এই সময়

ধানমন্ডি ৩২ নং এর এক সন্ধ্যায় ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে পায়চারী করছে একজন পুরোদস্তুর সাহেব। পরনে হ্যাট, কোট, প্যান্ট, বুট জুতা, দেখতে কৃষ্ণকায়। বুঝা যাচ্ছে তিনি কারো অপেক্ষায়।

হ্যালো মিঃ ডাট! বলে একজন অন্ধকার ফুঁড়ে বের হয়ে এলেন।

হাই কিশোরীচাঁদ! এসি পড়েচ! তোমার দাদা এলেন না যে!

ওইতো রিক্সা থেকে নামচেন। আমরা একসাথে এসেচি।

প্যারীচাঁদ মিত্র হাস্যোজ্জল মুখে হ্যান্ডশেক করলেন।

সরি মিঃ ডাট! একটু দেরী হলো। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ। আচ্ছা আর কাহারো কি আসিবার কতা?

হ্যাঁ ঈশ্বরচন্দ্রের আসিবার কতা। তিনিইতো জরুরী আসরের তলব করিলেন। আর তাহা ছাড়া অনেকদিন আসর হয়না। দক্ষিনারঞ্জনের আসিবার কতাও শুনেচি। নিশ্চিত নই। ঠিক আসিবে কিনা।

এসময় লাইটপোস্টের আলোয় দেখা গেল ঈশ্বরচন্দ্র হনহন করে আসছেন।

প্রণাম মিঃ দত্ত! কেমন আচেন আপনারা?

কিশোরীচাঁদ আর প্যারীচাঁদকে একসাথে দেখে বললেন কী সৌভাগ্য দুই সহোদর একসাথে!

মধুসূদন বললেন ঈশ্বরচন্দ্র আপনার পেছনে লাঠি হাতে শক্তপোক্ত ঐ লোকটি কে ?

ওহ! ও হচ্ছে ছিরি। শ্রীমন্ত। বাবা লাঠিয়াল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সেই যে বিধবাদের বে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করলুম। অনেক ব্রাহ্মণের শত্রু বনে গিয়েছিলুম। সেই থেকে ছিরি আমার সঙ্গী। এখন এই বঙ্গ দেশেও সে আমাকে ছাড়চে না। ওকে এখন কে বুঝাবে এসব আর প্রয়োজন নেই। আচ্ছা প্রায় সবাই যখন এসে গিয়েচে চলুন লেকের ধারে কোথাও বসি।

মধুসূদন বাগড়া দিলেন। এখানে মশা মাছির উপদ্রপ। তাছাড়া কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তারচে বরং পানশালার সন্ধান চলতে পারে।

প্যারীচাঁদ বলে উঠলেন শুনেচি এখানে একটা রেস্তোরাঁ আচে – এরাম।

মধুসূদন ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন হে রাম!

যাক এরকম জায়গায় এমন পানশালা জুটবে মধুসূদন কল্পনাও করেনি।

মধুসূদন, প্যারীচাঁদ আর কিশোরীচাঁদ দর্শনার কেরুর ভদকা নিয়ে বসলে ঈশ্বরচন্দ্রের চাউমিন নেয়া ছাড়া আর উপায় থাকলো না।

প্যারীচাঁদ বলে উঠলেন বুঝলেন মিঃ ডাট! সেবার বাগানবাড়ির আসরে আমার উপন্যাস “আলালের ঘরের দুলাল” নিয়ে কত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিলেন! বলেছিলেন এসব ছোটলোক চাড়ালের ভাষায় কি সাহিত্য রচনা হয়? অথচ এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে দেখুন আপনাদের তথাকথিত উচ্চমার্গীয় কটমটে সাহিত্যের অবস্থান আজ কোথায়?

মধুসূদন তার হ্যাট খুলে ফেললেন। মনে হয় পেটে দুই পেগ পড়ামাত্রই গা গরম হয়ে গেছে। তার পুরো বাঁকানো গোঁফের ফাঁক দিয়ে মিষ্টি হাসির বিচ্ছুরণ ছুঁড়ে বললেন হুম তা বটে! কিন্তু মানুষ এখনো ভদ্র পল্লীতে বা পার্টিতে ভদ্র পোশাক পরে কেনো যায়? লুঙ্গি গামছা জড়িয়ে গেলেই পারে।

কিশোরীচাঁদ মধুসূদনের পক্ষ নিয়ে বললেন হ্যাঁ তাইতো। ছোট লোক চাড়ালদের ভাষা যদি সাহিত্যের ভাষা হয় তবে ছোটলোকের পোশাকই হোক ভদ্র পল্লীর পোশাক।

মধুসূদনের নেশাটা মনে হয় একটু চড়ে বসলো। কণ্ঠে সুরার গাড় মাদকতা ছড়িয়ে বললেন আর বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস কী যেন নাম! যেটি আপনি রচনা করেছেন! পূর্বেও বলেচি এখনো বলচি বাংলা অতি কুৎসিত ভাষা। এটিকে সংস্কৃত দিয়ে না মোড়ালে ইহা দিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয় অতি দুর্গন্ধযুক্ত সে সাহিত্য আপনারা সেটি আলালী ভাষা বললেও আমি বলি চাড়ালি ভাষা।

প্যারীচাঁদ মিত্র মধুকে স্কুল থেকেই চিনেন। ভীষণ বুদ্ধিমান, উদ্ধত আর গোয়ার। মধুসূদনকে আরেকটু তাতিয়ে দেয়ার জন্যই বললেন। আপনিতো বিলাত যাবার জন্য খ্রিস্টান হয়েছিলেন। মিল্টনের অনুকরণে কাব্যও রচনা করেছিলেন। যদিও সেটা তেমন কেউ গিলেনি। আবার বাঙ্গালী মেয়েদের বেমালুম উড়িয়ে দিয়ে নীলকর সাহেবের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। পরবর্তীতে আরেক ফরাসী মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলেন। এত সাহেব বাবুর ঠমক দেখিয়ে আবার সেই বাংলাতেই ফিরে আসলেন! তাও শূন্য হাতে! নিজের যা আছে তাই নিয়ে গর্ব করা উচিৎ নয়কি!

এসব বাক বিতণ্ডার মাঝখানে ঈশ্বরচন্দ্র ভুল করে চাউমিনে থাকা একটা কাঁচামরিচ চিবিয়ে খেয়ে ফেললেন। এখন ঝাল নিবারণের নিমিত্তে মধুসূদনের গ্লাসে থাকা ভদকা পেটে চালান করে দিয়ে আরেক ভুলের সূত্রপাত করলেন। তার এখন ত্রাহিসুদন অবস্থা। ছিরিকে পাঠিয়েছেন এক বোতল ঠাণ্ডা পানির জন্য।

প্যারীচাঁদ দেখলেন মধুসূদন ঝিম মেরে আছেন। ঈশ্বরচন্দ্রকে বললেন তা আজকের এই আড্ডার কী নিমিত্ত? কোন বিশেষ কিছু?

ঈশ্বরচন্দ্র ঠাণ্ডা পানিতে চুমুক রেখে বললেন আপনিতো ভালো করেই জানেন যে বিধবা বে প্রচলনের জন্য আর স্ত্রীশিক্ষা চালু করণের জন্য আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েচে। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের সেই সময়ে যেতে হয়েচে। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে সাক্ষর নিয়ে জনমত তৈরি করতে হয়েচে। নারীদের জীবন ছিল পশুর থেকেও নিকৃষ্ট। তৎকালীন হিন্দু নারীদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রথম ধাপ ছিল সতীদাহ প্রথা বন্ধ করা। তারপর বিধবা বে প্রচলন করা। স্ত্রীশিক্ষা চালু করা। কিন্তু এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে শুনতে পেলুম মেয়েদের স্কুল-কলেজ যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। তাদের নাকি ক্লাস ফোর ফাইভ পর্যন্ত পড়লেই যথেষ্ট।

প্যারীচাঁদ অবাক হয়ে বললেন আপনি এসব তথ্য কোতায় পেলেন?

কেনো পত্রিকা পড়েননি! মাওলানা শফি হুজুর বলেছেন।

হু ইজ ড্যাট শাফি হাজুর! মধুসূদনের ঝিমানি ছুটে গেছে। তিনি চামচ দিয়ে কিছু কাঁচা ছোলা আর চানাচুর মুখে পুরে বললেন ঈশ্বরচন্দ্রবাবু শুনেন একটা কথা বলি খুব মন দিয়ে শুনেন। যে বঙ্গ দেশের নব্বই দশক থেকে সবগুলো প্রধানমন্ত্রীই নারী সেই দেশে কোনো হুজুরের কথায় এসব আলাপ প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি আপনার গদ্য সাহিত্য নিয়ে কিছু বলতে চাইলে বলুন। আমরা সুরা পান করতে করতে শুনি।

ঈশ্বরচন্দ্র বললেন বাংলা গদ্য রচনার শুরু সেতো আরো আগে থেকেই। তবে যখন শকুন্তলা প্রকাশিত হলো তখন সাহিত্য সমাজে ধন্য ধন্য রব পড়ে গেল। সবাই এক যোগে বলতে লাগলো শিল্পগুণবিবর্জিত নীরস গদ্য থেকে বাংলা সাহিত্য যেন পরিত্রাণ পেল।

আড্ডা জমে উঠতে না উঠতেই পানশালার ম্যানেজার এসে জানালো এখনই দোকান বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় থানা থেকে জরুরী নোটিশ দেয়া হয়েছে। আশেপাশে কোথাও ঝামেলা হচ্ছে।

মধুসূদন খুব বিরক্তি প্রকাশ করতে করতে মাথায় হ্যাট পরলেন। বললেন চলেন সবাই। আজকের মতো আসর মূলতবি ঘোষণা করা হইল।

ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা রাত তিনটা ছুঁয়ে ফেলেছে। ধানমন্ডি ৮ নং এর রাস্তা ধরে চারজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। তাদের সাথে একজন লাঠিয়াল। অসংলগ্ন তাদের পথচলা। আকাশে একটা থলথলে চাঁদ সোডিয়াম লাইটের আলোতে ম্লান মুখ করে তাকিয়ে আছে। কোত্থেকে টহল পুলিশের একটি গাড়ি এসে তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল।

দুইজন পুলিশ কনস্টেবল গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল কেউ এক পা এগুবে না। দাঁড়াও। একজন খুব কাছে এসে বিড়ালের মতো শুঁকে শুঁকে তাদের দেখছে। মুখে তার দিগ্বিজয়ের হাসি। গাড়ির বড় স্যারকে উদ্দেশ্য করে বলল স্যার পাওয়া গেছে। সবগুলা মাল খাওয়া। চল মুকসেদ থানায় চল বলে সবাইকে গাড়িতে উঠার নির্দেশ দিল।

হ্যাট পরা কালো সাহেব বলে উঠলেন মুকসেদ! হু ইজ ড্যাট গাই! আই এম মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

ওসব আলাপ রাখ। আগে থানায় চল। তারপর কয়েক ঘা খেলেই বাইর হইবো কে মধু আর কে সূদন!

ধানমন্ডি থানার ওসি মোকাররম সাহেব মহা বিপাকে পড়েছেন। কাল রাতে টহল পুলিশের দল যে পাঁচজনকে ধরে নিয়ে এসেছে তাদের একজন মধুসূদন দত্ত, একজন প্যারীচাঁদ মিত্র ছদ্মনাম টেকচাঁদ ঠাকুর, একজন কিশোরীচাঁদ মিত্র আর একজন লাঠিয়াল সহ নিজেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলে দাবী করছেন। সাহেবমতো দেখতে কোট হ্যাট পরা মধুসূদন দত্তের পকেটে বেশকিছু ইয়াবা পাওয়া গেছে। যদিও সে এই বস্তু সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত