মৃত্যুঞ্জয়ী

এক

বন্ধ দুইটা চোখ দেখা যাচ্ছে। তার উপরে অনবরত বৃষ্টি পড়ছে। পাথরের ফোটার মত বৃষ্টির বেগ। তার সাথে মেঘ ও সমুদ্রের গর্জন। দ্বীপের দক্ষিণ দিগন্ত ধরে বৃষ্টিকে ছাপিয়ে বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আচড়ে পড়ছে লাশের মত পড়ে থাকা লোকটার গায়ে। এমন সময় লোকটার চোখের পাতার ঠিক উপরে কোন একটা গাছের ডাল বেয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে। তখনি তার চোখ নড়ে উঠে। হঠাৎ সে চোখ খোলে বড় করে। লম্বা দম ছাড়ে। ঘাস, ঝোপ আর ছোটবড় মাথাভাঙা গাছে ভরা একটা জায়গা। ঝড়ো বাতাশ, বৃষ্টি, কালো হয়ে আসা আকাশ আর সমুদ্রের ভয়ঙ্কর গর্জন সব কিছু মিলিয়ে কেয়ামত তুল্য অবস্থা।

ঝড়ো বৃষ্টির মাঝে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ছে। লোকটা দৌড়ে লাফ দিয়ে উপড়ে পড়া গাছটার নিচে আশ্রয় নেয়। শীতে কাঁপতে থাকে তার হাড়মজ্জা। গামছাটা চিবিয়ে মাথা মুছতে মুছতে তার চোখ এক জায়গায় থমকে যায়। চোখ মুছে ভাল করে সেদিকে তাকিয়ে তার চোখ মুখ স্থির হয়ে যায়। 

দশ-বারো হাত দুরে উপকুলের দিকে হেলে পড়া গাছের মাথায় যেখানে বিশাল বিশাল ঢেউ এসে মিলিয়ে যাচ্ছে সেখানে একটা মানুষ! মানুষ না জ্বীন-পরি সে আন্দাজ করতে পারে না। ভেজা বালুতে উপুড় হয়ে এদিকে মুখ করে আছে! তার শরীরে শিহরণ দিয়ে উঠে। একটা গাছের গুড়ির উপর এক পা, বাকা হয়ে থাকা মুখটায় ঢেউ আসলে কিছু পানি ঢুকে আবার বের হয়। একটা নারী দেহের বুক থেকে নিচের অংশ ভাসছে ডুবছে। 

এদিকে অনবরত ঝড়ো বাতাস, বৃষ্টি, এদিক সেদিক ছোটবড় ঢাল ভেঙ্গে পড়ছে। লোকটা ভালো করে চারিদিক দেখে নিল। কাছে ধারে কোন মানুষজন, ট্রলার, কোস্টগার্ডের জাহাজ কিছুই চোখে পড়ে না। ওদিকে দেখে তার ভীষন ভয় হয়। লাশটা ঢেউয়ের সাথে সাথে তার দিকেই আসছে। সে একা। লোকটা চোখ লাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। ঝড় হচ্ছে, লাশ আসছে, তার চারিদিকে ডালপালায় জমাট বেধে যাচ্ছে, সাগর উত্তাল হয়ে ধেয়ে আসছে তার দিকে, সে জ্ঞান হারিয়ে মাথা ফেলে দেয়। 

দুইটা লাশ মুখামুখি পড়ে আছে। তার মাঝে ঝড়-বৃষ্টি চলতে থাকে অনবরত। এক সময় হেলে পড়ে থাকা গাছ ভিজে ফোটা ফোটা পানি তার গালের উপরে পড়তে থাকে, আবার পানি প্রবহ গড়িয়ে একটু সরে গিয়ে পড়ে তার কান বরাবর। কানে পানির ফোটা ঢোকার পর সে কানে হাত দিয়ে মাথাটা ইঞ্চি দুয়েক তুলে চোখ খোলে। চোখের এক ফুট সামনে অনবরত পড়তে থাকা বৃষ্টির মাঝে এক জায়গায় গিয়ে থামকে যায়। এক অপরুপ সুন্দরী নারীমুখ!

সে চমকে উঠে বসে পড়ে! অজ্ঞান হওয়ার আগের সেই লাশটা সে চিনতে পারে। আরেকটু ভালো করে দেখে সে ভয়ে ভয়ে বসে পড়ে। যা ঘটে চলেছে তার মধ্যে এ আর বেশি কী! সাগরের অনেক গল্প তার জানা। জলপরীর গল্প শুনেছে সে ছোট বেলায়। উনিশ বছর ধরে সাগরে যাতায়াত করে কিন্তু আজকের আগে এমন কিছু চোখে দেখেনি! হায় খোদা… রক্ষা করো! 

ছেলেটা লাশটার মুখের দিকে তাকিয়ে তার উপরে পড়া বৃষ্টি দেখছে। আর ভাবার চেষ্টা করছে লাশটার এখানে আগমনের হেতু। মনেহয় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মরা। বড়লোকের বেটি দেখে বুঝা যায়। কতদূর থেকে আসছে কে জানে! এটা মৃত্যুর আগেকার মুহুর্ত নাকি পরের সে তফাৎ করতে পারে না। দোলাচালে পড়ে  নিজের হাতে চিমটি দিয়ে নিশ্চিত হয়। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সে চেয়ে আছে জল পরীর দিকে। তার কালচে কপালের উপরে পড়তে থাকা পানি প্রবহ নাকের মাথা থেকে লাশের মুখের সামনে পড়ে- তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার ঘোর লাগে। হঠাৎ লাশটা চোখ মেলে তাকায় তার চোখে। সে চমকে উঠে। তারপর পেট উগলে পানি বের হতে থাকে মুখ দিয়ে। ছেলেটা হা করে তাকিয়ে দেখে। মেয়েটা শীতে কাঁপতে কাঁপতে উঠে আধা বসে চোখ বড় করে তাকায় চারিদিকে। কেয়ামতের মত অবস্থা। সে আত্মবিশ্বাসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাল করে দেখে অবচেতনে বলে- বেঁচে আছি! থ্যাঙ্কস গড। তখনি তার মুখ দিয়ে অবচেতনে বেরিয়ে আসে- “বাকীরা?” 

সে চারিদিকে ভাল করে দেখতে থাকে। এ কোথায় এসেছে সে। 

মাঝি মুখটা হা করে আছে। অবাক হয়ে দেখছে। এক সময় মেয়েটার চোখ যায় ভেঙে পড়া একটা গাছের গোড়ায়। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য মাথার উপরে গাছটাকে রেখে একজন অদ্ভুত রকম মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তেলতেলে কালো চেহারার লোকটাও শীতে কাপছে। মেয়েটা শোয়া থেকে অর্ধেক উঠছে এমন সময় লোকটাকে তার চোখে পড়ে। দেখেই সে চমকে উঠে বসে যায়। “এই কে আপনি? আমি কোথায়?”

বৃষ্টি পড়ছে। লোকটা তাকে ইশারা দেয় গাছের ছাউনির নিচে আসতে। মেয়েটা উঠে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে কাছাকাছি এসে বলে- কে আপনি? তখন সে জানায় তার বিস্তারিত। ইলিশের জাল দেখতে সাগরে এসে ট্রলার উল্টে যায় তাদের। তারপর কিভাবে কি হয়েছে সে বলতে পারে না৷ মেয়েটাও বলে তার কথা। সে ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। সুন্দরবনে গবেষণার জন্য তারা এসেছে। হঠাৎ আকাশটা খারাপ হয়ে যায়। মহাবিপদ সংকেত মাথায় নিয়ে জাহাজ ছাড়ে শেল্টার সেন্টারের দিকে। এক সময় তাদের জাহাজ ঝড়ের ঘুর্নিতে পড়ে ডুবে যায়। এই ঘটনা হয়তো এতক্ষণে সারা দেশে তোলপাড় চলছে। গত রাতে ঘটে যাওয়া জাহাজ দুর্ঘনার ভয়ঙ্কর লৌমহস্যক বর্ননা দেয় মেয়েটা। মাঝি চোখ বড় বড় করে শুনে। 

মেয়েটা শীতে কাঁপতে কাঁপতে আরও কাছে ঘনায়। ঠিক তখনি বিশাল একটা ডাল এসে পড়ে তাদের দিকে। মেয়েটা লাফিয়ে পড়ে উপড়ে পড়া গাছের তলায়। ছেলেটার পাশে। মেয়েটা উষ্ণতার জন্য কাছে ঘনায়। কিন্তু মাঝি অস্বস্তিতে ভোগে। তা কাটিয়ে উঠতে সে চারিদিক ভালো করে দেখতে থাকে।

সাগর ফুলতে ফুলতে গাছের গোড়ায় পানি এসে গ্যাছে। আর এখানে বেশিক্ষণ থাকার উপায় নাই। এভাবে আরও ঘন্টাখানেক থাকলে দ্বীপের ভুমিটাও পুরোপুরি ডুবে যাবে। এই দ্বীপে মনুষ্য বসতি নাই। মাঝি জানে। 

সমুদ্র ফুলছে অনবরত। ঝড়ো বাতাস কিছুটা হালকা দেখে ছেলেটা একটু দাড়িয়ে দেখতে যাবে এমন সময় সে পড়ে যায় “মাগো” বলে। তখন প্রথম সে টের পায় তার পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা। সে পা’টা ভালো করে দেখে- তালুতে গোড়ালির অংশের বড় এক টুকরা মাংস নাই। খাদের মত জায়গাটার উপরিভাগ সাদা হয়ে আছে। সে টেরই পায়নি এতক্ষণ! মেয়েটা প্রশ্ন করে- কী হয়েছে এখানে?

মাঝি জানেনা সুচক ইশারা দেয়। সে তখন থেকে ব্যাথাটা ভালো করে টের পায়। তারা যেন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। তবুও হাল ছাড়া যাবে না। ছেলেটা সংকল্প-বদ্ধ। বেঁচে যেহেতু আছি লড়ে যাবো। ছেলেটা এক পায়ে দাড়িয়ে ডালপালার মাঝ থেকে মাথা বের করে দক্ষিণ দিকে দেখতে থাকে একটা ট্রলার উল্টে আটকে আছে কয়েকটা কেওড়া গাছের ভাঙা গোড়ায়। ট্রলার বললে ভুল হবে। ছোট সাইজের ইঞ্জিনের নৌকা। বিশাল বিশাল ঢেউ এসে নৌকাটাকে নাচাচ্ছে অদ্ভুৎভাবে।

ঝড়ো বৃষ্টির প্রতিটা ফোটা গায়ে পড়ে বুলেটের মত, মানুষ উড়িয়ে নেয়ার মত বাতাস বইছে, উত্তাল ঢেউয়ের ভয়ঙ্কর গর্জন, সমুদ্র প্রতিনিয়ত ফুলছে- ঠিক তখনি ছেলেটা শীতে কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যায়; যেন দাঁড়ানোর শক্তি নাই তার। 

এক সময় জোরে একটা ঢেউ আসলে তারা দু’জনে হেলে পড়ে। তারপর ধরাধরি করে উপড়ে পড়ে থাকা ডালে পা দিয়ে মেয়েটা ছেলেটাকে টেনে তোলে। তারা দাড়িয়ে ধরাধরি করে শুয়ে থাকা গাছের উপরে উঠে দেখতে পায় ট্রলারের কাছাকাছি বহুদূর ভুমি ডুবে গেছে। সমুদ্রের হুঙ্কার গর্জনে কান বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! 

উপরে দাড়িয়ে থাকা অসম্ভব। আরেকটু জোরে বাতাস আসলে তাদেরও উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। বাতাস, শীত, বৃষ্টির ফোটা যেন হাড়ে লাগে। সমুদ্রের গর্জন, বিজলি, বাজ সব মিলিয়ে প্রকৃতি আজকে গলা চিপে ধরেছে।

এমন সময় মাঝি তার হাত ধরে টান মারে। কাটা বাম পায়ের সামনের অংশে ভর দিয়ে প্রায় লাফাতে লাফাতে তারা ছুটে যায় ট্রলারের দিকে। 

শো শো বাতাস, পড়ে থাকা ডালপালা, ঘাস, সাপ, ছোটবড় গাছ সবকিছু পার হয়ে তারা একটা গাছের গোড়ায় আসলে হঠাৎ মাঝি চিৎকার দিয়ে বলে- ম্যাডম…! 

জেরিন ডান দিকে ঘুরে দেখতে পায় বিশাল উঁচু এক ঢেউ ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। ভেঙ্গে যাওয়া একটা গাছের গোড়া চেপে ধরে সে রক্ষা পায়।

দুই

দুইজন মিলে গাছটাকে শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে ঝাপটে ধরে। তাদের মাথার উপরে ঢেউ একটু দুরে গিয়ে পড়ে। তারা ভেসে উঠে আবার গাছটাকে জড়িয়ে ধরে। পানি নেমে যায়…। মাঝি আর জেরিন চারিদিক দেখতে থাকে। জেরিন ডেকে বলে- মাঝি ট্রলার…। 

মাঝি ঘুরে দেখতে পায় গত ঢেউয়ে ট্রলারটা বিশ-ত্রিশ হাত ভেতরে তিনটা গাছের চিপায় এমনভাবে ফেসেছে যেন একদিকে প্রেসার দেয়া গ্যালে এটাকে সোজা করে নেয়া যাবে। তারা কোমর সমান পানিতে প্রায় সাতরে কিছুদূর গিয়ে দেখতে পায় তিন থেকে চার হাত লম্বা একটা সাপ তাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। তারা হাতে হাত ধরে থেমে যায়। সাপটা তাদের ঠিক সামনে আসার পর একটা মাঝারী ঢেউ এসে সাপটাকে আরও আট দশ হাত পেছনে নিয়ে যায়। সাপটা আবার আসতে থাকে। আবার ঢেউ। 

পানির উপরটা দেখে মনে পড়ে যায় বৃষ্টির কোপ কিছুটা কমেছে। তবে ঝড়ো বাতাশ বইছে। তার মাঝে আরেকটা ঢেউ নামার সময় সাপটাকে আরও দূরে পিছিয়ে দেয়। তারা দাড়িয়ে দেখতে থাকে সাপ এবং তাদের বাচার লড়াই। তখনি মাঝি হাত টান দিয়ে বলে “ছলেন”। 

তারা আরও এগিয়ে গেলে বৃষ্টি বাড়ে। তীব্র ঠাণ্ডা বাতাশ বইছে। সমুদ্রের পানি একেবারে বরপ। তারপরও তারা গলা ডুবিয়ে আগায়। চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত এভাবে যাওয়ার পর দেখতে পায়- ট্রলারটা তিনটা গাছের গোড়ায় আটকা। মাঝি কোমরের গামছাটার একটা অংশ ছিড়ে পায়ের কাটা জায়গায় পেছিয়ে ট্রলারের একটা কাঠ ধরে ঝুলে একটা দড়ি পেছনের দিকে ছুড়ে দেয়। তারপর নেমে এসে ট্রলারের মাথার দিকে একটা গাছের গোড়ায় পেছিয়ে এগিয়ে দেয় মেয়েটির দিকে। দুইজনে মিলে টানতে টানতে অনেক্ষণ পার করার পর ট্রলার খাড়া হয়। এবার  বাতাস আর ঢেউ মিলে ট্রলারকে এক দিকে টানতে থাকে। মাঝি তাড়াহুড়ো করে গিয়ে একটা গাছের সাথে পেচায়। ঠিক তখনই মেয়েটা চিৎকার দিয়ে পেছন দিক থেকে মাঝির হাত ঝাপটে ধরে নৌকার দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকে। মাঝি মুখ ঘুরিয়ে নৌকার দিকে তাকিয়ে দেখে নৌকার উপরে একটা মানুষের পা দেখা যাচ্ছে। মাঝি মেয়েটার হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় নৌকার দিকে। লাশটা উপুড় হয়ে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে মুখ দেখে চমকে উঠে বলে- লিটন! তারপর সে মেয়েটাকে জানায় বিস্তারিত। লাশটা তার পূর্ব পরিচিত এবং বন্ধু। তার চোখে পানি চলে আসে। তারপর ঝড়ের অবস্থা দেখে সে লাশটাকে এক পাশে রেখে পানি সেচতে থাকে। কিছুক্ষণ সেচার পর বৃষ্টি আরো বাড়ে। কিন্তু তুফান বাতাশ কিছুটা কম। 

মাঝি একপাশে পড়ে যাওয়া ছাউনিটা টেনে এনে দেখতে পায় এর মাঝ বরাবর লম্বা হয়ে ভেঙ্গে আছে। দুইজনে মিলে ছাউনিটাকে টেনে এনে বেধে দেয়। তখন আবার বাতাসে টেনে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা। শেষে আরেকটু নিচু করে বেঁধে নিলে বাতাস কম ধরে। ঝড়ো বাতাশ, উত্তাল ঢেউ, বৃষ্টি বা ফুলে উঠা সমুদ্র- সব মিলিয়ে আজ মহাপ্রলয়ের গন্ধ পাচ্ছে তারা। বাঁধা অবস্থায় ট্রলারটা এমনভাবে ঢেউয়ে উঠা নামা করছে যেন যেকোনো সময়ই উল্টে যেতে পারে। তারা শীতেও কাপছে। জেরিন আর সহ্য করতে পারে না। সে ট্রলারের একটা রড ধরে বসে যায়। এবার মাঝি ভেতরের বাক্সটা খুলে দেখার চেষ্টা করে কী কী আছে? একটু শুকনো কাপড় এই মুহুর্তে তাদের সবচে বেশি দরকার। তারা কাঁপছে।

সেইফটি বক্সে পাওয়া গেল বিস্কুট, ক্যারোসিন, সরিষার বোতল, মুড়ি, বয়ুমে বিড়ি আর লাইটার। দশ টাকার দুইটা নোট, সাথে প্লাস্টিক প্যাচানো পুরনো কাপড়চোপড়। 

ঢেউয়ে বাধা ট্রলার উল্টে পাল্টে যাওয়ার অবস্থা। সমুদ্র প্রতিনিয়ত ফুলছে, পানি বাড়ছে তো বাড়ছেই। এতক্ষণে গাছের গোড়া চার থেকে পাঁচ হাত ডুবে গেছে। মাঝি যেকোনো ভাবেই হোক দ্রুত ট্রলার ছাড়তে চায়। মেয়েটা ভয় পায়। মাঝি ইঞ্জিনের উপরের তেলের টাঙ্কির ঢাকনা খুলে দেখে তেল ক্যামন আছে। এবার সে প্যাডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করে। মেয়েটা থামতে বলে। মাঝি বলে ইঞ্জিন চলে কি না টেস্ট করে দেখবে। 

মেয়েটা একটা গেঞ্জি গায়ে ছাউনির নিচে বসে আছে আর মাঝি খোঁড়া পা নিয়ে ইঞ্জিন চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজে। এক সময় ইঞ্জিন স্টার্ট হয়। তারপর আবার বন্ধ হয়ে যায়। মাঝি এগিয়ে ছাউনিতে জেরিনের পাশে আশ্রয় নেয়। ট্রলার খুব ঝাঁকাচ্ছে। স্থির হয়ে থাকা যায় না।

জেরিন বলে- আমার খুব খুদা লাগছে। মাঝি বলে মুরি বিস্কিট আছে। কিন্তু মেয়েটা বলে বিস্কুট মুরি খাইলে এখন বমি পাবে। বমি পাবে। তখন মাঝি বলে দাড়ান। খুড়িয়ে খুড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে জেলেদের মাছের বক্সটা। সেখানে বরপে ঢাকা কয়েকটা মাছ দেখা যায়। সেখান থেকে একটা মাছ নিয়ে, মাছটাকে কাঠ দিয়ে অনেক্ক্ষণ ধরে পুড়িয়ে, উপরে লাল লাল কাঁচা লবন ছিটিয়ে এগিয়ে দেয় মেয়েটার দিকে। 

তারপর মেয়েটা একটু খেয়ে মাঝির দিকে এগিয়ে দেয়। মাঝি সামনে রেখে দেয়। ট্রলার কোন ভাবেই স্থীর হয় না। বিশাল বিশাল ঢেউয়ে আচড়ে পড়ে। ক্যামন যেন এক ধরণের ঝাকুনি লক্ষ্য করে মেয়েটা। পরিস্থিতি ভয়াবহ। এক সময় মেয়েটা জিগ্যেস করে মাঝিকে তার বাড়িতে কে কে আছে, তারা তার জন্য চিন্তা করছে কি না। অন্যদিকে মেয়েটা তাকে বলে তার হাজবেন্ড ও ছোট্ট ছেলের গল্প। বৃষ্টি কমেছে। কিন্তু গাছ ভেঙে উড়িয়ে নেয়ার মত বাতাস অনবরত বইছে। নৌকার ছাউনি উড়িয়ে নেয়ার ঝুঁকি এখনো কমেনি। 

মাঝি এক পা আরেক পায়ের উপর রেখে ক্ষতটা দেখছে। উপরিভাগের রংটা কিছুটা নীলচে আকার ধারণ করেছে। মাঝি প্রচন্ড ব্যাথা দাত চেপে সহ্য করে এক সময় তাড়া দেয় তাদের ট্রলার ছাড়া উচিত বলে। মেয়েটাকে সে আশ্বস্ত করে- ট্রলার ছাড়লে পাশের দ্বীপ তিনচার মাইল দূরে,  সেখানে গিয়া পৌঁছাতে পারলে আর কোন চিন্তা নাই। সেদিকে বসতি আছে। তবে লোকজনকে সম্ভবত শেল্টার সেন্টারে সরায় নিছে। সেখানে মানুষ না পাইলে আরো কয়েক কিলো পুবে ঝংলার দ্বীপে সেল্টার সেন্টার। 

মাঝি যতো কিছুই বলুক না কেন মেয়েটার মনে হয় এটা অসম্ভব। নৌকাটা এখানেই টিকতে পারতেছেনা গাছের ফাঁকে। যেকোনো সময় ছাউনি উল্টে যেকোনো দিকে নিয়ে যেতে পারে। মাঝি সাগরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে বাতাস আরেকটু কমা ছাড়া যাত্রা করা সম্ভব নয়। শেষে আরেকটু অপেক্ষা করতে রাজি হয়। 

এক সময় মাঝি টের পায় তার পায়ের ব্যাথা অসহনীয়। শেষে আগুন জ্বালিয়ে জ্বলন্ত আগুনে শেক দিতে থাকে। তাতে ব্যাথা কিছুটা কমে। তারপর গামছা ছিড়ে বেঁধে ফেলে পুরো গোড়ালিটা। পা বাঁধা শেষে দাঁড়িয়ে মাঝি বলে আর মুহুর্তও অপেক্ষা করা যাবে না। সে গিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করে দেয়। তারপর নৌকার পেছনের অংশে দাঁড়িয়ে এক হাতে এক্সেলেটরের রশি অন্য হাতে ব্রেকের লোহার রড। মুখে বিড়ি নিয়ে দাতে দাঁত চেপে সে ট্রলার ছাড়ে। 

তিন

ঢেউয়ের জন্য সে কোন ভাবেই আগাতে পারে না। এই চেষ্টা চলে অনবরত। সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ এসে বারবার নৌকাটাকে ধাক্কা দেয়। সেই ধাক্কা খেয়ে মাথা ভাঙা গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে ঘুরে গিয়ে আবার আরেকটা গাছের সাথে ধাক্কা খায়া ততক্ষণে আরেকটা ঢেউ চলে আসে। এমন চিত্র বেশ কিছুক্ষণ চলার পর মাঝি দাঁড়িয়ে দেখলো দ্বীপ ছেড়ে বের হবে কি, সে এতক্ষণে বিশ-পঁচিশ হাত দ্বীপের ভেতরে ঢুকে গেছে এবং প্রতিনিয়ত যাচ্ছে। এদিকে লেকচারার জেরিন দেখতে থাকলো মাঝির ট্রলার ছাড়ার ব্যার্থ চেষ্টা। বেচারা এই কাটা পায়ে তড়পানো অবস্থায়ও কি চেষ্টা করে যাচ্ছে বাঁচার। 

বৃষ্টি চলে গেলেও আকাশ আরো কালো হয়ে আসে। আকাশের দিকে মাঝি বারবার অভিমানি চোখে তাকায়। মনে মনে প্রার্থনা করে “হে খোদা, এবারের মত বাঁচিয়ে দাও”। সে এবার পায়ে একটা প্লাস্টিক বেঁধে লাফ দিয়ে নৌকা ছেড়ে নিচে নেমে নৌকার এক মাথা ধরে টানতে থাকে। অনেক্ক্ষণ ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ চালানোর পর এক সময় সে লাফিয়ে উপরে উঠে দড়িটা ধরে টান দেয় বাম হাতে আর ডানহাতে স্টিয়ারিংটা ধরা। ঠকঠক শব্দে ইঞ্জিন চলছে তা শোশো শব্দের ভিড়ে হারিয়ে গেছে অনেক আগে। তখন মাঝির দড়ির টানের সাথে শব্দটাও বাড়তে থাকে। এক সময় সমুদ্রের গর্জনকে ছাপিয়ে যায়। নৌকা চলছে মাথাভাঙা গাছকে পাশ কাটিয়ে।  নৌকাটা একটু দক্ষিণ পূর্ব কোণ হয়ে দ্বীপ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। মেয়েটা জীবন-প্রাণ সবকিছু মাঝির হাতে সপে দিয়ে ছাউনির নিচে একটু বাকা হয়ে দেখতে থাকে। একবার মাঝির দিকে একবার সামনের দিকে। আর বিড়বিড় করে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে। এভাবে আরো কিছুক্ষণ চলার পর ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে নৌকাটা দ্বীপের বাইরে যেতে সক্ষম হয়। সাগরের ঢেউ ফুলে ফুলে আসে। জ্বলোচ্ছাসের মত অবস্থা। নৌকা চলছে তার মাঝে। ঢেউ আসলে নৌকা মনেহয় পাহাড়ের উপর উঠে আবার নেমে যায়। তক্ষুনি বুক ধড়ফড়িয়ে উঠে মেয়েটার। এই বুঝি ডুবে গেল! কিছুক্ষণ স্বাভাবিক চলে আবার ঢেউ আসে। 

লাশটার দিকে চোখ গেলে মেয়েটার ভেতরে ক্যামন যেন একটা অন্য রকম ভয় জাগরিত হয়। সে তড়িৎ আবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়। আকাশটা প্রতিনিয়ত আরো কালো হয়ে আসছে। আকাশ যতো কালো হয় ততো মনেহয় আরো কাছাকাছি চলে আসে। নাকি সন্ধা ঘনিয়ে আসছে বুঝা যায় না। মাঝির কথা শুনে মেয়েটার ঘোর লাগে। মাঝি বলে উপকূল ছাড়া নিরাপদ কিছু নাই।  কেয়ামতের যে বর্ননা শুনে সে বড় হয়েছে- এই পরিস্থিতি তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এভাবে প্রকৃতির সাথে শ্বাসরুদ্ধকর এক ঘন্টার লড়াই চলার পর আবার বৃষ্টি আসে। বৃষ্টির ফোটা যেন মাঝির গায়ে বিধে। সাথে সাথে বাতাশও বাড়ে। মাঝি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে বসে পড়ে। বসে বসে অনেক কষ্ট করে চালাতে থাকে। এমন সময়ে ইঞ্জিনও বন্ধ করা যায় না। তাই চালাতে থাকে। এক সময় দ্বীপ দেখে মেয়েটার কলিজা বড় হয়ে যায়। মাঝিকে সে জিগ্যাস করে এটাই কি সেই দ্বীপ? মাঝি হা সুচক মাথা নাড়ে। কিন্তু দ্বীপ দেখে তার যতোটা খুশি হওয়ার কথা ততোটা তার চেহারায় দেখতে না পাওয়ায় মেয়েটার খুশিও ম্লান হয়ে যায়। হয়তো আরো খারাপ কিছু তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু মাঝি তাকে বলছে না এমন আশঙ্কা মেয়েটাকে পেয়ে বসে। সে ঝিম ধরে বসে থাকে। এক সময় একটা বালুচর দেখা যায়। বালুচরের ভেজা মাটিতে ট্রলার এসে ঠেকে। দ্বীপের বেশিরভাগ অংশই ডুবন্ত। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাকিটাও ডুবে যাবে। মাঝি লাফ দিয়ে নেমে নৌকাটাকে শক্ত করে গাছের সাথে বাঁধে। তারপর উঠে ছাউনির নিচে এসে গেঞ্জিটা চেঞ্জ করে। ঝড়বৃষ্টি অনবরত চলছে। নৌকা টেনে হিছরে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা। আকাশের গর্জনে কান বন্ধ হয়ে আসে। তার মাঝে বিজলির আলোয় নৌকাটাকে দেখা যায়। সন্ধা হয়ে গেছে। তাদের এই রাত এভাবেই নৌকায় কাটাতে হবে। 

ছাউনির নিচে সামান্য একটু জায়গা। বাকিটাতে পানি। ভাঙ্গা ছাউনিটা মনে হয় জোর করে লাগানো। তার উপরের প্লাস্টিকটা ভাল। এজন্য বাঁচা গেছে। বাঁশ ফালি করে বানানো জায়গাটায় দুইজনের বসতে কষ্ট হয়ে যায়। দুইজন মুখোমুখি বসে পাটা বিপরিত দিকে লম্বা করে হেলান দেয়। ঘোর অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিজলির আলোয় একজন আরেকজনের মুখ দেখতে পায়। মাঝির কাটা পায়ের বাধ খুলে নৌকার গুলির ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা। এমতাবস্থায় মাঝির চোখ বন্ধ হয়ে আসে। 

চার

মেয়েটা চোখ খুলে দেখে তার ঠিক চোখের সামনে মাঝির পা। তারপর সে আরেকটু সচেতন হয়ে আবিষ্কার করে যে সে মাঝির কোলে মাথা দিয়ে হাতপা গুটিয়ে শুয়ে আছে। সে বুঝার চেষ্টা করে মাঝি সজাগ না ঘুমে। নিশ্বাসের শব্দ শুনে নিশ্চিত হয়ে আস্তে বসে দেখে গুড়া বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুটা আলো ফুটেছে। সাগর উত্তাল। শো শো শব্দ শুনা যাচ্ছে। সে মাথা একটু তুলে দেখে পানি অনেক দুরে চলে গেছে। তাদের নৌকাটা শুকনো জায়গার মধ্যে দ্বীপের অনেকটা ভেতরে। বাতাসের বেগও রাতের চেয়ে কম। 

এক সময় মাঝি নড়াচড়া দিয়ে উঠে। চোখ খুলে ব্যাথাটা টের পায়। অসহনীয় ব্যাথা। তাও উঠে বসে। তার পরনের ভিজা লুঙ্গিটা শুকিয়ে গেছে প্রায়। সে ছাউনির ফাক দিয়ে একটু প্লাস্টিক তুলে লাশটার দিকে তাকায়। লাশটা একই অবস্থায় পড়ে আছে। তার উপর অনবরত বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। তখন মাঝি লক্ষ্য করে লাশ মনে হয় কিছুটা ফুলে আসছে। এবার সে মুখ ঘুরিয়ে বসে। গভীর একটা চিন্তার রেখা তার চেহারায় লক্ষ্য করা যায়। চিন্তারত অবস্থায় সে ছাউনির বাইরে হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি হাতে জমিয়ে তারপর এনে মুখ ধোয়, কুলি করে সামনেই নৌকার ভিতরে ফেলে। এ দেখে মোয়েটার ঘেন্না লাগে। তাও কিছু বলে না। মাঝি কুলি করা শেষে পাশ থেকে মুড়ির প্যাকেট ছিড়ে বয়ুম থেকে একটা বিস্কুট মিলিয়ে মুখে দিয়ে তারপর মেয়ের দিকে এগিয়ে দেয়। মেয়েটা মাথা নাড়ে। তারপর মাঝি বলে- এভাবে চলতে থাকলে আমরা কবে উপকূল বা শেল্টারে পৌছাবো তার কোন নিশ্চয়তা নেই। সামনে মুড়ি বিস্কিটও হয়তো মিলবে না। শেষে মেয়েটা দুই-এক মুঠ মুড়ি ও দুই একটা বিস্কুট খায়। এভাবে আরও দুই ঘন্টা কোটে যায়। ধীরে ধীরে বৃষ্টি কমলেও বাতাস বাড়তে থাকে। সমুদ্র আবার ফুলতে শুরু করে। ঢেউ বড় হতে থাকে। তখন মাঝি পায়ে একটা প্লাস্টিক বাধে। মাথায় একটা গামছা বেঁধে ছাউনি থেকে বের হতে যাবে এমন সময় মেয়েটা জানতে চায় কোথায় যাচ্ছে। মাঝি জানায় একটু সামনে ছোট্ট একটা জেলেদের গ্রাম আছে। সে দেখে আসতে চায় সেখানে কোন মানুষ আছে কি না। মেয়েটা কোন ভাবেই এখানে লাশের সাথে একা থাকতে চায় না। সে মাঝির পিছনে পিছনে ভিজতে ভিজতে বের হয়। 

তারা ঘাস-ঝোপ-জংলার মাঝ বরাবর মানুষের চলাচলে তৈরি হওয়া পথ দিয়ে ভিজতে ভিজতে চলছে। মেয়েটা আগে মাঝি খুঁড়িয়ে পিছন পিছন হাঁটছে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর এক জায়গায় গিয়ে দেখা গেল লম্বা একটা ঘর। চারপাশে বেড়া উপরে টিন। ঘরের অর্ধেক উল্টে পড়ে আছে। তার উপরে উপড়ে পড়ে যাওয়া একটা গাছ শুয়ে আছে। তারা চারিদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে গিয়ে উল্টে যাওয়া বেড়ার তলার অংশ দিয়ে ভাল করে দেখতে থাকে। তারপর তারা মাথা নুয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। ঠিক তখনি তাদের সামনে দিয়ে কোন একটা পাখি মুহুর্তেই পার হয়ে যায়। মেয়েটা একটু অপ্রস্তুত হয়। মাঝিকে দেখে বুঝা যায় তার এসবে অভ্যস্ততা আছে। 

মাটি থেকে এক ফুট সমান উচু ভিটি। ঘরের একেবারে পূর্ব পাশে ঝাক দিয়ে রাখা জাল ও প্লাস্টিকের ফ্লুট। তার আগে একটা চকি পাতা। বাঁশের ফালি দিয়ে তৈরি ছাউনির উপরে একটা চাটাই। এক পাশে বালিশ-কাথা পেচিয়ে বেঁধে রাখা। পড়ে যাওয়া চালের অংশে উঁকি দিয়ে দেখা গেল বাঁশ ও গাছের খুটি। তারপর আর কিছু দেখা যায় না। তারা দেখতে দেখতে পূর্ব দিকে চকির দিকে যাচ্ছে। এমন সময় চিকন বাচ্চা কন্ঠে একটা কান্নার শব্দ শুনে মেয়েটা চমকে উঠে ফিরে তাকায় বাঁশ আর খুটিতে ভরা ঘরের পড়ে যাওয়া অংশের দিকে। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ে না। মাঝি ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সেই দিকে। মেয়েটা তার একেবারে গা ঘেঁষে পিছে পিছে। এগিয়ে সামনে গেলে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। তারা খুজতে থাকে। কিন্তু ভেতরটা অন্ধকার, বদ্ধ। মাঝি আউলাঝাউলা খুটির ঝাকের উপর মাথা তুলে দেখে উপরের অংশে জালের স্তুপ। তারপর ঘোর অন্ধকার। এমন সময় তুফানের শোশো শব্দ আসতে থাকে দক্ষিণ দিক থেকে। ধীরে ধীরে বাতাস বাড়তে থাকে। তারা এগিয়ে খাটের দিকে গিয়ে দেখে ঘরটা উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা। ঘরের সিমেন্টের পিলার কাঁপছে বাতাসের চাপে। ঘরটাতে এক পিলার পর পর একটা বাঁশের খুঁটি। খুঁটিগুলি মডমড শব্দ করছে। যেন যেকোনো সমই ভেঙে যেতে পারে। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে তারা চকির নিচে আশ্রয় নেয়। এমন সময় আরো শক্তিশালি একটা বাতাসের চাপ এসে টিনের চালটাকে উল্টিয়ে একটু দুরে গাছের সারির উপরে নিয়ে ফেলে। তারা খাটের নিচ থেকে হা করে চেয়ে থাকে। ঘরের বেড়াটা এখনো ঠিক আছে। তবে বাতাস বইছে অনবরত। বাতাসের সাথে গাছের ডালপালা উড়ে যাচ্ছে। এমন সময় দক্ষিণ পাশের একটা মোটামুটি বড় গাছ এসে এমন ভাবে পড়ে তার উপরের অংশ অর্থাৎ পাতা ও ডালের মাথা এসে ঢেকে দেয় চকির উপরটা। এসে ঠেকে পূবপাশের জালের স্তুপ ও বেড়া পিলারের উপরে আটকে যায়। তাদের চোখের সামনে ঘরের ভিতরের জায়গাটায় একটা বড় ডাল আর পাতায় আটকে যায়। তারা এখন একেবারে বন্দি। উপর থেকে চকির উপরের চাটাই ভিজে পানি তাদের গায়ে এসে পড়তে থাকে। এই দেখে মাঝি তাকে নড়াচড়া না করতে বলে চকির উত্তর পাশ হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে তাড়াতাড়ি উপর থেকে একটা কাথা চকির উপরে পেতে দিয়ে আরেকটা কাথা ও বালিশ দুইটা চকির নিচের মেয়েটার দিকে এগিয়ে দেয়। তারপর স্তুপ থেকে কিছু জাল ফেলে চকির উপরটা ঢেকে দিয়ে তাড়াহুড়া করে আবার চকির নিচে ঢুকে যায়। ততক্ষণে ঝড় চলে গেছে। কিন্তু সে ভিজে গেছে। সে গা মুচতেছে গামছা দিয়ে। এদিকে অনবরত বাতাস বইছে। বৃষ্টিও বেড়েছে। তারা কাথা বিছিয়ে চকির তলে দুইজন দুইপাশে শুয়ে থাকে। এভাবে একদেড় ঘন্টা যাওয়ার পর বৃষ্টি কমে আসে। বৃষ্টি কমার পর আবার শুনা যায় কান্নার শব্দটা। শব্দটা ভৌতিক। কিন্তু এটা মানুষের কন্ঠ নয়। চিকন টেনে টেনে কাঁদছে যেন। মাঝি মনযোগ দিয়ে শুনার চেষ্টা করে। বিড়ালের শব্দও না। তাইলে এটা কিসের শব্দ! মেয়েটা ভয়ে ভয়ে মাঝির দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকায়। 

পাঁচ 

কিসের শব্দ বুঝা কঠিন। এমন জল্পনা-কল্পনা করতে করতে বাতাসও কিছুটা কমে। মাঝি তার পায়ের ক্ষতটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাতাস কমেছে বুঝতে পেরে সেখানে প্লাস্টিক বেঁধে সে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে মাথায় বাঁধা গামছাটা ঠিকঠাক করে নেয়। মেয়েটাও তার মাথার গামছাটা ঠিকঠাক করে নেয়। মাঝি দুই হাত দিয়ে ভেজা পাতা সরাতে সরাতে জানায় ঝড় কমছে। আরেকটা ঝড় আসার আগে তাদের কেটে পড়তে হবে। আরেকটা ঝড় আসার আগে দ্রুত এই দ্বীপ ছাড়তে হবে। তাদের শব্দ বাড়ার পর কান্নার শব্দটা কমতে থাকে। মাঝি এগিয়ে গিয়ে উল্টে যাওয়া বেড়া তুলে বের হয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে বেড়া তোলা দিয়ে দেখে- ছোট্ট একটা পেচার বাচ্চা ভিজে জালে আটকে কাৎরাচ্ছে। এই দেখে বেড়াটা ছেড়ে দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটা শুরু করে। 

মেয়েটা পেচার বাচ্চার মায়াবী চোখে জীবন বাঁচানোর আকুতি দেখে সহ্য করতে পারে না। সে মাঝিকে একটু দাড়াতে বলে বেড়াটা তুলতে শুরু করে। মাঝি এগিয়ে আসে। তারপর দুইজনে মিলে জাল থেকে খুলে মেয়েটা গামছা দিয়ে মুছে তারপর গামছার তলে নিয়ে হাটতে শুরু করে। তারা প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে নৌকার কাছে গিয়ে থমকে যায়। লাশটা অনেকটা ফুলে গেছে। এই দেখে মাঝি এগিয়ে গিয়ে লাশটাকে পানিতে ফেলে দেয়। তারপর হাত ধুতে ধুতে চেয়ে থাকে ভেসে যেতে থাকা লাশের দিকে।

ঝড়-বৃষ্টি একেবারে থেমে গেছে। কিন্তু বাতাস বইছে লাগামহীন বিরতিহীন। সাগর আবার ফুলছে। তারা নৌকায় উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট করে। মেয়েটা ছাউনির পাশে দাড়িয়ে আছে। মাঝি একহাতে ইঞ্জিনের দড়ি, অন্যহাতে লোহার মোটা হাতলওয়ালা স্টিয়ারিংটা ধরে একটা বাক দিয়ে রশি টেনে ধরে রাখে। তখনই ইঞ্জিনের ঠকঠক শব্দ বাড়তে বাড়তে নৌকা ছুটতে থাকে। চারিদিকে মেঘ। কিন্তু উত্তর দিকের আকাশ কিছুটা পরিস্কার দেখা যায়। অদ্ভুত এক রং ধারণ করেছে। ট্রলার ছুটছে উত্তর-পূব কোন বরাবর। বিশাল বিশাল ঢেউ আর জলোচ্ছ্বাস নৌকাটাকে উপরে তোলে আর নামায়। উপর থেকে নিচে নামার সময় মেয়েটার মনেহয় নৌকাটা তলিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার সমানে চলে। এমন সময় তার কোলে পাখির বাচ্চাটা নড়াচড়া দিয়ে ডেকে উঠে। সে মাথা নত করে ছাউনিতে ঢুকে একটা নেকড়া দিয়ে ভাল করে মুছে নৌকার গুলুইয়ের নিচে রেখে দেয়। তাও তার ডাক কমে না। মনেহয় তার ক্ষুদা লোগেছে। সে মাছের বাক্সটা খুলে সেখান থেকে একটা মাছ নেয়। মাছটাকে ছোট ছোট টুকরা করে কেটে ভাঙ্গা একটা প্লাস্টিকের বাটিতে রেখে পাখির সামনে এগিয়ে দেয়। পাখিটার খাবারের দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। সে খেতে চায় না। মুখ সরিয়ে নেয়। তারপর সে ওকে কোলে নিয়ে ঠোঁট ফাঁক করে একটু মুখে দেয়। বাচ্চাটা গিলার চেষ্টা করতে গলায় আটকে যায়। সে গলা বাঁকা করে মাথা ঝাঁকাতে থাকে। এক সময় গিলে ফেলে। এরপর আরেক টুকরা দেয়া হয়। এভাবে চলতে থাকে অনেক্ষণ। এক সময় হঠাৎ ইঞ্জিন থেমে যায়। মেয়েটা অস্থির হয়ে জানতে চায় কি হয়েছে। মঝির ধারণা তেল শ্যাষ! তাও সে এগিয়ে এসে ইঞ্জিনের উপরের তেলের ঢাকনাটা খুলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। মেয়েটা এগিয়ে এসে বলে- এবার কি হবে মাঝি? মাঝি কোন কথা বলে না। 

এবার শুরু হয় অন্য এক যাত্রা। বাতাস আর ঢেউ যেদিকে নেয় নৌকা সেদিকে যেতে থাকে। মাঝি হাঁক দিয়ে ডাকতে থাকে অদ্ভুত এক সুরে। চিৎকারে যেন দুনিয়া কাপে। তাও মানুষের কোন অস্তিত্ব অনুমান করা যায় না। শব্দ বাতাসের কারণে বেশি দূরে যেতে পারে না। এভাবে অনেক্ষন ধরে হাঁক-ডাকের পর মাঝি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। তারপর মেয়েটা চিৎকার শুরু করে। দুই-তিনটা ডাকের পর মেয়েটা গলা ধরে বসে পড়ে। তারপর আরেকটু সচেতন হয়ে নৌকার এক পাশে গিয়ে পানিতে বমি করতে থাকে। পেট উগলে বেরিয়ে আসার শব্দ শুনা যায়। 

ছয়

মাঝি বুঝতে পারে ঘটনা। ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার পর ভাসতে থাকা নৌকায় প্রচন্ড ঝাাকি লাগে। তখন নতুনরা বমি করে। তবুও মাঝি উদগ্রীব হয়ে উঠে। কিন্তু কাছে ঘনানোর সাহস তার হয় না। বমি বন্ধ হওয়ার পর সে পানি নিয়ে কুলি করতে করতে এক সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায়। নৌকার তলার পানিতে গা ভিজে যায়। মাঝি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে এগিয়ে এসে প্রথমে তার হাত ধরে উঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও সে বল পায় না। শেষে দুই হাতের গোড়ালি ধরে টেনে ছাউনির নিচে নিয়ে শুইয়ে দেয়। 

এভাবে সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে ডাকাডাকি চলতে থাকে থেমে থেমে। একেই বলে অকূল সমুদ্র। তারা দুটি মানুষ আর একটি প্যাচা অকূল ভাসতে ভাসতে সন্ধা নেমে আসে। সন্ধার পরপরই ঝুম বৃষ্টি নামে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টি বাড়াটা স্বস্তির ব্যাপার। কারণ ঝড়ের তীব্রতা কম থাকলেই এমন অঘোর বৃষ্টি হতে পারে। এত তীব্র বৃষ্টি যে মাঝিকে এই অন্ধকারে বিশ মিনিট সময় পর পর ভিজে ভিজে পানি সেচতে হচ্ছে। সত্যই অদ্ভুত অন্ধকার নেমে এসেছে পৃথিবীতে আজ। এমন অন্ধকার যে নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না। মেয়েটা জোরে জোরে গলা পরিস্কার করে নিজের উপস্থিতি জানান দেয় বারবার। সে মাঝে মাঝে কান খাড়া করে পাখির বাচ্চাটার দিকে মনযোগ দেয়। ঝুম বৃষ্টির মাঝেও শুনা যায় পাখিটা ডাকছে অনবরত। এবার সে হাত বাড়িয়ে আন্দাজ করে তাকে কোলের গামছায় ঢেকে রাখে। এই দুনিয়া জোড়া একাকীত্বের মাঝেও কিছুটা সঙ্গ অনুভব করে তার ভাল লাগে। মাঝিটা একেবারে গম্ভীর! 

মাঝি তখনি পানি সেচে ভিজে একাকার হয়ে ছাউনিতে ঢুকে। তার শরীলের পানির ফোটা মেয়েটার মনযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। তার শরীল ঠান্ডায় কেঁপে উঠে। 

মাঝি তখন লাইটার জ্বলিয়ে গামছাটা নিয়ে খালি গা মুছে খুলে রাখা গেঞ্জিটা পরে নেয়। তার গেঞ্জি থেকে বারবার ভিজে শুকাতে থাকা বিরক্তিকর গন্ধ বেরিয়ে আসে। তাও এত কাছে মানুষের উপস্থিতি তাকে এক ধরনের আনন্দ ও স্বস্তি দেয়। মাঝি বিস্কিটের প্যাকেট খুলে এক হাতে লাইটার জ্বালিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিবে এমন সময় সে টের মেয়েটা জ্বরে কাঁপছে। আলো দেখে চোখ খুলে এক সীমাহীন তাকায় মাঝির দিকে। মাঝি বিস্কিটের প্যাকেট রেখে তার কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠে। এই তীব্র শীতেও তার কপাল আগুন হয়ে আছে। সে মাঝিকে বলে আমার পাশে একটু শোন। মাঝি বুঝতে পারে তার শরীলের কাপ বাড়ছে। সে মেয়েটার পিছনের দিকে শুয়ে তার বাম হাতে মাথা রাখে আর ডান হাতে আগলে রাখে মেয়েটাকে। ওদিকে বৃষ্টি ঝরে চলেছে অনবরত। একই সুরে, একই তালে। নৌকায় একই ঝাঁকুনি, বাতাস একবারে বন্ধ, আকাশের হাঁক-ডাক শুনা যায় দূরে দূরে। বিজলির আলোয় নিচটা দেখা যায় মাঝে মাঝে। পাখিটা একপাশে দাড়িয়ে ডাকতে থাকে। এভাবে সময় পার হয়ে যায়। মেয়েটার ঘুম চলে আসে। তার নাকের ডাক শুনা যায়। তখনই মাঝি বুঝতে পারে নৌকায় পানি বেড়ে গেছে। সে নিজের হাত থেকে মাথাটা সরিয়ে মাথার নিচে একটা তক্তা দিয়ে খুব সাবধানে পানি সেচতে যায়। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পানি কমিয়ে তারপর কাঁপতে কাঁপতে এসে ছাইনিতে ঢুকে। গা মুছে জামা গায়ে দিয়ে দেখে মেয়েটা কাঁপতে থাকে। সে লাইটার জ্বলিয়ে কোন রকমে দেখে নেয় পাখিটাকে। তারপর কয়েক সেকেন্ড ভেবে তারপর পাখিটার গায়ে থাকা গামছাটা মেয়েটার গায়ে দেয়। সে নিজেও কাঁপতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে পড়ে আগের জায়গায়। একইভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে। 

সাত

এক সময় আলো ফোটে। মেয়েটার পা ভিজা আন্দাজ করে লাফিয়ে উঠে দেখে পানি একেবারে তাদের গা ছুঁই ছুঁই। সে মাঝিকে গা ধরে ঝাঁকাতে থাকে। মাঝি উঠে পানি দেখে তাড়াতাড়ি বের হয়ে পানি সেচতে থাকে। কিছুক্ষণ সেচার পর হঠাৎ সে চোখ ঘুরিয়ে দেখে দ্বীপ। নৌকাটা দ্বীপের কোলে। সে ভালো করে চোখ ঘুরিয়ে দ্বীপটাকে চেনার চেষ্টা করে। তারপর মেয়েটাকে ডাক দেয়। মেয়েটা তখন হাঁটুতে দুই হাত দিয়ে বসে বসে কি যেন ভাবছে। সে মুখ ঘুরিয়ে দেখে মাঝি তাকে ইশারায় ডাকছে। 

মেয়েটা গুড়া বৃষ্টির মাঝে হালকা মাথা বের করে দেখে তার চোখ স্বপ্নোজ্জল হয়ে উঠে। সে বাচার স্বপ্ন  দেখে। তারপর আধমরা পাখিটাকে কোলে নিয়ে হাত বুলাতে থাকে। পাখিটা তার চেয়েও দুর্বল হয়ে গ্যাছে। মেয়েটা খুবই মলিন কন্ঠে জানতে চায় আমরা এখন কোথায় আছি? মাঝির ধারণা যেই দ্বীপ থেকে তারা বেরিয়েছে এটা সেই দ্বীপের আরেকটা পাশ। সাগরে ভাটা পড়াতে তাদের এতোটা পিছিয়ে নিয়ে আসছে। এবার কোন সাহায্য আসা ছাড়া তাদের আর এই দ্বীপ ছাড়ার উপায় নাই। 

মাঝি বলে সে গিয়ে দেখে আসতে চায় দ্বীপের ভেতরকার অবস্থা। কিন্তু মেয়েটা এখানে একা থাকার সাহস পায় না। এদিকে মাঝির পায়ের বেড়েই চলছে। তার তাড়াতাড়ি ঔষধ খাওয়া ছাড়া উপায় নাই। খাবার ফুরিয়ে আসছে প্রায়। বের হওয়া ছাড়াও উপায় নাই। 

অবশেষে বৃষ্টি কিছুটা থামলে মাঝি নোঙ্গর ফেলে প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে তারা নৌকা ত্যাগ করে। গুল্ম ঝোপ-ঝাড়ের আশপাশ ধরে কাদামাটির পথ পার হয়ে তারা বসতি খুঁজতে থাকে। মাঝির ধারণা এখানে কিছু শুঁটকি জেলেদের বানানো কিছু ঘর আছে সেগুলো খুঁজে দেখা দরকার। সেখানে পৌঁছাতে পারলে তারা হয়তো তারা খাবার ও বিশ্রামের সুযোগ পাবে। 

গুড়া বৃষ্টি চলতে থাকে কয়েক ঘন্টা ঘন্টা ধরে। মেঘলা বিকালের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। সাগরের আকাশ ধুম ধরে থাকা একটা আকার ও আকৃতি ধারণ করেছে। তারা হাঁটছে আশ্রয়ের খোঁজে। এক সময় তারা সিদ্ধান্ত নেয় নৌকায় ফিরে যাওয়ার। এখানে মাথা গোজানোর ঠাই মিলবেনা। ঠিক তখনই জংলার মাঝে আবিস্কৃত হয় শুঁটকি জেলেদের পাড়ার পথ। সেই পথ ধরে কয়েক মিনিট হাটার পর দেখা গেল গতকালের দেখা ঘরটার মত কাছাকাছি ৫ টা ঘর। তার মাঝে তিনটা ঘর উল্টে পড়ে আছে। একটু দুরে দুরে। মাঝি এদিক সেদিক দেখে বুঝার চেষ্টা করছে দাঁড়িয়ে থাকা দুইটা ঘরের কোনটা তাদের বেশি কাজে লাগবে। এমন সময় হাটতে হাটতে চোখে পড়ে কাঠের দরজা, নীল কালারের টিনের একটা দরজা খোলা। সে হাঁক দিয়ে ডাকতে থাকে কেউ আছে কি না। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করার পর সে এগিয়ে গিয়ে খোলা দরজায় ঢুকে অনুসন্ধানী চোখে ভেতরটা দেখতে থাকে। এই ঘরটাও ঠিক আগেরটারই মতো- নেট, ফ্লুইড, খুটি, একটা মাকড়সার বাসায় ভরা চোকি, সুতার একটা মশারি ঝুলানো, চকির উপর একটা নৌকার ইঞ্জিনের ধ্বংসাবশেষ সব মিলিয়ে গিঞ্জি অবস্থা। মাটিতে ইঁদুর মাটি তুলে ঘরের অবস্থা যা-তা করে ফেলেছে। তারা পা টিপে টিপে হেঁটে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে থমকে যায়! একটা কালো গোখরা বসে আছে খাটের নিচে। তাদের দেখে তারা মগ্নতা ভঙ্গ হয়।  এই দেখে তারাও তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যায়। 

আকাশের হাঁক-ডাক ক্রমেই বাড়ছে। দূরে ঝড়ো বাতাসের শো শো শব্দ বয়ে চলছে অনবরত। আকাশ এতটা কালো হয়ে আছে যে সন্ধার আগমন সম্পর্কে কোন নিশ্চিত ধারণার সুযোগ নাই। তারা কাদামাটি পার হয়ে পাশের ঘরটার সামনে গিয়ে তালা লাগানো দুটি দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকে ভিতরটা। দেখার এক পর্যায়ে মাঝি এক হাতের আঙ্গুল ঢুকিয়ে দুই আঙুলের মাথা দিয়ে আংটার ভেতরের বল্টু খুলে দরজা খুলে ফেলে। তখনি কিছু ইদুর চিকা বা বাদুড়ের উড়ে যাওয়ার শব্দটা হারিয়ে গেল দুনিয়া কাঁপানো একটা বাজের শব্দের ভিড়ে। মাঝি হাতের লাইটার জ্বালিয়ে পথ দেখার চেষ্টা করে। এখানেও জ্বাল খুটি আর ফ্লুইড জায়গাটা ভরে আছে। দরজার সামনেই একটা সাত-আটজন মানুষের আন্দাজে বিরাট চকি। চকির উপরে ওগলা পাতার মাদুর। এক মাথায় কাঁথা বালিশ পেচিয়ে রাখা। চকির নিচে বেশ কয়েকটা তকতা এলোমেলো ঢুকিয়ে রাখা। চকির উপরে বাঁশের খুটির সাথে ঝুলানো একটা ক্যারোসিনের বোম্বা। মাঝি বোম্বাটা নাড়াচাড়া করে দেখে তেলে ভরা। সে বামহাত দিয়ে লাইটার জ্বালিয়ে ডান হাতে বোম্বার ঝুলানো হাতলটা ধরে নিচটা ভাল করে দেখতে থাকে। পেছনে মেয়েটা উৎসুক ও ভয়ের চোখে চারিদিকটা পর্যবেক্ষণ করছে। মেয়েটা খাটের দিকে এগিয়ে পাখিটাকে কোল থেকে রেখে তার পাশে বসে ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে। 

আট

রাত নেমে এসেছে ছোট্ট পৃথিবীতে। রাত নামার সাথে সাথে আবার ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে। তারা ঘরটাতে আশ্রয় নেয়। তারপর মাঝি আইসের বাক্স থেকে দুইটা মাছ এনে কাঠ জ্বালিয়ে পোড়ানোর পর উপরে লবন ছিটায়। মেয়েটা কাথা গায়ে দিয়ে জ্বরে কাঁপতে থাকে। সৌভাগ্যবসত এখানে কাথাবালিশ পর্যাপ্ত। সে দুই তিনটা কাথা গায়ে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাঝে মাঝে সামান্য চোখ খুলে মাঝির মাছ পোড়ানো দেখে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। এমন সময় আস্ত মাছের বারবিকিউ একটা স্টিলের প্লেটে তার চোখের সামনে ধরে। সে মাথা নাড়ে। মাঝি আবারও অনুরোধ করলে সে বলে রাখতে পরে খাবে। মেয়েটার জ্বরের মাঝে মাঝির পায়ের ব্যাথা ঢাকা পড়ে গেছে। মাঝি পায়ের কাটা জায়গাটার প্লাস্টিক খুলে দেখতে থাকে। খাদের উপরিভাগটা এবার কালচে রং ধারণ করে। এমন সময় ঘরের বাইরে জব্দ ব্যাঙ্গের ডাক শুনা যায়। সাপ যখন ব্যাঙকে ক্যাচিকলে প্যাচিয়ে ধরে তখন শেষ মুহুর্তে ব্যাঙ এভাবে ডাকে। ব্যাঙের ডাকের কথা ভাবতে ভাবতে তারা চুপচাপ হয়ে যায়। 

এক সময় মাঝির ঘুম ভাঙ্গে দূরে কোন একটা বড়ো জাহাজের সাইরেনের শব্দ শুনে। সে আবার কান খাড়া করে শুনার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু শুনা যায় না। বৃষ্টি পড়তেছে অনবরত। তারপর আবার সে শুনতে পেল জাহাজোর শব্দ। এবার সে নিশ্চিত হয়ে তাড়াতাড়ি করে নেমে একটা সারের সাদা প্লাস্টিকের বাঁকানো অংশ মাথার উপর দিয়ে দৌড়াতে থাকে শব্দের উৎসের দিকে। অনেক্ষণ দৌড়ানোর পর উপকূলে এসে সে ধুধু সাগর ছাড়া কিছুই দেখতে পায়না। জাহাজের ডাক কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে! সে কিছুক্ষণ হাকডাক দিতে থাকে। কিন্তু তার ডাক বেশি জোরে বের হয় না। সাহায্য কি পাওয়া যাবেনা তাইলে। সে হতবিহ্বল হয়ে দূর সাগরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টি পড়ছে অনবরত। সে এক সময় সে পায়ের ব্যাথা ও ক্লান্তিতে হাঁটুতে হাত দিয়ে বসে পড়ে। 

অন্যদিকে মেয়েটা ঘুম থেকে উঠে দেখলো ঘরের ভিতর পরিস্কার দিনের আলো। সে চোখ খুলে চকি থেকে নামতে নামতে লক্ষ করে খাটে মাঝি নাই। পাখিটা মরে পড়ে আছে বিছানার এক পাশে। সে খুব একাকীবোধ করে। সে পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে। ঠিক তখনি বিড়ালের শব্দে সে চমকে উঠে মুখ ঘুরিয়ে দেখে একটা সাদাকালো বিড়াল তাকে উদ্দেশ্য করে এমনভাবে ডাকলো যেন সে কিছু চাইলো। মেয়েটা পাখির বাচ্চাটার দিকে একবার তাকিয়ে আবার বিড়ালের দিকে তাকায়। বিড়াল আবার একই ভঙ্গিতে ডাকে। সে এবার মরা পাখিটাকে নিয়ে বিড়ালের দিকে ছুড়ে দেয়। বিড়ালটা পাখিটাকে কামড় দিয়ে মুখে নিয়ে দরজার দিকে যায়। সে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা খোলা। সে ভালো করে চার দিকে দেখে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। মুখ বের করে সব দিকে ভাল করে দেখতে থাকে। 

বৃষ্টি পড়ছে। বিড়ালটা পাখিটাকে মুখে নিয়ে পশ্চিম দিকে ঝড়ে পড়ে যাওয়া ঘরের সামনে দিয়ে যেতে যেতে এক সময় চোখের আড়াল হয়ে যায়। কিন্তু কোথাও মাঝির কোন অস্তিত্ব নাই। সে মাঝিকে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। শরিলের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাকে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নাই। সে আবার ঘরে ঢুকে ভাল করে দেখে। আবার দরজায়। এভাবে চলতে থাকে অনেক্ষণ। এক সময় বৃষ্টি একেবারে থেমে যায়। আকাশ ধুম ধরে থাকে। মেয়েটা বের হয়ে ভয়ে ভয়ে পূর্ব দিকে ঘাসের মাঝে থাকা পথ ধরে হাটতে থাকে। আর ভয়ে ভয়ে দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে চারিদিকে দেখে আগায় পূর্ব দিকে। 

এভাবে আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর সাগরের দেখা মিলে। সাগর উত্তাল। শোশো বাতাস বইছে। আকাশ ধুম ধরে আছে। দূর সমুদ্রের বুকে আকাশে বিজলি চমকাচ্ছে। চারিদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে এক সময় সে চমকে উঠে। একটা বিশাল কাঠের নৌকা উল্টে পড়ে আছে পানি থেকে অনেক উপরে গাছের গোড়া বরাবর।  নৌকাটা দেখে মনে হয় এটা এবারের ঝড়ে পড়া। সে নৌকাটার আরেকটু কাছে গিয়ে ভয়ে ভয়ে ডাক দেয়- কেউ আছেন? মাঝি…? কোন দিক থেকে কোন সাড়াশব্দ নাই। সে দাঁড়িয়ে ভাবে এতো বিশাল পৃথিবী এতো বড় সমুদ্র কিন্তু সে একা! তাকে জীবন বাচিয়ে ফিরতে হবে। তার জন্য দরকার মাঝিকে। মাঝি কোথায় হারিয়ে গেল! 

সে আবার ফিরে যায় ঘরে। ঘরের সামনে গিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে মাঝিকে ডাকতে থাকে। সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখে নাই। তখন সে হতাশ হয়ে চকিতে বসে হাঁফাতে থাকে। মাঝির কোন বিপদ হল নাকি! লোকটা গেল কই! তার বুকটা ভেঙে কান্না আসে। সে মুক চেপে থামায়। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে দৃঢ়চিত্তে দাড়ায়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বামদিকে অর্থাৎ বিড়াল যেদিকে গেছে সেদিকে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাটতে একটা ঝোপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে থমকে দাঁড়ায়! কোন কিছুর উপস্থিতি সে আন্দাজ করতে পারে। তার হাতে থাকা বাঁশের লাঠিটা সে সজাগ রেখে চারিদিকে নজর রেখে এগিয়ে চলছে। তখন সে স্পষ্ট শুনতে পায় বিড়ি খাওয়া মানুষের কাশি। এটা মানুষের কন্ঠ এতে কোন সন্দেহ নাই। আরেকটু এগিয়ে ঝোপ পার হওয়ার পর তার চোখে পড়ে মানুষ। সে আরো ভাল করে দেখে মাঝি  এক হাতে একটা লাঠি আর অন্য হাত দিয়ে হাঁটু চেপে ধরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এদিকে আসছে। মেয়েটা উদগ্রীব হয়ে ছুটে যায় মাঝির কাছে। কি হয়েছে তার, কোথায় গেছে, সে তাকে কোথায় কোথায় খুঁজছে এসব বলতে থাকে। কিন্তু মাঝির কথা বলার শক্তি নাই। তারপরও জানায় একটা জাহাজের সাইরেন শুনে সে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বেরিয়ে এসে পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পায়। তারপর আর যেতে পারছিলো না। শেষে মেয়েটা মাঝিকে ধরে নিয়ে যায়। কালো আকাশকে পেছনে ফেলে তারা ঘরে ঢুকে।  মাঝি বিছানায় পড়ে কাৎরাচ্ছে জবাই করা মুরগির মত। তাদের আর কোন খাবার অবশিষ্ট নাই। কিন্তু খাবারের একটা ব্যাবস্থা না করতে পারলে তারা আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। খাবার কোথায় পাওয়া যাবে! এমন আলোচনার সময় মেয়েটা বলে, যে মাঝিকে খুঁজতে খুঁজতে পূর্ব উপকূলে গিয়ে সে উডেন বডির বড় একটা ট্রলারকে উল্টে পড়ে থাকতে দেখেছে। এই শুনে মাঝির চোখ বড় হয়ে যায়। কথাটা যদি সত্যি হয় তাইলে এটা তাদের এই মুহুর্তে রক্ষাকবজ হতে পারে। সে মেয়েটাকে বিস্তারিত জিগ্যেস করে নিশ্চিত হয়। তারপর নিজেকে একটু সামলে মেয়েটাকে নিয়ে বের হয়। 

নয়

ঝড়ো বাতাস বাড়তে দেখে তাদের বের হওয়া উচিৎ কি না মাঝি ভাবছে। যতো কষ্টই হোক খাবারের ব্যাবস্থা না করতে পারলে তাদের বেঁচে থাকাটাই সম্ভব নয়। সো যেতেই হবে। তারা ঝড় মাথায় নিয়ে বের হয়ে পূর্ব দিকের জংলার মাঝে পায়ের হাটায় তৈরী হওয়া পথ ধরে এগিয়ে যায়। উপকূলের কাছাকাছি আসার পর ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হয়। উপকূল থেকে বাম দিকে দুই-তিন’শ গজ দূরে যেখানে গাছের সারির গোড়ায় অনবরত বিশাল বিশাল ঢেউ এসে পড়ছে- তারও উপরে একটা আইস ট্রলার। বাঁকা হয়ে উল্টে, কয়েকটা গাছের মাথা ভেঙে আঁটকে আছে। তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ট্রলারের দিকে। কাছাকাছি আসার পর বাতাসে ক্যামন যেন একটা বিদঘুটে বাজে গন্ধ নাকে আসে। ট্রলারের দিকে যত আগায় তত গন্ধটা স্পষ্ট হতে থাকে। গন্ধের তেজে মেয়েটা বমি করার অবস্থা। সে এবার মুখ সরিয়ে বাতাসের ঠিক বিপরীতে নাক রেখে নাকে গামছা চেপে ধরে বাম হাতে। চোখে সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখে ছোট্ট এক ঝাঁক কচুরিপানা ঢেউয়ের উপরে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে। 

মাঝি গন্ধের জ্বালায় টিকতে না পেরে মাথার গামছাটা নাকে-মুখে শক্ত করে বেঁধে নৌকার একপাশ ধরে ঝুলে আরেকটা হাত এগিয়ে বানরের মত ঝুলে উঠে যায় উপরে। গাছে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা ট্রলারের উপরের অংশটা দরজার মতন সামনাসামনি হয়ে আছে। ট্রলারে মাঝিদের থাকার ঘর একেবারে মাঝখানে। সে থাকার জায়গাটাকে টার্গেট করে। আরেকটু এগিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখতে পায় থাকার ঘরের বাকা হয়ে থাকা অংশে একটা লাশ! গায়ের সবুজ গেঞ্জিটা বাদে বাকি অংশটা এক থেকে দেড় ইঞ্চি ফুলে গেছে। মাঝি সেই দিকে মনযোগ না দিয়ে ঢুকে যায় গুদামঘরে। চাল, ডাল, তেল, নুন, বিস্কিটের প্যাকেট একটা বালতিতে নিয়ে বের হয়ে মেয়েটার দিকে বালতিটা এগিয়ে দেয়। সে ইঞ্জিন ঘরের দিকে গিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে দেখতে থাকে। তারপর আইস বক্সের মুখ খোলার পর মাছ দেখে তার চোখ ঝলঝল করে উঠে। মাথা ঘুরে যায়। এতো মাছ!  বড় ঝাঁকের ইলিশ, রুপচাঁদা, চিংড়ি সহ বিভিন্ন জাতের মাছ। সে একটা বড় ইলিশ, দুইটা রুপচাঁদা, কয়েকটা চিংড়ি একটা টুকরিতে নিয়ে বের হয়ে দরজাটা লাগিয়ে নিচে নামে। 

বালতিটা নিয়ে মেয়েটা সামনে হাঁটছে আর মাঝি খুড়িয়ে খুড়িয়ে পেছনে। তার হাতে মাছের টুকরিটা। তাদের আপাত বাসস্থানে গিয়ে রান্না বসাতে যাবে এমন সময় ঝড় আসে। বাতাসের তীব্রতা বাড়ে বাতাসের কারণে আগুন জ্বালানো অসম্ভব। যেন ঘরটাই উড়িয়ে নিয়ে যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝড়ো বৃষ্টি। বৃষ্টি বাড়ার সাথে সাথে বাতাস দুর্বল হয়। তারা রান্না করে খেতে খেতে সন্ধা নেমে আসে। সারারাত জুড়ে অঝোর বর্ষণ চলতে থাকে। 

পরের দিন মাঝি কিছুটা সুস্থ অনুভব করে। কিন্তু পা নিয়ে তার চিন্তা বাড়ছে। মেয়েটা বলে পরীক্ষা করা দরকার। ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। তারা তখন সিদ্ধান্ত নেয় আইস ট্রলারের ইঞ্জিন থেকে তেল নিয়ে তারা যাত্রা করবে। যদিও সাগর এখনো অপরিবর্তিত। তবুও আর কতদিন এভাবে অসুস্থ শরীল নিয়ে থাকা যায়। ওদিকে জাহাজ ডুবির পর তিনদিন ধরে তাদের খোজ না থাকার দরুন হয়তো সবাই ধরেই নিয়েছে তারা মরে গেছে। পরিবারের মানুষজনের কথা তার মনে পড়ে। তাদের কি অবস্থা। মাঝির নিজের পরিবারের কি অবস্থা! এসব ভেবে তারা অস্থির হয়ে পড়ে। দুপুরের আগে বৃষ্টি কমে এলে তেল নিয়ে তাদের নোঙর করে রাখা নৌকার কাছে গিয়ে দেখে নৌকাটা গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। পানি সেচে বারবার চেষ্টা করার পর ইঞ্জিন গরম হয়ে এক সময় স্টার্ট নেয়। তারা যাত্রা শুরু করে। সাগরের ঢেউ জলোচ্ছ্বাসের মতো ফুলে ফুলে আসছে। তিন ঘন্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর ড্রাইভের পর কুয়াকাটার ওয়াচ টাওয়ার দেখে তাদের ধড়ে প্রাণ আসে। তারা প্রথমবারের মত বেঁচে থাকার সত্যতা উপভোগ করে। 

তীরের কাছাকাছি যাওয়ার পর তাদের দেখে কয়েকজন মাঝি এগিয়ে আসে। তারা সবাই তার পরিচিত। তারা তাদের ধরে ধরে শেল্টার সেন্টারে নিয়ে যায়। শেল্টার সেন্টারে যাওয়ার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় হসপিটালে। একটা রুমে চারটা বেড। তার মধ্যে পাশাপাশি দুইটাতে তাদের দুইজনকে রাখা হয়। বাকী দুইটা বেড খালি। রুগীরা হাটাচলা করছে। একজন নার্সের ফোন থেকে মেয়েটা ফোন করে তার পরিবারকে জানায়। আর মাঝিকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। সে দেয়ালের দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে থাকে সারা রাত। আর মেয়েটা মাঝে মাঝে জেগে উঠে দেখে। তার পায়ে ব্যান্ডেজ দিয়ে রাখা। 

তিন-চার দিন পর ঝকঝকে রোদ উঠে। সকাল হলে সময় মাঝির পরিবারের লোকজন তাকে দেখতে আসে। শাড়ী পরা ২৭/২৮ বছরের তরুণী। তার কোলে একটা বাচ্চা আর হাতে আরেকটা বাচ্চাকে নিয়ে সে কেবিনে প্রবেশ করে। তার হাউমাউ কান্নার শব্দে ডাক্তার নার্স সহ সবাই চলে আসে। মাঝির বউ খবর শুনে সে মারা গেছে। এই ঝড়ে উপকূলের কয়েকশ মৃত মানুষের মাঝে সে তার স্বামীকে রেখেছে। অবশেষে মৃত মানুষ তার সামনে ফিরে এসেছে। 

তারপর মেয়েটা তাদের নিয়ে মাঝির বাড়ি যায়। তিন দিনের এই জীবন মৃত্যুর লড়ায়ে জিতার গল্প বলে সে মাঝির বউকে। এ সময় গাড়ির হর্ন শুনা যায়। দুইটা গাড়ি মাঝির বাড়ির উঠানটায় চাকার দাগ তৈরী করে এক জায়গায় থামে। মেয়েটার পরিবারের লোকজন নিয়ে মাঝির ছোট ভাই হাজির হয়। তার মা-বাবা, বোন এবং হাসব্যান্ড। এ সময় এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। 

এক সময় ঢাকাগামী দলের বিদায়ের সময় হয়। মাঝি, বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে মাঝির বউ, তারপর মাঝির ছোট ভাই, তার হাতে ধরা মাঝির মেয়েটা, এক এক করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাঝির সামনে এসে কথাবার্তার ফাঁকে কেঁদে ফেলে এবং এক সময় সবার সামনে মাঝিকে হাগ করে চলে যায়। তার হাসব্যান্ড ও বাবা মা চোখ সরিয়ে নেয়। মাঝির বউ, মাঝি এবং তার ছেট ভাই অবাক হয়ে যায়। মাঝি নিজেও অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তাদের চলে যাওয়ার পথের দিকে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত