অনির্ণেয়

ষোলো বছর আট মাস পঁচিশ দিন পর

বলে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অলকা। প্রশ্ন করেছিলাম, কতদিন পর দেখা হল মনে করতে পারো?

আমি চোখ নামিয়ে নেই। ওই চোখে চোখ রাখা কঠিন। এখনো তীব্রাতা কিছু কমে নাই! কোনো বদল নাই! টকটকে লাল ঠোঁটে মৃদু অথচ তীক্ষ্ম হাসি লেগে আছে।

আমি চিরকাল ভীতু মানুষ। অলকাকে একটু ধরতে, ছুঁতে চাওয়া ছাড়া আমার তেমন কোনো বড় উদ্দেশ্য কখনো ছিলো না।

মাঝখানে অনেক বছর মাস সময় গড়িয়েছে এবং সম্পুর্ন সময় সে কাউন্ট করে রেখেছে জেনে একটু ধাক্কাই খেলাম।

এখনো চোখে মুখে চটুল ভাব। পাতলা ফুরফুরে শরীরে অনেক খানি মাংস লেগেছে অলকার। ওড়না কখনো গায়ে থাকতে চাইতো না ওর। তাই গলায় পেঁচিয়ে রাখতো। এখনো তেমন। সেই চিকন কোমর, দুই বিঘত একসাথে করে প্রায় আয়ত্তে আনা যেত, ভালো পরিমাণে স্থুল হয়েছে। তবে এর থেকে বেঢপ কিছু বরং আশা করেছিল আমার মন।

এতো বছর পর দেখা হবার কথা সামান্যও যখন আর মনে নেই ও তখন দিন মাস সব গুনে রেখেছে ভেবে ভেতরে মোচড়ানো বন্ধ হচ্ছে না।

বারান্দার কম আলোতে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে। ঘরে অনেক আলো, অনেক শব্দ, অনেক মানুষ। যে কেউ যেকোনো সময় বারান্দায় এসে পড়তে পারে। দূরত্ব তাই ভদ্রতা ভোলে না। অথচ এসব ভদ্রতার কোনো বালাই কোনো দিন আমারও ছিল না। অলকারও ছিলনা। আমি চুপ থাকলে অলকাই ঝাঁপিয়ে পড়তো একেকদিন।

ছোটো বোনের বান্ধবী অলকা। বড় ভাইয়ের জন্য মা পছন্দ করতেন। বড় ভাইয়ের অমত ছিল না। একদিন চুমু খেতে খেতে অলকা বলেছিল, তোমার ভাইকে কেন বিয়ে করব জানো? আমি ঠোঁটে আলতো চাপ দিয়ে বলেছিলাম, উহু ভাইয়া না, আমি তোমাকে বিয়ে করব। পালটা দাঁতের জোর বসিয়ে আমার ঠোঁটে, অলকা বলেছিল, ‘প্রশ্নই আসে না। তোমার পড়া শেষ হয়নাই, কবে চাকরি পাবা, কবে বিয়ে করবা, তার থেকে ভাইয়াকে বিয়ে করব তাহলে রোজ তোমাকে পাব।’

তৎক্ষনাৎ কথাটা মাথায় কাজ করেনি। আমাদের চারটি হাত তখন খুব ব্যাস্ত। নিশ্বব্দে। সিঁড়ি ঘরে। উপর বা নিচ থেকে যে কেউ চলে আসতে পারে। কোনোদিকে কোনো খেয়াল নেই।

পরে যখন অন্যান্য দিনের মতো অলকার স্পর্শসুখ রোমন্থন করতে পারছিলাম না তখন বুঝলাম সমস্যাটা কোথায়। সমস্যার বীজ অলকা নিজের হাতে আমার মগজে পুঁতেছিল।

ভেটো দিয়েছিলাম ভাইয়ার বিয়েতে। বোনকে বলেছিলাম অলকা যেন কোনো দিন এ বাড়ির সীমানায় প্রবেশ না করে।

ভালোমানুষ ভাইয়াটাকে বাঁচানোর উপায় ওই একটাই। ভাইয়া এসব কিছু জানতো না। তবে অলকাকে পছন্দ ছিল। সেক্সি, ক্রেজি, বুদ্ধিমতি, মায়াবতী বলতে যা যা বুঝায় সেসব ছিল অলকার মধ্যে। তার উপর ধবধবে সাদা ত্বকের মেয়ে সব ছেলে ই চায়। অলকাও এমন অভিনয় করত ভাইয়ার সামনে। যেন লাজুক লজ্জাবতী লতা। ছুঁয়ে দিলে চৌচির হয়ে যাবে। আমার ইঞ্জিনিয়ার ভাই সারাজীবন পড়াশোনা নিয়ে থেকেছে। এখন যখন বই থেকে মুখ তুলেছে তখন প্রেমের দেবী অলকা তার সমুখে।

তাদের বিয়েটা থামাতে ভালো বেগ পেতে হয়েছিল তখন। ভাইয়া খুবই বিরক্ত হয়েছিল। ছোটো বোন আর মা দুঃখিত হয়েছিল। অলকা অভিশাপ দিয়েছিল। আমি হেসেছিলাম। হৃদয় ক্ষরণের হাসি।

অলকার সাথে জাপটাজাপটি করতাম সেটা ঠিক প্রেম ভালোবাসা থেকে নয়। আমার করতে ইচ্ছে হতো। অলকাও না করে নাই। বরং একশত ভাগ সায় ছিল তার। আমি ভাবতাম আমাকে ও ভালোবাসে। অথচ কী দারুণ অসততা অবলম্বন করে, আমার ভাইয়ের বউ হয়ে, আমার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাবার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে! এ কথা তখন আমি কাকে বলতে পারতাম! মা, বোন, ভাই কাউকে বলা সম্ভব হয়নি। কেবল সবার সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে ভাইয়া কিছু একটা সন্দেহ করেছিল নিশ্চিত। বুদ্ধিমান মানুষ। ছকে ছক মেলালে অনেক তথ্য আপনা থেকে বের হয়ে আসে।

আজ বোনের বিবাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠানে আসতেই হলো। সামাজিক এইসব হইহল্লা এড়িয়েই চলি। ভালো লাগে না। কে জানে অলকার অভিশাপ সত্যিই লেগে গিয়েছিল কিনা। কেঁদে কেঁদে শেষ কথা বলেছিল, তুমি কখনও সুখী হবে না। কখনো না।

সুখ অন্বেষণে আমার যেতেই ইচ্ছে হয়নি। আমি বিয়ে করিনি। অলকার পর আরো অনেক মেয়ে দেখেছি। দেখতে দেখতেই সময় চলে গেছে। কারো সাথে বন্ধন তৈরি হয়নি। তার চেয়ে ভাইয়াই সুখী আছে। মা বিয়ে দিয়েছে দেখেশুনে। ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে ওদের।

অভিশাপ দিয়ে অলকা যে খুব সুখে নেই তা আমি জানি। বোনের কাছেই দুই একবার শুনেছি ওর কথা। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অলকা। কিন্তু দুবার বিয়ে করে দুবার’ই সংসার করতে ব্যার্থ হয়েছে।

এমন সময় সিগারেট হাতে ভাইয়া এলো বারান্দায়। এবং ভূত দেখার মতো চমকে গেলো মনেহয় আমাদের দেখে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত