দিনের পথে দিন

পুব আকাশটা আলো ছাড়ছে । বাড়ির চারপাশের উঁচু-ঘন গাছপালার পিছন দিকটা থেকে নবজাতকের জন্মের মতোই রোদের শরীর; কচি কচি সোনা মাখানো। কমলা, হলুদ তারপর সাদাস্রাবে ভেসে যেতে যেতে বায়বীয় ঘর। তারপর সূর্যবাবুর মুখ দেখা যায়। সাদা রস্মির হাত পা ছড়িয়ে তিনি কর্ম কাণ্ডের উপযোগী হচ্ছেন। বড় বড় নারিকেল সুপারি তাল গাছের ছায়া শুয়ে থাকে উঠুন জুড়ে। হেমন্ত বাতাসে কাঁঠালিচাপার মিষ্টি গন্ধের সাথে ভুস করে নাকে ঢুকে গোবরের গন্ধ। উঠোন গোবর মাটি দিয়ে লেপা হয়েছে। বেশকিছু শুকনো আম, জাম, নারিকেল ফুল, কাঁঠাল পাতা উড়ে এসে পড়ছে, কিছু উড়োবালি।

লীলাবতী উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে; হাতে নারিকেল শলাকার বানানো নতুন ঝাড়ু এমন ঝাড়ু দেখলে কার না ইচ্ছে করে সরাৎ সরাৎ করে উঠান সাফ করে! দুই ঘরের ফাঁকের দোহাইন্দসহ ঝাড়ু দেয় লীলা। সকালের বালুতে মাখা থাকে কুয়াশা তাই বেশি উড়ে না। প্রতিদিনের নিয়মিত কাজের থেকে আজ একটু ভিন্ন কাজ; ভিন্ন আমোদ এ বাড়ির সকলের মনে। আজ আমন ধান কাটা হবে। কতদিনের অপেক্ষা! ধান পেকে ঝুরঝুরে। না কাটলে কালই ঝরা শুরু করবে। ধান ঝরলে শুরু হবে ভাগ্যের অলক্ষুণে কাল। লীলাবতীর বাপ ও ময়না ভাই সুরুজ উঠার আগে ঘর ছেড়েছে। মা বিসমিল্লাহ পড়ে লীলাবতীর হাতে তুলে দেয় নতুন শলার ঝাড়ু পূব-উত্তরের কোণায় ধানের আঁটি পারা দেওয়া হবে। তারপর মলন। মলন গরুর তাড়ানোর হাইট হাইট আর বাড়ি জুড়ে উৎসব খাবার-দাবার ছোটরাও ব্যস্ত ফাই-ফরমাসে। এবাড়ি ওবাড়ি থেকে অনেকে এসে উৎসবকে উসকে দেয়। সোরগোল গল্পগুজব আর ধান-ধান গন্ধে দক্ষিণের মাঠটাই যেন বাড়িতে উঠে আসে। কেউ বা মাড়াই লওয়া নাড়ার উপরই বিছিয়ে দেয় ক্লান্তির ঘুম।

লীলাবতীর মন নেই নিকনোর কাজে। চোখ উঁচু-গাছদের পেছনে। যেন আকাশের রঙটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। যেন অন্য রঙ ধরেছে আকাশটা। চোখ দুটো রগড়ে নেয়। রাতে তো ভাল ঘুমই হয়েছে। ঝিলমিল ঝিলমিল। কখনো হলুদ কখনো গোলাপি। পাখিদের নিত্য নৈমিত্তিক ডাকও বেশি মিষ্টি মাখা, দূরের দিকে ডাকে, উদাস করে। মাকে জিজ্ঞেস করবে? আজ অন্য কথা শুনবে না কেউ। ‘বালাই বালাই মন আয় তোর কাজে।’ টানাটানি করে কাজ সারতে সময়ের চেয়ে বেশি সময় নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে লীলা। ক্ষুধায় পেটে ডাক দিতে শুরু করেছে…

প্রতিদিনের মতো পানিভাত ভাগ করে চার ভাগে বেড়েছে মা টিনের থালায়। বাবাও ময়না ভাই ভাত খেয়ে কাজে গেছে। ময়না পাশের বাড়ির জমির জ্যাঠার ছেলে। তারা বড় ভাই ডাকে। থালার কিনারায় একটু লবন ও একটুখানি পেঁয়াজ মরিচের ভর্তা এ-ই বেশিদিন; কোনদিন আলুর ভর্তা, পোড়া বেগুনের ভর্তা। মাঝেমাঝে চালের কণার সাদা জাউ। তাও ভর্তা দিয়ে খাওয়া হয়। মাসে একদিন খিচুড়ি ডিম থাকলে ডিম ভাজি দিয়ে খায়। ডিম বেশিরভাগ রান্না হয়-সিদ্ধ করে পেষা-নারিকেল তরকারি। ভাতের দিকে তাকিয়ে লীলা বেঁকে বসে। আরও কোন সুস্বাদু কিছু খেতে চাইছে মন। উঠানের কাজে দেরি দেখে মা এমনিতে চটে আছে। ‘খামু না’ বলতেই ধুম করে পড়ে পিঠে ভাদ্রমাসের তাল। ‘ও মাগো ও বাবাগো-মাগো লীলা ক্ষুধা নিয়ে, অস্থির মন ও শরীর নিয়ে বাগানের দিকে দৌড় দেয়। মা আহত হয়। কী অলুক্ষণে কাজটা করল! ঘরে লক্ষ্মী আসবে। আজ আনন্দের দিন। কোথায় কোন বাঁশি থেমে গেল–

ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্কভাবে নয় বছরের বটু আর ছয় বছরের মিঠুকে ডেকে ভাত দেয়। ভাত আর পানির ভেতর হাত ডুবিয়ে ডুবিয়ে নাকের নস্যির সাথে মিশিয়ে তারা খায় কোন কথা না বলে। মা গলা উঁচিয়ে, ‘লীলা ও লীলা কপালে তোর শনি আছে রে- অলক্ষী মাইয়া’। মায়ের খিস্তি শুনে টলতে টলতে ফিরে আসে। ভাতের থালা নিয়ে পিঁড়ির একপাশে বসে। কোনোমতে ঠেলে ঠেলে গলায় ঢুকায়। হাত কাঁপে, হাঁটু দিয়ে চেপে ধরা স্তনে ব্যথা পায়। আবার নড়ে চড়ে বসে। ছলকে পড়ে কিছু ভাতের পানি। মাটিতে সে ভর্তা-ভাতের পানি কালো দাগ রেখে দেয়। সারাদিন ব্যস্ততা আর সোরগোল। তিনজন কামলা আর বাবা-ভাই। দশ বিঘা জমির ধান আনতে আনতে দিন চলে যায়। কামলাদের দুপুরের ভাত খাওয়ানো হয়। ঘরের খাবার আজ খুব ভালো। কাতল মাছ আর কাঁচাকলার তরকারি। হেলন বিচি আর নারিকেলের সীমা-ডাল। মিষ্টি কুমড়ায় গুড়াচিংড়ি । বাচ্চাদের মনেও খুশি। সবাই কাজ করছে। বটু আর মিঠুর কাজ ধানের মোরগ তাড়ানো। ধানের আঁটির মাথাগুলো ভিতরের দিকে গোল করে উঁচু পারা দেয়া আছে। মোরগ যে কিভাবে ধান বের করে আনতে পারে! তাদের বুদ্ধির শেষ নাই। নয়ত উড়ে উপরে উঠে যায়। একটা বাঁশের মাঝারি কঞ্চি নিয়ে পারার চারদিকে ঘুরছে দশ বছরের বটু আর পিছে পিছে ছেঁড়া চেইনের একটা পেন্ট হাত দিয়ে ধরে দৌড়ছে মিঠু। মা এক ফাঁকে একটি বাটিতে পাঁচ-ছয়টা মুড়ির মোয়া দিয়ে যায় সাথে কুড়ানো নারিকেল। লীলা ঝরা ধানের ছড়া কুড়িয়ে কুড়িয়ে ছোটমতো একটা বাঁশের টুকরিতে তুলছে শুকনো সুপারি পাতার মুঠো ঝাড়ু দিয়ে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারা খায় আর সুর করে গায়: উঠানে ধান, পাটিতে ধান ধানের উপর ধান/ধান বেইচ্চা মাইয়ারে দিমু বিয়া/রাখমু বাপের মান।

সন্ধ্যায় শুরু হয় মলনের কাজ। দুটো কাল ষাঁঢ় , উঁচু গলা। গলার ঘণ্টি বাজিয়ে ঘুরে ঘুরে তাদের মালিকের নির্দেশ মতো ধান মাড়াই করে। তাদের মুখে বেড়ী বাঁধা। উঁচু বাঁশের আগায় হেজাক বাতি দিয়ে বাড়ি আলো করা। বাবা আর বড় ভাই ধান গাছ নেড়ে চেড়ে দেয় তাদের ঘুরন্ত পায়ের নীচে, ঝরে গেলে নতুন ধান পাতে। একেবারে ঝরে না ধান- ছড়ার কোথাও না কোথাও রয়ে যায়। এগুলো আবার বেছে বেছে নয়ত সব একত্রে জড় করে মা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আলগা করবে কাল। এত ব্যস্ততার ভেতর প্রায়ই লীলার খোঁজ পড়ে। বিনিময়ে ধমক ধামক আর নালিশ। সবাইকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। এমন কাজ নিয়ে সরে থাকে যা থেকে দূরে থাকা যায়। আর কাজও হয় না সবার মনমতো। লীলা প্রাণপণ চেষ্টা করে মনোযোগ ধরে রাখতে। কোন দূরের পাড়ভাঙা সুর তার চেনা পদচালনাকে অচেনা করে দেয়। খুব গোপনে, সবার অলক্ষ্যে এক জটিল বেদনাবোধ ছোট মনটিকে সাপের প্যাঁচের মতো শক্ত করে ধরে থাকে। কয়েকদিন ধান শুকানোর কাজ চলে। তার থেকে চিটা বের করে তবে পরিষ্কার ধান গোলায় ঢুকে।

ধীরে ধীরে ভারী কাজ কমে আসে। জীবন স্বাভাবিক হয়। লীলা ছাগলদুটো নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। বনে বনে পাতা কুড়ায়, সুপারির ঝরে পড়া খয়েরি বাইল যোগাড় করে, শুকনা লাকড়ি খুঁজে আনে। মা খুশি হয়। লীলা একটু বড় হলে বটুই করত এসব। কতই আর বয়স– বার কি তের হবে। মনে মনে কথা বলে মা, আজকাল মেয়েরা ঘরে বাইরে কাজ করে। অনেকদিন ধরে বটু স্কুলে যাওয়ায় তার এসবের কমতি দেখা দিয়েছিল। কিনতে শুরু করেছিল প্রায়। নারিকেলের শুকনা পাতা শেষ হয়ে গেছে, পাটের কাঠি কিনবে কিনবে করছে। আর এখন উঠান ভরে যায় লাকড়ি আর সুপারির ঝরা ডোগায়; এগুলোকে বাইল বলে তারা। বাইলগুলো টানা বাঁশের উপর সারি সারি করে রাখে। খুব বড় খোল কেটে নেয়, নৌকার মতো বানায়। এটা ছাই ফেলতে নয়ত মটকায় ধান ভরতে কাজে লাগে। নারিকেলের দু’একটা ডোগ্গা পায়। এটা দেখলে খুব খুশি হয় মা। এটাতে দু’টাই মেলে; পাতা ও গোড়া। এ গোড়াটারও একটা নাম আছে গোদা। গোদাগুলো কেটে ছেটে উঠানে চুলার পেছনে বেড়ার সাথে রাখে খাড়া করে। একটু ভেজা স্যাঁতস্যাঁতেগুলো রান্নাশেষে চুলার উপর দেয়। লীলাকে ঘরের কাজ নিয়ে আর বিরক্ত করে না। নিজেই করে–উৎসাহ নিয়ে করে। লীলার চঞ্চল মন বনের আধো আলো আধো ছায়ায় নিজের মনের অতল খুঁজতে থাকে। কী হয়েছে তার কিছু তো হয়েছে? কিছু হারানোর বেদনা বা না পাওয়ার ব্যথা!

ঢেঁকিতে ধান ভানার দিনে লীলা ঘরে থাকে। সপ্তাহে দু’দিন বাজার। মাছ কাটলে মা’র সাথে বাতি ধরে পুকুরে মাছ ধুতে যায়। তাও ফোঁস ফোঁস করে বড় নিশ্বাসে নিভিয়ে দেয়। রতনা নয় মমিনদের ঘর থেকে বাতি ধরিয়ে আনে। তাকে দেখলেই মমিন মিষ্টি হাসে। মমিনের হাসি কেমন যেন শরীরের ভেতরে ঢুকে যায়। মমিন্যা কী কোন যাদু শিখেছে! মা একটু চিন্তিত হয়। মেয়ে বড় হচ্ছে। বেশি হুশ দরকার। পরের বাড়ির ভাত কম হুশে কি গেলন যায়? কত চড় থাপড়, কত চোখা চ্যাপ্টা কথা তীরের মতো, বিছার হুলের মতো জ্বালাতে থাকে। এক কাজের পিঠে জোঁকের মতো লেপ্টে থাকা আরেক কাজ; কান্নার ফুরসৎও মেলে না। ঘরের কাজ কিছুটা করে দিয়ে লীলা নিয়মিত বাইরে যায়। বন বাদাড় তার ভাল লাগে। ঝোপঝাড় গাছপালা। একটা নারিকেল গাছে প্যাঁচ দিয়ে রেখেছে একটা আম গাছ। আম গাছ বেয়ে নারিকেল গাছের ভেতর পাখির ডিম দেখে। কাঠ ঠোকরায় গর্ত করেছে, পাখিরা সে গর্তে ডিম পাড়ে। বেশিরভাগই শালিক নয়ত টিয়া। ডিম ফুটলে বাচ্চা কী সুন্দর তুলার মতো! বাচ্চাদের চোখ নাই। হা করে লীলার আঙ্গুল খেতে চায়। ততক্ষণে মা পাখিও চলে আসে। লীলা নেমে যায়। একদিন গর্তে হাত ঢুকিয়ে দেখে সাপ না গুইসাপ কি যেন ঘুরছে। লীলা ভয় পেয়ে তড়িগড়ি করে সরাৎ সরাৎ নামে। দূর থেকে মমিন দেখতে পেয়ে মায়াভরা কণ্ঠে বলে, কিরে দুখ পাইলি? মমিনের কথা তার বুকে একটু মোচড় মারে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে চায়। ‘মমিন রে দেখলে বুকটা এমন করে ক্যান!’ কোন কোন ছেলে শিস মারে। লীলা হাতের দাও দিয়ে গাছে জোরে ঠুকে দেয়। ছেলেরা সরে যায়। পরিচিত কেউ কথা বলতে আসলে ‘তোমার কামে যাও।’ লীলার ধমক খেয়ে সরে যায়। ইতিমধ্যে বাঁশঝাড়ের ভেতর একটি জায়গা করে নিয়েছে।

ছাগলগুলো ক্ষেতে খুঁটি বদল করে শুকনো বাঁশপাতার ভেতর চলে আসে। বসার ঘর, বিছানা। দুটো বাবুইয়ের উড়ে আসা বাসা রাখে একপাশে। চারদিকে ঘনঝোপ। আসাম লতার ঝোপ এত গভীর যে একটু দূরে চিকন হাঁটার রাস্তা দিয়ে কেউ গেলেও তাকে দেখা যাবে না। শাড়ীর কোঁচে করে মুড়ি আনে। শুয়ে বসে তাই চিবোয়। কেউ ধমক ধামকের নেই। বাতাসে বাঁশগাছ একটার সাথে একটা লেগে খটাখট শনশন কত রকমের শব্দ । কুঁরুর কুঁরুর পুকুরের মাছ নিয়ে উড়ে যায় কুরুয়াল। ঝুরঝুর করে বাঁশপাতা পড়ে। গান ধরে, ‘বাঁশবাগানে বাঁশের পাতা ঝুর ঝুর করে। ও মাগো তোমার কথা কত মনে পড়ে।’ না কেউ যদি শোনে আর দেখে এ জায়গা- সব আরাম হারাম হয়ে যাবে। চুপ থাকে, চুপ থাকতেও ভাল লাগে। ঘনঝোপের গাঢ় স্নিগ্ধতায় লীলার মনে আলতো প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। চঞ্চল চোখ দুটি বুঁজে সে স্পর্শ মেখে আরও রঙিন আরো মধুরতম কী যেন ভাবে নিজেই জানে না! কয়েকদিন পরে দুই লীলার সমান উঁচু বাঁশের উপর ভিমরুলের চাক। ব্যস্ত ভিমরুলের আসা-যাওয়া। লীলা কাঁপে। এখানেই বটুরে গতবার বাসা ভাঙায় ভিমরুল বেড় দিয়েছে। সে কী অবস্থা-বটুর! শরীর দেখা যায় নাই! গায়ের সাথে আটকে আটকে রয়েছিল কালো ভিমরুল। বটুর চিৎকারে নন্দনপুরের মানুষ এক হয়। লীলার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তাকেও যদি শত্রু মনে করে। ‘না সোনামণিরা আমি তোমাগো কোন ক্ষতি করমু না। আমি অসহায় মাইয়া মানুষ সবাই আমার ক্ষতি করব– রেণু ভাবীর কথা নকল করে। না তোমরা করবা না। ‘নিরীহ পোকা মাকড়’ মধু স্যার বলতেন। ‘বাবারা তোমরা কি নিরীহ যে বিষ তোমাদের ঠোঁটে’! না তার দিকে কেউ তেড়ে আসে না। লীলা তাকিয়ে থাকে। বোঁ বোঁ গোঁ গোঁ শব্দ করে কি যেন বলে।

সে আগে আগে বেরিয়ে আসে। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলেছে। তবে বেশ রোদ আছে। ছাগলের খুঁটা তুলে দেয়। দু’টো ছাগলেরই বাচ্চা হবে। পেট বেশ ভারী হ’য়ে আছে। একটা গুটুস-গাটুস ছোট্ট ছাগল আর একটা রাম ছাগল। ছোট্ট ছাগলটা বর্গাদারের কাছে ছিল। ছাগলের দু’টি বাচ্চা হলে একটি আর একটি হলে বাজারে বাচ্চার দাম যা হবে তার অর্ধেক বর্গাদার মালিককে দিবে। কিন্তু নিয়মমতো ছয়মাস পার হবার পরও না ডাকায় বর্গাদার ছাগল ফিরিয়ে দিয়েছে। তার কথা ছাগলের বয়স হয়েছে। কিন্তু ফিরিয়ে দেয়ার একমাসের মাথায় ছাগল ডাকছে। এ ডাকার মানে তাকে নিয়ে যেতে হয় কোন পুরুষ ছাগলের কাছে। এখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী; বাচ্চা দিতে আরও এক মাস বাকি। রাম ছাগলের চার মাস চলছে বাচ্চা দিতে আরও দু’মাস বাকি। ছাগলের রশি ধরে ধরে আলের পাশের ঘন ঘাস খাওয়ায়। ছাগলগুলো পুত পুত করে চিকন- মোটা ঘাস, তিতলি ও থানকুনি পাতা খায় খুঁটে খুঁটে। লীলার ভালো লাগে। ছাগলের বাচ্চা তিড়িং বিড়িং করে লাফ দেবে। ঘাড়ে উঠবে, কান বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে নাচতে নাচতে আগে পিছে দৌড়বে। তার অর্জিত লাকড়ি, বাইল ভেতর বাড়ির উঠানে রাখে আর ‘মা মা’ করে ডাক দেয়। মা মাটির পৈঠায় সন্ধ্যাবাতি পরিষ্কার করতে বসেছে। মাকে আগের মতো খুশি হতে না দেখে মন খারাপ করে আবার চলে যায়। এক স্তূপ ঝরা পাতা জড়ো করেছিল তার ইচ্ছা হয় না আনার। খুঁটায় খুঁটায় জড়িয়ে বনের ভেতর দু’গাছের দু’দিক দিয়ে আসতে গিয়ে ছাগল দুটো গাছের সাথে আটকে আছে। কেমন অভিমানে ভার হয়ে আসে মন। অন্য কোনো দিকে চলে যেতে ইচ্ছে করে। দূর পাহাড়ের কোন অচীন গুহায়। মনে পড়ে এ সময়ে স্কুল থেকে ফেরার কথা। কত আদর করে মা ভাত বেড়ে দিত, জমিয়ে রাখত দিনভর কতরকম খাবার। স্কুল গেল, সবই গেল। লীলা তো লেখাপড়ায় ভালই ছিল। কোনদিন মার খায়নি, অংকে একটু কম নম্বর পাওয়াতে পঞ্চম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়েছে। এবার ক্লাশ সেভেনে উঠত। অংকে আরও ভাল করবে কিভাবে ভাবছে আর পরদিন বাবা বলে, ‘লীলা তোর আর স্কুলে যাওনের দরকার নাই। বাড়িত মেলা কাম তোর মা একলা কুলায় না’। সেই থেকে লীলা ঘরের কাজ করে সকাল-বিকাল-রাত। সেই থেকে লীলা এক সাধারণ ঘরের মেয়ে। যার শুধু আছে কাজ আর শাসন। নিজের কথা বলার সময় নাই, তার কথা শোনারও কারও সময় নাই। কাজ ছাড়া আর থাকবেই বা কোন কথা। স্কুলের ঘণ্টী শুনলে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বাড়ির কাছের স্কুলে এসে অন্যগ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়ে। অন্যবাড়ির ও এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা যখন গল্প করতে করতে যায়। লীলা টিনের বেড়ায় কান পেতে শোনে। দৌড়ে রান্নাঘরের মুলিবাঁশের বেড়ায় বুক পাতে। স্কুলের আনন্দঘন দিন তার মনের ঢোলে বাড়ি মারে। মন কেঁদে কেঁদে ওঠে, আমাকে নাও– আমাকে নাও– আমিও স্কুলে যাব।

সন্ধ্যা পুরুপুরি জমে এসেছে। ছাগলগুলোকে ছুটিয়ে দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ধ্যার ধূসরতা তার মনে এসে বসে। ক্ষুধা, ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে আসে, মাথাটা শূন্য। রাগে দুঃখে জমতে থাকে ক্রোধ। একঠায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ। পুকুরের আরেক পাড়ে কেউ কুপি নিয়ে ঘাটে আসে। লীলার মনের আলো কেড়ে জলের ভেতর কুপির আলো ঢেউ তুলে। লীলা পানিতে ঝুঁকে পড়া নারিকেল গাছে পা ঝুলিয়ে বসে। পায়ের পাতা পানির ভেতর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কুপিওয়ালীরা চলে যায়। এ বিশ্ব-প্রকৃতির গাঢ় অন্ধকার তার উপর চেপে পড়ে থাকে। শুনতে পায় না অনেকক্ষণ ঝিঁঝিরা ডাকছে তারস্বরে আরও দূরে শেয়াল, কক কক করে বনমোরগ কঁকিয়ে উঠে– শেয়াল বা বেজি তাড়া করছে।রাস্তার পাশে কলারমুড়ায় কেউ দাঁড়িয়ে- স্থির। জলভেজা চোখ মুছে ভাল করে তাকায়। কে কে? বেটি মানুষের গড়ন। ‘ও বাবা ও মা’ চিৎকার করতে চায়। কোন স্বর বেরোয় না। এই বুঝি পেত্নী তাল গাছের মতো উঁচু হয়ে দু’পা ফাঁক করে বলবে, ‘যা আমার পায়ের নীচ দিয়ে।’ যেতে গেলেই বগার ঠোঁটে পুঁটিমাছের মতো চিপে শেষ করবে তাকে। টেনে টেনে পড়ে ‘ক্কুলহু আল্লাহু আহাদ। আল্লাহুচ্ছামাদ…’ ‘ফুঁক ফুঁক’ জামার গলা তুলে ফুঁ দেয় বুকে ও পেত্নীটাকে। দোয়ায় কোন কাজ হয় না। লীলা কি পানিতে ঝাঁপ দেবে? ভূতের পানিতে সাঁতার কাটার কোন গল্প সে শোনেনি। শুনেছে রাক্ষসের নদী সাঁতারের গল্প। অনড় ভূত ফস করে ম্যাচের কাঠি জ্বালে। ঘন-সুপারি বাগানের কুয়াশার ভেতর লীলা দৌড়ে এসে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার ছোট বুকটি কাঁপছে ধুপধুপধুপ।উঠতি বয়সি এ মেয়েটির মনের নানা জটিলতা পরখ করে বিহ্বল মাতা কাঁদে ঝরঝর। ভয় পাওয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরেই ঘরে আসে। তখনো বাবা হাট থেকে ঘরে ফেরে না। অতি ভারী স্বামীর সামনে এক নীরিহ বোকা হয়ে থাকা ছাড়া আর কী করতে পারে মা! কার সাথে কথা বলবে! এত ব্যস্ততা, এত কাজ এর ভেতর এ জটিলতা তার মনকে শামুকের খোলসে গুটিয়ে রাখে।

মাঘ মাসে লীলার দুটো ছাগলই উনত্রিশ দিনের ব্যবধানে তিনটি তিনটি ছয়টি বাচ্চা দেয়। এত মায়ামুখ, আদরে আদরে চোখ। এত সোনাময় কালো রঙ। যেন দুদিন গেলেই বলবে, আমরা তোমাকে ভালোবাসি। লীলা হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়। সেবা-যত্নে দিন চলে যায়। রাম ছাগলের বাচ্চাগুলো নাদুসনুদুস। ছোট ছাগলের বাচ্চারা দুধ পায় না। তারা ল্যাংল্যাংগা। মা আটার গুড়ো দিয়ে পাতলা জাউ বানিয়ে বোতলে নিপল লাগিয়ে খেতে দেয়। লীলা তাদের খাওয়ায়। শীত থেকে বাঁচাতে বাঁশের বড় টুকরির ( লাই’) ভিতর খড় বিছিয়ে রাতে শু’তে দেয়, আরেকটি দিয়ে ঢেকে রাখে। পুরনো কাপড় কেটে জামা বানিয়ে দেয়। মাকে বলে বাচ্চাদের নাম রাখার কথা। মা হাসে। কি নাম হবে? কুকুরদের তো সব হয় ইংরেজি নাম। টিংকি, জেমি, মন্টু, জেমস… কুকুর কী ইংরেজের দেশ থেকে এসেছে? ছাগল তো তা নয়। ইংরেজের দেশে হয় ভেড়া। ব্যা ব্যা ব্লাকসিপ হেভ ইউ এ্যনি উল… পুঁই , জুঁই, লাল, কুকি, রামা, তিতই নামে ছয়টি নাম রাখে। ধরে ধরে নাম শেখায়। তারা কি বোঝে বোঝা যায় না। শুধু মুখের কাছে মুখ এনে ওমহ্ ওমহ্ ডাকে। উজ্জ্বল কালো চোখে কুঁতকুঁত করে তাকায়। রাতে ঘরে আলো দেখলেই ম্যায়্যয় ম্যায়্যয়। দিন হলেই লীলার পিছু পিছু। কোলে, কাঁখে, পাশে নিয়ে সকালের রোদ পোহায়। পুকুরে গেলে তারাও পুকুর পাড়ে কলরব তোলে।

লীলার মায়ের একসাথে ছয় নাতিনাতনির ঠাট্টা করে মনিরা চাচি। কেউ কেউ ঈর্ষার চোখে তাকায়। তাই কালো ছাগলের গায়ে দেয় সাদা-চুনের ফোঁটা। নজর তুই হজরে যা-ধুতরা গাছের ফুল খা। বটুকে নিয়ে দূরের মাঠে যায়। সপ্তাহ দিনের মধ্যেই বাচ্চাগুলো ঘাস খাওয়া শুরু করে। ছোট ছোট মুখ দিয়ে ছোট ছোট ঘাস মাথা নেড়ে নেড়ে কায়দা করে খায়। ঝকঝকে চিকন সাদা দাঁত। দুপুরের রোদে গাছের ছায়ায় কোলে নিয়ে বসে। মাঝেমাঝে বন থেকে পাতা কেটে রাখে খোয়াড়ে। মাঠের ঘাসে তাদের পেট ভরে না। বাচ্চারা চঞ্চল ও বড় হয়। তাধিন তাধিন করে মা’দের পিছু পিছু ঘোরে। আয়ের চেয়ে শ্রম বেশি। এ কাজের জন্য অতিরিক্ত একজন লোকের কথা এ পরিবার ভাবতে পারে না। বাচ্চা ছাগল যতই বড় হতে থাকে সমস্যাও বাড়ন্ত হয়। এর লাউয়ের চারা খেয়ে ফেলল তো ওর ফুলের। মাঠে অন্যের খেসারি ক্ষেতে ঢুকে পড়ে, মরিচ ক্ষেত নষ্ট করে। কেউ বিচার নিয়ে আসে, কেউ ধরে দেয় হাটের খোয়াড়ে । তা থেকে ছুটিয়ে আনতে দুই টাকা লাগে। কেউবা বাড়িতে বেঁধে রাখে। খুঁজতে খুঁজতে ঘর্মাক্ত হয়ে আনতে গিয়ে নানা কটু কথা শুনতে হয়। এই যেমন মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে ইনকাম করছে, ছাগলের ফার্ম খুলেছে…। আরও অনেক কথা, হাসাহাসি। একদিন ছাগল আনতে দেরি হওয়ায় ছোট ছাগলটার ছোট বাচ্চাটা যে এমনিতেই একটু দুর্বল ছিল। তাকে শেয়ালে ধরে নিয়ে যায়। আহা মাঠ থেকে বন পর্যন্ত রক্তের চিহ্ন ধরে খুঁজেছে কত। “শিয়াল নিয়েছে ধরে, আমার প্রিয় ছাগলটারে ও বন ও গাছ বল না কেন মোরে।” শেষমেশ একদিন কাউকে না জানিয়ে বাবা বেপারি ডেকে দক্ষিণের মাঠ থেকেই সব ক’টা ছাগল বিক্রি করে দেয়। তখন লীলা দুপুরের ভাত খেতে ঘরে এসেছে।

কাউকে কিছু বলে নাই লীলা। শুধু কাঁদে, নিঃশব্দে। কানের কাছে শুনতে পায় প্রাণের সরল ডাক। সকালে ঘুম ভাঙলে টুকরি তুলতে দৌড়ে যায় ম্যায়ে ম্যায়ে ম্যায়ে। বাঁশবনে গিয়ে আগের জায়গাটিতে বসে থাকে। ভিমরুলেরা ইতিমধ্যে ছানা ফুটিয়ে চলে গেছে। তার জায়গাটাও অনেকদিন ব্যবহার না করায় অপরিচ্ছন্ন। মন আগের সৌন্দর্য মাখে না। উদাসী বাতাস, শূন্যতা খামছে ধরে থাকে বুকে পিঠে শক্ত সিলগালার মতো। যেখানেই একমুঠো আনন্দের জন্য হাত বাড়ায় কে যেন বাড়ানো হাতে কয়লা আগুন ঢেলে দেয়। দল বেঁধে বাড়ির ছেলেমেয়েরা নাড়ার ক্ষেতে গোল্লাছুট খেলে– লীলা তাকিয়ে থাকে; ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। অন্যদের ছাগলেরা সংসার নিয়ে শুকনো ঘাসের ক্ষেতে চরে বেড়ায়। তাকে ঘরে ফিরে যেতে হয়।

এরই ভিতর একদিন বিছানা ছাড়তে গিয়ে দেখে তার শরীর ও বিছানা রক্তে মাখামাখি। একি হল তার! কোথায় কিভাবে কেটেছে বুঝতে পারে না। ‘মা ওমা মাগো’ ঢুকরে ঢুকরে কাঁদে। ভগ্ন-কন্ঠে সে স্বর ফ্যাসফ্যাসে। মা-বাবার ভয়ে খেতে বসতো বটে কোনদিনই খায়নি ঠিকমতো। লীলাকে দেখতে এসে মা দেখে একটি কঙ্কাল উবু হয়ে বিছানায়। যার জামা, পাজামা রক্তে মাখামাখি। বিছানার কাঁথা টান দিতেই হুড়মুড় করে পড়ে পঞ্চম শ্রেণির বই। বইয়ের কয়েকটিতেও রক্তের ছোপ-ছোপ দাগ। ক্ষীর রান্না করে বাড়িতে উৎসব হয়েছে। মেয়ে সাবালিকা হবার উৎসব। উৎসবে কার মনে কতটুকু আনন্দ বোঝা না গেলেও পাড়ার ভাবও ও দাদিরা গলা মিলিয়ে গান ধরে, হাততালি দিয়ে নাচে। নারী হয়ে উঠার সুখে লীলার মনের কোথাও আনন্দের কণাটুকু জমা না করে আগামীর দিকে আরও ভয়ের ডানা নাড়ে।

ঝিঁঝিপোকা ও তুরুল্লা ডাক ছেড়ে একটু বিশ্রাম নিয়েছে। রফিক চাচার ঘরে অতিপড়ুয়া মমিনের পাঠধ্বনি নিস্তব্ধতার ভেতর গুড়গুড় করে ঢোকে। মশারীর ভেতর শুয়ে কথা বলে মা, অনেক তো প্রস্তাব আসছে দেইখ্যা-শুইন্যা একটা বিয়া দিয়া দেন। মাইয়া মনমরা থাকে সবসময়। জবাব দেবার জন্য পাশ ফিরতেই বাবার লুঙ্গির কোঁচায় হেড মাষ্টারের ঝর্ণা কলমে লেখা চিঠিটা খস খস করে। মেরুদণ্ডে একটা শীতল স্রোত বয় এক ঝটকায়। বুকের ভেতর সাৎ সাৎ। কাউকে দেখাননি এ চিঠি। তবা মিস্ত্রীর বানানো হলুদ আমকাঠের মাঝারি আলমারির পেছনে সতর্ক হয়ে লীলাবতী শুনতে চেষ্টা করে বাবার উত্তর। বাবা কী যেন বলছে অস্পষ্ট! মাস্টার, চিঠি, স্কুল অস্পষ্ট থেকেও স্পষ্ট হয়ে উঠে ঘুটঘুটে মধ্যরাতে। বাবার একটি দীর্ঘশ্বাস বড় হতে হতে ঘরের অন্ধকার কাঁপিয়ে দিয়ে যায়…

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত