দুঃখী পাথরে সাজানো নদী

রাজা ও রাণীর প্রিয় পুত্র একদিন হঠাৎ নদীতে ডুবে হারিয়ে গেলো। অনেক খুঁজেও তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হলো না। পুত্রশোকে রাজা পাথর হয়ে গেলেন, রাজার সাথে সাথে রাণীও পাথর হয়ে গেলেন। রাজপুত্র হারানোর শোক নেমে এলো পুরো রাজ্যে। মন্ত্রী, সেনাপতি, সৈন্য-সামন্ত, রাজ্যের সব প্রজা সবাই শোকে পাথর হয়ে গেলো। পাথর হয়ে তারা সাংগু নদীর বুকে দাঁড়িয়ে রইলো। এই হলো রাজা পাথর নিয়ে আদিবাসীদের মিথ। আর এই রাজা পাথর বা বড় পাথরের দেখা পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে বান্দরবানের থানচি উপজেলার তিন্দুতে।

আদিবাসীরা এই রাজা পাথর বা বড় পাথরকে খুব ক্ষমতাবান বলে ভাবে। তারা মনে করে, সাংগু নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে সব পাথর ডুবে গেলেও রাজা পাথর কখনো ডুববে না। তারা আরো মনে করে ,এই পাথরকে অসম্মান করলে বিপদ হতে পারে। খরস্রোতা সাংগু নদীতে প্রতিবছর কেউ না কেউ মারা যায়। তাই রাজা পাথরকে খুশি রাখতে আদিবাসীরা নিয়মিত পুজা দিয়ে থাকে। এমন কি কোন পর্যটক যদি রাজা পাথরের মিথ নিয়ে অবিশ্বাস প্রকাশ করে বা বিদ্রুপ করে, তবে আদিবাসীরা মনে কষ্ট পায়। তারা মনে করে, এতে রাজা পাথরও অসন্তুষ্ট হবে আর এই পথে আবার সেই পর্যটককে দেখতে পেলে ডুবিয়ে মেরে ফেলবে। এজন্য তারা সেই পর্যটককে আর রাজা পাথরের সামনে দিয়ে যেতে দেয় না। অনেকটা পথ ঘুরিয়ে তারপর নিয়ে যায়। তাই এরকম জায়গায় বেড়াতে গেলে এমন কোন কথা বা আচরণ করা উচিত নয়, যাতে আদিবাসীরা কষ্ট পায়।

বড় পাথরগুলো দেখতে হলে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে তিন্দুতে আসতে হবে। পাহাড়ি সাংগু নদীর স্বচ্ছ জলে নৌ ভ্রমণটিও খুব উপভোগ্য। চারপাশে পাহাড়, দুপাশে সবুজ গাছপালা। ফড়িং আর প্রজাপতিরা উড়তে উড়তে আপনার নৌকাতেই চলে আসবে বারবার। এছাড়াও নানা রকম রঙ বেরংগের নাম না জানা পাখি তো রয়েছেই। পাহাড়ি নারীদের দেখবেন নদীতে শামুক সংগ্রহ করছে। লম্বা লম্বা বাঁশের ভেলা চালিয়ে চলে যাচ্ছে ৫/৬ বছরের শিশুরাই। সাংগু নদীর টলটলে জলের উপর দিয়ে চলতে চলতেই এক সময় হঠাৎ দেখবেন, দৃশ্য পালটে যাচ্ছে। পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে, অসংখ্য বড় বড় পাথর। এই পাথরগুলো কোথা থেকে এসেছে, এগুলোর বয়স কত কেউ জানে না। কোন কোন পাথর দেখতে মানুষের মুখের মত। আবার ভরা বর্ষায় যদি সেখানে যান, দেখবেন, পাথরগুলো ভোজবাজির মতো উধাও! সাঙ্গু নদীতে পানির উচ্চতা এতটাই বেড়ে যায়। শুধু রাজা পাথর ও অন্যান্য বড় পাথরের কিছু অংশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে জলের ভেতর থেকে।

আদিবাসীদের অনেকেই রাজা পাথর’র মিথে বিশ্বাস করে। ধারণা করা হয়, ভূমিকম্পের ফলে পাহাড় থেকে এই পাথরগুলো নিচে পড়েছে। খাঁজকাটা পাহাড়গুলো দেখে মনে হয় ধবংস হয়ে যাওয়া কোন সভ্যতার পুরাকীর্তি। নদীতে এলোমেলো ভাবে পড়ে থাকা বড় বড় পাথরগুলোকে দেখে হঠাৎ মনে হবে, তারা সত্যই খুব দুঃখী। চারপাশের নির্জনতা, পাহাড়ের বিশালতা, নদীর পানির মৃদু ছপছপ শব্দ আর আলুথালু বেশে পড়ে থাকা রাজ্যের সব দুঃখী পাথর… সব কিছু মিলে এমন এক রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয় যে ভালো মত কান পেতে শুনলে পাথরের কান্নাও শোনা যায়। রাজপুত্র হারানোর দুঃখ তখন আপনাকেও স্পর্শ করবে। এমন জাদুময় পরিবেশ মুহূর্তেই আপনাকে নিয়ে দাঁড় করাবে শত শত বছর পূর্বের এক অচেনা গল্পকারের সামনে, যিনি দুখী পাথরের এই মিথ তৈরি করেছিলেন।


যাতায়াত ও থাকার ব্যবস্থাঃ ঢাকা থেকে বান্দরবান যেকোন এসি/নন-এসি বাসে আসা যায়। বান্দরবান থেকে চান্দের গাড়ি বা বাসে করে তিন/চার ঘণ্টায় থানচিতে পৌঁছে যাওয়া যায়। থানচি থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে খুব সহজেই চলে আসা যাবে তিন্দুতে। থানচিতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তিন্দু থেকে অল্প কিছু দূরত্বে রেমাক্রিতেও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তিন্দুর পাথর দেখে রেমাক্রি ফলসে ঘুরে আসা যায়।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত