নিহন্তা

নীলার মনটা আজ বেশি ভালো নেই!
মন খারাপ থাকার মত বিশেষ কিছু অবশ্য ঘটে নি,তাও মন ভালো নেই !
নীলা,তার চারিপাশের পরিবেশ- পরিস্হিতিতে অভ্যস্ত। শুধু মাঝে মাঝে সীমাহীন নীল আকাশটাকে ছুঁয়ে দিতে বড় ইচ্ছে করে ,তখন কাব্যকে বুকে চেপে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আজ নীলার একমাত্র সন্তান কাব্যর জন্মদিন!কাব্যের জন্মের সময়কার প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় এখনও নীলার স্পষ্ট মনে আছে! সারারাতের অসহ্য যন্ত্রনার পরে যখন তারস্বরে নিজের আগমনী বার্তা জানান দিয়ে কাব্য এ পৃথিবীতে এলো ,তখন মনে হল এর চেয়ে মধুর ধ্বনি আর প্রশান্তিময় মুহূর্ত আর কিছুই হতে পারে না। এরপর নীলা দেখলো ,ছোট্ট একটা সাদা মেঘের টুকরো যেন ওর বুকে তুলে দেওয়া হল।কি নরম তুলতুলে মায়াবী আদুরে আদুরে ছোট্ট একটা মানুষ।
যার প্রতিটি ধ্বনি যেন কবিতার মতই হৃদয়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়! কবিতা প্রেমী নীলা সাথে সাথে ছেলের নাম “কাব্য” রাখবে বলে ঠিক করে ফেললো ….

নীলার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত যেন হয়ে উঠলো কাব্যময়!নীলার স্বামী জাহেদের সন্তানের প্রতি ভালোবাসার কোন কমতি ছিল না ! কিন্তু সন্তান পালনের ক্ষেত্রে জাহেদ বরাবরই উদাসীন!তার ধারনা ছিল,এসব তো মেয়েদের কাজ ,পুরুষদের ওসব মানায় না !

নীলার কাব্যময় জীবন আর জাহেদের উদাসীনতায় দুজনের মাঝে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল এক অদৃশ্য দেয়াল।

দেয়ালের এপারে জমা হচ্ছিল কাব্যর একটু একটু করে বেড়ে উঠার ছোট ছোট গল্প আর নীলার অগনিত নির্ঘূম রাতের গভীর একাকিত্ব !
তবে দেয়ালের ওপারের জাহেদের গল্পগুলো অদেখাই রয়ে যেতো নীলার।

দুজনের মাঝের এই দেয়াল যে দুজনকে কতটা দূরে নিয়ে গিয়েছিল,তা বুঝতে পারার মত সময় ও সুযোগ কোনটাই নীলার ছিল না।
তাছাড়া জাহেদের প্রতি নীলার ভালোবাসা ও বিশ্বাস ছিল অপরিসীম!
তবে জাহেদের ক্রমাগত উদাসীনতা নীলাকে করে তুলছিল আরও বেশি নি:সঙ্গ ! সেই ছোট বেলায় বাবা-মা হারানো নীলা ক্রমশ যেন ডুবে যাচ্ছিলো বিষন্নতার অন্ধকার গহ্বরে!

নীলা নিজের প্রতিও হয়ে গিয়েছিল উদাসীন ….
একটা পর্যায়ে কাব্যর স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজগুলোতেও তার অহেতুক ভুল হতে লাগলো প্রতিনিয়ত।কোন কোন দিন নীলা দূর আকাশের দিকে তাঁকিয়ে উদাস হয়ে যেত! ভুলে যেত যে কাব্য নামে তার একটি সন্তান আছে,যে হয়তো পেটের ক্ষুধায় নীলার পাশে শুয়েই কাঁদছে ! কিন্তু কোন শব্দই যে নীলার কানে যেতো না!সে যেন হারিয়ে যেতো সম্পূর্ণ অন্য কোন জগতে!

এমন এক অস্থির সময়ই নীলা একদিন হঠাৎ করেই জানতে পারলো,জাহেদের জীবনে অন্য কোন নারীর উপস্থিতির খবর,জানতে পারলো এই নারীকে নিয়ে জাহেদ নাকি প্রায়ই প্রোমদ-ভ্রমনে যায়।
অথচ নীলা জানতো অফিসিয়াল ট্যুরেই জাহেদকে ঢাকার বাইরে থাকতে হয়!
নীলা তথ্যটি জানতে পারার সময়ও জাহেদ ঢাকার বাইরেই ছিল।
ঘটনার আকস্মিকতায় নীলার যেন সকল বোধ-বুদ্ধি লোপ পেতে থাকলো।প্রচন্ড রাগ,ক্ষোভ ,আক্রোশ ,ঘৃণার মাঝে যেন সে ডুবে যেতে লাগলো ক্রমশ!একবার চোখ তুলে ঘুমন্ত কাব্যর দিকে তাকালো ,অবিকল জাহেদের চেহারাটা যেন কাব্যর মুখে এঁকে দেওয়া হয়েছে! কাব্যর শোয়ার ভঙ্গিও ঠিক ওর বাবার মত। যেন ছোট্ট জাহেদই বিছানায় ঘুমিয়ে আছে!
নীলা আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না ….এক ঝটকায় দুই বছরের কাব্যকে কোলে তুলে নিল……….!!!!

যখন নীলার সংবিৎ ফিরে এলো ,নিজেকে আবিস্কার করলো একটি ছোট গাড়িতে!অনেকটা মাইক্রোবাসের মত ,তবে সিটগুলো বসিয়েছে একটু অন্যরকম ভাবে!তার সাথে আরও দুজন মহিলা আছে একই রঙের পোশাক পরা,একটু অদ্ভুত ডিজাইনের! পোশাক গুলো খুব চেনা চেনা লাগছে ,কিন্তু নীলা ধরতে পারছে না।
তার মাথা এখনও পরিস্কার ভাবে কাজ করছে না !!

নীলার দুচোখ কাব্যকে খুঁজছে ,কাব্যকে কোলে তুলে নিয়েছিলো এতটুকু মনে আছে ।কিন্তু ,তারপর কি হল?! এখন কাব্য কোথায় ,কার কাছে আছে!?জাহেদ ? জাহেদ কোথায় ? এতক্ষনে তো ওর অফিস থেকে বাসায় চলে আসার কথা ! না না জাহেদ তো ঢাকার বাহিরে গিয়েছিল,আরও দুদিন পরে আসার কথা। ইদানীং মানুষটাকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে ! প্রায়ই অফিসের কাজে এখানে-সেখানে ছুটা-ছুটি করতে হচ্ছে।নীলার ভীষণ মায়া লাগে !!

একটা ঝাঁকি দিয়ে গাড়িটি দাঁড়িয়ে গেল!নীলাও ভাবনার জগত থেকে ফিরে এল!
পাশের মোটা করে মহিলাটা সজোড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে নীলাকে বের হওয়ার ইশারা করলো ! নীলা সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিল! আর সাথে সাথে আবিস্কার করলো ,তার হাত দুটি বাঁধা ! নীলার কাছে সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মত হচ্ছে…না না স্বপ্ন না , দু:স্বপ্ন !
নীলা বিরক্ত হলেও কিছু বললো না …গাড়ী থেকে বের হতে হতেই নীলার চোখ আবার কাব্যকে খুঁজতে লাগলো!
কোথাও না পেয়ে পাশে থাকা মহিলাটার দিকে তাঁকালো ,যে তার সাথেই গাড়ীতে করে এখানে এসেছে।মহিলাটি নীলার হাতের কনুইয়ের কাছে ধরে সামনে নিয়ে যাচ্ছিলো ।তাকে ,অন্য মহিলাটির তুলনায় একটু নরম মনে হচ্ছে।

নীলা জিজ্ঞেস করলো,”আপনি জানেন আমার একটি ছেলে আছে ,কাব্য! ওকে আপনি কোথাও দেখেছেন?কোথায় আছে এখন? নিশ্চই বাচ্চাটা অনেক কান্না করছে !আমাকে ছাড়া এক মুহুর্তও থাকতে পারে না! “

মহিলাটি অবাক হয়ে নীলার দিকে তাঁকালো ,খুব বিরক্তির একটা আওয়াজ করলো ,কিন্তু মুখে কিছু বললো না !
নীলা হন্যে হয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগলো! তার চোখ শুধু কাব্যকে খুঁজছে! সেই সাথে পারিপার্শ্বিক অবস্থাও একটু একটু করে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে সে !

নীলাকে দুদিক থেকে ধরে রেখেছে একই রকম পোশাক পরা দুজন মহিলা! এতক্ষনে নীলা বুঝতে পারলে ,এটা তো পুলিশের ড্রেস! তাকে টেনে যে বিল্ডিংটির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,তার ফটকের উপরে “থানা” লিখা !!
এসব দেখতে দেখতেই কোথা থেকে যেন ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন হাতে কিছু তরুন-তরুনী ছুটে এল নীলার দিকে ! অসংখ্য অদ্ভুত কিছু বাক্য ,শব্দ তীরের মত এসে আঘাত করতে লাগলো নীলাকে –

-“বলুন,মা হয়ে আপনি কিভাবে এমন করতে পারলেন?”
-“সেই সময় আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?”
-“আপনি কি মানসিক ভাবে অসুস্থ?”
-“ঘটনার সময় আপনার স্বামী কোথায় ছিলেন?”
-“শুনেছি,আপনার স্বামীর পরকীয়ার জেরেই নাকি আপনি এই ঘটনা ঘটিয়েছেন?কথাটা কতটুকু সত্য?”
-“ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনার বক্তব্য কি?”

এত প্রশ্নের কোনটিই নীলা ঠিক মত বুঝতে পারছিলো না! নীলা ভেবেই পাচ্ছিলো না! এসব কি বলছে ,কেন বলছে ?নীলার মনে হল এসব প্রশ্ন তার জন্য হতেই পারে না!নিশ্চই অন্য কাউকে এসব জিজ্ঞেস করা হচ্ছে,তার এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই !
দুইপাশের মহিলা দুজন নীলাকে শক্ত করে ধরে সকল ভীড় সরিয়ে থানার ভিতরে টেনে এনে একটি ছোট্ট খাঁচার মত জায়গায় ঢুকিয়ে দরজায় তালা
লাগাতে লাগাতে মোটা মহিলা পুলিশটি বিড়বিড় করছিল,”মর!শালী ডাইনী!!”

খাঁচার ভেতরে ঢুকেই নীলার মুখে হাসি ফুটে উঠলো! ওইতো এক কোনায় কাব্য বসে আছে! নীলাকে ঢুকতে দেখেই ফিক করে হেসে দিয়েছে!
নীলা দুহাত বাড়াতেই কাব্য দৌড়ে এসে নীলার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো !
কাব্যকে কোলে নিয়ে নীলা এক কোনে ফেলে রাখা ময়লা কম্বলটির উপরে গিয়ে বসলো।কাব্যর টানাটানিতে নীলা বাধ্য হয়েই কাব্যকে স্তনপান করতে দিল! মুখে প্রশ্রয়ের হাসি! এত বড় হয়ে গিয়েছে বাচ্চাটা ,দুবছর হতে চলল ,তাও অভ্যাসটা কোন ভাবেই ছাড়ানো যাচ্ছে না ! নীলাও অবশ্য জোড় করে না,থাক না! অন্তত এই উছিলায় হলেও যে কটাদিন বাচ্চাটাকে বুকে চেঁপে রাখা যায়!স্তনপান করাতে করাতে নীলা গুনগুন করে কাব্যকে গান শুনাচ্ছে! এটা নীলার সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত।এই সময়ে কাব্য দুধ খেতে খেতে হাত দিয়ে বারবার মায়ের মুখ-ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়! নীলার এত ভালো লাগে !!

কারাগারের বাহিরে মহিলা কন্সটেবল অবাক হয়ে নীলাকে দেখছে!এত বড় একটা কান্ড ঘটিয়েও কিভাবে একজন মানুষ এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারে!
আবার খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে গুনগুন করে গানও গাচ্ছে!মনে হচ্ছে কাউকে কোলে বসিয়ে যেন গান শোনাচ্ছে! নিশ্চয়ই বদ্ধ উন্মাদ !

নীলার দিনকাল খুব বেশি খারাপ কাটে না। কাব্যকে নিয়ে বেশ ভালোই দিন কেটে যায় ! তাকে ছোট কারাগার থেকে সরিয়ে অন্য একটি বড় কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে। এই জায়গাটা অনেকটা হাসপাতালের মত।এখানে আরও অনেক মহিলা আছে।আসার সময় নীলা কাব্যকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলো না । কোথায় যে লুকিয়ে ছিল বাচ্চাটা?!
কোন ভাবেই নীলাকে প্রিজন ভ্যানে উঠানো যাচ্ছিলো না,পরে জোর করেই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে!

কি আশ্চর্য ,এখানে নীলা এসে দেখে কাব্য তো আগেই এসে হাজির !বিছানার উপরে বসে মার দিকে তাকিয়ে দুষ্টোমি ভরা হাসি দিচ্ছে !যেন মাকে বোকা বানিয়ে খুব মজা পাচ্ছে!

এখানে, মাঝে একদিন জাহেদ দেখা করতে এসেছিল নীলার সাথে! নীলার ব্যাপারে যে ক্ষোভ,ঘৃণা তার মনে জমা হয়েছিল,নীলাকে দেখে তা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল! সেই মুহূর্ত নীলা কাব্যকে কোলে নিয়ে স্তনপান করাচ্ছিলো আর গুনগুন করে গান গাচ্ছিলো! জাহেদকে সে চিনতেই পারেনি!!

জাহেদের দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছিলো! সে কাকে দোষ দিবে ?কেন এমন হল তার সাথে? এটা কি তার নিজেরই দোষ নাকি সবই কপাল??!
একটু যদি নীলাকে বেশি সময় দিত,নীলার পরিবর্তিতে মানসিক অবস্থাকে বুঝার চেষ্টা করতো,তা হলে কি এসব কাটানো যেত না?! এই অনুশোচনা থেকে সে কি করে বেড়িয়ে আসবে?

নীলা-কাব্যর দিন অবশ্য ভালোই কাটছে! নীলার অতি ছোট্ট কামরাটিতে তার আর কাব্যর একক সংসার।
শুধু মাঝে মাঝে নীলা খুব অস্থির বোধ করে ,কাব্য যেন কোথায় হারিয়ে যায়!
সেই রাতগুলোতে নীলার ভয়ংকর দু:স্বপ্নটা ফিরে ফিরে আসে! স্বপ্নে সে দেখে ,প্রচন্ড রাগে সে কাব্যকে কোলে তুলে সজোরে আছড়ে দিলো পাশের দেয়ালটিতে -একবার,দুবার,তিনবার….বারবার …..
কাব্যর মাথা ফেটে রক্ত,ঘিলু বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে …ভরে যাচ্ছে পুরো ঘর,নীলার মুখ ,শরীর!ঠোঁটে যেন কাব্যর রক্তের স্বাদ অনুভব করতে পারছে সে! উফ্ …কি ভয়ংকর,কি জঘন্য ,অকল্পনীয় …..আর পারছে না ,নীলা আর নিতে পারছে না …….ছটফট করতে করতে নীলা ঘুম থেকে জেগে উঠে!পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ!

হন্যে হয়ে নীলা খুঁজছে কাব্যকে ….ভোর হতে চলল ,এখনও কাব্য এল না ! কোথায় গেল বাচ্চাটা!
আজকে কাব্যর জন্মদিন ,কত কাজ বাকি …কেক আনাতে হবে,ঘরটা সাজাতে হবে!

মানসিক হাসপাতালের ছোট বদ্ধ কামরাটির একফুট বাই একফুট জানালাটি দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে
নীলা কাব্যর জন্মদিনের ছোট ছোট পরিকল্পনাগুলো করতে লাগলো।
পিছনে খুঁট করে একটু আওয়াজ হতেই নীলা তাঁকিয়ে দেখে,ওইতো নতুন পোশাক পরে হাসি মুখে কাব্য দাঁড়িয়ে আছে! জন্মদিনে পরানোর জন্য অনেক শখ করে একটু বড় সাইজের একটি পোশাক কিনে নীলা অনেকদিন আগে আলমারীতে তুলে রেখেছিল!নীলা প্রায়ই চিন্তা করতো এই পোশাকে কাব্যকে একদম রাজপুত্রের মত লাগবে!
আজকে সেই পোশাক পরেই কাব্য হাজির! নীলা মুগ্ধ চোখে তার রাজপুত্রকে দেখতে লাগলো….

দুহাত বাড়িয়ে দিতেই কাব্য দৌড়ে মায়ের কাছে ছুটে আসতে লাগলো …..
নীলা মুগ্ধ নয়নে এক বুক ভালোবাসা নিয়ে কাব্যকে বুকে জড়িয়ে ধরার অপেক্ষা করছে…..
কাব্য আসছে …..আসছে…..আসছে………

————————

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত