প্রেম ঘটিত রাজনীতি

আমার পিতৃকুল, মাতৃকুলে কেউ রাজনীতি করেনি। পেশাগত জীবনে বাবা শিক্ষক। তার বাবা চাষাবাদ করতেন। কাকা মামারাও মিলিয়ে মিশিয়ে চাকুরী আর গৃহস্থ করে। তবু্ও রাজনীতিতে আগ্রহ আমার ঘাড়ে চাপলো। অনেকটা নেশার মতো। হৈচৈ, হাঙ্গামা, যে বিষয়টা তীব্র জটিলতা মনে হয়, তারপর মনে হয় ফোঁপরা, মুখোশ পরা মানুষের খুব কাছে গিয়ে তার নাড়ি নক্ষত্র আলটে পালটে দেখার সুযোগ রাজনীতি ছাড়া আর কই। এই নেশা একদিনে আমাকে পায়নি। দীর্ঘদিন, বলা যায় দিনের পর দিন খুব কাছে থেকে দেখতে দেখতে এর থেকে আর নিজেকে আলাদা করতে পারি না। আসলে আলাদা করতে চাই না। সেই গণিত প্রিয় মেয়েটি এখন প্রবল রাজনীতি আসক্ত! এতো কিছুর মূলে কারণ একটাই – যাকে ভালোবাসি সে একজন রাজনীতিবিদ। এবং রাজনীতি অঙ্গনে এখন সফল বলা যায়। যদিও জেনেছি রাজনীতিতে সফলতা মরিচীকা সম।

আমার গল্পটা নিছক আমারই কথা। কোনো রাজনীতির গল্প না। একটা দিশেহারা মনের কিছু কথা। এই প্রেমে কেবল মুখের দিকে তাকিয়ে ছাড়া কোনো কার্যক্রম নেই। কাছে আসা নেই।হঠাৎ কোনো স্পর্শ নেই। বাতাসে ওড়নার আঁচল ছুঁয়ে যাওয়া নেই। এমনকি চার চোখের মিলনও খুব নেই। সে কথা বলে অন্যদিকে তাকিয়ে। কখনো হাতের দিকে, কখনো টেবিলের দিকে। দুই একবার বুকের দিকে ভুলেও চোখ যায় না যে পুরুষ মানুষের। তার প্রতি প্রেম হলে দিশাহারা হওয়া ছাড়া আর কী করার থাকে। হাতের কাজ রেখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। কখনও নাক, কখনো ঠোঁট, কখনও চোয়াল, চোখের পাতা পড়ার কাজটা প্রথম দিন থেকে করে আসছি। কিন্তু কিছুতেই তা পুরাতন হয়না।

বুকের ভিতরে খুব ব্যথা হয় যখন অনেক ভালো লাগা জমে যায়। যারা প্রেম করেন তারা সহজে অনুমান করতে পারবেন ব্যাপারটা। এই ব্যথা নিয়ে আমি চলি, ফিরি, কাজ করি, পড়ি, খাই, ঘুমাই বেঁচে থাকি। মরে যেতেও ইচ্ছে হয়েছে কতবার!

একতরফা ভালোবাসাকে কী প্রেম বলা যায়? আমি তার পিএ। পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট। তার পদ এখন আমাদের মহরমপুরের সাংসদ।

তখন সে শুধু এলাকার বড় ভাই এবং চেয়ারম্যানের ডান হাত ছিল সেই সময় আমাকে চাকরিতে বহাল করে। আমার মায়ের খালাতো বোনের ভাসুরের ছেলে সে। গ্রামে গঞ্জে এই আত্মীয়তার গুরুত্ব এখনো আছে।

তখন আব্বা প্যারালাইজড, আমাদের সংসার চলে না। চার ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার বড়। ওই অবস্থার মধ্যে চাকরি দিয়ে সে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়েছিল আমাদের পরিবারে, আত্মীয়দের কাছে এবং আমার কাছে তো অবশ্যই।

চেয়ারম্যানের অফিসে একটা কক্ষ ছিল, বৈঠক কক্ষ বা সেমিনার রুম, সেই কক্ষেই আমাকে একটা টেবিল চেয়ার দিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়। মায়ের কাকুতি মিনতি আর ভালো রেজাল্টই চাকরি দেবার কারণ ছিল তা ভাবতে ভালো লাগে না।

মাস গেলে সাত হাজার টাকা দেয়া হত আমাকে। পুরো টাকাটা মা’র হাতে তুলে দিয়েছি। কারণ প্রতিদিন বা এক দুইদিন পর পর উনি টিফিন খাবার জন্য কিছু টাকা দিত। নিজের পকেট থেকে। ওতেই আমার হাত খরচ চলে গেছে। টাকাটা সে দিত এমন সময় যখন সে ঘর থেকে চলে যায় এবং অন্য কেউ তখন অফিস ঘরে উপস্থিত না থাকে। বুঝতে পারি আমার অস্বস্তি ভরা মুখ দেখতে বা দেখাতে চায় না কাউকে। বর্তমান ভাতা অবশ্য তিনগুণের বেশি। সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস। সপ্তাহে ছয়দিন হাজির থাকতে হবে, অফিসের এবং চেয়ারম্যানের যাবতীয় তথ্যাদি নিখুঁত ভাবে গোপন রাখতে হবে অন্যথায় চাকরি থেকে বরখাস্ত এবং জেল জরিমানা অনিবার্য – এই মর্মে চাকরিতে নিয়োগ পেলাম।

তখন বি এস সি পরীক্ষা দিয়েছি সবে। এলাকায় সবাই জানে শান্তশিষ্ট, সাতচড়ে রা নেই টাইপ মেধাবী মেয়ে আমি। অনেক মায়ের চোখে উদাহরণ। কিন্তু আমার মায়ের চোখের বিষ। কারণ পড়া লেখা করতে চাই। বিয়ের প্রস্তাব এলে সদম্ভে না করে দেই। প্যারালাইজড শিক্ষক বাবার ঘাড়ে তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে আমি বড়। ভাইটা সবার ছোটো। আমার বিয়ে না হলে মেজো, ছোটো’র বিয়ে হচ্ছে না। তাই মায়ের ক্ষোভ। কী হবে পড়ে। বিয়ে না করে কতকাল বাপেরবাড়ি খুঁটি হয়ে থাকব। সেই মানুষ আমি বই থেকে মুখ উঠিয়ে যে মুখ দেখলাম সে মুখ যেমনই হোক প্রেমে পড়বই এটাই অবধারিত ছিল।

পাঁচ বছর আগের এবং পরের দৃশ্য অনেক বদলে গেছে। বহু ঝড়ঝাপটা গেছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা গেছে চেয়ারম্যান। সেইবার ইলেকশনে দাঁড়ায় সে এবং চেয়ারম্যানের ছেলে। স্বাভাবিক ভাবে সেই চরিত্রহীন ছেলে হেরে গেছে। উপজেলা চেয়ারম্যান হবার পর দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ একটা আমূল পরিবর্তনের জোয়ার এলো। রাতারাতি সাংবিধানিক পরিবর্তনের কারণে সংসদ নির্বাচন হয়। বিপুল ভোটে সে সাংসদ নির্বাচিত হয়। এই সময় তার সাথে সাথে মাঠে নামার খুব ইচ্ছে থাকা সত্যেও সম্ভব হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণায় সারাক্ষণ চোখের আড়ালে থাকতো। শুধু তাকে দেখতে পাবো বলেই মাঠে হাটে ঘুরতে চেয়েছি। তা হয়নি তখন আমার এমএসসির প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। সব ঠিকঠাক ভাবে অতিক্রম করতে দেখলাম পাহাড়ের মতো অটল একজন মানুষকে। সাথে সাথে আমার এমএসসিও শেষ হলো ভালো ভাবেই। পড়াশোনার সব রকম সুবিধার জন্য তার দৃষ্টি ছিল। ফার্স্টক্লাস হলনা। আশাও করিনি। পড়ালেখা আর আমাকে টানে না।

সেকেন্ড ক্লাস পাবার পর সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করল নিজে। নিরিবিলি পেয়ে আমাকে বলল, ইন্টারমিডিয়েট এর পর আমার আর পড়া হয় নাই কিন্তু যারা পড়াশোনা করে তাদের আমি মন থেকে শ্রদ্ধা করি।
খুব লজ্জা লাগলো বয়সে যোগ্যতায় আমার থেকে কত উপরে সে। খালি সার্টিফিকেট দিয়ে কী মানুষের যোগ্যতা যাচাই হয়!

একদিন আমাকে বলল, রিতা তোমার জন্য নতুন অফিস কক্ষ ঠিক করছি। তুমি সে-ই কক্ষে বসবে।

মাথা নিচু করে, পরিষ্কার বললাম, আপনি যে কক্ষে বসেন সেই কক্ষতেই বসব।

সে আমার দিকে না তাকিয়ে ঘন ঘন সিগারেট টানতে লাগলো।

তারপর গলা নামিয়ে বললো, আমার কয়েকদিনের জন্য আত্মগোপন করতে হবে। তারপর ঠিক করা যাবে।

তার আত্মগোপনের প্রয়োজনীয়তা জানলাম। চেয়ারম্যানের ছেলে তাকে খুন করার জন্য ভাড়াটে খুনি লাগিয়েছে। চেয়ারম্যান এর ছেলের সাথে নাকি মন্ত্রী পর্যায়ের চুড়ান্ত খাতির।

কোথায় আত্মগোপন করেছিল প্রথম কয়েকদিন জানি না। অফিসে নিয়মিত গেছি। তাকে দেখতে পাই না। অফিস হয়ে উঠল অসহ্য। ভয় ভয় করত তাকে ছাড়া অফিসে।

এক গভীর রাতে আমাদের বাড়ি এসে হাজির হল। দুই দিন দুইরাত আমাদের বাড়িতে আত্মগোপন করতে চায় জানালো। মা-বাবার পক্ষ থেকে কোনো বাঁধা এলো না। কিন্তু আমার নাওয়া খাওয়া ঘুম উবে গেলো।

আটচল্লিশ ঘন্টা তাকে আমার ঘরে থাকতে দিয়েছি। আমি থেকছি ছোটো বোনের ঘরে। মেজো বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটো বোনের বিয়েও ঠিক। কেবল আমাকে বিয়েতে রাজি করাতে পারছে না মা। সেই আশাও বাদ দিয়েছে। এখন আর রাগ করে না মা। ছোটো ভাই মালয়েশিয়া গেছে। অসুস্থ বাবা মাকে দেখার জন্য হলেও আমাকে তাদের লাগবে।

পরের দিন ঠিকঠাক অফিসে গিয়েছি। যাতে কেউ সন্দেহ না করে। সে-ই রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ঘরের পিছনের বারান্দার কোণায় বসে সিগারেট ধরালো সে। আমি জানি এই সুযোগে কথাটা না বলতে পারলে আর কখনো বলা হবেনা। সে আমাকে দেখল কয়েক মুহূর্ত তারপর বলল, কিছু বলবা রিতা?

আমি আস্তে আস্তে বললাম, হ্যা বলব।

সে বললো, আমারো কিছু কথা বলার ছিল। আগে তুমি বলো কী বলতে চাও?

আমি মৃদুস্বরে বললাম, না আগে আপনি বলুন।

সে কোনো প্রকার ভূমিকা ছাড়াই বলল, তুমি আমাকে খুব পছন্দ করো আমি বুঝি। তুমি ভাবো তোমাকে আমি খেয়াল করিনা, তোমার মন খারাপ হয়। অথচ তুমি কখনও জানো না, সব সময় আমার লোকেরা তোমার সব দিকে খেয়াল রাখছে, আমার হুকুমে। এখনো রাখে। এই যে এতো ঝুট-ঝামেলা তুমি কখনও কোনো বিপদের মুখে পড়ছ?

মাথা নেড়ে বললাম, না।

কোনো একটা নেগেটিভ কথা উঠছে তোমাকে নিয়ে?

আবারও বললাম, না।

এবার বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকলাম সত্যিই তো এতো হাঙ্গামার মধ্যেও কখনও কোনো ঝড়ঝাপটা পোহাতে হয়নি আমাকে! তার কারণ শুধু সে! বুকের ভিতর আনন্দের কালো রোল ওঠে।

সে একটু থামে। আমিও চুপ করে আছি। তার ভাষ্য এখনো পরিষ্কার না। বলতে শুরু করে, তোমার মতো বুদ্ধিমতি আর ভালো একটা মেয়েকে যে পাবে তার জীবন বর্তে যাবে। কিন্তু তুমি যা চাচ্ছ তা আমার পক্ষে সম্ভব না রিতা।

শুধু বুদ্ধিমতি আর ভালো! নিজের ভেতর কুঁকড়ে যাই। আমি সুন্দর নই! তাই কী তার অনাগ্রহ? এটা জানাও জরুরি।

বললাম, কেন সম্ভব না? আমি সুন্দর না তাই?

একটু অসহিষ্ণু হয়ে বলল, কী বল? আয়নায় দেখো না নিজেকে?

মনেমনে বলি, খুব দেখি। আপনিইতো দেখেন না কখনো।

সে আবার বলতে লাগলো, রাজনীতি সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তায় ভরা একটা জীবন। তাছাড়া আমার একটা অতীত আছে, নিশ্চয়ই জানা আছে তোমার।

আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে প্রায় ঘেঁষেই বসলাম। গাঢ় স্বরে বললাম, আমি সবই জানি, যেমন আপনি আমার সব জানেন।

এই প্রথম আবছা অন্ধকারে সে আমার দিকে তাকালো। একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালালো। আগুনটা নিভিয়ে দিল না। দুই জোড়া চোখ সেই আলোতে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপর সিগারেট না ধরিয়ে নিভে যাওয়া কাঠি ফেলে দিয়ে আমার হাত ধরলো। উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলাম কিনা জানিনা তবে বহুদিনের ব্যাথা গলে চোখ বেয়ে নেমে এলো। অন্ধকার বলে রক্ষা সে দেখতে পাচ্ছে না।

হাতে হাল্কা চাপ দিয়ে বলল, কাঁদছ কেন? আমি আছি তো।

এই কথার পর কী হল জানিনা। সমস্ত দিক ভেঙে কান্না এলো।

আমার হাতটা নিজের দুইহাতের ভেতর নিয়ে বলল, কিন্তু রিতা আমি বীথিকে কখনও ভুলতে পারিনি। ভুলতে পারব বলে মনে হয় না। আমি তাকে এখনো ভালোবাসি।

এবার আমিও তার দুইহাতে তার হাত চেপে ধরলাম। বহুদিনের আক্ষেপ, জেদ, প্রেম সব মিলে প্রবল বেগ পেলো কান্নায়। আমি তাকে চাই। এই হাত কখনও ছাড়ব না। বিনিময়ে সব ভাবে প্রস্তুত আমার দেহ মন। এই হাত ছাড়ার অর্থ আমার হার। বীথির জয়। যে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন আগে। বীথি তার প্রেমিকা ছিলো অনেক দিন। বিয়ে করা বউ ছিলো তিন মাস। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। এবং বীথির অভাব ভুলতেই জনমানুষের সাথে তার মিশে যাবার ইচ্ছা। এই সব কিছুকে শ্রদ্ধা করি আমি।

কান্নার দমক সামলে বললাম, তাকে ভুলবেন কেন! তাকে ভুলতে হবে না। শুধু আমাকে….

এটুকু বলে আর কথা এলো না। নিজেকে এতো ছোটো করার প্রয়াস নিজেই কেন করছি সেই অভিমান হয়তো প্রেমের চেয়ে প্রবল হয়ে ওঠে।

সে বাঁচিয়ে দেয় এই যাত্রা। আমার কাঁধে হাত রেখে নিজের কাঁধের সাথে মিশিয়ে বলে, তুমি কত ভালো রেজাল্ট করছ, ভালো চাকরি করবা, উন্নতি করবা। অনেক আগে থেকে চাইছি তুমি এখান থেকে সরে যাও। কতো চাকরি আছে, বিসিএস দিবা, হয়তো বিদেশে যাবা। কোথায় চলে যাবা তুমি।

এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে একটা দিয়াশলাই কাঠি ধরালাম। তারপর মুখের খুব কাছে চোখে চোখ রেখে বললাম, কিছুই করব না, কোথাও যাবোনা, আপনার সাথে থাকব, রাজনীতি করব।

নাটকীয়তা চেয়েছিলাম কিনা জানিনা। হয়তো চেয়েছি। অথবা আমার চোখে বিশেষ কিছু ছিল। হয়তো আমার প্রেম এতোদিনে এসে জয়ের মুখ দেখবে বলে নাটকীয়তা সে পূর্ণ করল জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আসলেই পাগল আছো মেয়ে।

তার বুকে মিশে যেতে যেতে ভাবছি আসলেই আমার পাগলামি সত্য হলো তবে! ঝিম মেরে থেকে একা একা চলার ভীষণ কঠিন দিন শেষ হলো?

মুহুর্তে রাজনীতি, প্রেম নীতি, জীবন নীতি মিলেমিশে একাকার হলো।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত