অসুখ

দিন গুনে গুনে নসিমনের স্বামী সোলায়মানের বাপ ওসমান ফি-বছর মাঘ মাসের অপেক্ষায় কেমন তৎপর হয়ে ওঠে। যদিও নসিমন ত্রিশ বছরের সংসার জীবনে কোনদিনই বুঝে উঠতে পারেনি আপাত শান্তশিষ্ট স্বামীটি তার কেন মাঘের ঠান্ডা-শীতল আবহাওয়ায় চঞ্চল থেকে ক্রমশ অস্থির হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে পুত্র সোলায়মানের বছরের কোন অমাবস্যায় পিতার বাতের ব্যথা ওঠে, কোন পূর্ণিমায় যৌবনে ইয়ার দোস্তদের সাাথে দেখে আসা যাত্রা-পালার কথা মনে পড়ে কিংবা ফুলতলীর বিলে সারারাত ধরে কলা গাছের ভেলায় ভেসে মাছ শিকারের কেচ্ছা শোনাতে শোনাতে মাছের আঁশের মতো চোখ চকচক করে ওঠে সে সম্পর্কে আগ্রহ খুব সামান্যই। এইতো গেল শীতেই হাঁপানির টানে যখন বাপ তার যায় যায়, নসিমনের একটানা আহাজারিতে দু-দশ ঘরের লোকজন জড়ো হয় তখনো নির্বিকার ভঙ্গিতে সে বেড়ার দরজা টেনে জুয়ার আসরেই পড়ে থাকে। পিতার জীবনে পৌষ-মাঘ বা ফাল্গুন-চৈত্রের কী প্রভাব তা তার দেখবার বা ভাববার বিষয় নয় কোনকালেই।

তবে পুরো বছর পার করে নসিমন এই বিশেষ সময়টিতেই স্বামীর সঙ্গে এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলায় মেতে ওঠে। যেমন; গভীর এক আকুতি নিয়ে ওসমান মাঘ মাস আসার আগেই স্ত্রীকে কড়া হুকুম করে পরনের কাপড়চোপড় আর কিছু শুকনো চিড়েমুড়ি দিয়ে একটা পোঁটলা গুছিয়ে রাখতে যাতে যেকোনো সময় সে যাত্রা শুরু করতে পারে এবং পরবর্তী দিনগুলোতে তাগাদা দিতে দিতে রীতিমত অস্থির করে তোলে। ওদিকে নসিমন ঠিক এই সময়টিতেই নানাবিধ সাংসারিক কাজকর্মে নিজেকে নিবিষ্ট করে ফেরতে চায়। ডালের বড়ি দিয়ে বাড়িময় আলপনা এঁকে ফেলা, গোবরের লাকড়ি বানানো কিংবা ছেঁড়া শাড়ির টুকরো দিয়ে কাঁথা তৈরির চেয়ে অন্য কোন কাজে তাকে অধিক মনোযোগী হতে দেখা যায় না। স্বামীর বাৎসরিক সফরের যোগাড়যন্ত করার ক্ষেত্রে রাজ্যের অনীহা দেখে ওসমান মাঝেমাঝে মারমুখী হয় তবুও নসিমনের নির্লিপ্ততা কাটে না। কেন না সে জানে বুড়ো যতই ক্ষ্যাপাটে হয়ে তেড়ে আসুক না কেন ওই জিনিসগুলো তার দরকার পড়বে মাঘের শেষাশেষি, তার আগে নয়।

প্রথম প্রথম খুব আগ্রহের সাথে কাজটি করেছে সে কিন্তু স্বামীর গন্তব্য রহস্যের কূলকিনারা না করতে পেরে স্বামীকে নির্লিপ্ততা দেখিয়ে উত্তেজিত করার মধ্যেই আনন্দ খোঁজে মাঘের অর্ধেকটা জুড়ে।

ত্রিশ বছর আগের কোন এক অঘ্রানে ১৪ বছরের নসিমন ওসমানের বউ হয়ে এসেছিল। সাদাসিধা মানুষটার ওপর মায়া জন্মেছিল বিয়ের রাতেই যখন বউকে জড়িয়ে ধরে সে বলেছিল, ‘তুই ছাড়া আমার কেউ নাই রে বউ, আমারে তোর জিম্মায় রাখিস।’ নসিমন কেঁদে ফেলেছিল। বিয়ের আগেই জেনেছিল সে যাচ্ছে জন্ম এতিমের ঘরে। স্বামী তার পরের বাড়িতে মানুষ। পরবর্তীতে সে মানুষটিকে ভালো না বেসে পারেনি। বিয়ের ছয় বছরেও ছেলেপুলে না হওয়া এবং মানুষের হাজারো কুমন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও সতীনের ঘর করতে না হওয়া উপরন্তু দূরদূরান্ত থেকে সন্তানের আশায় পীরফকিরের পানি পড়া নিয়ে আসা এসবের জন্যে স্বামীর প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা অনুভব করে এবং নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে কেন না এমনি এক পড়া পানির বদৌলতেই সে সোলায়মানকে পেটে ধরতে পেরেছিল।

স্বামীগৃহে নসিমনের প্রথম মাঘ মাসটি আসে বিয়ের মাত্র এক মাস পরেই। তখনও আড়ষ্ঠ সে স্বামী ও সংসারে। প্রতিবেশীরা আসে, পান-দোক্তা খায় এক ফাঁকে সতর্ক করে দেয় নতুন বউয়ের হাজারো ছুৎঅছুৎ, জাদুটোনা আর হলদি মেন্দির গন্ধে ছুটে আসা অশরীরি আত্মাদের ক্ষয়ক্ষতির ধান্দা সম্পর্কে। নসিমন এসবই আয়ত্ব করছিল সন্ধ্যা বেলা খোলা চুলে বাইরে না গিয়ে, লোহা জাতীয় বস্তু কাছে কাছে রেখে, এমনকি বিয়ের শাড়িটি সে ট্রাংকের একেবারে নিচে নকশিকাঁথা ও সায়া-ব্লাউজেরও নিচে এমনভাবে রেখে দেয় যাতে সেখান থেকে সুতা চুরি করে তাবিজ-কবচ বানিয়ে কেউ তার সংসারের ক্ষতি করতে না পারে।

ওসমানের ইয়ার দোস্তরা তখন নসিমনের হাতের পান-সুপারি খেতে আসতো বন্ধুর বাড়ি ফেরার পথের সঙ্গী হয়ে। একসময় তারা নানা রসাত্মক আলোচনায় মেতে উঠতো আর নসিমনকে প্রায়ই দৌড়ে চলে যেতে হতো পাক ঘরের দিকে, লজ্জায় লাল হয়ে। এমনি এক সময়ে তার বিবাাহিত জীবনের প্রথম মাঘ মাসটি আসে।

জড়োসড়ো হয়ে সে স্বামীকে শুধায়, ‘কুনদিন আইবেন?’

‘বেশি না এই দুই-তিন দিন বাদেই, তুই রাইতো কালা চাছিরে নিয়া থাহিস।’

কথা হয়েছিল এ পর্যন্তই। এমনকি তিন দিনের পর সাত দিন, সাত দিনের পর আরও সাত দিন পার করে স্বামীর বাড়ি ফেরা কিংবা ত্রিশ বছর একসাথে পার করে ছেলে সোলায়মানের তেইশ বছরের যুবক হয়ে ওঠার পরও সে জেনেছিল ওই সামান্যই। নসিমন দিনে ঘরদোরের কাজ করে আর রাতে কালাচাচীকে নিয়ে ঘুমায়। সদ্য বিবাহিত নসিমনের অশরীরি আকর্ষণের ভয় উবে গিয়ে শরীরি আকর্ষণ মূখ্য হয়ে ওঠে। কালা চাচীকে জড়িয়ে ধরে প্রতি রাতে তার স্বপ্নের রঙ বদলাতো তবু ওসমানের ফেরা হয়নি এবং পরবর্তীকালেও কমপক্ষে সাতদিন অতিবাহিত না করে কোন সফরই শেষ হয়নি তার। কাক তাড়ানোর অছিলায় ঘরের বাইরে এসে দূরের মাঠ পেরিয়ে বড় সড়কের মাথায় মানুষের অবয়ব খুঁজতে খুঁজতে একেক সময় স্বামীর আকৃতি মনে করে কত পুরুষকে সে বার বাড়ী আসা পর্যন্ত নজরে রেখেছে তার ইয়াত্তা নেই। যদিও যে পর্যন্ত আসার পর মানুষগুলোর তাকে দেখে ফেলার সম্ভাবনা তৈরি হতো তার আগেই সে ঘরের ভেতর ঢুকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে নজরদারীর কাজটি চালিয়ে যেতো কিন্তু তাদের কেউই সোলায়মানের বাপ হয়ে ভেতর বাড়িতে প্রবেশ করেনি। ওসমানের ইয়ার দোস্তরা কখনো কখনো খোঁজখবর নিতো যে সে ফিরেছে কি-না কিন্তু কেউই নসিমনকে স্বামীর এই অদ্ভুত খেয়ালের কোন হদিস দেয়নি। কালা চাচীকে সে শুধু ঘুমের ঘোরে বলতে শুনেছে, ‘কামরুক কামাক্ষার দ্যাশে যায়, যে দ্যাশে খালি মায়ার খ্যালা।’ কিছু বুঝে ওঠতে না পেরে কালা চাচীকে শুধায়, ‘দ্যাশটা কুনু চাছি?’

‘দ্যাশটা এই দুনিয়ার বাইরে। যে দ্যাশের তামান মানুষ ন্যাংটা হয়া দূর দ্যাশের মানুষরে ইশারা করে আর যারা ওই দ্যাশের নারীরা জোয়ান পুরুষ পোলাগো জাদু টোনা করে, মায়ায় ফেলে। একবার ওই দেশের মায়ায় পরলে হারা জনমেও তা ছাড়ে না’, কালা চাচী বলে।

নসিমনের মাথা ঘোরে। অদেখা এক মায়ার দ্যাশের চিত্রকল্প আঁকে সে। মাথার ওপর সূর্য নিয়ে বার বাড়িতে শিম তুলতে তুলতেও তার চোখে কিছু উলঙ্গ নারী-পুরুষের চেহারা ভাসে যারা হাত ইশারায় ক্রমাগত মানুষজনকে ডেকে যাচ্ছে। কালা চাচী সারা দুপুর নসিমনকে ডেকে ডেকে সাড়া। গভীর ঘুমে অচেতন সে পড়ে থাকে শিমের জাঙ্গলার নিচে সন্ধ্যেবেলায় কুয়াশা গায়ে লেগে শীত শীত অনুভবের পর পর্যন্ত।

ওসমান বাড়ি ফেরে ফাল্গুন মাসেরও এক দিন পার করে। কাক ডাকা ভোরে। নসিমন তখন ঘুমঘোরে একপাল উলঙ্গ নারী-পুরুষের ভিড়ে স্বামীকে খুঁজে ফিরছিল মায়ার দেশের নারীদের বশীকরণ বিষয়ে সাবধান করতে। যখনই সে স্বামীকে চিনতে পারে তখনই আওয়াজটা আসে। ‘চাছি তুমরা গুমাইতাছ?’ ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে দ্বিতীয়বার শোনার জন্যে কান পাতে সে, যেন আজন্ম এই ডাকেরই প্রতীক্ষায় ছিল সে!

পরপর দুদিন ওসমান পড়ে পড়ে শুধু ঘুমিয়েছিল। আচমকা জেগে ওঠে মাঝেমাঝে ইতিউতি অস্থির দৃষ্টি ফেলে আবার ঘুমিয়ে পড়ত। নসিমন ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ার দেশের চিহ্ন খোঁজে। যে মায়া তার স্বামীকে টেনে নিয়ে যায় দূরদেশে।

ওসমান সংসারে ফিরেছিল আরও সপ্তাহ খানেক পর। একদিন সকালে সে ক্ষেত কামলা দিতে যায় এবং ফেরার সময় একটা কোদালও কিনে নিয়ে আসে। নসিমন স্বামীর ঘোর কেটে যাওয়া উপলক্ষ্যে খানিকটা উত্তেজিত হয় এবং কালা চাচীর কাছে এই উচ্ছাস প্রকাশ করে যে মায়ার দেশের নারীরা তার স্বামীকে বশীভূত করতে ব্যার্থ হয়েছে, কেন না সে আগের মতোই সংসারী এবং সঙ্গে করে নিয়ে আসা কোদাল তারই ইঙ্গিত বহন করে। প্রকৃতপক্ষেই ওসমান সংসারে ফিরেছিল। তার অনুপস্থিতিতে ঘরের চালের সরে আসা খড় ঠিক করা কিংবা লাউ-শিমের ন্যাতানো লতায় জাঙ্গলা তৈরি করে দেয়া সব কিছুর দিকেই তার দৃষ্টি ফিরেছিল। দৃষ্টি ফিরেছিল স্ত্রীর দিকেও। যদিও নসিমন উৎকন্ঠিত ছিল এই ভেবে যে স্বামীর সহবাস তাকেও টেনে নিয়ে যাবে অজানা-অচেনা কোন ঘোরের ভেতর। উৎকন্ঠাগুলো আবেগের স্রোতে ভেসে যায়। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে প্রতি রাতেই সে স্বপ্ন দেখে ছিমছাম গৃহকোণ, নিকানো উঠোন ও অনাগত সন্তানের। আর এইসব স্বপ্নীল-বর্ণিল অনুভূতির ভেতর সে হারিয়ে ফেলে মায়ার দেশ, উলঙ্গ নারী-পুরুষ আর কামরুক কামাক্ষার দৃশ্যপট। সবকিছুই সে ভুলে যায়। এমনকি শীত-গ্রীষ্ম পার করে পরের বছর লুঙ্গি-গামছা পরিষ্কারের তাগিদ আসার আগ পর্যন্ত সে ভুলেই থাকে। এভাবে বছরের পর বছর লুঙ্গি-গামছা, চিড়ে-মুড়ির পোঁটলা বেঁধে স্বামীকে বিদায় জানায় সে কিন্তু কখনই স্বামীর কাছ থেকে মায়ার দেশ সম্পর্কে কিছু জানতে পারে না। তবে এই না জানা তাকে বিচলিত করে না বরং সেই দেশের প্রতি নসিমনের কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরি হয় এক ফাল্গুন মাসে ওসমানের বাৎসরিক প্রত্যাবর্তন এবং সাদা রঙের একটি শিশি হাতে পাবার পর।

‘দুই ফোঁটা কইরা সকালে আর রাত্রে খাবি’, স্বামীর হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে নসিমন, আলগোছে কথায় কথায় জেনে নিয়েছিল এক কামেল পীর এই পানি দিয়েছে যার বদৌলতে শীঘ্রই মা হতে পারবে সে। বাস্তবিক চৈত্র মাসের দিনগুলোতে সে টের পায় শরীরের অস্বাভাবিক অস্থিরতার কারণ গরম নয় বরং শরীরে নতুন জীবনের উপস্থিতি। পরবর্তী পৌষের হাঁড় কাঁপানো শীতেই জন্ম নেয় সোলায়মান আর জন্মানোর এক মাসের মধ্যেই পিতার মাঘী পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সন্তানের জন্ম বা জন্ম দিতে পারার সাফল্যে নসিমনের মনে মায়ার দেশের প্রতি ভক্তি জন্মায়, সাথেসাথে স্বামীকে সে বুজুর্গ ব্যক্তি হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করে এবং একসময় সে এই সমীকরণে এসে পৌঁছায় যে দ্বীনের সন্ধান বা ওলি-ওলামার সংসর্গ লাভেই স্বামী তার সংসারত্যাগী হয়। প্রতিবেশী নারীকূলের কাছেও স্বামী সম্পর্কে সে এই ধারণা প্রচার করে। সন্তান লাভে ব্যর্থ প্রতিবেশীদের কেউ কেউ কামেল পীরের পড়া পানি পাবার আশায় নসিমনের দ্বারস্থ হয় এবং স্বামীর কাছে আরজি করে কাউকে কাউকে তা সরবরাহও করে।

নসিমনের অজান্তেই একদিন মায়ার দেশের পূর্বেকার চিত্রকল্প মন থেকে মিলিয়ে যায়। দ্বীনি স্বামীর সাংসারিক মনোযোগ ও আধ্যাত্ববাদী মূর্তি তার ভেতরকার যাবতীয় উৎকন্ঠা, দুশ্চিন্তা মুছে স্বামীর বাৎসরিক গৃহত্যাগকে নিয়মিত ও স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে প্রতিস্থাপন করে। সমবয়সী নারীকূলের মধ্যে বিষয়টি নসিমনের অবস্থানকে খানিকটা উচ্চে তুলে ধরে কি ধরে না নসিমন স্বামীকে নিয়ে একপ্রকার গর্ববোধ করে, যে গর্ববোধ টিকে থাকে সংসারধর্ম পালনের ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর পর্যন্ত।

ওদিকে পাক পানির বদৌলতে জন্ম নেয়া সোলায়মান পিতার স্বভাবের বৈপরীত্য নিয়ে যুবক হয়ে ওঠে। যদিও নসিমন সেদিন পর্যন্ত ছেলের যৌবন প্রাপ্তির সংবাদ পায় না যেদিন সে দেখতে পায় লাগোয়া ভিটার আসমা সোলায়মানের ঘরের বেড়ার দরজা ঠেলে বেড়িয়ে যায়। কেমন যেন শংকা অনুভব করে সে, একসময় স্বামীর কাছে গিয়ে বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরে। সোলায়মানের বাপ শোনে কিন্তু তাকে বিচলিত দেখায় না। নসিমনের রাগ হয়। সারাদিন ছেলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আর আপন মনে বিড়বিড় করে, ‘কেমন বাপের কেমন পোলা!’ পরবর্তী রাতে ঘরের পেছনে একজোড়া নর-নারীর অস্পষ্ট কথোপকথোনে গোপন অস্থিরতায় বিছানায় শুধু এপাশ-ওপাশ করে। আবছা আলোয় স্বামীর ধীর লয়ে বুকের ওঠানামা দেখতে দেখতে একসময় ফজরের আজান শুনতে পায় সে এবং এই স্থির সিন্ধান্তে উপনীত হয় যে ছেলের মুখোমুখি হবে।

সোলায়মান মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চাইতে ব্যক্তিগত বিরক্তি প্রকাশকে গুরুত্ব দেয়। ‘খালি আমারডাই দেকলা, বাবায় যা কইরা বেড়াইছে দেহ নাই?’, বলে মায়ের দিকে তাকায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নসিমন শুধু এই পর্যন্ত মনে করতে পারে যে তার এলেমদার স্বামী নাকি তাকে বোকা বানিয়েছে বছরের পর বছর। ছেলের কাছ থেকে এই অপ্রত্যাশিত তথ্য নসিমনকে হতবিহ্বল করে। নসিমন এ-ঘর-ও-ঘর করে, উঠানে যায়, বারবাড়িতে যায় বুকের ভেতর কেমন মোচড়ানো একটা ব্যাথা টের পায় সে। ত্রিশ বছরের সিন্দুক খুলে হঠাৎ বুঝতে পারে না জমে থাকা অতীত থেকে কী নেবে সে? দুয়ারে দাড়িয়ে শূন্যে চোখ মেলে লাউ-শিমের ঝোপ অথবা কলতলায় বসে বহুদিন পর আবার সে মায়ার দেশের একপাল উলঙ্গ জাদুকর-জাদুকরী নর-নারীর ফ্যাকাশে স্মৃতি হাতড়ে বের করে। ততদিনে কামরুক কামাক্ষার একমাত্র গল্পবাজ কালাচাচীও উধাও, মানে মৃত; সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সোলায়মানের বাপের মাঘী পরিভ্রমণের অভ্যাসটিও বিতাড়িত। কার কাছে জানতে চাইবে সে? একবার ভাবে হাসমতের কাছে, কেন না সারাজীবন এই মানুষটিকেই তার স্বামীর সবচেয়ে কাছের লোক বলে মনে হয়েছে তার। একবার ভাবে স্বামীর কাছেই জানতে চাইবে। যে সত্যের ইঙ্গিত সে পেয়েছে ছেলের কাছে তার পুরোটা জেনে নেবে। ভাবতে ভাবতে পুনরায় ছেলের মুখোমুখী হয়, ‘যা তা কস বাপেরে নিয়া তোর বুক কাঁপে না? কপাল কইরা জন্মাইছস এমন বাপের ঘরে।’ ‘হ হ কপালইতো, বছর বছর কই গেছে? জানি না মনে করছো?’

নসিমনের দুচোখে অন্ধকার নেমে আসে। হিসেব করে দেখে কোনমতেই সেদিন অমাবস্যা নয় কিংবা জ্বলজ্বলে সূর্যটা নিদেনপক্ষে এটা জানান দিচ্ছিল যে আর আই হোক তখন রাত নয়। সুতরাং অমাবস্যা না হলেও দিনের বেলায় অন্ধকার নেমে আসার কোন কারণই নেই; অথচ নসিমনের সামনে ত্রিশ বছরের অন্ধকার। কালো, অনুন্মোচিত এবং দুর্ভেদ্য। অদ্ভুত এক অসহায়বোধ তাকে চিরচেনা সংসার থেকে এক নিমেষে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পুরোনো, নোনা ধরা ব্যথায় সারাদিন চৌকিতে পড়ে থাকে। ফাল্গুনের নির্জলা বাতাস ঘরের এমাথা ওমাথায় পাক খেয়ে ঘুরে যায়, কিছু কাক উঠানে জটলা বেঁধে একটানা ডেকে চলে কিন্তু কোনদিকে ভ্রক্ষেপ নেই তার। গভীর এক আচ্ছন্নতায় ঠাহর করতে পারে না সকাল কি সন্ধ্যা।

ওসমান স্ত্রীকে ডাকে না কিংবা ভাবে তার শরীর খারাপ। নিজের হাতে ভাত বেড়ে খেতে বসে। ত্রিশ বছর যাবত দেখে আসা গার্হস্থ্য কাজে প্রচন্ড মনোযোগী আর আগ্রহী স্ত্রীকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়; তিন দিনের দিন বিচলিতবোধ করে। ছেলেকে মায়ের অসুস্থতার সংবাদ দেয়। বরাবরের মতো নিস্পৃহ হয়ে ঘরের কপাট টানে সোলায়মান। চতুর্থ দিন বিচলিত মন নিয়ে স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসে ওসমান। স্ত্রীকে ডাক দেয় কিন্তু সাড়া পায় না। ফাল্গুনের তপ্ত দুপুরে খুলে যাচ্ছে স্মৃতির পর্দা। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় কোন এক দূর গাঁয়ে দেখে আসা যাত্রার নায়িকা রেবেকার কথা। যৌবনে যার ছন্দবহুল শরিরী অভিব্যক্তি কোরবান করে দিয়েছিল অসংখ্য যুবকের হৃদয়। দু-দশ ক্রোশ পায়ে হাঁটার কষ্ট যার জন্যে মেনে নেয়া যেত অনায়াসে। স্ত্রীর বিস্ময়কর শয্যাগ্রহণকালে তার মনে পড়ে যায় রেবেকার জন্য কী উন্মাদনাই না বোধ করেছিল সে যা জীবন্ত ছিল এই পৌঢ় কাল অব্দি, এবং সেই উন্মাদনার সমাপ্তি ঘটে রেবেকার মৃত্যুতে। অথচ ঘরসংসার, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আপাত সংসারী জীবন পার করেছে সে। অস্থির এক ভাবালুতা আছন্ন করে তাকে।

স্ত্রীর পাশে বসে ভ্যাপসা গরমে হাতপাখার বদলে প্রশান্ত হয় সে যৌবনে ফিরে গিয়ে। কোন একদিন যাত্রামঞ্চের পাশে রেবেকার ওপর চোখ পড়েছিল। একজোড়া মায়াময় চোখই তাকে ঘোর লাগিয়ে দিয়েছিল যার ছেদ ঘটেনি এতবছরেও।

রেবেকাকে ওসমান মনের কথা খুলে বলেছিল। রেবেকা ঠাট্টাচ্ছলে উত্তর দেয়, ‘কত বেডাইতো আমারে চায়, তাই বইলা সবার ঘরে যামু নাকি?’ ওসমান আহত হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল, প্রত্যক্ষ করেছিল যুবকের আহ্বান উপেক্ষা করা নারীর আশ্চর্য সুন্দর, রহস্যময় হাসিমুখ। সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছিল যে রেবেকাকে তার পেতে হবে। অথচ আজ বয়স ষাঠের কোঠায় এসে ঠেকলেও রেবেকা শুধু তার অনুভূতির সুখ, বাস্তবে যার নাগাল পাওয়া কঠিন। হু হু করা এক দুঃখবোধ তাকে টেনে নিয়ে যায় মলিন অথচ মূল্যবান এক অতীতে। রেবেকা বলেছিল, ‘বিয়া না কইরা আর কদ্দিন থাকবা? এক পুরুষের ঘরে থাকার ভাইগ্য কি আমাগো!’

ওসমানের প্রশান্তি ওখানেই যে রেবেকা তাকে ভালোবেসে ছিল কিন্তু ভয় পেয়েছিল সমাজের চোখ রাঙানোকে, মানুষের সংকীর্ণতাকে। রেবেকা তাই চায়নি প্রথাগত সামাজিক সম্পর্কে প্রবেশ করে ভালোবাসার মৃত্যু ঘটাতে। কেন না যেসব পুরুষ তাকে হরদম ভালোবাসে তারা কেবল যাত্রামঞ্চের পেছনে তাকে জড়িয়ে ধরতে চায়; একমাত্র ওসমানই তাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল। সেও স্বামী বলে মনেপ্রাণে স্বীকার করে নিয়েছিল তাকেই। ওসমানের স্ত্রী-সংসার-সন্তান কোনকিছু থেকে নিজেকে আলাদা ভাবেনি সে। বিয়ের ছয় বছর পরও ওসমান যখন সন্তানহীন ফকিরের কাছ থেকে পানি পড়া এনে দিয়েছিল সেই।

ওসমান খুশি হয়ে বলেছিল, ‘আমার সন্তান তরেও মা কইয়া ডাকবো।’

রেবেকা সোলায়মানের মা ডাক কখনো শুনতে পায়নি এমনকি সোলায়মানেরও বাবার প্রেমিকা সম্পর্কে ততক্ষণ পর্যন্ত জানা হয়নি যতক্ষন পর্যন্ত তার বয়সীদের টিপ্পনী এবং পিতার বাংসরিক পরিভ্রমণের মধ্যে একটা যোগসূত্র সে খুঁজে পেয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে পিতার মুখোমুখি দাঁড়ানো, মায়ের মনে পিতার ঐশ্বরিক অবস্থানকে প্রশ্ন করা বা পিতার নির্দিষ্ট একটি উন্মাদনার পক্ষে-বিপক্ষে বিরাজমান বিবিধ মতবাদ এ-সবকিছুই সে কেবল অন্তরে ধারণ করে রেখেছিল এবং মায়ের সাথে আসমা কেন্দ্রিক ইঙ্গিতপূর্ণ আলাপচারিতায় উত্তেজিত হয়ে প্রকাশ করে ফেলে।

চারদিনের দিনও যখন নসিমন বিছানা ছাড়ে না সোলায়মান তখন খানিকটা উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ে; কিছুটা অপরাধবোধও তাড়িয়ে নেয় তাকে। আসমা আসে, সাড়া না পেয়ে চলে যায়। কী পণ করেছিল নসিমন নিজেই জানে। শুয়ে শুয়ে স্বামী-সন্তানের আসা-যাওয়া দেখে কিন্তু নড়ে না। বিগত সময়ে সংসারে তার অবস্থান আর অপরিহার্যতা নিয়ে ভাবে। ক্ষয়ে যাওয়া এক অস্তিত্ববোধ গ্রাস করে তাকে। দুপুরের পর যখন ওসমান কবিরাজ ডাকতে যায় সোলায়মান মায়ের পাশে গিয়ে বসে। মায়ের শক্ত মুখ, আধবোজা চোখের তিরতির কাঁপন সোলায়মানের কেমন অচেনা লাগে। নসিমন কোন আওয়াজ করে না। সোলায়মান ভীত চোখে বাইরে তাকায়, বিকেলের আলো মরে আসতে শুরু করেছে, দুটো কাক তখনও উঠানে খাবার খুঁটে খাচ্ছে। কে যেন তার মনের ভেতর জানিয়ে দেয় তার মায়ের যে অসুখ, এ বড় শক্ত অসুখ, কোন কবিরাজ-বদ্যির সাধ্য নেই এ রোগ সাড়ায়।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত