ঈদগ্রস্ত

|ঈদগ্রস্থ|

ইচ্ছে করলে বৃষ্টিটা এড়িয়ে যাওয়া যেত, তার ইচ্ছে করেনি। দ্রুত বাড়ি ফেরার তাড়া, মাথার ভেতর কারা যেনো প্রবল আক্রোশে করাত চালাচ্ছে, ব্যথায় কুকড়ে উঠছে সে। ঘরে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই শান্তি, কিন্তু ঘর যে বহুদূর। কত মানুষ আস্ত জীবন কাটিয়ে দেয় বাড়িতে, বাড়ি হতে ঘরের দূরত্বটুকু আর পেরোনো হয় না। চারকোনা বাক্সের দেয়ালে দেয়ালে কত যে বাড়ির ঘর হতে না পারার বেদনার গভীরতম দীর্ঘশ্বাস জমে প্রতিদিন।

বৈশাখ মাস প্রায় শেষ। তপ্ত রোদের দুপুর শেষে হঠাৎ থেমে থেমে বৃষ্টি শুরু। হাওয়ার ঝাপটায় কান্নার সুর, দূরে কোথাও ঝড় হচ্ছে।  বৃষ্টির বেগ বাড়ে, মাথার ভেতর যন্ত্রণা বাড়ে, সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। যানজট কেটে কেটে থেমে থেমে ধীরে এগোতে থাকে রিকশা, মাথার ভেতর তীক্ষ্ম যন্ত্রণায় বদলে যায় দৃশ্যপট। সাড়ে তিন দশক আগের রমজান মাসের দুপুর, ছাদের কোনে বসে বই পড়ছে এক কিশোর। আড় চোখে দেখেছে রোজার দুপুরের ক্ষণিক অবসরে মা সেমাই বানাচ্ছে। ময়দার গোলা হতে এক চিমটি করে নিয়ে দুই আঙুলে তুড়ি বাজানোর মত করলেই তৈরী হয়ে যাচ্ছে সেমাই, প্রতিটা দানা সমান, বাসমতি চালের দানার চাইতে কিছুটা বড়। রোদে ভালো করে শুকোলেই খাবার উপযোগী হবে। হঠাৎ করে সেমায়ের একটা দানা প্রশ্ন করে,
– মানুষ, তোমার কি খুব বেশী যন্ত্রণা হচ্ছে?
– হু
– এমন যে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছো, যন্ত্রণা তো আরও বাড়বে।
– বাড়ুক, বাড়তে দাও।

সেমাই দানা বিরক্ত হয়,
– ধ্যাত্তরি, তুমি একটা যা তা।

কথা বলতে ভালো লাগছে না। কোনো উত্তর না পেয়ে হতাশ হয় সেমাইদানা। একটু বিরতি নিয়ে মায়াময় স্বরে বলে,
– তোমার প্রচণ্ড যন্ত্রণা দেখে ছেলেবেলা থেকে উঠে এলাম। আমার নাম মনে আছে!
– শব্দশূন্য তুড়ি বাজানোর ঢংয়ে বানাতে হয় বলেই হয়তো তোমার নাম চুটকি সেমাই। ঈদের দিন মুরুব্বীদের কাছে ঘন দুধে ভিজানো তোমার যে খুব কদর ছিলো।

প্রশংসা শুনে বিব্রত হয় চুটকি, কষ্টও পায়,
– আমার সে দিন আর নেই, মানুষ। কে আর আমাকে মনে রেখেছে বলো!

কে কাকে মনে রেখেছে বা ভুলে গেছে- এ হিসাব কোনোদিন মিলে না। প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলি,
– তুমি কি খেয়াল করেছো, চুটকি, সেমাই বানাতে বানাতে মাঝে মাঝে মা’র চোখ পানিতে ভরে উঠতো!
– হ্যা। খুব খেয়াল করেছি, কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি।
– বড় ভাইয়া মারা গেলেন মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে, আজ প্রায় ৪২বছর হলো। মা আজও ভুলে যান সে কথা। যখন বিভ্রম কাটে, মনে পড়ে ভাইয়া আর আসবে না, মা’র চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, তিনি আঁচলে চোখ মুছেন।
– মানুষ, তোমরা এমন কেনো! আনন্দ আর কষ্টে তোমাদের এত মাখামাখি!
– এসবের কারণ জানিনা, জানতে ইচ্ছেও করে না। শুধু জানি, আমাদের ঈদের প্রবল আনন্দ জুড়ে মিশে থাকে গাঢ় বিষাদ।

চুটকি ভেবে পায় না কি বলবে, কিশোরের মনে ভেসে ওঠে বাবার মুখ।

রোজার দিনগুলোতে বাবা অন্যরকম হয়ে যেতেন, খুব বেশী চুপচাপ। তবু রোজার প্রথম সপ্তাহেই শুরু হত কেনাকাটা। কাজের চাপে দশ রোজার পর থেকে দর্জি দোকানে অর্ডার নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। রেডিমেড পোশাকের বাজার তখনও এত রমরমা হয়নি, অভিজাত হয়ে ওঠেনি। আশপাশের তিন চার পাড়ায় মহিউদ্দীন খলিফা’র খুব নামডাক। রোজার শুরুতে তার দোকানে টিনের ছোট্ট সাইনবোর্ড ঝুলতো, কালো রঙের উপর সাদা অক্ষরে লেখা- “অর্ডার নেওয়া বন্ধ”। বাবা বললে চাঁদরাতেও অর্ডার নিতে দ্বিধা করবেন না। তবু দশ রোজার আগেই পৌছে দেওয়া হতো শার্ট আর প্যান্ট পিস। এরপর যে কোনো ছুতোয় মহিউদ্দীন কাকার দর্জি দোকানের সামনে দিয়ে দিনে কয়েকবার ঘুরে আসার বিনে বেতনের চাকরি, হ্যাঙারে ঝোলানো প্যান্ট আর শার্টের ভিড়ে কৌতূহলী চোখে অনুসন্ধান করা নিজের পোশাক।

পনেরো রোজার পর দিন খুব দ্রুত যেত, শুরু হত ঈদের দিন গুণা। কোনো এক দুপুরে বাবা ব্যাগে করে বেশ কিছু শাড়ি এনে মা’র হাতে দিতেন। মা দেখে দেখে বাছাই করতেন কাকে কোনটা মানাবে, কে কোনটা পেলে খুশী হবে। আত্মীয় স্বজন আর নিকট প্রতিবেশীদের ঘরে উপহার হিসেবে পৌছে যেত সেসব শাড়ি। যে সকল আত্মীয় আর নিকট প্রতিবেশীরা খারাপ অবস্থায় আছে, যাদের কাছে ঈদ উদযাপন কিছুটা চাপ হয়ে আসে- তাদের ঘরে পৌছানো শাড়ির সাথে থাকতো ঈদের বাজার আর নগদ অর্থ। প্রতিবেশী এক মাসিমা দুর্গা পূজায় কিশোরকে নতুন কাপড় উপহার দিতেন, তাই তার জন্যও বরাদ্দ ছিলো ঈদ উপহার।

সাতাশ রোজা থেকেই শুরু হত পুরান ঢাকার ঈদ। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন  নাজেল শুরু হয়েছিলো রমজান মাসে, সাতাশ রমজানকে ধরা হয় কোরান নাজেলের সেই মহিমান্বিত রাত, লায়লাতুল কদর। ছাব্বিশ রোজার সন্ধ্যা হতেই সাতাশ রোজার শুরু। তাই ইফতার শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে সময়ের আগেই দ্রুত মসজিদে পানে ছোটা। মসজিদ ঘিরে উৎসব উৎসব আমেজ। তারাবী শেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সকল ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে আর সকল মানুষের মঙ্গল কামনায় ইমাম সাহেবের কান্নায় জরো জরো দীর্ঘ মোনাজাত, ‘আমিন’ ‘আমিন’ শব্দে মুখরিত মুসল্লিরা সংক্রমিত কান্নায়। এ কান্না পরম করুণাময়ের কাছে নিজেকে নিবেদনের, এ কান্না বরকতময় রমজানের সাথে পরবর্তী এক বছর বিচ্ছেদের আকুলতার।

কদরের রাতে পুরান ঢাকা ঘুমহীন, ইবাদতে মশগুল সব। তবু সেহেরির সময়ে ধীর পায়ে গান গাইতে গাইতে আসতো কাসিদার দল, পৃথিবীর সব আবেগ তাদের কণ্ঠে, “এয় তিশ দিনকে মেহমা/এয় মাহে রমজা আল বিদা/তুঝে সে থি সারি খুবইয়া/এয় মাহে রমজা আল বিদা…” কখনো বা “হে নামাজি আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ/দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ..”। এই বিশেষ রাতে কাসিদা দলের গানের সুর শুনলেই প্রতিটা বাড়ি থেকে একজন রাস্তায় এসে দাঁড়াত, কাসিদা পার্টি সামনে দিয়ে যাবার সময় দলের সদস্যদের হাতে নগদ টাকা গুঁজে দিত। এটা পারিশ্রমিক নয়, ঈদের তোফা।

ফের ঘোর কেটে যায়, বদলে যায় দৃশ্যপট। মাথার যন্ত্রণার আধিপত্যে শবে কদরের রাত ঝাপসা হয়ে আসে। শরীর কাঁপছে, বোঝা যায় জ্বর আসছে, খুব শীত লাগছে। মাথার ভেতর করাত চলায় বিরাম নেই, কারা তুমুল উল্লাসে হৈ-হুল্লোড় করে কাটছে সকল শিরা-উপশিরা! আত্মা মনকে বলছে, “ঘরে ফেরা না পর্যন্ত এই প্রকট যন্ত্রণা, এই জ্বর, এই শীত ভুলে থাকো… ভুলে থাকো… ভুলে থাকো..।” ভুলিয়ে রাখার জন্যই গায়ের সাথে লেপ্টে যাওয়া ভিজে শার্টটা প্রশ্ন করে,
– মানুষ, তোমার কি মনে আছে মশলার বাজার?
– মনে আছে.. খুব মনে আছে। মা ঈদবাজারের লিস্ট করে দিয়েছেন, বাবার সাথে কিশোরও বাজারে যায়। দু’চোখ ভরে দেখে থরে থরে সাজানো দারুচিনি, এলাচি, লবঙ্গ, গোল মরিচ, তেজ পাতা, শাহি জিরা, কাবাবচিনি, কাঠ বাদাম, পেস্তা বাদাম, জয়ত্রি, জায়ফল, আলু বোখরা, পোস্তদানা, জাফরান আরও কত যে মশলাপাতি।

ফোড়ন কেটে ওঠে বৃষ্টিবিন্দু,
– মশলার নাম শুনেই মন ভরে যায়। মানুষ, আমাকে মনে আছে! আমি তোমার ছেলেবেলার মেঘ, মেঘ হতে ঝরে যাওয়া বৃষ্টি। তোমার সাথে লেপ্টে আছি, তাই বাষ্প হয়ে মিলালেও ফের বৃষ্টি হয়ে ফিরে ফিরে আসি।
-ওহ! তাই না কি!
– হ্যা, তাই। এই দেখো আমার মনে আছে– ঈদের দু’তিন আগে মা তোমাকে কাঞ্চনপুরী নারকোল কিনতে পাঠাতেন, তোমার সে কি উত্তেজনা!
– শুধু কি নারকোল! অনেকটা পথ হেটে গিয়ে ঈদের আগে ক্যাপিটাল কনফেকশনারীর লাচ্ছা সেমাই আনতো কে! বাজারের পাইকারি দোকান থেকে ১নাম্বার ভাজা জর্দা সেমাই কিনতো কে! এরপর ছিলো মেহেদী পাতা কেনা। তিরু ঘোষ কাকার দোকান থেকে টকদই,  হালিমের জন্য খাসির মাথা, মাংস আর হরেক রকম ডাল আনতো কে!
– তোমার দেখি সব মনে আছে! আহা, সেই সব ঈদ! ২৯রোজার দিন ইফতারের সময় থেকে তোমাদের সে কি উন্মাদনা, আকাশে খুঁজে বেড়াচ্ছো ঈদের এক ফালি চাঁদ। কে আগে দেখবে এ নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা।
– হ্যা। আকাশ থেকে চোখ সরানো দায়, ঈদের প্রথম চাঁদ দেখে চাঁদকে সালাম করার ছেলেমানুষির সেইসব দিন…।

বৃষ্টিবিন্দুর কণ্ঠে স্মৃতিকাতর উচ্ছাস,
– চাঁদ উঠার সাথে সাথেই ঈদের শুরু।
– হ্যা। মা এক ফাঁকে মেহেদি বেটে দিতেন। ঈদ অথচ হাতে মেহেদি রং থাকবে না- এ অসম্ভব। ভাই-বোনরা মিলে মেহেদি দেওয়া হত। মেয়েরা হাতে নকশা করে মেহেদি দিতো, ছেলেরা ডান হাতের তালুতে গোল চাঁদ এঁকে আর কনে আঙুলের উপরের কড় রাঙাতো মেহেদিতে।
– হাহাহা, এই মেহেদি নিয়েও প্রতিযোগিতা- কার হাত বেশী লাল হয়।

লেপ্টে থাকা শার্টের কণ্ঠে বিস্ময়,
– এসব যেন বহু আগের রূপকথা!

বৃষ্টিবিন্দু বিরক্ত,
– রূপকথা হবে কেনো! এ যে আমাদের ছেলেবেলার ঈদ গো। চাঁদ উঠলেই পরপর তিনবার বেজে উঠতো সাইরেন। টিভি আর রেডিওতে বাজতো “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ..।”

প্রবল যন্ত্রণা ভুলে থাকতে বলি,
– সাথে সাথে শুরু হত মা’র ব্যস্ততা। সবার আগে দুধে ভেজাতেন খুরমা, সকালে খুরমা খেয়ে বাড়ির ছেলেরা ঈদের নামাজ আদায় করতে যাবে। এরপর সারা রাত ধরে রান্নার ব্যস্ততা। রাত ১২টায় রান্না হত জর্দা সেমাই।

ভেজা শার্টের কণ্ঠে কৌতূহল,
– তারপর!
– ওই রাতেই সেমাই পৌছে দিতে হত আশপাশের আত্মীয় স্বজন আর প্রতিবেশীদের। এরপর রান্নার সব আয়োজন করতে করতে ভোর হয়ে আসতো। ভোরে মা রান্না করতেন পানি খিচুরি,  মিষ্টি কুমড়ো দিয়ে গরুর মাংসের ঝাল ঝাল ঝোলওয়ালা তরকারি। ত্রিশ দিন রোজা রাখার পর মুরুব্বীরা ঈদের দিন এ খাবারটা খুব মজা করে খেতেন। ঈদের জামাতের জন্য রওয়ানা করার আগেই রান্নাঘর থেকে ভেসে আসতো সাদা পোলাও আর মুরগির রেজালার ঘ্রাণ।
– এত্ত খাবার!
– এত্ত খাবার কোথায়! আত্মীয় প্রতিবেশীরা ঈদের দিন আসবে, কাউকে খালি মুখে যেতে দেওয়া হবে না-  হয় চুটকি, জর্দা বা লাচ্ছা সেমাই খেতে হবে, নয়তো ফিরনি খেতে হবে। মিষ্টিতে রুচি না এলে অল্প করে হলেও খিচুরি বা পোলাও খেতে হবে। ঈদের দিন এসব খেয়ে খেয়ে যারা ক্লান্ত, তাদেরও ছাড় নেই। বড় আপা বানাতেন চটপটি, হালিম আর বোরহানি। প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই সাধ্য আর সামর্থ্য মত বিভিন্ন পদ রান্না হত, ঈদের দিন কাউকে খালি মুখে বিদায় দিতে নেই যে।
– কিন্তু যারা বাড়িতে আসতে পারতো না!
– তাদের ঘরে বাটিতে বাটিতে করে পৌছে যেত পছন্দের খাবার, তাদের বাড়ি থেকেও আসতো এমন উপহার। তখন সবাই মোটামুটি জানতো প্রতিবেশী ও নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কে খাবারের কোন পদটা বেশী পছন্দ করে, কার রান্নাঘরে উল্লাস আর কার রান্নাঘরে নিরব হাহাকার।

বৃষ্টিবিন্দু বলে,
– জানো ভেজাশার্ট, পুরান ঢাকার ঈদ ছিলো অন্যরকম। ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশীরাও যোগ দিত উৎসবে। তারাও আমন্ত্রিত হত, তাদের জন্য রান্না হত মুরগি বা খাশির মাংস আর সাদা পোলাও। তাদের বাড়িতে পৌছে যেত সেমাই।

বৃষ্টিবিন্দুর কথা শেষ হতেই জ্বর বা শীতে কাঁপতে কাঁপতে দেখতে পাই, সাড়ে তিন দশক আগের ঈদের সকালে জর্দা সেমাই ও ফিরনি নিয়ে এক কিশোর দাঁড়িয়ে আছে সুবীরদের দরজায়। মাসিমা দরজা খুলেই বললেন, “আইজ সেমাই দিয়া নাস্তা করুম বইল্যা বইসা আছি, বাবা। তুমি ভিত্রে আইস্যা বসো। চা খাইব্যা! একটু বানাইয়া দেই?”

কিশোরের চা খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাড়ির ভেতর যায়না, সে জানে সুবীরদের খুব খারাপ সময় চলছে, চা খাওয়ার বিলাসিতা এখন তাদের নেই। টিফিন ক্যারিয়ার খালি করে দিলে কিশোর বলে, “মাসিমা, দুপুর আর রাতের খাবার রান্না করতে মা না করেছে। একটু পর ঈদের খাবার নিয়ে আসবো। আর, আগামীকাল, আপনাদের সবাইকে মা দাওয়াত দিয়েছেন, মা’ই আসতেন, কিন্তু ঘরে যে কাজের চাপ।” মাসিমা মুখে স্বস্তির হাসি এনে তাকান, চোখে বিষন্নতা মিশে থাকে। মেসো “সালাম করলা না, বাবা!” বলে খুব সঙ্কোচে পকেটে সামান্য খুচরো টাকা গুঁজে দেন- ঈদ সালামি।

অসহ্য ঘোর হতে মানুষ যতই মুক্তি চায়, তাকে ততই ঘিরে ধরে স্মৃতি। ঈদের সারাটা দিন মা চোখের পানি সামলে রাখেন, কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মুখে একটা নির্জীব হাসি ধরে রাখেন। ঈদের ক্লান্তিময় বিকেল শেষে সময় যত রাতের দিকে ধায়, মা’র ক্লান্ত মুখে প্রসন্নতার আভা গাঢ় হতে থাকে। তিনি খুব যত্মে খাবার গরম করেন, সুন্দর করে সাজান, ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করেন একসাথে খাবেন বলে। পৃথিবীর সব বিভ্রান্তি কাটে না, কিন্তু বিভ্রম কেটে যায়। মা’র বিভ্রম কাটে, উনার চেহারা বিষাদে ম্লান থেকে ম্লানতর হয়ে আসে। এই সত্যে তিনিও স্থির হন, সন্তান আর কোনোদিন ফিরবে না। যে একেবারে যায়, সে ফিরেনা কখনো।

বাইরে ঈদের খুশি, রাতের মৃদু কোলাহল, শুধু মা’র ঘর থেকে ভেসে আসে হুহু কান্নার একটানা মৃদু আওয়াজ। বারান্দার বাতি নিভিয়ে বাবা ইজিচেয়ারে বসেন, সিগারেট ধরান, কোনো কথা বলেন না। অবছায়াতেও চশমার কাঁচের ভেতর স্পষ্ট দেখা যায় বাবার চোখ- অশ্রুতে টলমল, চোখের সীমানা গড়িয়ে নামতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। বাবাদের যে কাঁদতে নেই।

সবার বয়স বাড়ে, শুধু একজন আটকে থাকে চৌদ্দ বছর আয়ুর সীমায়, তার ফেরা নেই, তার মুছে যাওয়া নেই, না থেকেও সে রয়ে গেছে প্রবলভাবে।

রিকশা ছুটছে, বৃষ্টি কমে এসেছে। থিরথির করে শরীর কাঁপছে, ভেজা কাপড়ের জন্য ঠাণ্ডা লাগছে, চোখ ঘোলা হয়ে আসছে। চারদিক ঘোর ঘোর,  হাওয়া এসে কানে কানে বলে,
– মানুষ,  মনসুখিয়ায় গেলে তোমারও বয়স বাড়বে না।
– আমি কবে মনসুখিয়ায় যাবো, বলতে পারো হাওয়া?

হাওয়া কিছুই বলেনা, যার বিদায় সন্নিকট, তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানানোর মত অনর্থক কাজ আর নেই।

#মনসুখিয়া

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত