পারফিউম

আমি খুব একটা পারফিউম ব্যবহার করি না। প্রয়োজন হয় না। দীপ্তি সব সময় বলে তোমার তো গায়ে গন্ধই নেই। প্লাস্টিক মানব কুনহানকার। আমি হাসি। কারণ এই অভিযোগ আংশিক সত্যি। আসলে ও চায় না আমি কোনো পারফিউম ব্যবহার করি। ওর ধারণা পারফিউমের সুগন্ধে সুন্দরীরা আমাকে জেঁকে ধরবে। অনেকটা টিভির বিজ্ঞাপনের মতো।
বেশ কিছুদিন আগে আমার অফিসের এক ক্লায়েন্ট আমাকে একটা পারফিউম উপহার দিয়েছিলেন। একটিভ অথবা ইনএক্টিভ ম্যান টাইপের কিছু। আমি অফিসের ড্রয়ারে ফেলে রেখেছি। ব্যবহার করি না।
কয়েকদিন ধরে ভীষণ গরম পড়েছে। যাকে বলে তালপাকা গরম। অফিসে এসে কয়েকদিন পারফিউম হাতে নিয়েছি কিন্তু দীপ্তি কী মনে করে ভেবে আর ব্যবহার করিনি।
দীপ্তি একটু কেমন যেন। এইতো কিছুদিন আগেই আমার ব্যবহার করা একটা শার্ট হাতে নিয়ে বলছিল এটা কীসের গন্ধ?
আমি বললাম কই?
কই মানে! এই যে সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে এটা কীসের?
দীপ্তির এসব কথায় আমি হাসি। বলি তোমার বরটাতো সুন্দর আর মিষ্টি। এটা তারই গন্ধ।
আমাকে ভুলাও না! এসব হবে না। সত্যি করে বল কী পারফিউম মেখেছ? কার সাথে কোথায় ঘুরেছ?
আরে আমি তো অনেক জায়গায় অনেকের সাথেই ঘুরি। কার কথা বলব!
দীপ্তি তারপরেও শার্ট শুঁকেই চলে। বুঝতে চায়। কোনো গন্ধ হয়তো পায়। সন্দেহেরও একটা গন্ধ থাকে হয়তো।
ইমতিয়াজ ভাইয়ের সাথে আমার একবারই দেখা হয়েছিল। তাও বছরখানেক আগে কোনো এক সন্ধ্যায়। আমার এক ফ্রেন্ডের জুনিয়র। আজ একটা বিশেষ দরকারে তাঁর সাথে দেখা করা দরকার।
ফোন করতেই তিনি চিনতে পারলেন। বললেন ভাই আমার ফিরতে একটু দেরি হবে।
বললাম সমস্যা নেই। আপনি আসেন। আমি অফিসেই থাকবো।
তাঁর বাসা আমার অফিসের কাছেই। গুলশান ১ নাম্বার। তিনি আসবেন ফকিরাপুল থেকে।
তাঁর সাথে দেখা করতে আমাকে একটা অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হল। কারন রাত নয়টা বেজে যাওয়ার পরেও তিনি তখনো জ্যামে। পৌঁছতে পারেননি।
আমি পুলিশ প্লাজার সামনে চলে গেলাম। ভাবলাম তাঁর বাসার কাছাকাছি থাকি যাতে আসামাত্রই দেখা করা যায়। সাড়ে নয়টার দিকে ফোন করে জানলাম তিনি তখনো জ্যামে।
দশটায় একবার কল দিলাম। তখনো জ্যামে। এদিকে দীপ্তির একের পর এক ফোন। দীপ্তিকে বললাম বাদ দেই। ইমতিয়াজ ভাইয়ের সাথে আজ দেখা না করি। এত রাত হবে আগে তো বুঝিনি।
দীপ্তি নিজেই বলল এতক্ষণ যখন থাকলা দেখা করেই আসো।
পুলিশ প্লাজা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তা অনেকটা নীরব। ফুটপাতে একটা চায়ের দোকানে একটা দুইটা লোক সিগারেট টানছে। প্লাজার সামনের চাতালে একটা কাপল বসে আছে। মেয়েটির স্লিভ্লেস বাহুতে ছেলেটি হাত বুলাচ্ছে। এই বৈশ্বিক উষ্ণায়নে হয়তো তারাও একটু উষ্ণতা চাইছে।
রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল তবুও ইমতিয়াজ ভাইয়ের দেখা নেই। বিরক্তির চরম শিখরে পৌঁছে আমি আবার কল দিলাম। তিনি জড়ানো কণ্ঠে বললেন ভাই আপনি এখনো আছেন?
কথাটা শুনে মেজাজ সত্যিই খারাপ হয়ে গেল। বললাম জ্বি ভাই আমি আপনার জন্যই সেই বিকেল থেকে অপেক্ষা করছি।
আচ্ছা আসেন। বাসায় আসেন।
আমি বললাম আচ্ছা। ফোন রেখে দেয়ার পর মনে হলো আচ্ছা যে বললাম আমি তো তাঁর বাসা চিনি না। ঠিকানাও দেন নি। বছরখানেক আগে ফ্রেন্ডের সঙ্গে গিয়েছিলাম কিন্তু অতোটা মনে নেই। শুধু এরিয়াটা মনে আছে।
আমি আবার কল দিলাম। ভাই আপনার বাসার ঠিকানাটা বলেন।
তিনি বললেন যে কাউকে বললেই হবে চৌধুরি বাড়ি। বলে ফোন রেখে দিলেন।
মুশকিলে পড়া গেল। একে তো এত রাতে লোকজন কম। তারমধ্যে ঢাকা শহরে কাউকে যদি আমি বলি ভাই চৌধুরি বাড়ি কোনটা। নিশ্চয়ই সবাই আমাকে মফিজ ভাববে। ইমতিয়াজ ভাইয়ের উপর রাগ হচ্ছে। উনি যদি একান্তই দেখা করতে না চান বলে দিলেই পারেন। আর আমাকেও তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে হবে বিষয়টা এরকমও নয়। মনে হয়েছিল তিনি একজন প্রফেশনাল লোক। আলাপ করলে ভালো সাজেশন দিতে পারবেন।
আমি অনুমান করে একটা রাস্তা বেছে নিলাম। ফুটপাতে পিঠা বিক্রি করছে এরকম একজনকে পেলাম। বললাম ভাই চৌধুরি বাড়ি চিনেন?
তিনি বললেন কোন চৌধুরি?
তাঁর প্রশ্ন শুনেই বুঝলাম এভাবে কাজ হবে না। বললাম হাঁদারাম চৌধুরী। বলে হাঁটা শুরু করলাম।
আমি গুগলে সার্চ দিলাম চৌধুরী বাড়ি দিয়ে। গুগল আমাকে মালিবাগ চৌধুরিপাড়া নিয়ে গেল। একটা লোককে আর কতবার ফোন দিব!
পরিশেষে ইমতিয়াজ ভাইয়ের বাসা খুঁজে পেলাম কিন্তু ততক্ষণে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। আলিশান এপার্ট্মেন্টের কেয়ারটেকার আমাকে ইমতিয়াজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে নিয়ে ড্রইং রুমে বসাল। একটা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধে বাসাটা ভর্তি। চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মতো টিমটিমে আলো জ্বলছে। সাদা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরা ইমতিয়াজ ভাই আসলেন। এসেই বললেন আই এম এক্সট্রিমলি সরি ভাই। ভয়াবহ জ্যামে পড়েছিলাম।
ক্লান্ত অবসন্ন এই আমাকে ভদ্রতা করে বলতে হল ইটস ওকে ভাই। কিন্তু উনার হাতে ভদকার গ্লাস আর লাল চোখ দেখে বুঝাই যাচ্ছিল তিনি এইমাত্র বাইরে থেকে আসেননি।
ইমতিয়াজ ভাইয়ের চেহারাটা আমার বিশেষ মনে ছিল না। তবে কথা বলতে বলতে মনে হলো হ্যাঁ ইনিই সেই। তিনি আমাকে ডাইনিং এ নিয়ে বসালেন। সেখানে অনেক রকমের খাবার পরিবেশন করা আছে। বললেন নিন ভাই খেতে খেতে কথা বলি।
আমি সেই বিকেলে এক প্যাকেট লেক্সাস বিস্কিট খেয়েছিলাম। খাবার দেখে বুঝতে পারলাম বেশ ভালোই খিদে লেগেছে।
উনার সাথে কথা বলার একটা সময়ে ভেতর থেকে রাতের পোশাক পরা এক পরমা সুন্দরী এসে ইমতিয়াজ ভাইয়ের পাশে বসল। এতক্ষণ ধরে পারফিউমের যে গন্ধটা পাচ্ছিলাম সেটা আরো তীব্র হলো। ইমতিয়াজ ভাই পরিচিয় করিয়ে দিলেন। বললেন ভাই ও স্নিগ্ধা। কিন্তু স্নিগ্ধা কে! এটা বললেন না। আমিও আর জিজ্ঞাসা করলাম না। ধরে নিলাম স্ত্রী অথবা গার্লফ্রেন্ড। আজকাল একটা পরিচয় হলেই হয়।
ইমতিয়াজ ভাইয়ের সাথে আমার আলাপের বিষয় ছিল দশ মিনিটের। যেহেতু উনি টায়ার্ড আর অনেক রাত হয়েছে তাই আর বেশি সময় নিতে চাইছিলাম না।
উনি SMIRNOFF এর একটা নতুন বোতল খুললেন। বললেন অর্ণব ভাই নিন। খুব ভালো জিনিস।
আমি ডিনাই করলাম। বললাম সরি ভাই। এসব তো খাই না অনেকদিন। পছন্দ না।
আমি যখন বিদায় নিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম হঠাৎ করেই আমার মাথাটা দুলে উঠলো। ব্ল্যাকআউট হলো। যখন চোখ খুললাম দেখলাম নরম তুলতুলে একটা বিছানায় আমি শুয়ে আছি। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। ঘড়ি দেখলাম রাত দুইটা পনেরো। দীপ্তির ১৯ টা মিসড কল। ঘরের কোণে সোফায় বসে পা দোলাচ্ছে স্নিগ্ধা। মুখে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে বললেন এই যে মিস্টার! কিছু না খেয়েই অজ্ঞান হয়ে গেলেন! কেমন পুরুষ আপনি?
সরি! আই থিংক আই ওয়াজ ভেরি টায়ার্ড। ইমতিয়াজ ভাই কোথায়। আমাকে এক্ষণি যেতে হবে।
ছুটির দিন একটু বেশি করে ঘুমিয়ে নেই। এটা আমার চিরাচরিত অভ্যাস। অন্যান্য দিনের ঘুমটুকু পুষিয়ে নেয়া আর কি।
নাশতা করে দীপ্তি আর আমি বারান্দায় বসে দুইজনে একসঙ্গে কফি খাই। সবুজ দেখি। দুইটি বুলবুলি পাখি এসে লেজ নাচায় বাগানে। সেটা দেখি। কুটকুট গল্প করি। আজকেও দীপ্তি দুইটা কফি নিয়ে বারান্দায় আসলো। কিন্তু হাতে একটি শার্ট। শার্টটি আমার কাছে নিয়ে এসে বলল তুমি নিজে শুঁকে দেখ।
দেখলাম। খুব সুন্দর একটা পারফিউমের ঘ্রাণ।
এবার আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
কী প্রশ্ন?
হ্যাঁ অথবা না বলবে। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করবো না।
ঠিক আছে বল।
তোমার কাছে কি এমন কোনো পারফিউম আছে যা আমি জানিনা। যেটা তুমি অফিসে রাখো?
আমার মনে পড়ল এক ক্লায়েন্টের কথা। যিনি আমাকে অনেক দিন আগে একটা পারফিউম গিফট করেছিলেন। কিন্তু এটা আমি কখনোই দীপ্তিকে বলি নি। কেন বলিনি এটা একটা রহস্য। মনে হচ্ছে আজকের এই সুনামির জন্যই বলা হয়নি।
কি জবাব দিচ্ছ না কেন? হ্যাঁ অথবা না শুনতে চাচ্ছি। ব্যাস।
আচ্ছা আমি কি এক্সপ্লেইন করতে পারি?
না। আমি শুধু জানতে চাইছি হ্যাঁ অথবা না।
দীপ্তির সাথে আমি কখনো মিথ্যা বলিনি। এবারও বলব না। যা হবার হবে। আল্লাহ ভরসা!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত