মহাজাগতিক এইসব শরীরে মানুষ এক চিরায়ত দাগ

শরীরে জ্বর আসলে কিংবা জ্বর জ্বর ভাব হলেই আমার গল্প লিখতে ইচ্ছা করে। আর এবার সেই ইচ্ছাটা প্রবল হতেই আমার তার কথা মনে পড়ে যায়, কাউকে বাম হাতে শাদা টিস্যু নিয়ে ডান হাতের আঙুলগুলো মুছতে দেখলে যার কথা সাধারণত আমার মনে পড়ে। সর্বশেষ, আজ চকবাজার থেকে এক নম্বর রুটের গাড়িতে জানালার পাশের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে ঝুলে বাসায় ফেরার কালে আবাসিকের একটু আগে (বহদ্দারহাটের খানিক পরে) রিকশায় এক যুবতী বধূকে (যার বাম পাশে তার স্বামী বসে ছিলেন এবং যাকে দেখে বধূটির চাইতেও কমবয়সী মনে হচ্ছিল, আর যিনি কিছুটা জড়সড় হয়ে বসে ছিলেন, আর তাদের বসার পজিশন দেখে আমার মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছিল- কেম বধূটি ডান পাশে অর্থাৎ রং সাইডে, আর কেন স্বামীটি বাম পাশে অর্থাৎ সেফ সাইডে! আবার ধরেন, এমনও হতে পারে যে, তারা স্বামী-স্ত্রীই নন৷ কিন্তু, আমার কাছে মনে হল স্বামী-স্ত্রী, তাই সেভাবেই বলা।) বাম হাতে শাদা টিস্যু নিয়ে ডান হাতের আঙুল মুছতে দেখে তার কথা আমার মনে পড়ে যায়, আর তখনই আমার মনে চিন্তা আসে তাকে নিয়ে একটা গল্প লেখার, আর এমনতর চিন্তা হতেই জ্বরের সূত্রপাত, কেননা গল্প লিখতে গেলে, কিংবা গল্প লেখার ইচ্ছা করলেই আমার জ্বর চলে আসে, কিংবা জ্বর জ্বর ভাব হয়।

(১)
আমি তখন ভার্সিটি দ্বিতীয় বর্ষ, এবং অতি অবশ্যই ভার্সিটির হিসাবে বালেগ, কেননা ততদিনে হলের গেস্ট রুমে আমরা সিনিয়র হয়ে গেছি এবং নতুন আসা জুনিয়রদের আদব কায়দা তালিম দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি। ভার্সিটির অলি-গলি, কানা-কানচি, চিপা-চাপা ততদিনে বেশ চেনা হয়ে গেছে। এমনই এক সময়ে, জানুয়ারি মাসের তীব্র শীতে, জালালের দোকানের রকে বসে, দেয়ালে হেলান দিয়ে চা খেতে খেতে বন্ধু ময়নার সাথে প্ল্যানটা করি। ভার্সিটিতে ময়না আমার প্রথম দিককার এবং কাছের বন্ধু ছিল, আর তার একটা সুন্দরী প্রেমিকা ছিল এবং সে পতিতালয়ে যেত। আর সংগত কারণে বিষয়টা আমার কাছে আশ্চর্যজনক লাগত যে, এত সুন্দর একটা প্রেমিকা থাকতেও সে কেন পতিালয়ে যায়! সে তো আর রুদ্র নয়! তবে! যাই হোক, ময়নার জন্য যেটা বিলাসিতা ছিল, আমার জন্য তা ছিল প্রয়োজন। কেননা আমার কোন প্রেমিকা ছিল না। আর তাই ময়নার সাথে প্ল্যানটা করি।

(২)
গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে ডান দিকে খানিক এগুনোর পর একটা গলির মুখে এসে ময়না বলল- “এখানে।” রাতের আলোয় তামাম ঢাকা শহর নিয়ন আলোর ঝলকানিতে প্রায় দিনের মত আলোকিত হলেও এই জায়গাটা বেশ অন্ধকার। অন্ধকার গলিপথ ধরে কিছুটা হেটে আমরা পৌঁছুলাম তিনতলা দালানটার সামনে। ঢোকার মুখে একটা চল্লিশ ওয়াটের হলুদ বাল্ব জ্বলছে। প্রতি তলাতেও তাই। বাল্ব চল্লিশ ওয়াটের, এটা আমি আন্দাজ করে নিলাম, এর চাইতে কমও হতে পারে, তবে এর বেশি কিছুতেই নয়। অবশ্য বাল্ব চল্লিশ ওয়াটের কম হয় কিনা তাও আমার ঠিক জানা নেই। যাই হোক, চল্লিশ ওয়াটের কিংবা তার চাইতেও কম পাওয়ারের এই বাল্ব আমাদের এই গল্পে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা এই বাল্ব দেখে আমার কৃষণ চন্দরের কথা কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। পতিতালয়ের বেশ চমৎকার একটা বর্ণনা আমি পড়েছিলাম কৃষণ চন্দরের একটি গল্পে, যদিও গল্পের নাম এখন আমার মনে নেই। সেই বর্ণনার এক জায়গায় চন্দর সাহেব এই রকম বাল্বের কথা বলেন, যেখানে তার বয়ান ছিল অনেকটা এরকম- “কম পাওয়ারের এই হলুদ বাল্বটা অন্ধকারকে যেন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল!” তো চন্দর সাহেবের গল্পটা, পতিতালয়ের চিত্রটা আর বাল্বটা আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল; এখানে এসেও এই বাল্ব, এই অন্ধকার আর স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগল- পতিতালয় মানেই কি তবে এমন? অন্ধকার, কম পাওয়ারের বাল্ব এবং স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ? যদিও সেটা ছিল নিম্ন এবং নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য বানানো এবং চন্দরের গল্পের পতিতালয়টিও ছিল এই শ্রেণীর জন্যই, আর তাই উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের জন্য পতিতালয়গুলো কেমন তা বলতে পারব না, যদিও শুনেছি সেগুলো বেশ আলো ঝলমল ও সুসজ্জিত। কিন্তু চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন আর হয়ে উঠেনি। কেননা আমরা ভার্সিটির ছাত্ররা আদতে নিম্নবিত্ত জীবনই কাটাতাম, আর তাই ‘এক শট-তিনশ’ এর বেশি উঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।

(৩)
নিজেকে তখন আমার মান্টোর গল্পের নায়ক মনে হতে থাকে, কিংবা সত্যি কথা বলতে কি, নিজেকে তখন আমার মান্টোই মনে হতে থাকে। যদিও এই মনে হওয়াটা একেবারেই অযৌক্তিক। কেননা, মান্টোর গল্পে যে পতিতালয়ের বর্ণনা আমি পড়েছি, কিংবা মান্টোর স্মৃতিধন্য হীরামান্ডীর পতিতালয়ের কথা ভাবলে মানসপটে যা ভেসে ওঠে, তার সাথে এই পতিতালয়ের বহিরাঙ্গের কোন মিলই নেই৷ তার চাইতে বরং কৃষণ চন্দরের গল্পে পড়া পতিতালয়ের সঙ্গেই এর ব্যাপক মিল। তবু কেন নিজেকে আমার চন্দর মনে না হয়ে মান্টো মনে হল! কিংবা চন্দরের নায়ক মনে না হয়ে মান্টোর নায়ক মনে হল! এমন না যে মান্টোকে আমি চন্দরের চাইতে বেশি পছন্দ করি, বরং দুজনকেই আমার একই রকম চমক সর্বস্ব রাইটারই মনে হয়৷ কিংবা, কে জানে, হয়তো অবচেতনে চন্দরের চাইতে আমি মান্টোকেই বেশি পছন্দ করি এবং এর একটা যৌক্তিক কারণও তৎক্ষনাৎ আমার মাথায় আসে, আর তা হল, আমাদের দেশে মান্টোকে যতটা চর্চা করা হয়, চন্দরকে নিয়ে তার ছিটেফোঁটাও হয়না, মান্টোর জীবনী নিয়ে যত সভা সেমিনার হয়, তার সিকি ভাগও চন্দরের জীবনী নিয়ে হয়না। আর এই কারণেই চন্দরকে যতটা না, তার চাইতে বেশি মান্টোকে ভিজ্যুয়ালাইজ করা সম্ভব, আর সেই একই কারণে মনের পক্ষে চন্দরের চাইতে নিজেকে মান্টো মনে করাটাই অধিকতর সহজ৷ সে যাই হোক, মান্টো কিংবা মান্টোর নায়ক হিসাবে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমার অন্তত দুজন পতিতার কাহিনী মনে পড়ে, যাদের প্রথম জনের কাহিনী আমি শুনেছি, আর দ্বিতীয় জনেরটা দেখেছি। প্রথম জন আমার কানে আসে আমার স্কুল জীবনে, একটু উপরের ক্লাসে, আমার সমশ্রেণীর কিন্তু অধিক বয়সী কিছু বন্ধুর কাছ থেকে, বয়সের গুণে যারা তখন নিয়মিত মাগীপাড়া কিংবা খানকিপাড়ায় যেত (তখন আমাদের কাছে এই নামেই পরিচিত ছিল) এবং পাড়াটা ছিল আমাদের বাসার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রেল লাইনের ধারে, আর সেই পাড়ায় কখনোই আমার যাওয়া হয়নি, কেননা আমি ছিলাম মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান এবং সেই কারণে অতি অবশ্যই ভীতু ও সংযমী। তবে পাড়া ফেরত বন্ধুদের কাছ থেকে তাদের অভিযানের কাহিনী শুনে মজাটা ঠিকঠাক নিতে কখনো কসুর হত না। এমনই এক পাড়া ফেরত বন্ধুদের আসরে তার গল্প আমি শুনি। ধরা যাক, তার নাম জরিনা। বন্ধুরা জানাল, সে রাতেও সে একই ভাবে পাড়ায় তার নির্দিষ্ট ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে খদ্দের ডাকছিল, যদিও তার গায়ে ছিল প্রচণ্ড জ্বর। আর তাই কোন খদ্দের তাকে নিচ্ছিল না, কেননা তাদের মনে হচ্ছিল, এই জ্বরের শরীর নিয়ে সে তাদেরকে যথাযথ ভাবে সন্তুষ্ট করতে পারবে না, যদিও সে তাদেরকে বারংবার আশ্বস্ত করছিল যে, জ্বরের কারণে কোন সমস্যা হবে না, সে তাদেরকে সম্পূর্ণ তৃপ্ত করতে পারবে এবং শেষের দিকে সে চিৎকার করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে জানাচ্ছিল যে, তার ঘরে কোন টাকা নেই এবং আজকে কোন খদ্দের না পেলে তার ছোট্ট মেয়েটার মুখে সে কোন খাবার তুলে দিতে পারবে না। তবু, বন্ধুরা জানাল, সেদিন সে কোন খদ্দের পায়নি। কাহিনীটা শোনার পর কেন জানি তা আমার মনে দাগ কেটে গেল, আর এমন ভাবে কাটল যে, তা আমি আর কখনো ভুলতে পারিনি। আর অপর জনের সাথে আমার দেখা হয় বাংলামোটরের একটা গলিতে, রাতে, খুব সম্ভব দশটা এগারোটার দিকে, বা আরও পরে। বাংলামোটরের একটা গলি দিয়ে বের হয়ে আসে সে- সুন্দর, আয়রন করা সালওয়ার কামিজ, পায়ে ট্র্যান্ডি পাম্প শ্যুজ, চকোলেট কালারের, কাঁধে কালো ভ্যানিটি ব্যাগ, আর হাতে চামড়ার বেল্টওয়ালা ঘড়ি- প্রথম দর্শনে তাকে আমার অফিস ফেরতা কোন কর্মকর্তা মনে হয়েছিল, এত মার্জিত ছিল চেহারা, আর সর্বত্র রুচির ছাপ। অথচ, খানিক বাদেই আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় যখন তার সাথে আমার দ্বিতীয় বার দেখা হয়, বাংলামোটরেরই একটু ভেতরের দিকে, একটা সাবওয়ের পাশে, যেখানে এক যুবকের সাথে তার দর কষাকষি হচ্ছিল। যুবকটি বলছিল যে, তারা চার জন, আর সে বার বার বলছিল যে, তার পক্ষে এক রাতে দুই জনের বেশি কখনোই সম্ভব নয়। বলতে লজ্জা নেই, প্রথম দর্শনে মেয়েটির প্রতি আমার প্রেম জেগেছিল, কিন্তু দ্বিতীয় এবং শেষ দর্শনের এই অভিজ্ঞতায় আমার সে প্রেম কর্পুরের চাইতেও বহু গুণে দ্রুত উবে গিয়েছিল, আর এই কথা শুনে ভার্সিটির এক বুদ্ধিজীবী বড় ভাই আমাকে তিরষ্কার করে বলেছিলেন- “তুমি তো মিয়া বড় লেখক হইতে পারবা না!”

*
পতিতালয়ের ছোট, চাপা, চল্লিশ কিংবা ষাট পাওয়ারের হলুদ বাতি জ্বলা প্রায়ান্ধকার ঘরের সস্তা কাঠের একটা খাটে যখন তার পাশে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম, তখন আমি পুরোপুরি মান্টো কিংবা চন্দর হয়ে গেছি! তখন আমি বুঝতে পারলাম, পুরোটাই আসলে একটা গেম- একজন মান্টো কিংবা একজন চন্দর হয়ে উঠার। আর তাই, তার পেটের খানিক উপরে দেখিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম- “এগুলো কিসের দাগ!”

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত