বিশ্বাসের বিবর্তন

ছোটবেলায় জমিয়ে গল্প শোনার সৌভাগ্য হয়নি কখনো। একবার গ্রামে রটে গেলো স্কুলের পথের পাকা পুলের নিচে এক পাগলী থাকে। পাগলি সারাদিন বলে, স্বর্ণ না দিলে কয় স্বর্ণের থালা। এই কথার মানে আজও বুঝতে পারেনি। পাগলির কথা অবশ্য গ্রামের মুরব্বিদের মুখে শুনিনি কখনো। যারা রটিয়েছে সব ছেলে ছোকরা। তা দেখার সময় আমরা ছোটদের ছিলোনা। আমরা শুনতে পছন্দ করতাম গল্প। সেই গল্পের মূল কাহিনী এই, একদিন সকালে সবাই স্কুলে যাচ্ছে। পুলের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই শুনতে পায় কেউ বলছে, স্বর্ণ না দিলে কয় স্বর্ণের থালা। শুনে তারা আশেপাশে তাকায়; কিন্তু একখণ্ড দিগন্ত বিস্তৃত সোনালী ধানক্ষেত ছাড়া আর কিছুই নাই। তখন তাদের দলের একজন চালাক চতুর ছেলে কি ভেবে জানি পুলের নিচে তাকায়, এবং সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে পানিতে পরে যায়। যখন সবাই চিৎকারের কারণ অনুন্ধানে ব্যাস্ত তখন পুলের নিচ থেকে এক পাগলী বুড়ি বের হয়ে আসে। তার মাথায় উস্কোখুস্কো চুল। হাতে পায়ে ইয়া বড় বড় নখ। হাতে একটা স্বর্ণের থালা। সেই থালায় একটা ছোট মানুষের বাচ্চার মাথা। পাগলী বুড়ি বের হয়ে এসে বলে, স্বর্ণ না দিলে কয় স্বর্ণের থালা, মাথা লাগবে আরও মেলা। শুনে সবাই উরাধুরা দৌড়। এক দৌড়ে বাড়ি।

    আমার তখন বয়স খেলাধুলা আর শেখার। বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র। যার কাছ থেকে যা শুনি তাই শিখি। বিশ্বাস করে ফেলি রূপকথার গল্প। মনে মনে রূপকথার গল্পের চরিত্র নিয়ে সৃষ্টি করি নতুন নতুন ভুবন। সেখানে রাজত্ব করি একা। যাক গল্প শুনলাম আমরাও। কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না। যা বুঝলাম না তাকে কাবু করে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হলো, আজ থেকে বাইরে বাইরে খেলা বন্ধ। আর যদি বাইরে বের হই তাহলে স্বর্ণের বুড়ি আমাদের মাথা কেটে নিয়ে যাবে। কিন্তু স্কুলে যাওয়া বন্ধ না। প্রাইমারী স্কুলের রাস্তা ভিন্ন। এক কথায় গল্পের সারমর্ম বুজে ফেললাম। পরদিন থেকে আমাদের বাইরে বের হওয়া বন্ধ। বন্ধ ঘরে পিপাসু মন তো আর আটকে থাকে না, পাখির ডানায় ভর করে উড়াল দেয় সপ্ন পুরীতে। আর আমাদের রুদ্ধ করে রাখা সেই স্বর্ণের বুড়ির কাছে। রাগে দুঃখে ব্যথিত হয়ে একদিন শুক্রবারে আমরা কয়েকজন বের হয়ে যাই। উদ্দেশ্য স্কুলের রাস্তার পুল আর স্বর্ণ বুড়ি। বাড়িতে সবাই আছে এদিক ওদিক, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, পা টিপে টিপে যখন রাস্তায় বের হয়ে আসি তখন নিজেকে মনে হয় পাখি। যার দুটি ডানা মেলে দিলে উড়ে যায় আকাশে। কিন্তু আমার ডানা নেই রুদ্ধতার পৃথিবীতে। কিন্তু মনের কোনে যে রূপকথার ভুবন সৃষ্টি করে রেখেছি তাতে আমি পাখি হই, আকাশ হই, আরও কত কি। সেখানে কে আছে রুখে আমাদের!

    দলের সবাই আসতে পারেনি। বের হতে দেয়নি বাড়ি থেকে। যারা এসেছে তাদের মধ্যে অর্ধেক যাবে না। তাদের মাথা কাটা পড়ার ভয়। সর্বশেষ যে কয়জন থাকলো, গুনে দেখি মাত্র আমরা তিনজন। বাদল, রবিন আর আমি। যদি কেউ না যেতে চায় তাহলে কি আর তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া যায়! তাই আমরা তিনজনই রওনা দিলাম। আমাদের আর পুলের দূরত্ব যতই কমে আসতে লাগলো মনের ভেতর ভয়ও বাড়তে লাগলো। হঠাৎ রবিন বলল, ‘আমি আর যামু না?’

    ‘কেন?’, বাদল জানতে চাইলো।

    ‘যদি সত্যি সত্যিই মাথা কাইটা নিয়া যায়, তাইলে?’ 

    বাদল একটু বেপরোয়া। সে বললো,‘ কিছু হইবো না। মাথা কাইটা নিয়া যাইবো, এতো সহজ!’

    অগত্যা কেউ আর কিছু বললাম না। পা টিপে টিপে এগিয়ে যেতে থাকলাম। পুলের উপর এসে দেখি, কিছুই নাই। কোন শব্দ নাই। নিরব সব। লোকজনও নাই। সবাই জুম্মার নামাজ পরতে গিয়েছে। কেউ প্রতিদিন নামাজ পড়ে না। শুধু শুক্রবারে নামাজ পড়ে। মসজিদে জায়গা হয় না। জিলাপি বিস্কুট খাওয়ায় জন্য মানুষের ভিড়। নামাজ শেষে ঝগড়া হয় খুব।

    বাদল বললো,‘স্বর্ণ বুড়ি কই? এখানে তো কেউ নাই।’

    ‘স্বর্ণ বুড়ি থাকে পুলের নিচে।’, রবিন বললো।

    ‘আয় তাইলে পুলের নিচে গিয়া দেখি।’, আমি বললাম।

    ‘না বাবা আমি নাই, যদি মাথা কাইটা রাইখা দেয়।’, রবিনের গলায় কান্নার সুর। 

    তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর বাদল পুলের নিচে যাবো। যতই সাহসিকতা দেখাচ্ছি, মনে ভয় ততই প্রবল হচ্ছে। কিন্তু এখন আর ফিরে যাওয়ার পথ নাই। পুলের নিচে কি আছে না জানলে শান্তি পাওয়া যাবে না। তারচেয়ে বড় কথা আমাদের খেলা বন্ধ। 

    ওমা, পুলের নিচে গিয়ে দেখি কিছুই নাই। আধহাত পানিতে একটা মাগুর মাছ টুপ করে চলে গেলো। বাদল আবার মাছ ধরার ওস্তাদ। একটু কসরত করে আধহাত মাগুর মাছটাকে ধরে নিয়ে এলো।

    আমরা বুঝতে পারলাম সব মিথ্যা কথা। অন্যদের মধ্যে কি পরিবর্তন হলো জানি না; কিন্তু আমি তখন ঠিক করেই ফেললাম এভাবে আর কিছু বিশ্বাস করা যাবে না।

    তারও কিছুদিন পরে এমন অনেক ঘটনা রটে আর আমরা গিয়ে দেখি কিছুই নাই। এতে আমাদের বিশ্বাসে ক্ষয় ধরতে শুরু করে। অন্যদের খবর জানি না আমার বিশ্বাসে ক্ষয় ধরেছে বলেই মনে হয়। এর পর থেকে সত্য কথা বললেও আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আজ এতকাল পর যখন মহাবিশ্বকে বুঝার মতো একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তখন মনে হচ্ছে সেইসব ঘটনা আমার জীবনে যা পরিবর্তন এনে দিয়েছে, তা আর কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না। 

    এটাই হয়তো বিশ্বাসের বিবর্তন। বিবর্তন সব উন্নত করে। আমার বিশ্বাসও উন্নত করেছে। এখন আমি বুজতে পারি কোনটা ঠিক কোনটা বেটিক, কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা, কোনটা সংস্কার আর কোনটা কুসংস্কার ইত্যাদি। 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত