ঝলমলে নদীর জল

আমি রিইয়ানা। নিজেকে আমার এই জগতের সব কিছুর বাইরের মনে হয়; সে এমনে এমনে নয়, সব সময় কিন্তু নয়-একটা বিশেষ সময়-একটা বিশেষ উপায়ে। সে এক দীর্ঘ সাধনায়। চোখ দুটো মৃদু  বুজতে হয়, বুজে সব ভুলে যেতে হয়- এক অন্যজগতে, ভীষণ অন্যভূবনে ঢুকে যেতে হয়; মাঝে মাঝে আমার এটা প্রয়োজন হয়, সেই মাঝে মাঝেটা হলো অনাহূত ঘটনায় , যাতনায় , ভালো না লাগায় -বিপদে মুখ লুকানোর মত ।

ধরেন কারও কাছে কোন পাওনাদার ধরনা দিচ্ছে দিনের পর দিন আর সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে,, একদিন পাওনাদার এলে ঘরের আলমারিতে ঘাপটি মেরে সে লুকিয়ে থাকলো – অনেকটা তেমন…তবে আমি আলমারিতে লুকাই না, নিজের ভেতর  লুকাই। এ পাওনাদার বিষয়ক উদাহরণ যুতসই হলো কিনা বুঝতে পারছিনা কারণ পাওনাদার বা দেনাদার বিষয়ে যত উপন্যাস পড়েছি বা নাটক সিনেমা দেখেছি সবটুকু পুরুষ কেন্দ্রিক। কি আশ্চর্য,  তাইনা? নারীরা কি তবে ঋণগ্রস্থ হয় না?  অবশ্যই হয় । …

যা হোক! আমার সেলফ হাইডিং বিষয়ে বলছিলাম। এইতো গতমাসেই বড় চাচী ফোন দিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে, চাচী যখন বলেলেন শম্পাকে নাকি ভূতে ধরেছ -আমার আর কোন আগ্রহ হলো না শুনতে, আমি সেই হারিয়ে গেলাম। সে এক অপূর্ব জগত, সবুজ ঘাস, ঝলমলে নদীর জল, সেখানে শম্পার সাথে দেখা হলো। শম্পা আমর কাজিন, বয়সে আমার চেয়ে বছর পাঁচেক ছোট, গ্রামে গেলে ওর সাথেই ঘুরতাম, পাড়া বেড়াতাম। ও আমাকে নিয়ে গিয়েছিলে ওদের স্কুলের সেই সুদর্শন শিক্ষকের সাথে দেখা করাতে, অবাক হয়েছিলাম যার নাকি বলিউড সিনেমায় থাকার কথা সে পড়ে আছে গ্রামের বিদ্যালয়ে।  শম্পা তার জন্য তীব্রভাবে পাগল, অথচ তিনি পাত্তা দিতেন না, আমি তাই শম্পার অগোচরে একটু বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। বেজেছিলেন, কথা হতো গভীর রাতে আমাদের, কত কথা, মিষ্টি কথা – তিতা কথা, মন ভোলানো কথা – আমি তাকে বাজাতাম। এক সকালে ঢাকাতে চলে এসেছিরেন আমার জন্য অথচ তার আগের রাতেই আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল দীর্ঘ দিনের প্রেমিক আবিদের সাথে।

চাচী ভূতের ছন্নছাড়া কান্ডকারখানার কথা বলছে আর আমি যেন শম্পার সাথে ঝলমল করত থাকা অবারিত নদীর পাড়ে কাশবনে রসময় কোন গল্প করছি…চাচী কি বলবেন তাতে কি যায় আসে! শম্পার আসল ভূত তো আমি।

এর মাস খানেক পর আবার চাচীর ফোন এসেছিলো। জানলাম – শম্পা আত্মহত্যা করেছে… ভীষণ কাঁদছিলেন চাচী; … কিন্তু ওনার কথা ওত শুনে আর কি করবো? মানুষ মরে গেলে তার ভূতের আছরও মরে যায় কিংবা হারিয়ে যায় ভীতি। অথচ শম্পার ভুত বেঁচে আছি – একটু কষ্ট হচ্ছে শম্পার জন্যে…

কিন্তু না যত কঠিন কষ্ট ততবেশি হারিয়ে যাওয়া, লম্বা সময়ের হারিয়ে গেলাম ফোন হাতে ধরে,   কখন ফোন কেটে গেছে জানা হয়নি । আমি মনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে হারিয়ে তখন, আনন্দ নিকেতনে ছুটছি তখন, হঠাৎ  দেখি শম্পার সেই শিক্ষক ছুটে এসে আমার পায়ে পরে কাঁদছে … আমি  উলঙ্গ পিঠে তার হাত বুলিয়ে শান্তনা দিচ্ছি…

আবিদ আর অরিলকে নিয়ে আমার বাস্তবতা। আর বাকী সব গভীরের রহস্যপুরী-অন্যজগত। এটা একটা অভ্যাস-চরমতম স্বার্থময়তায় ভরা অভ্যাস। আমি অর্জন করেছি। আমি ভালো আছি…

অরিল আমর ছেলে। অরিলের আজ ছুটি। ছুটি আবিদেরও। তবু ওরা বেরিয়েছে সাত সকালে।

এখান থেকে খানিকটা দূরে হাই ওয়ে ছাড়ালেই একটা পাহাড়ের সারি., তার মাঝে একটা লম্বাটে লেক। স্বচ্ছ তার জল। চেয়ে থাকে জলের মায়া, কতবার আমি সে মায়াতে আটকে চেথে থেকেছি…

প্রচুর মাছও আছে তাতে। বাপ ছেলে সেখানে গেছে মাছ ধরতে।

…ওরা গেছে সেই সাত সকালে, এখন দুপুর ছাড়িয়ে বেলা গড়িয়ে পড়ছে ঢালুর দিকে…

আমি একটা ফোনও দেই নি, ওরা ওদের মত এনজয় করুক না, আমি ওভেনে একটা আস্ত চিকেন রোষ্ট করেছি, ওরা এলেই খাব। একটা নতুন ওয়েব সিরিজ এসেছে – নায়কটা যখন ইচ্ছে মরে যেতে পারে, তারপর মিশে যেতে পারে ভূতের জগতে । ওটাই তার প্রোফেশন, সে আত্মা খুঁজে বেড়ায়, আত্মার থেকে উত্তর খুঁজে নিয়ে সমাধান দেয় বেচে থাকা মানুষকে।

গত সিজেনের শেষ এপিসডে দেখালো সে আটকে গেছে  এক বদ আত্মার খপ্পরে পরে , আর রিয়েলিটিতে ফিরে আসতে পারবে কি নিজ দেহের কাছে?  সময় মাত্র ৬ ঘন্টা, এর মধ্যে না এলে তার দেহ আর রিভায়িভ করতে পারবে না…

নতুন সিজন এসে গেছে, উত্তর জানা জাবে, এখন দেখতে বসবো…

আমার এসব আজগুবি এবং তীব্র ফ্যান্টাসি ভাল লাগে, যদিও মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে কেউ যদি সত্য সত্যি মৃত্যুর পরের কোন একটা ছোট খবর নিয়েই আসতে পারতো তাহলে তো এত্ত এত্ত বিভাজন আর বিশ্বাস অবিশ্বাসের খেলাই থেমে যেত – হয়তো ভালো হতো, হয়তো ভালো হতো না ; আমার তাতে কি?

হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠতেই ছুটে গিয়ে হাতে নিলাম, ছুটলাম কেনো জানি না। দেখলাম আবিদের নম্বর …

ধরেই বললাম, কি এখনও খাবার সময় হলো না, ছেলেটা কিছু খেয়েছে ?…

ওপাশে অচেনা কন্ঠের উত্তর, আর ইউ ওয়াইফ অব মি: অনন্ত ? আ ম জেসান, পুলিশ.. কলিং ফরম জিএস হসপিটাল, ম্যাম ইউ হ্যাভ টু  কাম টু দি হসপিটৈল কুইকলি, ইউর হাসবেন্ড এন্ড সন  হেড এ রোড একসিডেন্ট, দে আর…

আমার অবিশ্বাস্য বাস্তবতা না  শুনতে চাওয়ার কঠিন অভ্যাস বশেই হোক আর প্রচন্ড দূর্বল মানসিকতার জন্যেই হোক, বাকীটা শুনতেই পেলাম না, আমি চিরায়ত আমার মত হারিয়ে গেলাম আমার ভেতর -সেই কতকালের সজ্জিত জগতে ….

তারপর…

মাঝে কি হলো জানি না, আজ পথটা ছিলো অনেক লম্বা-একটা টানেলে নেমে চলেছি তো চলেছি…কেমন যেন বদ্ধ, বাতাস হীন-গুমোট; হঠাৎ টানেল শেষ হলো । আলো দেখলাম, চোখ মেললাম । এ সেই চিরায়ত সবুজ ঘাসের ধারে ঝলমলে জলের নদী তীর নয়, শ্বেত শুভ্র আকাশ নেই উপরে। চোখ মেলছি কিন্তু কিছু দেখছিনা…

ধূসর আঁধার..

হঠাৎ পরিচিত কন্ঠ কানে এল…

অরিল … অরিল কাঁদছে, আবিদ…স্বান্তনা দিচ্ছে–কিপ ইওর পেশেন্স বাবা…

তবে…তবে আমি কি মরে গেছি? ওরাও কি মরে গেছে একসিডেন্টে… আত্মার চোখ নেই তাই দেখছিনা? আত্মা কি তবে অন্ধ?

কিন্তু ওরা কাঁদছে কেনো ? ওদের আত্মা দেখছে কিভাবে?

হঠাৎ, অন্তত জিজ্ঞেস করলো কাকে যেন – ডাক্তার , ইজ সি ইন ডিপ কোমা? উইল শি রিকভার  সুন?

তৃতীয় কন্ঠ বলে উঠলো-শি ওয়াজ ইন সেন্সলেস ফর সো লং এন্ড  দ্যাট ওয়াজ এ মেজোর এট্যাক।

থ্যাঙ্ক গড.. শি ইজ এলাইভ… হার সেন্স ইজ গ্রাজুয়্যালি গেটিং একটিভ …

জাস্ট লুক লুক … হার ফেস ইস শোয়িং হ্যাপিনেস… প্রোব্যবলি শি ক্যান লিসেন আস…

অরিল মায়ের হাত ধরে বলে উঠলো, প্লিজ মান্মি, মাম্মি মাম্মি উঠো;  উই আর অল রাইট, দ্যাট ওয়াজ এ মাইনর একসিডেন্ট , আই এম ফুললি ফাইন, বাবা একটু ….( আবিদ তাকে ইশারায় থামিয়ে দিলো)…

কি হয়েছে আবিদের? যা হোক, বেচেতো আছে দুজন… আছি আমিও …

ঐতো নদীর ঝলমলে জল কলকল.. উপরে শুভ্র মেঘ…সবুজ ঘাসে আমার খালি পা… কিন্ত ওটা কি … ওটা কে শুয়ে আছে ? – শম্পা !  তার পাশে বসে কাঁদছে কে? -সেই শিক্ষক! …

চোখ দিয়ে জল চলে এলো… অরিল এর হাত মুছে দিচ্ছে সে জল …আমি টের পেলাম..তবু বসে রইলাম ঝলমলে জলে ডুবিয়ে পা, দূরে শম্পা আর তার শিক্ষক, আমি আর তাকালাম না …

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত