিটির এসব গুণাগুন তার আছে। অন্যসব সেলেব্রিটির সঙ্গে হায়দারের বউয়ের একটাই পার্থক্য তার ছবিটাও কেউ-কখনো দেখে নাই। হায়দার বলে তার পর্দানসীন বউয়ের ছবি বেগানা মানুষ দেখবে–এটা হতে পারে না।

তবে সেই বউ দেখতে কেমন, খায় কী, কী পছন্দ করে এসব তো বটেই–অফিসে বা অবন্ধু কাউকে বলা যায় না যেসব বিষয়, তাও হায়দার তার বউ নিয়ে বলে বেড়ায়। বিশেষ করে হিরণকে। হিরণের এখনও বিয়া হয় নাই। মেয়েদের নিয়ে ওর ছোঁকছোঁকানিটা হয়তো টের করেছে হায়দার, কে জানে! কিন্তু হায়দারের বউ জোছনারে নিয়ে আলাপ এ অফিসের একটা নৈমিত্তিক ঘটনা। পিওন আরশাদ, সিনিয়র অফিসার কবির, মেয়ে কলিগ যারা আছেন; হায়দারকে দেখলেই বুঝতে পারেন এখনই বউয়ের গল্প শুরু হবে। হয়দারের বউয়ের ছেলেমেয়ে হয় না। এর জন্য দোষ নাকি হায়দারের নিজেরই। বউ নাকি সবসময় তাকে হুমকি দেয়। বলে, মুরোদ যখন নাই তখন আর তারে বেঁধে রাখা কেন। হায়দার ঘটনার বিস্তারিত কলিগদের জানায় আর বলে–‘ছি ছি এগুলা কী কথা কন! গেরস্থ বাড়ির বউয়ের মুখে তো এসব মানায় না বলেন। তাও একটু মাথা আউলায়া যায় মাঝে মাঝে। আমারই দোষে কি না। মেয়েরা হলো মা-সত্ত্বা, তাদের মা হতে না পারার যন্ত্রণা কে বুঝবে দুনিয়ায়’?

হায়দার জানায়, পোয়াতি হইতে না পারার বেদনা নিয়ে জোছনা চজলে যায় তার মায়ের বাড়ি মানিকগঞ্জ। বউ কখন-কোথায় যায় কী করে সব হায়দার অফিসে জানায়। তিনি কেন মানিকগঞ্জের মেয়ে বিয়ে করছেন তাও অফিসের সবাই জানে। কারণ ওই এলাকার মেয়েরা ‘ভরভরান্তি’ হয়। ভরভরান্তি মানে কী সেটাও অফিসের যে যে জানতে চেয়েছে তাকে তাকে বলেছেন। বিশেষ করে হিরণকে, তার বউয়ের শরীর ভরা ভরা, কোথাও কিছুর কমতি নাই।

হায়দার বলে, ‘আমি অনেক খুঁজিছি। ধরেন যশোর, কুষ্টিয়া ওই অঞ্চল, ময়মনসিংহ। কিন্তু মানিকগঞ্জে যাবেন, দেখবেন শরীর জুড়ায়ে গেছে। ওরা খুব ফলায় ভালো। আমার বউয়ের খুব বল। হে হে, আমি তো পারিই না ওর লগে’। শুনে লজ্জা পায় হিরণ, কী পারে না তা মনে আসলেও মুখে বলে না। কী বলবে পাল্টা সেটাই সে খুঁজে পায় না–এতটা লাজওয়াব হয়ে যেতে হয় তাকে।

হায়দার আর তার বউয়ের গল্প আমোদ এবং বিরক্তি দুই-ই তৈরি করে অফিসে। তবে হিরণের আগ্রহ যে বেশি তা হায়দারের চোখে ধরা পড়েছে। হিরণ কেমন বেহায়ার মতো কথা শোনে। আর সুযোগ পায় যদি তো অন্য মেয়েদের কথা তোলে। তাদের অফিসেই কোন মেয়ে কলিগ কেমন, তাদের শরীর কেমন–এসব নিয়েও আলাপ হয়। মেয়েদের নিয়ে হায়দারেরও কথার বলায় ক্লান্তি নাই। কোন মেয়ে কেমন, কোন এলাকায় কেমন মেয়ে থাকে, হিরণ যদি বিয়ে করে তাইলে কেমন মেয়ে করা উচিত–এসব। দেখা গেল বেশিরভাগ সময় অফিসের নিচে চা-সিগারেট খেতে খেতে ওদের দুজনের আলাপের বিষয় হয় হায়দারের বউ জোছনা নয় অন্যকোনো মেয়ে।

হায়দারের হিসাবটা সেই গরুর গল্পের মতো। বিমানের গল্প লিখতে দিলেও যে বালক বিমানকে নদীতে ফেলে দিয়ে তার পাশের মাঠে ঘাস খাওয়ারত গরুর গল্পে ফিরায়ে আনে–হায়দার সেই বালকের মতো। হয়তো অবরোধ চলতেছে। মানুষের অফিস করা খুব কষ্টের। কে-কীভাবে অফিসে এল তা নিয়ে আলাপ। হায়দারের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় তো সে বলবে, বউ তারে আগায়ে দিছে। এবং বউ কীভাবে তাকে অফিসে দিয়ে গেল, রিকশায় হুড তুলে তারা কী করল, এসব বলা শুরু করে। লজ্জায় লাল হয়ে যায় মেয়েদের গাল। অবরোধ কেন, কীসের, মানুষের কষ্ট–এসব আলাপ হায়দারের সামনে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে হয়ে পড়ে। তখন আলাপ বিএনপি, আওয়ামী লীগ, পরিবহন খাত থেকে ঘুরে যায় তার দিকে মানে তার বউয়ের দিকে।

কষ্টও দেখায় হায়দার। সে বউরে বাচ্চা দিতে পারে না। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা করে…। কী ইচ্ছা করে সেটা আর বলে না। শুধু তাকায়। হায়দারের এসব বকবক মেয়েরা পছন্দ করতে পারে না। নিজের বউরে নিয়ে কোনো পুরুষ দিনের পর দিন কথা বলে যাইতে পারে এটা তাদের বিরক্তির কারণ। এত হ্যাংলা পুরুষ তারা আর কখনো দেখে নাই। পুরুষ মানুষের এমন স্বভাব হলে চলে না। নিজের বউকে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে এমন সব আলাপ, ছি ছি ছি! ব্যাপারটা ইরিটেটিং তো অবশ্যই এটা টিজিংও। হায়দারকে অন্যের মারফত এ বিষয়ে মৃদু ধমকও দিয়েছে মালিহা। যে কারণে ছেলেদের ভেতরে নিজেকে সংকুচিত করে রেখেছে ইদানিং হায়দার। তারপরও কথা হলো তুলার মতো, ভাসতে ভাসতে চলে যায় এ কান-ও কান।

একদিন হয়তো হায়দারের গালের কাটা দাগই অফিসের আলোচনরা বিষয় হয়ে উঠল। এমনিতে এটা একটা বেসরকারি ব্যাংক। তার ওপর বাংশাল শাখায় আসে যত সব উটকো, অশিক্ষিত, লুঙ্গি পরা লোকজন। তাদের আবার টাকার হিসাবের শেষ নাই। রড-সিমেন্ট, পাইকারি সব ব্যবসার টাকা। এদের ভাষায় সঙ্গে ব্যাংকের ভদ্রস্থ লোকেদের ভাষা মেলে না। মেজাজ মেলে না। আর তারা লোকাল, তাদের খুব নাকি দাপট। কীসের এত দাপট কে জানে! কিন্তু কাস্টমারকে কিছু বলার নিয়ম নাই করপোরেট অফিসে। মুখ গুঁজে কাজ করে যাওয়া এখানকার ধর্ম। টাকা গুনো, অ্যাকউন্ট খুলে দাও, ব্যালেন্স জানায়ে দাও, চেকবই ঠিক করে দাও, রেমিট্যান্স আসছে, স্যালারির টাকা জলদি ছাড়ো, বড় ক্লায়েন্ট এসে বসে আছে–ছুতানাতা কাজের শেষ নাই। এই এত হুজ্জতের মধ্যে জোছনা একটা ফুরসত যাদের জন্য তাদের কাছে বিষয়টা আমোদের। কিন্তু সবার কাছে না। অন্যের বউয়ের বিষয়ে আজেবাজে কথা শুনতে তাদের ভালো লাগে না। তারা মার্জিত। অন্যের পারসোনাল লাইফ নিয়ে তারা ঘাঁটাতে চায় না। জানতেও চায় না। তাদের পক্ষে এভাবে অন্যের ঘর, সংসার, বউ নিয় আলাপে যোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। হায়দারকে তারা কিছু বলতেও পারে না। বিষয়টা এত নোংরা মনে হয় যে এটা নিয়ে ম্যানেজার স্যারকে তাদের অভিযোগ করারও রুচি হয় না।

তা ছাড়া ব্যাংকের ঝামেলা আগের চাইতে এখন অনেক বেড়েছে। এখন একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে হাজারটা তথ্য মিলায়ে দেখতে হয়। ব্ল্যাংক চেক, রেমিট্যান্স, কোম্পানি অ্যাকাউন্ট, একজনের চেকে আরেকজনের টাকা তোলা এসব নিয়ে কড়াকড়ি। মাঝে মাঝে সার্ভার ডাউন, ক্যাশ না থাকা এসব ঝামেলাও তো আছে। আর আছে কিছু বিরক্তিকর কাস্টমার। এদের আহ্লাদের শেষ নাই। ভাংতি টাকা দেন, নোট দেন, আমার বাপের টাকা আমারে দিবেন না! মাঝে মাঝে যখন মাথা তুলে তাকায় ব্যাংকাররা তখন বুঝতে পারে তারা সব ভুলে ছিল, কে, কোথায়, কীভাবে ছিল–সহসা মনে পড়ে না। ধাতস্থ হতে সময় নেয়। এত ব্যস্ততার মধ্যে হায়দারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো বাড়তি মেন্টাল স্ট্রেস নেয়ার ঝুঁকি তারা নিতে চায় না। এমন নিরেট সময়ে জোছনায় কেউ কেউ আবার নির্মল মজা পায়।
এদের দুজন আসিফ আর হিরণ। তারা এখনো বিয়ে করে নাই। ওদের দুজনের দোস্তিটা একটু বেশি এ অফিসে। একসঙ্গে বের হয় বৃহস্পতিবারে। তারা সবচেয়ে বেশি মনে রাখে জোছনাকে। হিরণ একটু বোপরোয়া। বলে চল, হায়দার ভাই তো এখন অফিসে। আমি একটু যাই ওদের বাসায়। কী বলিস!

আসিফ হাসে, ‘শালা, তোর কী মাথা আউলাইছে’?

মাঝে মাঝে আসলেই হিরণের মাথা আউলে যায়। এই যে সেদিন, টেংরা মাছ আর বেগুন আর ছোট ছোট আলু দিয়া ঝোল ঝোল করে তরকারি করে নিয়ে আসল হায়দার। হিরণও খেতে বসেছিল সঙ্গে। তা হায়দারের মুখে তো অন্য কথা তেমন থাকে না। বউ, বউ আর বউ। এই বেগুন বউ নিজে নাকি গিয়ে কিনেছে। বেগুনওয়ালা কিছুতেই দামে ছাড়বে না। কিন্তু তাকেও নাকি কাবু করার কায়দা জানে জোছনা। কায়দাটা বিশেষ কিছু না। একটু হাত তুলে তুলে কথা বলে নাকি সে। আর টেংরা যে কিনেছে, তাও কম দামে। দামটা কমানো গেছে ওই বউয়ের দৌলতেই। সেদিন হায়দারও ছিল সঙ্গে। বাজারে গিয়েছিল সেদিন সকালে। বাজারে সকাল বেলা যে না গেছে সে বুঝবে না হট্টগোল কাকে বলে। সেই ভিড়ের মধ্যে একটু ঝুঁকে ঝুঁকে মাছওয়ালার সঙ্গে কী দরদাম করল তার বিশেষ হায়দার শোনেনি, কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ টাকা কমে টেংরা কিনে এনেছে।

সেই টেংরা খেয়ে দুজনে মিলে নিচে গেল। সিগারেট ধরাল। আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হায়দার বলল, ‘বুঝলেন হিরণ ভাই এগুলা সাগরের টেংরা, বুকের দিকটা না একটু ফেলা ফোলা থাকে। অনেক সময় ডিম থাকে, একটু তেল তেল থাকে। জোছনার মতো শুধু পিছলায়। আপনি ধরতে যাবেন আর সে পিছলাবে’।

এসব কথায় হিরণের কান ঝাঁ ঝাঁ করে। তার শুধু মনে হয়, একবার দেখতে যায় জোছনাকে। একবার শুধু। বার দুই হাসির মতো করে আসিফকে কথাটা বললেও সে সিরিয়াস। কিন্তু সমস্যা হলো হায়দার ঠিকানা দেয় না। শুধু বলে মোহাম্মদপুরে নাকি তার বাসা। বাসা বদলাবে বদলাবে করে বদলান হয় না। জোছনার নাকি এলাকাটা ভালো লাগে।

এর মধ্যে হঠাৎ বৃহস্পতিবার হায়দার বলে সে যাচ্ছে মানিকগঞ্জ। বউ আবার তার ফিরে এসেছে ঢাকায়। তবে কিছু জরুরি আনাজপাতি-কলা আনতে পারে নাই। ছোট বোনটাকে আনতে পারে নাই। হায়দারের টানে হঠাৎ চলে এসেছে। একে নাকি ‘বাই’ ওঠা বলে। এখন আবার ছোট বোনকে নাকি না আনলে তার আর সইছে না। যে কারণে হায়দার গিয়েই চলে আসবে। বৃহস্পতিবার একটু আগে আগে তাকে ছেড়ে দিলে ভালো হয়। মানিকগঞ্জ যাওয়া খুব বেশি সময়ের কাজ না। তারপরও ঢাকার জ্যাম তো পারাতে হবে। বৃহস্পতিবার রাতটা থেকে শুক্রবার চলে আসবে। তার শ্যালিকার আবার খুব ঢাকায় থাকার শখ। তার জন্য এটা-সেটা কিনে নিয়ে যাইতে হয়। বয়সের তুলনায় শালীকে নাকি একটু বড়ই দেখায়। শালীকে নিয়ে আবার শুক্রবার সকালেই ফেরা যাবে না হয়তো। তার নাকি সাজতে অনেক সময় লাগে। ঢাকায় আসার জন্য নতুন জামাও কিনে দিতে হয়। এসব করতে করতে শুক্রবারটাও হয়তো থেকে যাবে মানিকগঞ্জ। কারণ হয়দারের শ্বশুর সন্ধ্যার পর কাউকে বাড়ি ছাড়তে দেন না। এতে নাকি অমঙ্গল হয়। এ সময়টায় জোছনা তখন একা থাকবে বাসায়। কাজের বুয়াকে বলা হয়েছে বাসায় থাকতে। এখন তার আবার বাই না উঠলে হয়।

অফিসে কে শুনছে তার কথা জানে না হয়দার। খেতে খেতে তবু সে বলেই চলে। খুব ফিচলা নাকি তার শালীটা। দুলাভাইয়ের অফিস দেখার খুব শখ। এরপর সিগারেট খেতে খেতে হিরণকে বলে, তার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেবে যদি অফিসে নিয়ে আসতে পারে। আর হিরণ চাইলে এদিক-সেদিক কফি-টফি খাওয়াতে নিয়ে যেতে পারবে তার শালীকে।

হায়দারের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার খবরে দুরভিসন্ধি আঁটে হিরণ। এবার সে জোছনার সঙ্গে দেখা করবেই। কেউ দেখে নাই মহিলাটারে এখন পর্যন্ত, কারুর আগ্রহও নাই। বার দুই যে হিরণ প্রস্তাব তুলেছে তাতে সবাই মজা পেয়েছে। অফিসের কলিগরা এরে-তারে নিজেদের বাসায় দাওয়াত দেয়। কিন্তু হায়দারের বউকে দাওয়াত দিতে দেখা যায় নাই। হায়দারকেও টেকনিক্যালি দাওয়াত দেওয়ার বিষয়টা এড়াতে চায় তারা। অফিসের ঝামেলা বাসায় বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা কারুর নাই। সবারই বউ আছে, সংসার আছে। জোছনার মায়ায় কোন পুরুষ কলিগ নিজে বা নারী কলিগের স্বামী ফেঁসে যায়–রীতিমতো তা এক আতঙ্ক। এমনি দিন দুই গল্প করেছিল আলামিন সাহেব কার বউয়ের সঙ্গে। এতেই নাকি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

অফিস একটা বউনিরপেক্ষ জায়গা পুরুষদের জন্য। সেখানে এসে বউয়ের বদনাম গাওয়া যায়। আলামিন সাহেবও পরদিন এসে বউয়ের বদনাম গাইলেন।

‘এটা কোনো কথা বলেন, বিয়া করেছি বলে কী অন্য মাইয়া নিয়ে কথাও বলা যাবি না’!
এমন সব নানা টেনশন, চাপান-উতোর নিয়ে হায়দারের বউ জোছনা একটা সেনসেশন হয়ে আছে। অথচ তাকে কেউ কখনো দেখে নাই।

বা যদি এমন হতো যে হায়দার দাওয়াত দিয়েছে তার বাসায়, তাহলেও না হয় বউটাকে দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু হায়দারে মুখে দাওয়াতের কোনো আলাপ করে না কখনো। মোবাইলে এখন তো কত লোক কত ছবি রাখে। হায়দারের মোবাইলে কোনো ছবি নাই। বলে, ‘বউ যেসব ছবি তোলে সেগুলা কী আর বাইরের মানুষরে দেখানি যায় বলেন’। কিন্তু নরমাল ছবিও তো তোলা যায়, কোথাও ঘুরতে গেলে। কত লোক যায় না! খাইতে, বেড়াইতে, গ্রামের বাড়ি গেলেও তো ছবি তোলে লোকে। কিন্তু জোছনা তোলে না। জোছনা নাকি বলে, ‘আমার ছবি তুমি দেখায়া বেড়াবা এটা হবে না। আমি তোমার জন্যই ছবি তুলব। তুমি অফিসে গিয়ে দেখবা’। এই বলে কী কী সব ছবি নাকি তোলে হায়দার পরে তার বউ সেগুলো ডিলিট দিয়ে দেয়। তার কথায়, জোছনা গ্রামের মেয়ে হলেও অনেক চালাক। ভালো এলাকার মেয়ে তো। ভালো খেয়ে এরা বড় হয়েছে, এদের মধ্যে নাকি নানা ইশারা-ইঙ্গিত কাজ করে। এরা সহজে বুঝে নেয় অনেক কিছু। আবার বুঝায়েও দেয়। আর এদের শরীরে ক্লান্তি আসে না। যেন জোছনা পৃথিবীর এক আদিম মাটি। তাকে ছেনে ছেনে নিত্যনতুন আদল দেওয়া যাবে।

সেই জোছনার ছোট বোনকে নিয়ে আসার দিন থেকে হিরণ প্ল্যান করতে থাকে সে যাবে দেখা করতে। শুক্রবারই হয়তো শালীকে নিয়ে ফিরবে হায়দার। অতএব শনিবার হিরণ যাবে তাদের বাসায়। হায়দার থাকতে থাকতেই যাবে প্রথমবার। পরেরটা পরে দেখা যাবে। এমনকী আসিফকেও সে বিষয়টা জানায় না সে। হায়দারের বাড়ির ঠিকানাটা জোগাড় করে অফিসের অ্যাডমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অ্যাডমিনকে বুঝাতে যদিও একটু সময় লাগে। তবে ঠিকানাটা সে জোগাড় করতে পারে। হিরণ সহজ কৌশলই বেছে নেয়। অ্যাডমিনকে গিয়ে বলে, হায়দার লোকটার বাসার ঠিকানা কেউ জানে না। কেউ তার বাসায় কোনদিন যায়নি। হিরণ যেতে চায়। সে একবার দেখতে চায় হায়দারের বউ কেমন। দেখে এসে অ্যাডমিনকে সব জানাবে সে।

অপার কৌতূহলে রাজি হয় অ্যাডমিনের ষাটোর্ধ্ব পুরুষটা। হায়দারে বাসার ঠিকানাটা দেয় হিরণকে।

কিন্তু সে ঠিকানা ছিল ভুল। হায়দারের দেওয়া ঠিকানার ভবনটা এখন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সেখানে নতুন বাসাবাড়ি উঠবে। তাহলে হায়দার থাকে কোথায়? লোকটা তো মনে হচ্ছে হাড়ে বজ্জাত আছে। ভুল ঠিকানা দিয়ে বিভ্রান্ত করতে চায় সবাইরে। এটা সে কেন করল? হিরণ বুঝতে পারল না। সে বিফল মনোরথে ফিরে আসল নিজের ব্যাচেলর বাসায়। আজও তার ইচ্ছাটা পূর্ণ হলো না। নিজের কৌমার্য নিয়ে সে খুব মন খারাপের মধ্যে থাকে। তার বয়স বত্রিশ হতে চলল। ঘরবাড়ির যে অবস্থা তাতে বিয়ে করার সম্ভাবনা সহসা নাই। বড় ভাইয়েরই এখনো বিয়ে হয় নাই। তিনি পঁয়ত্রিশে আছেন। পাত্রী দেখা চলছে। কবে বিয়ে হবে, তারপর হিরণের আলাপ আসবে। বড় ভাইয়েরই তো মেয়ে দেখতে দেখতে তারা ক্লান্ত। তাদের বাবা ছিলেন কলেজ মাস্টার। ছেলেরা সবাই লেখাপড়া করলেও ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, বায়িং হাউজে কাজ করে–যার সামাজিক, আর্থিক মর্যাদা খুব বেশি না। বোনদের বিয়ে হয়েছে অবশ্য ভালো পরিবারে। এর মধ্যে একজন ইউএনও, আরেক বোনের জামাই চেয়ারম্যান। তারা দেখতে সুন্দর সবাই। সুন্দর ছেলের সঙ্গে মানানসই সুন্দর মেয়ে পাওয়া খুব মুশকিল। মেয়ে পাওয়া গেলেও পরিবারের হাইটের সঙ্গে যায় না। এসব জোড়াতালি মেলাতে মেলাতে বড় ভাইয়েরই যেখানে এখনও বিয়ে হয় নাই, সেখানে হিরণের বিয়ে কীভাবে হবে।

এ যৌবন সুধা বৃথা আজি গেল বিজনে–মনে মনে কিছুটা কাব্যও করে হিরণ। মেয়েদের সঙ্গে তার বিশেষ স্মৃতি নাই। কলেজের মেয়েরা বাস আর ক্লাস করত শুধু। ওদের সে পায় নাই। বড় পরিবারের সন্তান বলে কাজও থাকত তার কিছু কিছু। টিউশনি করাত। বাবার কলেজে পড়ত বলে কিছু করার উপায়ও ছিল না। এরপর ঢাকয় এসে মেসে থেকে থেকে পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে, চাকরি নেয়ার পর কিছুটা যখন থিতু হলো মনে হচ্ছে তার–তখন কেবল পোড়াচ্ছে এই মেয়েমানুষ । এ জীবনে যার আস্বাদ নেয়া হয় নাই। কিছু স্পট অবশ্য আছে সদরঘাট, বাংলাবাজার, বাহাদুরশাহ পার্ক এসব এলাকায়। ফার্মগেট, ধানমণ্ডিতেও আছে। সব জায়গাতেই আছে। দামভেদে জায়গা বদলায় আরকি। কিন্তু টাকা দিয়ে মেয়েমানুষের সঙ্গে শোয়ার কাজটা সে কীভাবে করে? সম্ভ্রান্ত পরিবারেরর সন্তান। যদি ধরা পড়ে যায় তখন? পুলিশও নাকি রেড দেয় মাঝে মাঝে–ভয়ে আরও বরং নিস্তেজ হয়ে যায় হিরণ।

এরপর আছে ফেসবুক, টু, হোয়াটসঅ্যাপ–এসব। হিরণ দেখতে ভালো বলে মেয়েদের রিকোয়েস্ট পায়। কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও চলে। কিন্তু আসল কথাটা বলতে পারে না। এর মধ্যে দুইটা মেয়ের সঙ্গে তার দেখাও হয়েছে। ছবির মেয়ে আর বাস্তবের মেয়ে যে এক না তা সে বুঝতে পেরেছিল ওই দুই দেখাতে। ক্যামেরার মুখ আর আসল মুখ কত যে আলাদা হয় মানুষের! বিশেষ করে মেয়েমানুষের। ওদের সঙ্গে বাহদুর শাহ পার্ক, বুড়িগঙ্গা ঘুরে হোটেলে খেয়ে রিকশা করে আবার দিয়ে এসেছে। একজনের বুকেও হাত দিয়েছিল। মেয়েটাও হাসছিল আর আরো কোলঘেঁষে বসছিল। রিকশার এতটুকু জায়গার মধ্যে আর কী কিছু করা যায়! কাউকে যে নিজের মেসে ডেকে এনে কিছু একটা করবে সে উপায়ও নাই। কারণ রুমমেট থাকে। হয়তো একদিন ছুটি নিয়ে সবাই অফিসে গেলে এক ফাঁকে ওই মেয়েটাকে ডেকে আনতে পারে সে। তখন ফ্ল্যাটের অন্যরা দেখে ফেলবে না? জানাজানি হয়ে যাবে না?

কাকে কী বলবে হিরণ। আর মেয়েটাকে কতটা বিশ্বাস করা যায়, যদি ফাঁসিয়ে দেয়! যদি বিয়ে করতে বলে। তার এক বন্ধুর অবস্থা তো আরও করুণ ছিল। ফেসবুকে খাতির করে একটা মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল বাসায়। সারারাত দুজনে মজা লুটেছে। সকালে উঠে দেখে বাসা ফাঁকা। মানিব্যাগ, মোবাইল, ঘড়ি, কাপড় সব নিয়ে ওই মেয়ে উধাও। আরেক বন্ধু, তার কলেজেই ছিল। এখন বিদেশ। মাঝখানে একটা এনজিওতে চাকরি করত। তার ঘটনা আরো ভয়ের। এক জুনিয়র মেয়ে নতুন চাকরিতে জয়েন করে তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল। বন্ধু নাকি মেয়েটার বুকে হাত দিয়েছিল। তা ঘটনাটা হিরণের কাছে ওর বন্ধু স্বীকার করেছিল। কিন্তু এর জন্য নাকি মেয়টা দায়ী। ওই মেয়ে নতুন নতুন কাজ শিখবে বলে একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়াত। পোশাক পরত এমন যে বুকে কাপড় থাকত না। কাজ করার সময় হয়ত তলপেটটা, হয়ত মাথার চুল, কখনও কখনও বুকটাও লেগে যেত গায়ের সঙ্গে। এগুলা কি ইশারা না? মেয়েরা এসব করে ওপরে ওঠার জন্য। ছেলেদের কাছ থকে কাজ শিখে, ছেলেদের পায়ের নিচে ফেলে তারা ওপরে উঠে যায়। এ মেয়ের কাহিনীও তাই। দরকার না থাকলেও যে মেয়ে ওই বন্ধুকে রিকশা করে এগিয়ে দিয়েছে। সেই মেয়ে একদিন এরকম রিকশায় বসে বুকে হাত দেওয়ার দোষে তার বন্ধুকে ডিপার্টমেন্ট ছাড়া করেছে। আরও বেশি কিছু হতো, তার বন্ধু মাফ চেয়ে ছাড় পেয়েছে। আর সেই মেয়ে নাকি এখন কয়েক ধাপ প্রমোশন পেয়ে ম্যানেজারিয়াল কোনো পোস্টে কাজ করছে।

সব মিলিয়ে হিরণের ক্রাইসিসটা এত সহজে বলে বুঝান যাবে না। লম্বা সময় নিয়ে বলতে হবে। এক কথায় তার উত্তর হয় না। এত সময় নিয়ে কে আছে যে শুনবে। হায়দার লোকটাকে তার এতদিন ভালো মনে হতো। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে সেও একটা দুই নম্বর। ভুল বাসার ঠিকানা দিয়েছে। তার বউটা সে যেমন বলে যদি তেমন হয়, খোলামেলা–কিছুটা বোল্ডটাইপ! খাতির হয়ে গেলে হিরণকে দিয়ে সে-ই সব করিয়ে নেবে। সব ভয়ডর টুটে যাবে তার। সে সুযোগ তাইলে কী আর হচ্ছে না? আবারও হতাশা লাগে। একা ঘরে শুয়ে থাকে। আজ ছুটির দিনেও তার কিছু করার নাই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আলো কমছে পৃথিবীর। আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে হিরণ। একা একা সঙ্গমে আর তৃপ্তি পাচ্ছে না। এখনই তো বয়স, এখনই তো সময়! কত ছেলে, কত মেয়ে কত কিছু করে বেড়াচ্ছে। আর সে পারছে না। আশপাশের বিল্ডিং থেকে মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে তাকে এলমেল বিছানায়। আরেকটু ঘুমিয়ে নেয়া ছাড়া আপাতত কাজ নাই আর।

ওর মনে হয় তার একবার ফ্রান্স যাওয়া বন্ধুটার কথা। সে নাকি ট্রেনে ওঠার আগে এক মেয়েকে বলেছিল, যাবা আমার সঙ্গে? মেয়েটা পাল্টা জবাব দিল, কী শোয়ার জন্য! সেই বন্ধু মাথা নাড়াতেই মেয়েটা নাকি চলে গেল তার সঙ্গে। সেই গল্প কতবার করেছে সে। হিরণও শুনেছে। অথবা ঢাকায় তার সঙ্গে চাকরিরর আশায় মেসে ওঠা ছেলেরা নাকি কী কী সব করে বেড়াচ্ছে–যার কিছুই ঘটল না হিরণের জীবনে।

এরপর অফিসে এলে হায়দারের সঙ্গে দেখা হয়। হায়দারকে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে। লম্বা, ছিমছাম শরীর তার। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। বয়স খুব বেশি না হলেও দেখে বয়স্ক লাগে। আজ সে নতুন কোনো গল্প বলবে বলে মনে হচ্ছে। মুখের ভেতর নিশ্চয় চুলবুল করছে বউয়ের গল্প। সে তো জানে না তার গোমর জেনে ফেলেছে হিরণ। সে এখন পালাবে কোথায়? গল্প করে নিক, তারপর ধরবে তাকে। বাসার ঠিকানা কেন ভুল দিয়েছে সে উত্তর আজ দিয়েই যেতে হবে। তার বউয়েরই বা ছবি দেখা যায় না কেন? হায়দার যদিও জানে না হিরণের মনের রাগের খবর। সে আছে তার মনের সুখে। কাজ শেষে দুপুরে লাঞ্চের জন্য ডাক দিলে হিরণ আর হায়দার একসঙ্গে খাওয়া শেষ করল। নিচে গিয়ে চা খেতে খেতে হিরণ ধরল তাকে। ‘মিয়া মিছা কথা কন আপনে খালি। অফিসে ভুল ঠিকানা দিয়া রাখছেন। আপনি খুব চালিয়াত আছেন।’

হয়দার হো হো হেসে উঠল তার কথায়। হাসির তোড়ে হিরণের সব অভিযোগ উড়েই গেল যেন ঝরা পাতার মতো। ‘আরে মিয়া অফিসের অ্যাডমিন আর আপনে কী এক হইলেন। আমার বাসার ঠিকানা আপনের লাগে তো আমারে কন। অফিসের অ্যাডমিন চোদাই নিকি আমি। আপনে আমার ভাই, জিগরি দোস্ত। আপনের ঠিকানা লাগে কন। ওই বাসা ভাঙা হইতেছে কইলেন না? বাসা পাল্টাইছি তো।’

হিরণ তাও শেষ একটা চেষ্ট চালায়, ‘আপনে সারাবছর বউ বউ করেন, বউয়ের ছবি তো জীবনে দেখলাম না। বাসায় একদিন দাওয়াত দিয়া খাওয়াইলেন না, ফোনে একটা দিন কথা কওয়ায়া দিলেন না।’

হায়দারকে তাতেও টলানো গেল না। বউয়ের ছবি দেখানো নিষেধ সেটা সে আগেই বারবার বলেছে। পারসনালি কেউ দেখতে চাইলে ভিন্ন কথা। কেউ তো দেখতে চায় নাই। আর বাসায় দাওয়াত কী কেউ কাউরে দেয় এ শহরে? এ অফিসে কে কার বাসায় কারে কয়টা দাওয়াত দিছে এতদিন? হিরণ কী চায় দেখা করতে, দেখতে, কথা বলতে? তাহলে বলুক না হায়দারকে। আরও কিছু চায় তো বলুক। হায়দার জানবেও না জিগাবেও না। হিরণের কী লাগবে? বউয়ের একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে সেটা? খুব গোপন কিন্তু এটা, খুব কম লোক থাকে সেখানে। আজই সে গিয়ে বলবে জোছনাকে হিরণের জন্য রিকোয়েস্ট পাঠাতে। খোলেন না, মোবাইলের ফেসবুকটা খোলেন, লেখেন জোছনার আলো, দেখবেন একটা চাঁদের ছবি। বউ কিন্তু ইনবক্সে ছবি দেয় বুঝছেন, প্রোফাইলে, কভারে, ফোল্ডারে তার ছবি পাবেন না। ইনবক্সে দেয় কি না হায়দার তা সিওর না হলেও তার ধারণা দেয়। তার বউ একা হায়দারকে নিয়ে খুশি না। তা ছাড়া স্বামী বাইরে থাকলে একা একা সে কী করে? এতক্ষণ কী একা থাকা যায়। তখন যদি কেউ যায়ও হায়দারের বাসায় তার কী বুঝার উপায় থাকবে? বউ তারে কোনোদিন বলে না আজ একটু আগে আগে আসো, এসব নিয়ে হায়দারের যদিও ক্ষোভ নাই। সে কিছু জানতেও চায় না। হিরণ যদি পারে বউয়ের সঙ্গে দেখা করতে, কিছু করতে–করুক না।

‘বুঝলেন, মেয়েমানুষ হলো সৌন্দর্য। সুন্দরের সুবাস বাইরের খোলা জায়গায় আসবেই। অন্যরা পাবেই।’ হায়দার কথাই বলতে দিচ্ছে না হিরণকে। এর মধ্যে কয়েকটা সিগারেট খাওয়া হয়ে গেছে। জোছনার আলোকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও পাঠানো হয় গেছে। হায়দারের এমন চোস্ত একটা ইমেজ হিরণ আগে দেখে নাই। কিছুটা ক্ষেপেছে হয়তো তার সন্দেহ করার কারণে। অফিসের যে দেরি হচ্ছে তা তারা আমলে নিচ্ছে না। আশপাশে কেউ কেউ তাকাচ্ছে হায়দারের দিকে। তাদের কথাবার্তা কিছুটা সিরিয়াস রূপ লাভ করেছে। টুং টুং করে বেজে চলা চা বানানির শব্দ, গাড়ির হর্ন, লোকসমাগমের একটা গমগম আওয়াজ–সবকিছুর মধ্যে হিরণ তন্ময় হয়ে কথা শুনতে শুনতে চলে গেছে অন্য কোথাও। মনে হয় জোছনার কাছে, যদি সে অ্যাকসেপ্ট করে রিকোয়েস্ট। তাহলে কী ধরনের আলাপ হবে তাদের মধ্যে? তারা কী খুব ঘনিষ্ট কথা বলবে, ছবি পাঠাবে জোছনা বুকের আঁচল ফেলে?

হায়দার আরো বলে, যেসব মেয়ে ফেসবুকে দেখবেন খুব ছবি দিচ্ছে, খুব সেক্সের কথা বলছে, বলছে উদার হতে–তারা তত কিপটা বাস্তবিক জীবনে। তাদের কাছে আপনি ঘেঁষতে পারবেন না। যারা রাখঢাক রাখবে, যাদের শরম বেশি, জায়গা মতো নিয়ে যেতে পারলে তারা খুলবে বেশি আপনার সামনে নিজেরে। আমার বউ দ্বিতীয় শ্রেণির, সে খুব লাজুক। লাজুক মানুষের মন ভরা শরীর।

সেদিন অফিসের ফাঁকে ফাঁকে অনেকবার ফেসবুক খুলেও হিরণ কোনো সাড়া পেল না। বাংলাবাজার নিজের বাসায় ফিরে রাতে খেয়াল করল রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেছে জোছনা। অনলাইনেই আছে সে। তার ফেসবুকে কিছু নাই। শুধু অ্যাকাউন্টটা খুলে বসে আছে। নক করে দেখল হিরণ। ছবি নাই কেন জানতে চাইল, সে যে তার জামাইয়ের অফিসের কলিগ তাও বলল। কিন্তু রিপ্লাই পাচ্ছিল না। হঠাৎ ছবি আসল একটা। হিরণের মাথায় বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে যাওয়া ছবি। পেছন ফিরে দাঁড়ায়ে আছে এক নারী জানলার ধারে। এক পরল শাড়ি পরে। কেমন শক্ত বাঁধন তার শরীরে। খুব ভরাট, যেমনটা বলেছিল হায়দার। হিরণ জানাল, বাহ খুব দারুণ। রিপ্লাই আসলো, শুধু কী দারুণ? হিরণ লিখল, পেছন থেকে দেখেই কী সব বুঝা যায়। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, তা কী কী দেখে সব বুঝা যায়। হিরণের কান গরম হয়ে আসছে, হাত ঘামাচ্ছে, আশপাশে রুমমেটরা মনে হচ্ছে তার দিকেই তাকায়ে আছে। একটা সিগারেট ধরানোর বাহানায় ছোট্ট বারান্দায় চলে গেল সে। হায়দারের বউ আবার ছবি পাঠিয়েছে। এবার আরো কাছের, তবে সেই পেছন দিকেরই। সঙ্গে একটা লাইন, এত সহজেই সামনের দিক কী দেখা যায়। এই শেষ। যত আশা নিয়ে বারান্দায় গিয়েছিল হিরণ, তার শুরুতেই সে দমে গেল। সিগারেটটাও বিষাক্ত লাগতে শুরু করল। সে রাতে আর কিছু ছবি অথবা মেসেজ এলো না।

দিনে দিনে জোছনার সঙ্গে বেশ জমে উঠছে আলাপ। বাসার ঠিকানা দিয়ে রেখেছে জোছনা যেকোনো দিন যেন চলে আসতে পারে হিরণের এমন আবদারে। জোছনা খুব সামান্য সময় রিপ্লাই দিলেও হিরণের অপেক্ষা বা বিরক্তি তৈরি হয় না। ভরা পুকুর মেয়েটার খোলতাই একটা চেহারা। বয়স তিরিশের বেশি হবে। হায়দারেরর বয়স পঁয়তাল্লিশ তো হবেই। বয়সের পার্থক্য আছে তাদের। হয়তো এ জন্য কোনো সমস্যা। সরাসারি ওদের বাচ্চা না হওয়ার বিষয়ে কথা হয়েছে। জোছনা বলে ওর কী করার আছে। ও তো বাচ্চা চায়। হিরণের কী কিছু করার আছে? হিরণ খুব সেনসেটিভ ছেলে। অল্পে পুলকিত হয়। ও বারবার সুযোগ চায় দেখা করার। কিন্তু জোছনা কীভাবে দেখা করবে যদি সময় না মেলে। এমন একটা উপায় খুঁজতে হবে যখন হায়দার ঢাকা শহরেই থাকবে না। হায়দারের গ্রামের বাড়ি যশোর। সে কবে কখন যায় বাড়ি তা জেনে নিয়ে জোছনার সঙ্গে দেখা করা যাবে ভাবে হিরণ।

জোছনার সঙ্গে তার আলাপ বিষয়ে হায়দার আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। সেও কিছু বলে না। একদিন হঠাৎ ওই শালীর কথা মনে হওয়াতে হিরণ জানতে চাইল ওই মেয়ের তাদের অফিসে আসার কী হলো? হায়দার কিছুক্ষণ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, ‘বাহ, হিরণ সাব! আমার শালীর খবর তো খুব মনে রাখছেন। তা ও কী আর অফিসে আসে? সে মুখের কথা। এই রবিবার তারে দিয়ে আসতি যাব। ওর বোন অবশ্য থাকবে। এক একা থাকপি, আমার না টেনশন হয়। আমার রাতটা সেখানে থাকতে হবে। ওদের ওখানে একটা ওরশ আছে। সেই মাজারের হালুয়া খেতে হয় অমাবস্যায়। বুঝেনই তো বাচ্চা-কাচ্চা হয় না, বুঝেন না; হালুয়াটা আনতে যাব এবার। এতদিন বিশ্বাস করি নাই।’

হিরণ চোখেমুখে উদ্বেগ ফুটায়ে তুললেও মনে মনে ভাবে তার সময় ঘনিয়ে আসছে। এত নিরাপদ সুযোগ আর সে পাবে না। চাপা একটা উত্তেজনা নিয়ে তার দিন পার হয়। শীত শীত একটা বাতাস দিচ্ছে। এরকম বাতাস গ্রামে পাওয়া যায়। কখন, কোন ফাঁক গলে ঢাকায় চলে আসে! একটু একটু মাঝে মাঝে গায়ে লাগলে ভালো লাগে, শরীরে শিহরণ জাগে।

এরপর একদিন শনিবার, বন্ধ তাদের অফিস–সেদিন রাস্তায় কোনো বাস ছিল না। সিটিং সার্ভিস বন্ধ নিয়ে জটিলতায় বাস মালিকরা রাস্তায় তাদের পরিবহন নামায় নাই। বাংলাবাজার থেকে রিকশায় মোহাম্মদপুরে আসতে হলো হিরণকে। অনেক টাকা তার ভাড়া গেল। ফিরতেও অনেক টাকা ভাড়া দিতে লাগবে অথবা হাঁটতে হবে। বের হয়ে সে দেখে রাস্তায় অনেক মানুষ হাঁটছে। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য নাকি এ শহরের মানুষ প্রস্তুত থাকে। তাদের গন্তব্য স্থির। হিরণের জন্য বরং একটা অন্য গন্তব্য আজ–হায়দারের বাসা। একটা উন্মোচন ঘটবে তার সামনে। হায়দারের বউকে দেখবে। হায়দারের বউকে দেখার অনেক দিনের শখ পূরণ হবে।

মোহাম্মদপুরের হুমায়ূন রোডটা একটু অদ্ভূত কিছিমের। মনে হবে নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকার রাস্তা। দূরে কোথাও নদী আছে। এখানে আগের আমলের কোনো একটা সাহিত্যের অফিস, পুরান দালান, আম গাছ আর আগের আমলের মতো কোনো দুধর্ষ ইংরেজবিরোধী বিপ্লবীর ঘরে ওঠার জন্য চিকন সিঁড়িওয়ালা বাসা। জংধরা কলাপসিবেল গেট, আধো অন্ধকার সিঁড়ি দারোয়ানবিহীন স্যাঁতস্যাঁতে ঘুম ঘুমায়। কেউ আসলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ একটা শব্দ, চাবির ঝনঝন, পদশব্দ মিলায়ে গেলে সেই অন্ধকার, সেই ঘুম আবারো এলায়ে পড়ে। এত শব্দ, এত ব্যস্ততার মধ্যে সিঁড়ির গোড়াটা কোথায় যে পায় ঘুমের আমেজ! হিরণ ঠিকানা মিলায়ে দেখে নেয় সব। হিসাব মতো সকালেই চলে গেছে হায়দার। সঙ্গে তার শালী। জোছনা একা। তার জন্য ভদ্রতাবশত ফুল ও মিষ্টি কিনেছে। সিনামায় দেখেছে–এসব করার আগে ফুল, মিষ্টি, মদ এসব কেনা হয়। মদ কি আর কেনা যায়! তাই ফুল আর মিষ্টি কিনেছে। প্রথমবার তার এই একান্ত রমণীগমন।

জোছনার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী হায়দারের বাসা হওয়ার কথা তিনতলায়। চিপা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কেমন অস্বস্তি হয় হারুণের। সে হয়তো কাজটা ঠিক করছে না। এভাবে তার হায়দারেরর বউয়ের সঙ্গে গোপন অভিসারে আসা উচিত হয় নাই। হায়দার জেনে গেলে, জানতে চাইলে সে কী জবাব দেবে? এটা অভদ্রতা নয় শুধু বেঈমানি। কিন্তু ওর ভেতরে একটা কামনা অনেকদিন ধরে ধিকি ধিকি জ্বলছে। এটাকে সে কিছুতে সামলে নিতে পারতেছে না। হায়দারের বউকে সে দেখবেই। সুযোগ পেলে আরো অনেক কিছু করবে। নফস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সে, নাজুক স্বভাব তার, সেই স্বভাব তারে তাড়ায়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

অন্ধকার সিঁড়ির মাথায় একটা ঘোলা কাঁচের ভেন্টিলেশন দিয়ে আলো আসছে। তিন তলায় একটাই ফ্ল্যাট। বিপরীত ফ্ল্যাটটা দাঁতহীন মুখের মতো, আন্ডার কনস্ট্রাকশন অবস্থায় পড়ে আছে। জোছনার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী হায়দারের বাসায় কাঠের দুই পাল্লার দরজা। এমন দরজা এখনকার শহরে তো দেখা যায় না! হিরণদের বাসার দরজা এমন ছিল। নীল রঙের দুই পাল্লার দরজায় লোহার আঁটা থাকত। হিরণ যখন ছোট ছিল তখন সে খুলতে পারত না নিজে নিজে সেই দরজা। তার কাছে রহস্যজনক মনে হতো ওই দুই পাল্লার কাঠের দরজা। মনে হতো খুলে যেতে পারলে দেখত কোনো বুড়ি হাওয়াই মিঠাই নিয়ে বসে আছে তার জন্য। যখন সে নিজে নিজেই দরজা খুলতে পারল, তখন দরজার ওপারের রহস্যও উবে গেল তার মন থেকে। এখন আবার বইরে থেকে নানাজনের দরজার ভেতরে কী আছে তা নিয়ে তার মনে রিরংসা ঘনীভূত হয়। তীব্র কামনা তৈরি হয় এর-তার ঘরে নির্জন ভরদুপুরে চুপি চুপি ঢুকে পড়ার। বাইরের দুনিয়ায় আর সে রোমাঞ্চ পায় না। রোমাঞ্চের যতটুকু তার জন্য, এখন সব অন্যদের ভেতর ঘরে। বলতে গেলে অনেকদিন পর সেই ছমছম রোমাঞ্চ উন্মুক্ত হওয়ার শিহরণ জাগছে শরীরে তার। এই প্রথমও বটে। মনে যেন তার কলি গজাচ্ছে নরম ফুলের ডাল ফুঁড়ে।

কী আছে দরজার ওপারে? কলিংবেলটাও পুরান। মনে হয় বুঝি শক করবে। কিন্তু হিরণকে হতভম্ব করে দিয়ে কলিংবেল বাজার কিছুক্ষণ পর দরজা খোলে হায়দার। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা হয়দারকে দেখে হিরণ টাল খায়।

‘আপনি হিরণ ভাই’!

‘আরেহ হায়দার ভাই, এটা আপনার বাসা! কী আশ্চর্য। এটা আপনার বাসা হবে কেন? এটা কি তিপ্পান্ন নাম্বার বাসা না?’

‘না না, তিপ্পান্নটা দুই বাসা পরে’।

‘ওহ, কী যে বলেন। আমাকে একটা লোক বলল এই বাসা। আমার ফুফাতো ভাইয়ের বাসা ওই তিপ্পান্ন নাম্বার। আজকে তার মেয়ের জন্মদিন। কিন্তু আপনাকে পায়া গেলাম। কী তাজ্জব। তা আপনি না মানিকগঞ্জ ছিলেন’।

‘আর মানিকগঞ্জ। আপনি আসুন ভিতরে, একটু বসে যান’।

‘নাহ থাক, আমি যাই। আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম’।

‘যাবেন কেন হিরণ ভাই একটু বসেন। ঘরের সামনে থেকে অতিথির চলে যেতে নাই’।

‘না, না যাই আমি। এদিকের অবস্থা জানেন তো রাস্তায় বাস নাই। দেরি হয়ে যাবে আবার’।

মুহূর্তে হায়দারকে দেখে কথা বানিয়ে বলে ফেলতে পারবে তা হিরণ নিজেও ভাবে নাই। তবে হায়দার যতই তাকে ঘরে বসতে বলছে মুখে তত ঠেলে দিচ্ছে সিঁড়ির দিকে। ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলছে ঘরে না যেতে। সে ধরে ফেলেছে হিরণকে। হিরণের সাহস বাজিয়ে দেখতে চাইছে। যেন গায়ের ওপর উঠে আসবে হায়দার। কিন্তু সরাসরি কেন যেন চলে যেতে বলছে না, ধমক দিচ্ছে না। মানে মানে কেটে যেতে দিচ্ছে হিরণকে। হিরণ ঘরে না ঢুকলেও কিছুটা ভেতরে দেখার সুযোগ হয়েছে। অন্য কারু চলাফেরা নজরে আসে নাই। কার সঙ্গে কথা বলছে স্বামী সেটা জানার জন্য কোনো স্ত্রীলোক উঁকি দিল না। ভেতরটা আবছা অন্ধকার। একটা খাট, একটা টেবিল আছে বুঝা যায়। ভেতরে আরো রুম আছে কি না! সিঁড়ির দিকে নামতে গিয়ে পা আটকে যায় হিরণের।

হিরণের খেয়াল হয় হায়দার বেশ লম্বা লোক। রেলিঙে নিয়ে গিয়ে ঠেকিয়েছে সে হিরণকে। এমন অবস্থায় এতটা পথ কীভাবে এল জানতে চাইছে। সে কিছুতেই মানতে পারছে না এত টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে এখানে এসেছে হিরণ। এ শহরে পরিবহন ধর্মঘট হচ্ছে, পৃথিবীর কোনো শহরে এসব হয় না। অসভ্য দুনিয়ায়ও না। যেসব কথা অফিসে কখনো বলে নাই হায়দার, সেসব কথাই যেন ঠেসে ঠেসে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে হিরণের মগজে। চোখ-মুখ কেমন পাল্টে যাচ্ছে হায়দারের। সব চুদির ভাইকে একাকার করে দেবে হায়দার একদিন যদি সুযোগ পায়, এসব বলছে। হিরণের ভয় বাড়ে।

মিথ্যা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। সে যাওয়ার দিকে পা বাড়ায়। হায়দারের কথা তখনো শেষ হয় নাই। ভয় যেন জাঁকিয়ে ধরে হিরণকে। খুব ধীরে, যেন ভয় পায় নাই, যেন পালায়ে যাচ্ছে না, যেন হায়দারের বাসায় না সে সত্যি আসছে ফুফাতো ভাইয়ের বাসায়, এমন ভঙ্গিতে নামতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে। নামতে গিয়ে বুঝতে পারে পালানোর অভ্যাস নাই হিরণের।

হায়দার, হুমায়ূন রোড, এই শহর–কোথাও থেকে পালায়ে যাওয়া তার ধাতে নাই। সে শুধু আটকা পড়ে যেতে জানে, নিজেকে আত্মসমর্পণে অভ্যস্ত করে তুলেছে প্রতিদিন।
হিরণ ফিরে চলেছে আবারো রিকশায়। এবার আর বেশি টাকা নিয়ে তার মাথাব্যাথা নাই। বাস না থাকা নিয়েও না। এবারের ভয় তার নিজেরে নিয়ে নিজের। এরপর হায়দার অফিসে তাকে দেখলেই যে হা হা হাসিটা দেবে সেই ভয়।

তবে এখন সে তার হাতের মিষ্টির প্যাকেট আর ফুল নিয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

জুলাই ২০১৬, পল্টন

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত