আহুতি

আহুতি

১.
আমাদের ঘরে কখনো সকাল আসে না। এখানে সময় স্থির, স্তব্ধ। ভৌতিক আঁধারে দিনরাত্রির হিসাব ভুলে আমরা এই ঘরে নিশ্চল বসে থাকি। থেকে থেকে ঝিঁঝিঁ পোকা, ব্যাঙের ডাক শুনতে পেয়ে অন্ধকারের ঘনত্ব, লোকালয়ের দূরত্ব পরিমাপ করার চেষ্টা করি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝিঁঝিঁ পোকার নিরবচ্ছিন্ন শব্দ ভেদ করে জিপের চাকার ভয়ালো শব্দ জোরালো হতে থাকলে আমাদের বুকে তোলপাড় ভয় জাগে। আমরা দরজার চৌকাঠের ফাঁক দিয়ে দেখি বাইরে আলোর লাল আভা জ্বলে-নেভে। বুটের ধুপধাপ শব্দ, জন্তু-জানোয়ারের হিংস্র হাসির সঙ্গে বিজাতীয় ভাষার কথোপকথনের শব্দ ভেসে আসে। আমরা নিজেদের কণ্ঠনালী চেপে চুপচাপ শুয়ে থাকি। কোনো কোনো সময়ে চারপাশে এত গাঢ় অন্ধকার ঘনিয়ে আসে যে দেখে মনে হয় আমরা কবরে চাপা পড়েছি। কবরের মতো নিস্তব্ধ এই ঘরে আমাদের সময় আটকে গেছে, আমরা আলোর প্রতীক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, যেই ক্লান্তি আমাদের স্বপ্নগুলো গলা টিপে মেরে ফেলছে।

আমাদের এই স্যাঁতস্যাঁতে সবুজ চার দেয়ালের ঘরে আলো আসে আচমকা। এই ঘরে একটি মাত্র জানালা। জানালাটি বন্ধ থাকে সারাদিন। আমাদের জীবনের স্পন্দন তবু ওই জানালার কপাটে লেপ্টে থাকে। সকালে জমাদারনি এলে এই জানালার কল্যাণেই আমরা আলোর দেখা পাই। খয়ের-জর্দা দেয়া পানের ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে সে ঘরের মেঝে ঝাড়ু দেয় আর আমাদের গালিগালাজ করে। জমাদারনির মুখের উৎকট গন্ধে আমরা কিছু মনে করি না, তার বাক্যবিষে নীলও হই না। আমাদের শরীর শত শত আঘাতে শত শত বছর আগে থেকেই নীলবর্ণ। আমরা কেবল অপেক্ষায় থাকি জমাদারনি কখন জানালাটি খুলবে।

একসময় জমাদারনি জানালাটি খোলে। কাঠের পাল্লা দুটি খুলে যেতেই জানালার শিকগুলো আলোর চাপে ভেঙে যায়। আমরা তৃষ্ণার্তের মতো সেদিকে ছুটে যাই। আলোর ভাগাভাগি করতে করতে উন্মত্ত হয়ে উঠি। হুড়োহুড়ি, গলাগলি করে একে ওকে ঠেলতে ঠেলতে খিলখিল করি। আমাদের উন্মাদনা দেখে জমাদারনি ঘরের কোণে পানের পিক ফেলতে ফেলতে চিৎকার করে ওঠে, ‘বেবুশ্যে মাগিরা।’ আমরা তার উচ্চারিত অনাকাক্সিক্ষত কোনো শব্দ কানে তুলি না। আমরা মুঠো ভরে আলো তুলি। খোলা জানালায় চোখ রেখে আকাশের আলোর ক্ষরণ দেখতে গিয়ে আমরা কত কী দেখি-বিস্তীর্ণ মাঠ, সবুজ পাতার সামিয়ানা, পথের বাঁক, আলোর ঘোর, মুক্ত বাতাস, লাল-সবুজের ক্লান্তিহীন ঢেউ।

জমাদারনি বেশিক্ষণ জানালাটি খোলা রাখে না। ঘরের দূষিত হাওয়া বাইরে উড়িয়ে নিতে যতক্ষণ সময় লাগে কেবল ততক্ষণ আমরা আলোর দেখা পাই। আলোর নৈঃশব্দ্যের মুহূর্তটুকু আমাদের কাছে কলরব হয়ে বেজে ওঠে। একসময় যেমন দুম করে জানালাটি খুলেছিল তেমন দুম করে জানালাটি বন্ধ করে জমাদারনি আবর্জনার বালতি টানে আর গালমন্দ করতে করতে চাপা কণ্ঠে জানায়, পাপ থেকে আমাদের মুক্তি নেই। থপথপ পায়ে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায় জর্দা আর আলোর ঘ্রাণ। এরপর ঘরের ভেতর ঢোকে অনেক মানুষ। একজন দুজন, তিনজন, সাতজন। বহু জন।

এই ঘরে একটি মাত্র জানালা। দরজা দুটি। যেই দরজা দুটি দিয়ে বহু মানুষ একসঙ্গে ঢোকা যায়। কিন্তু বের হওয়া যায় না।

২.
আমি কেন, কখন জিপ থেকে লাফ দিয়েছি, মনে নেই। মুখ থুবড়ে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তের কথা কেবল মনে আছে। জিপের পেছনের খোলা দিক দিয়ে ভুরভুর করে বাতাস আসছিল। চাঁপা ফুলের মতো তুলতুলে নরম বাতাস। বাতাসের ঘ্রাণে ভাসছিল সরিষা ফুলের রেণু। মন চাইছিল বুক ভরে ঐ বাতাস টেনে নিই। লোভীর মতো সবটুকু আলো কেড়ে নিয়ে নিজের নোংরা শরীরে মাখি।

দিন পনেরো আগে ওদের বড় অফিসারের কাছে ভেট পাঠানোর পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে ওরা আমাকে এক বালতি পানি দিয়েছিল। অনেকদিন পর সেদিন মাথার জটাধরা চুলের আড়াল খুবলে উকুন আনতে আনতে সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করেছিলাম। ছোটবেলায় মা যেমন করে আমাকে ঘষে ঘষে গোসল করাতো বালতির আধময়লা পানি দিয়ে তেমনি নিজের ঘাড়, গলা, মুখ ঘষেছিলাম। গোসল শেষ হলে সেদিন প্রথম ওরা আমাদের কয়েকজনকে নতুন কাপড় দিয়েছিল। যদিও রাতে আবার সেই কাপড় খুলে নিয়েছিল। জমাদারনির কাছে শুনেছিলাম, এই ঘরে একটা মেয়ে নিজের শাড়ি গলায় দিয়ে ফ্যানে ঝুলে পড়েছিল। মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে সিলিংয়ের দিকে চোখ গেলে আমি অজ্ঞাতকুলশীল ঝুলন্ত মেয়েটিকে দেখতে পাই। আধময়লা পেটিকোট আর ব্লাউজ পরিহিত অবস্থায় সিলিংফ্যানের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি সেই মেয়েটিকে ভীষণভাবে ঈর্ষা করি!

আমিসহ আরো পাঁচজনের সৌভাগ্য দেখে আমাদের ঘরের কেউ কেউ আজ ঈর্ষাকাতর হয়েছে। আজ আমি বাইরে এসেছি। সকালে যখন বাইরে বের হয়েছি তখন আলোর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। অনভ্যাসে চোখ কুঁচকে যাচ্ছিল। বাকি পাঁচজনেরও তখন একই অবস্থা ছিল। আলো সয়ে এলে আমি লোভীর মতো জিপের পেছনদিকে তাকিয়ে ছিলাম। জিপ তখন ছুটছে। মাটির রাস্তার থৈ থৈ তালে আমার কানের পাশে নাক গুঁজে কেউ কিছু একটা বলেছে। এই ভাষা চেনা। বাকিরা হাসছে। এই হাসির শব্দ চেনা। আমার আশেপাশের সবাই এভাবে হাসে। যখন ইচ্ছা তখন।

আমি হাসি না। কাঁদি। যখন ইচ্ছা তখন। কাঁদি বলে মার খাই তবু কাঁদি। ওদের অনেকেই আমার মতো কাঁদে। কেউ কাঁদে স্বামী-সন্তান, মা-বাবার কবরের জন্য, কেউ বা ফেলে আসা উঠান, ঘরদোর, কদমতলা, তুলসীবেদীর মায়ায়। কারো কারো চোখে এক বিন্দুও পানি থাকে না, থাকে আগুনতাপ। বিশেষ করে যশোরের ইরা নামের মেয়েটি যখন শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তখন গনগনে তাপে ওর ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে যায়। দেখে আমি ভীষণ ভয় পাই। ইরা বলে, ওই শুয়োরগুলোর মুখে থুতু মারবে। দুর্বিনীত ইরার কথা শুনে আমার বুকের ভেতরে ঢংঢং করে বিপদঘন্টা বাজে।

জিপের একেবারে বাম কোণায় বসা মেয়েটি ইরার ঠিক উল্টো। ও কখনো হাসেনি, কাঁদেনি, ক্ষেপেও ওঠেনি। মেয়েটি সবসময় বোবাদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকে। এই এক মাসের মধ্যে মাত্র একবার কী দুবার কথা বলতে শুনেছি ওকে। ওর বুকের মানিককে ভাতের গরম হাঁড়িতে ছুঁড়ে ফেলেছিল পাকজন্তুরা। স্বামীর সামনে বিবস্ত্র করে টানতে টানতে ওকে তুলেছিল জলপাই রংয়ের জিপে।
আজ বাইরে যাবার ডাক পড়তেই, মেয়েটি আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। আমাদের ভেতরে কারো বাইরে যাবার ডাক পড়লে আমরাও এমন নিস্তব্ধ হয়ে যাই, কেউ কেউ খুশিও হই। অনেকেই এমন করে বাইরে এসেছে আর ফিরে আসেনি। যারা ফিরে আসেনি তাদের আমি বা আমরা ঈর্ষা করি।

জিপটা কী কারণে যেন থেমেছে। ওদের কেউ একজন শিস বাজাতে বাজাতে ভারি পায়ে এগিয়ে গেছে ঝোঁপের দিকে। আমি পথের ধারের বকফুল, বাবলা, খয়ের, চম্পার আড়াল দেখছি। ঠিক তখনই জলাটা চোখে পড়েছে। জলার ধারে মোচড়ানো শরীরের একটা পিটালি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। হলুদ হলুদ ফুলের লম্বা মঞ্জুরি মুখ বাড়িয়েছে পানিতে। জলার পানি টলমল করছে। বাতাস পানিতে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ঢেউ তুলছে। কতদিন এমন টলটলে পানি দেখিনি আমি! আমি ছুটে গিয়ে জলার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। কী ঠান্ডা পানি! সেই পানিতে নেমে আমার শরীর জুড়িয়ে গেছে, মুছে গেছে সকল গ্লানি। পরে শুনেছি, জিপ থেকে লাফিয়ে মাটিতে পড়েছিলাম। সেদিনই ক্যাম্প বদলেছিল আমার।

এখন আমি যে ঘরে থাকি সেই ঘরেও একটি জানালা। দরজা দুটি। যেই দরজা দুটি দিয়ে বহু মানুষ একসঙ্গে ঢোকা যায়। কিন্তু বের হওয়া যায় না।

৩.
মেয়েটি কখনো আল্লাহকে ডাকছে, কখনো ভগবানকে। প্রথমদিন আমরা কারণ জানতে চেয়েছিলাম। ও ভয়ার্ত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘কোন ডাকে তিনি খুশি হবেন ঠিক বুঝতে পারছি না।’ তিনি খুশি হলে কী হবে এই প্রশ্ন করতে করতে আমাদের কেউ কেউ হেসেছে। লম্বা চুলের শান্তমতো মেয়েটি সবচেয়ে কম হাসে, কাঁদে বেশি। বেশি কাঁদে বলে মারও খায় সবার চেয়ে বেশি। ওর নাম সোনালি। ঘরের পশ্চিমকোণে মেঝেতে সোনালি ঘুমাচ্ছে। ওর শরীরে জ্বর। এই ঘরে জ্বর বা ব্যথা পরিমাপের পারদ নেই। গতকাল রাতে সোনালির চুলের মুঠি ধরে একজন সৈনিক এমনভাবে টেনেছিল যে ওর এক গাছি চুল হাতে উঠে এসেছে। মেঝেতে এখনো সেই চুলের গোছা পড়ে আছে।

সোনালি কাল ব্যথায় চিৎকার করে মা মা বলে কাঁদছিল, তখন সৈনিকটি ওর ডান স্তনে হ্যাঁচকা টান মেরে বিকৃত স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘খানকি, খানকি।’ সৈনিকটি অবিকল বাঙালিদের গলায় অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিল। ওর সঙ্গে একজন বাঙালিও ছিল। গতকাল মিলিটারিদের উচ্ছিষ্ট পাতে তুলতে এসে ওরা সবাইকে নিয়ে টানাটানি করছিল। এই ঘরের নতুন সদস্য আলপনাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় সোনালিকে কাঁদতে দেখে ওকে ইচ্ছামতো চড়-থাপ্পড় মেরেছিল।

রাতের খাবার খায়নি সোনালি। বেশ কয়েকবার বমি করেছিল। টিনের থালায় রাখা থকথকে সবজির ওপর বমির তরল দেখে সকালেও রেগে উঠেছিল ওরা। থালার ওপরে সোনালির মুখ ঠেসে ধরেছিল। উল্লাস করতে করতে শায়ের আওড়াচ্ছিল। এদের আনন্দ দেখলে আমরা নিজেদের মৃত্যুকামনা করতে থাকি। যে কোনো মুহূর্তেই মরে যাবার জন্য প্রস্তুত আমি বা আমরা। কিন্তু ওরা আমাদের মারে না। মাঝেমাঝে জায়গা বদল করে শুধু। এখানে এসেছি অনেকদিন হয়ে গেল। শহরতলীর এই দিকটা খুব নিরিবিলি। মাঝেমাঝে বাইরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়, জিপের চাকার যান্ত্রিক শব্দের সঙ্গে পশুদের জান্তব চিৎকার কানকে বিবশ করে তোলে।

সৈনিকদের কথোপকথন থেকে আমরা জানতে পারি, আজ ব্লাকআউটের রাত। পথে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে অন্ধকার থরে থরে সাজানো। এক পা বাইরে ফেললেই নিশ্চিত মৃত্যু। মৃত্যু আমরা দেখেছি, নতুন করে মৃত্যুকে চেনার কিছু নেই। আমরা তাই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে এর ওর সঙ্গে গল্প করি, দুআঙুলের নখের চাপে চটচট শব্দে উকুন পিষতে পিষতে হালকা রসিকতা করি, অন্ধকারে আলোর নিশানা খুঁজে আন্দাজ করি সময়ের নিষ্প্রাণ গতিবেগ।

আমাদের ঘরের চারদেয়ালে কালো অন্ধকার রাত চিরকালের জন্য থমকে গেছে, ঘরের দেয়ালেও সময় ঝুলানো নেই। যদিও কয়েকদিন ধরে ঘরের বদ্ধ বাতাসে ঠান্ডার ভাব দেখে বোঝা যায়, শীত আসছে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে পৌঢ় মুখ শিখাদি দিনক্ষণ হিসাব করে বলেছে, এখন কার্তিক মাস। শিখাদির কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর। কদিন ধরে দিদি গুনগুন করছে,
‘কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা,
একবার আসেন মায়ের সাথে,
একবার আসেন একলা।’

শিখাদির গুনগুনানি আমাদের মস্তিষ্কের কোণে কোণে আনন্দ ছড়াচ্ছে। শিখাদি এখন বুকের ওপর দুহাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে। আধন্যাংটো শরীরে তাকে বুকের ওপর এমন ক্রসবেল্টের ভঙ্গিতে দুহাত রাখতে দেখে এখন আর আমাদের হাসি পায় না।

অন্যসময় হলে আমরা হাসতাম। আজ আমাদের ঠোঁটে ব্যথা। কারো কারো স্তনে, নিতম্বে, উরুসন্ধিতে, যোনীপথে ব্যথা। গতকাল কোনো কোনো শরীরে ওদের ঢুকতে দেরি হচ্ছিল বলে ওরা আমাদের শরীর কামড়ে মাংস খুবলে নিয়েছে। আমরা ওদের চিনি না। শরীরের খাকি পোশাক ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে ওরা যখন আমাদের ভোগ করতে থাকে তখন ওদের মুখগুলো আমাদের একইরকম লাগে। এই সৈনিকটিও একই চেহারার। সৈনিকটি এগিয়ে আসছে। আমরা সতর্ক চোখে তাকাই। এখন কার পালা জানি না। একজন ফিসফিস করে, ‘ওরে নিয়া যাইব আইজ।’

সৈনিকটি ঘুমন্ত সোনালির নিতম্বে লাথি মারছে। বুটের সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ঘরের চার দেয়ালে। সোনালি দুমড়ানো শরীরে উঠে দাঁড়ায়। আমরা চমকে তাকাই।

আমরা টের পাই, সোনালি আর ফিরবে না। সোনালির গর্ভের শিশুটিও ফিরবে না আর এই ঘরে। যে ঘরে একটি জানালা। দরজা দুটি। যেই দরজা দুটি দিয়ে বহু মানুষ একসঙ্গে ঢোকা যায়। কিন্তু বের হওয়া যায় না।

৪.
সাপের ফণা তুলে এক একটি পুরুষাঙ্গ আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে আর আমি বেদনার ভারে নীল হতে থাকি। একসময় ওরা চলে গেলে রাশি রাশি অভিমান ধেয়ে আসতে থাকে আমার দিকে। বদ্ধ ঘরে গাঢ় অভিমানের মতোন অন্ধকার আরো জমাট হয়। সেই আঁধারে আমার আশেপাশের পরিত্যক্ত শরীরগুলো যখন ঘুমে কিংবা জাগরণে কাতরাতে থাকে তখন আমি জেগে জেগে মাকে স্বপ্নে দেখি। দীর্ঘ পাঁচ মাসের বকেয়া ঘুম মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমাবো ভেবে অপলক তাকিয়ে থাকি।

মা আমাকে মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে রেখেছিল। দাদার তৈরি ‘স্বপ্ন মঞ্জিল’র স্বপ্ন সংগোপনে পুঁতে রেখেছিল বাগানের শিমুল গাছের পাশে। কিন্তু রক্তবর্ণ ফুলের চাদর আমাকে আড়াল করে রাখতে পারেনি। সেদিন আমাদের বাড়ির পাশের বিহারিপাড়া থেকে মুহুর্মুহু ভেসে আসা শ্লোগানে মা ভয় পেয়েছিল খুব। মা আমাকে ইশারা করতেই আমি শিমুল তলায় ছুটে গিয়েছিলাম।

দিনের ঝকঝকে আলোতে সেদিন যান্ত্রিক বাহনে করে পাকজন্তুরা রাস্তায় নেমেছিল। ওদের সঙ্গী হয়েছিল কিছু বাঙালি আর উর্দুভাষী বিহারি। গোটা দেশ তখন লাশে ডুবে গেছে। রাস্তার ধারে, পুকুরপাড়ে সারি সারি লাশ পড়ে ছিল। ঘাঘট নদীর পানি লাল বর্ণ হয়ে গিয়েছিল। নদীর ধারে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল বেয়োনেটে খোঁচানো, গুলিবিদ্ধ সব লাশ। যেসব লাশের শেষকৃত্য হয়নি। শহরের এসব খবর শুনেশুনে মা আমাকে গর্তে ঢোকার পরও নিজের বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখতো। মায়ের শরীরের ঘাম আর মসলার গন্ধ আমার চোখে-নাকে মাখামাখি হয়ে থাকতো।

মায়ের সোনা মেয়ে আমি। সোনার মতো বরণ। শহরের ছিপছিপে পথে যে সোনা রং ঝলমল করতো রোদের সামান্য পরশ পেয়ে। মা তার হাতের অনন্তবালা জোড়া মেয়ের নাম করে তুলে রেখেছিল। আমি বিয়ের দিনে রাজরানি সেজে বসে থাকবো সেই সুখের কথা ভেবে মায়ের ঘুম হতো না। আর মা এখন কী নিশ্চিন্তেই না ঘুমিয়ে আছে।

ওরা যখন আমাকে হিড়হিড় করে টেনে গর্ত থেকে বের করে নিয়ে এসেছিল তখন মা চিৎকার করে উঠেছিল, ‘আমাদের মেরে ফেলো, মেরে ফেলো…।’ ওরা মাকে মেরে ফেলেছিল, আমাকে মেরে ফেলেছিল।

আমি আমার শবদেহ নিয়ে মেঝেতে শুয়ে আছি। এই ঘরের বাইরেও অনেক শবদেহ শুয়ে আছে।

আজও জানালা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমি আলোর দিকে হামলে পড়েছিলাম। তাপে আমার চোখ পুড়ে যাচ্ছিল। দগ্ধ চোখে বাইরে তাকিয়ে মাঠে পড়ে থাকা বেয়োনেটে খণ্ডিত পাঁচটি লাশ দেখছিলাম। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতো একটি লাশ গাঁথা ছিল জানালার ওপাশের মেহগনি গাছের কাণ্ডে। লাশটির পরিচয় আমি জানতাম না। কিন্তু লাশটি ওপড়ানো চোখেও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল আমি ওর কত দিনের চেনা। আমি ভয়ে জানালার সামনে থেকে সরে এসেছিলাম।

তখন সময় কত হবে জানি না। জমাদারনি প্রতিদিনের মতো জানালা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই একটা শুয়োর এসে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে আমাকে পাশের ঘরে টেনে নিয়েছিল। আমাকে নগ্ন করার জন্য হাত বাড়াতেই আমার ওপর ইরা ভর করেছিল। সারাদিন ধরে মুখে জমিয়ে রাখা থুতু আমি প্রচ- আক্রোশে শুয়োরটার মুখে ছুঁড়ে মেরেছিলাম। দিশেহারা হয়ে দাঁতাল শুয়োরটা দুহাত বেঁধে রেখে আমার মুখে প্রস্রাব করেছে।

ভেবেছিলাম আমাকে মেরে ফেলবে। যেভাবে ইরাকে মেরেছে-ওর স্তনজোড়া, নিতম্ব, যোনী টুকরো টুকরো করে কেটেছে সেভাবে খণ্ড খণ্ড করবে আমাকে। কিন্তু না, ওরা আমার জন্য বেঁচে থাকার মতো কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করেছিল। উলঙ্গ আমাকে টানতে টানতে ঘরের কোণে ছুঁড়ে ফেলেছিল। আমি নরকযন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বারবার নিজের গলা চেপে ধরেছি। আমাকে ব্যথাতুর চোখে দেখতে দেখতে গতকাল আসা নতুন মেয়েটি থরথরিয়ে কেঁপেছে আর জানতে চেয়েছে, ‘আমরা কি কোনোদিনও এখান থেকে বের হতে পারবো না?’ মেয়েটির পাখি কণ্ঠস্বর ঘরের অতলস্পর্শী গিরিখাতে তলিয়ে গেছে।

মেয়েটি জানে না, এই ঘরে একটি জানালা। দরজা দুটি। যেই দরজা দুটি দিয়ে বহু মানুষ একসঙ্গে ঢোকা যায়। কিন্তু বের হওয়া যায় না।

৫.
যেদিন শেষবারের মতো আমরা আমাদের কবরখানায় মৃত্যুর বিষপাত্র হাতে শুয়ে আছি সেদিন আমাদের অবাক করে এই ঘরের একমাত্র জানালাটি খুলে যায়। বন্ধ দরজা দুটিও উদার হাতে খুলে দেয় কেউ। দেখতে দেখতে অন্ধকার ঘরটি ভেসে যায় আলোর স্রোতে। সময়ের বিপন্ন পুলসিরাত পার হয়ে দীর্ঘ নয় মাস পরে আমাদের ঘরের ভেতরে পায়রার অজস্র নরম পালক ঢুকে পড়ে। সেই পালকে ভর করে অপূর্ব এক নবীন সকাল আসে।

যে সকাল আমরা কখনো দেখিনি। আমাদের শৈশবে না, কৈশোরে না, তারুণ্যে না, পৌঢ়ত্বেও না। ঝলমলে এই সকালের ডাবের শাস রংয়ের আকাশ মেঘশূন্য। চারদিকে অফুরান আলোর খেলা। আমাদের ঘিরে থাকা বাতাসে রক্ত আর এলাচের ঘ্রাণ মাখামাখি করে থাকে। যেই ঘ্রাণ আমাদের ক্ষতবিক্ষত শরীরে আনন্দের তীব্রতা ছড়িয়ে দেয়, আর সেই ঘ্রাণে বুঁদ হয়ে আমরা খোলা দরজা-জানালা দিয়ে মুক্ত দেশের মুক্ত আলো দেখতে থাকি।

(রচনাকাল: ২০১৯, প্রথম প্রকাশ: গল্পগ্রন্থ-মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ)
ঋণ: নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ এবং গেরিলা ১৯৭১

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত