ঈশ্বর পুত্র

ঘুম থেকে উঠেই ব্যাপারটা টের পেলাম। আমার ঠোঁটের কোণে দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার মত আলতো একটা হাসি ফুটে উঠেছে, নিজেই টের পেলাম। মনটা খুব ফুরফুরে হয়ে গেলো। উঠে পাশের ঘরে যেতেই মায়ের মুখোমুখি। আমার মুখে হাসি দেখে মা-ও হাসলেন।

মাঃ  কি রে, এত খুশি খুশি! কারণ কী?

আমিঃ  তুমিই আন্দাজ কর।

মাঃ তুই কি প্র্যাগনেন্ট?

আমিঃ  ঠিক ধরেছো।

‘এক্ষুণি ঘর থেকে বের হয়ে যা! মরে যা তুই! তোর ঐ মুখ আমরা আর দেখতে চাই না।’ – নাহ, মা এসবের কিছুই আমাকে বলেন নি। বরং খবরটা বলার পর আমরা দুজন আনন্দে হেসে উঠলাম। মা আমাকে খুশিতে জড়িয়ে ধরলেন। খুব আনন্দ হচ্ছিল দুজনেরই। মা জিজ্ঞেস করলেন, — যোসেফ জানে?

আমিঃ না, এখনো জানাই নি। আমি নিজেই তো টের পেলাম কিছুক্ষণ আগে।

মাঃ ওকে কথাটা বল। বাসায় আসতে বল।

আমিঃ আচ্ছা।

যোসেফ, আমার প্রেমিক। কিছুদিন পর আমাদের বিয়ে। আমাদের বিয়ে হবে ঘটা করে। নানান সব আয়োজন। এখন সেসবেরই প্রস্তুতি চলছে দুই পরিবারে।

কথাটা যোসেফকে জানানোর জন্য আমিও অস্থির হয়ে আছি। তবুও কেমন একটু ইতস্তত লাগছে। এটাকে কি ভয় বলবো, নাহ এটা ভয় নয়। অন্য কোন কিছু। মোবাইলটা হাতে নিয়ে যোসেফকে কল দিই।

আমিঃ গুড মর্নিং।

যোসেফঃ  মর্নিং!

আমিঃ ঘুম ভাংগলো?

যোসেফঃ  ভাংগলো। এখন বলো, কী খবর?

আমি খবরটা খুব স্বাভাবিকভাবেই যোসেফকে জানাই। যোসেফ আমাকে একবারও ‘অসতী, কুলটা, নষ্টা, ভ্রষ্টা মেয়ে’ এসব বলে অপমান করে নি। ব্রেক আপের প্রসংগ-ও তোলে নি। বরং সেদিন সে অনেকগুলো গোলাপ ফুল নিয়ে আমার সাথে দেখা করেছে। ওর পরিবারে সবাই নানা রকম উপহার নিয়ে আমাদের বাসায় এসে উপস্থিত। প্রতিবেশিরাও জেনেছিল খবরটি। তারা কেউ নাক সিঁটকে আমাকে ‘ছি ছি’ করে নি। মুখ লুকিয়ে হাসাহাসিও করে নি। তারাও আনন্দিত হয়ে অনেক অনেক উপহার নিয়ে এসে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। পুরো বাড়ি উৎসবমুখর হয়ে উঠে। যেন সেদিন-ই আমার ‘বেবি শাওয়ার’! এত কিছুর পরেও আমার মন আনন্দে ভরে উঠবে না, কেন? আপনারাই বলুন!

সব কিছু অবশ্য এত সহজ ছিল না। আমার গর্ভের সন্তানটির জৈবিক পিতা কিন্তু যোসেফ নয়। এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক নেতা ‘জনাব এক্স’ এর একমাত্র ছেলে ‘সেকেন্ড এক্স’ । যোসেফের সাথে আমার বিয়ের দিন তারিখ পাকা হয়ে যাবার পর সেকেন্ড এক্স প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠে। আমাকে অনেক দিন থেকে সেকেন্ড এক্স প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে উত্যক্ত করে যাচ্ছিল। কোন কিছুতে যখন কাজ হচ্ছিল না, তখন হঠাৎ একদিন আমাকে অপহরণ করে তার বাংলোতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। তারপর আধ মরা করে ফেলে রেখে যায় রাস্তায়। আমার জন্য খুব খারাপ সময় ছিল সেটি। শারীরিক, মানসিক সব দিক থেকেই বিপর্যস্ত ছিলাম। সে সময় আমার প্রেমিক , যোসেফ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমরা দুজনেই এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠি। আমাদের দুজনের সাথে সারা দেশ ধর্ষকের বিচারের দাবিতে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তার-ই ফলশ্রুতিতে সেকেন্ড এক্স এখন জেলে। সব কিছু এত দ্রুত হলো যে, কিছুদিন পরেই ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। আর এখন আমি প্র্যাগনেন্ট। ডাক্তার বলেছেন, আমার সন্তানের জন্ম হবে ডিসেম্বরের শেষ দিকে। যোসেফ আর আমি চাইছি আগে থেকে ঠিক করে রাখা দিয়ে দিনটিতেই আমাদের বিয়ের উৎসব করতে। আর আল্ট্রাসনোগ্রাফের রিপোর্ট দেখে আমরা ঠিক করেছি আমাদের সন্তানের নাম রাখবো, যিশু। হ্যাঁ, যিশু আমাদের সন্তান, আমার আর যোসেফের।

নির্ধারিত দিনে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলেও কিছু সমস্যা শেষ পর্যন্ত থেকে গেলো। সেকেন্ড এক্সের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগে আগে জনাব এক্স ও তার সাংগ পাংগরা আমাদের বারবার হুমকি দিতে লাগলো। তখন যোসেফ ও আমাকে কিছুদিন পালিয়ে থাকতে হয়েছে। আমরা অনেক দূরের এক গ্রামে পালিয়ে যাই। ভিলেনেরা কিন্তু ঠিকই বারবার আমাদের পাত্তা পেয়ে যাচ্ছিল। শেষে এক গ্রামের খুব সাধারণ কৃষক আমাদেরকে তার গোয়াল ঘরে লুকিয়ে রেখে দেন। যোসেফ অবশ্য কমুনিকেটিং ডিভাইসের মাধ্যমে তার বন্ধু বান্ধবদেরকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ওরা চাইছে সারা দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা দ্রোহের আগুণ ছড়িয়ে দিতে। যোসেফ অনেক কষ্ট করছে। একদিকে আমার যত্ন নিচ্ছে, আবার থিতিয়ে যাওয়া আন্দোলনটা আবার চাংগা করারও চেষ্টা করছে। এরকম অবস্থাতেই একদিন গোয়াল ঘরে আমি জন্ম দিই যিশুকে। তারিখটা অবশ্য আমার খেয়াল নেই। যোসেফই জানালো, আজ ২৫ ডিসেম্বর। আর আজই সারা দেশের মানুষ আবার প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে জনাব এক্স ও তার পুত্রের বিরুদ্ধে। জনাব এক্সের নানান অপকর্মের খবর এবার প্রধানমন্ত্রীও জেনে গেছেন। সেকেন্ড এক্সের মৃত্যুদণ্ড-ও আজ রাতেই কার্যকর হবে। আমাদেরও আর লুকিয়ে থাকতে হবে না।

আমি তখন যিশুকে দেখছিলাম। পয়মন্ত ছেলে আমার। কী সুন্দর দেখতে!ওর জন্ম কিভাবে হলো, কোথায় হলো , বাবা কে, এগুলো কোন বড় বিষয় নয় আমার কাছে। বড় হলে যে আমার এই ছেলে অত্যন্ত মানবিক গুণের অধিকারী হবে, এ আমি দিব্য চোখে ঠিক দেখতে পাচ্ছি। যিশুর স্পর্শে সাধারণ মানুষের সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যাবে। হবেই তো, হতেই হবে, ও যে আমার সন্তান! ওহ না না, শুধু আমার নয়, আমার আর যোসেফের, আমাদের দুজনের সন্তান। ছেলেকে দেখতে দেখতেই শুনি হেলিকপ্টারের শব্দ। যোসেফকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। আনন্দে ও প্রায় চেচাচ্ছে , ‘’মেরি! দেখো, দেখো, যিশুকে দেখতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী চলে এসেছেন।’’ আমিও খুব অবাক হলাম। ঘোর লাগা চোখে দেখলাম, তিনি আমার যিশুকে কোলে নিয়ে চুমু খাচ্ছেন। কৃষকের গোয়াল ঘরের বাইরে সাংবাদিকদের ভীড়। লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে যিশুর জন্ম আর প্রধানমন্ত্রীর আগমনের খবরটি। আহা, কি যে শান্তি! আনন্দে আমার চোখে জল চিক চিক করে।

আমার চোখে জল চিক চিক করে। না, না, আনন্দে তো অবশ্যই নয়। আমার চোখে জল চিক চিক করে। আমি মেরি, আমি বসে আছি একটি ক্লিনিকে। নিজেকে আপাদমস্তক এক কালো বোরখায় ঢেকে রেখেছি, যেন আমাকে কেউ চিনতে না পারে। এলাকার প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক নেতা ‘জনাব এক্স’ এর একমাত্র ছেলে ‘সেকেন্ড এক্স’ আমাকে অপহরণ করে ধর্ষণ করে। খবরটা যেন কেউ না জানে, সেজন্য মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। বলেছিল, কেউ যদি কিছু জানে আমাকে তো মারবেই, বাবা-মা আর সবাইকেও মেরে ফেলবে। আরো আরো অনেক কিছু। আমার না, এতো কিছুর পরেও খুব বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কীভাবে যে বেঁচে থাকতে হয়, তা আমার জানা নেই। তা-ই সব চেপে গিয়েছিলাম। সেকেন্ড এক্সের কথা মত এবারশনের সিদ্ধান্ত নিই। এজন্য সেকেন্ড এক্স আর তার সাংগ পাংগরাই সব কিছু করলো, তবে গোপনে। এই যে ক্লিনিকে বসে আমি, আমার পাশে একজন লোক। আমি তাকে চিনি না, দেখিও নি কোন দিন।টাকার বিনিময়ে আমার স্বামী সেজে এসেছে। সেকেন্ড এক্স-ই তাকে ঠিক করে দিয়েছে। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ডাক্তারদেরকেও ওরা এবারশন করার জন্য রাজি করিয়েছে।

— আপনিই কি মেরি!

— হ্যাঁ।

— আমাদের সাথে আসুন।

— হ্যাঁ, চলুন।

ক্লিনিকে্র কর্মচারী ও নার্সের পিছু পিছু আমি যেতে থাকি। তারপর অপারেশন টেবিলে উঠে শুয়ে পড়ি। আজ ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, আজ বড়দিন। আমি এখানে এসেছি এবারশন করতে।আমার গর্ভের সন্তানটিকে আমি একই সাথে অত্যন্ত ঘৃণা করি ও ভালবাসি। আমাকে সে চাইলে ক্ষমা করে দিতে পারে, না-ও পারে। তাতে আমার এখন কিছুই যায় আসে না। ঠোঁটে দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার মত আলতো হাসি রেখে চোখ বন্ধ করে দিই আমি।

২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত