ইকতিয়ারের জন্মদিন

ইকতিয়ারের আব্বা কী মনে করে যে তার নাম ইকতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি রেখেছিলেন সেটা তিনিই ভাল জানেন। তবে বঙ্গবিজেতা এই মুসলিম বীরের নামটা ইকতিয়ারকে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে রাখতো। অবশ্য তার যে বখতিয়ার খিলজি তা খুব কম লোকই জানে। লেখক সমাজে তাকে সবাই তন্ময় ইকতিয়ার বলে চেনে। ইকতিয়ার চায় না তার পৈত্রিক নামটা লোকে জানুক। প্রথম কথা হলো, ইকতিয়াররা মোটেও খিলজি বংশের লোক না, তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় সে প্রগতিশীল হয়ে উঠেছিল। বাম রাজনীতি শুরু করেছিল। বঙ্গের মুসলিম শাসকদের নিয়ে তার অস্বস্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাত্ত্বিকভাবে ইকতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ায় খিলজিকে এক রকম ঘৃণাই করতে শুরু করেছিল সে। কিন্তু কাগজে পত্রে সবখানে আব্বার দেওয়া নামটা রয়ে গেছে। তন্ময় ইকতিয়ারের জীবনের মূল সমস্যা বলতে এটাই। লেখক সমাজে তাকে সবাই তন্ময় বলে ডাকে। তন্ময় বললে ইকতিয়ার নিজেও খুশী হয়ে যায়। অবশ্য এই নামটার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। পনেরো বছর হলো সে নতুন নাম ধারণ করেছে। পুরনো বন্ধুরা তাকে ইকতিয়ার বলেই ডাকি। বন্ধুদের মধ্যে একটা ভাগ তৈরি হয়ে গেছে। যারা ইকতিয়ার বলে ডাকে তারা পুরনো বন্ধু, আর যারা তন্ময় বলে তারা নতুন বন্ধু। ইকতিয়ার আমাদের বন্ধু হলেও বয়সে কয়েক বছরের বড়। ওর বয়স এরই মধ্যে পঞ্চাশ হয়ে গেছে। তবু বন্ধুত্বে বয়স কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আমরা পরস্পরকে তুমি তুমি বলি। ওর পঞ্চাশ হওয়ার আগে থেকে ক্লোজ ফ্রেন্ডদের মধ্যে দিনটা উদযাপনের পরিকল্পনা চলছিল। পঞ্চাশ হলে ঘটা করে জন্মদিন পালন করার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছে ঢাকায়। স্বাভাবিকভাবে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম পাঠক সমাবেশ বা বাতিঘরে ঘরোয়া আয়োজন করে ইকতিয়ারের জন্মদিন পালন করা হবে। কিন্তু জন্মদিনের আগে ইকতিয়ার বেঁকে বসলো। বললো, ঢাকায় না দোস্ত, চলো আমরা নরসিংদী যাই। ওখানে আমার এক বন্ধু তার কারখানার পাশে বাগানবাড়ি করেছে। সেখানে গানবাজনা সহকারে জন্মদিন পালন করে আসি। প্রস্তাবটা লুফে নিলাম আমরা। মেলাদিন ঢাকার বাইরে যাওয়া হয় না। ইকতিয়ারের জন্মদিন উপলক্ষে এরকম একটা আয়োজন হলে মন্দ হয় না। কিন্তু অরুণ ইমতিয়াজকে নিয়ে আমার আপত্তি। ইকতিয়ার ফোন দিলে আমি বললাম, অরুণ থাকলে কিন্তু আমি যাবো না। ইকতিয়ার বলে, এইসব ছেলেমানুষি যে কেন করো। এরকম একটা আয়োজনে অরুণকে বাদ দিলে হয়? নাকি তুমি যেতে চাও না? আমাকে কী তোমার গুরুত্বপূর্ণ কবি মনে হয় না? আমি বললাম, কী বলো? নব্বই দশকের কবিতায় কসমোলজি তুমি ছাড়া আর কে আনছে, বলো? কসমোলজির কারণেই তুমি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবা। কিন্তু দোস্ত, আমার একটাই শর্ত, অরুণ যেন নরসিংদী গিয়াই সবকয়টা মদের বোতল নিজের দখলে নিয়ে না নেয়। ওর জ্বালায় শান্তিমতো এনজয় করা যায় না। ইকতিয়ার হাসে, বলে তুমি এটা নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি তোমার ভাগটা পেলেই তো হয়, নাকি? আমি বললাম, মদ খাওয়া নিয়ে আমার ওই ধরনের ইয়ে নাই। কিন্তু অরুণের ব্যাপারটা বিরক্তিকর। কথা দাও তুমি এইটা থামাবা।

ইকতিয়ার বলে, ওইসব নিয়া চিন্তা করো না। তুমি বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটায় শাহবাগে থাকবা।

আমার অফিস শেষ হয় রাত আটটায়। আমি দুপুর দুইটায় কেমনে শাহবাগ থাকবো বুঝতে পারি না। তবু বন্ধুর জন্মদিন, কোনোভাবে মিস করা যাবে না। বলি, দোস্ত এইটা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমি থাকবো।

অফিসে বসকে বললাম, একটা জরুরি সাহিত্য সম্মেলন আছে। আমি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবো, যেতেই হবে।

বস বললো, কীসের ওপর?

বললাম, জীবনানন্দের কবিতায় ঘাস ও ঠ্যাং এবং উত্তর আধুনিক কবিতার পূর্বাপর।

বস আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।  আর কিছু বললো না।

বৃহস্পতিবার দুপুরে নরসিংদী গিয়ে পরদিন বিকালে ফেরার পরিকল্পনা। দুপুরের রোদে আমি যাদুঘরের সামনে গিয়ে ইকতিয়ারকে কল দিলাম।

ইকতিয়ার বলে, আসতেছি। মোহাম্মদপুর থেকে তটিনী, শৈলীনি, জিগাতলা থেকে অরুণ, মায়াবিনী, বাটার মোড় থেকে ইলিয়াস ও বকুলকে তুলে নিয়ে আসতেছি। আমি একটার পর একটা সিগারেট ধরাই আর কিছুক্ষণ পরপর ইকতিয়ারকে কল দেই। ইকতিয়ার নানা কথা বলে, যেমন বাশারের বৌ তনিমা ঢুকছে পারসোনায়। ইকতিয়ারের জন্মদিন উপলক্ষে তনিমার স্পেশাল পারফর্মেন্স। রবীন্দ্রসঙ্গীত উনিই পরিবেশন করবেন। ফলে, তারে রেখে তো যাওয়া যাচ্ছে না। আবার মেকাপ করে না গেলে সঙ্গীত পরিবেশনে সমস্যা। তনিমা সম্পর্কে সর্বশেষ যা জানতে পারলাম, তাতে সাড়ে তিনটায় তিনি মেকাপ সেরে গাড়িতে উঠলেন। তনিমা ওঠার পর মাইক্রো যাচ্ছে সাত মসজিদ রোড। ওইখানে অরুণ ইমতিয়াজ আর মায়াবিনী রহমান উঠবে। অরুণের কাছে মাল। ফলে, সে বাসা থেকে বের হতে পারছে না। ওকে বাসা থেকে তুলতে হবে। একটা মাইক্রো তাই মোহাম্মদপুরে তটিনী আর শৈলীনিকে আনতে গেছে, আরেকটা তনিমাকে নিয়ে জিগাতলায়। এইসব ইতংবিতং করে যাদুঘরের সামনে মাইক্রোবাস এলো সাড়ে পাঁচটায়। মাইক্রো পৌঁছাতেই দেখলাম, বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ আসিফউদ্দিন ঠাকুর এগিয়ে আসছেন। তিনি আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। খেয়াল করিনি। তিনিও আমাদের সহযাত্রী হিসেবে তশরিফ আনবেন। ওনার আসল নাম আসিফউদ্দিন আহমেদ। আমি আহমেদের জায়গায় ঠাকুর বলি। একটা মাইক্রোবাসে বসলো, ইকতিয়ার, শৈলীনি, তটিনী, মায়াবিনী, ইলিয়াস, বকুল আর মাল সহ অরুণ। আরেকটায় তনিমা, বাশার, আসিফউদ্দিন ঠাকুর, আমি ও তরুণ কবি মির্জা, মুকুল ও কথাসাহিত্যিক জাহাঙ্গীর আকবর। মাইক্রো দুটো ভরলে ইকতিয়ার বললো, ফলো আস।

কিন্তু, ওদের ড্রাইভার চাঙ্গা। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, সামনে ওই মাইক্রো নাই। আমরা তো কেউ কিছু জানি না। কোথায় যাবো, কোন রাস্তায় কোনো ইন্সট্র্যাকশন নাই।

ইকতিয়ার ফোনে বললো, নো টেনশন। ড্রাইভারকে বলা আছে।

ড্রাইভারকে জিগাইলাম, জানেন তো কোথায় যাচ্ছি? ড্রাইভার বললো, নরসিংদী যাইতে কইছে।

আমি বললাম, যান তাহলে।

গাড়িতে একটু গতি আসতেই ঠাকুর বললো, শিল্পী তনিমা মহসিন, আপনার সঙ্গে এক গাড়িতে যাচ্ছি। কী সৌভাগ্য। যেতে যেতে দুএকটা গান হলে কেমন হয়। গুরুদেবের বাণী আর সুর আপনার কণ্ঠে এতটা মূর্ত হয়ে ওঠে। কী বলবো। দেশে শান্তিনিকেতনের আমেজটা আর কারো গলায় পাইনে, জানেন। পথে তনিমার কথা আর ঠাকুরের কথা বেশ জমে উঠলো। বউয়ের সঙ্গে আসিফউদ্দিনের কথাবার্তায় বাশার ঈর্ষাকাতর হলেও কিছু করার ছিল না। কারণ, আসিফউদ্দিন এমন ভাব নিচ্ছিলেন যেন তিনি গুরুদেবের নিকটাত্মীয়। ফলে, তনিমার ওপর বাশারের চাইতে তার অধিকারই বেশি। গানে গানে কখন যে বেলা হয়ে গেছে আমরা বুঝতে পারি নাই। ইকতিয়ারের ফোনে ফোনে ঘোর কাটলো।

ইকতিয়ার বলে, তোমরা কই বলো তো, রাশেদ। আমরা তো পৌঁছে গেছি সেই কখন।

আমি রাস্তার পাশের সাইনবোর্ড দেখতে থাকলাম।

বললাম, আমরা যে কই।

ড্রাইভারকে বললাম, আমরা কই?

ড্রাইভার বললো, ঠিক রাস্তায় আছি। আমি ইকতিয়ারকে বললাম, দোস্ত ড্রাইভার তো বলতেছে ঠিক রাস্তায় আছি। কিন্তু জায়গাটা কোথায়? আরে সাইনবোর্ড তো দেখি না। বাট উই আর অন রাইট ট্র্যাক।

ইকতিয়ারের টেনশন তনিমাকে নিয়ে। অনুষ্ঠান শুরুর কথা ছিল সাড়ে পাঁচটায়। এখন বাজে রাত আটটা। আবার শুরুটা হবে গুরুদেবের গান দিয়ে। আমার এই দেহখানি…। তনিমা ছাড়া সেই গান কে গাইবে। আমার সঙ্গে পেরে না উঠে ইকতিয়ার একে একে মাইক্রোবাসের সবাইকে কল দেওয়া শুরু করলো। শেষে কথাসাহিত্যিক জাহাঙ্গীর আকবর আবিষ্কার করলো, আমরা আসলে গন্তব্য পেরিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছি। ফলে ঘোরাতে হবে। অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাতে নয়টা বেজে গেল। এর মধ্যে আবার তনিমার মেকাপ ভচকায়ে গেছে। মূলত খোঁপার বকুল ফুলের মালা গেছে খুলে। বাশার মালার টেনশনে ঘেমে নেয়ে উঠলো।

কারখানার বড় গেট দিয়ে ঢুকে একটুখানি আগালে পেছনের প্লটের লম্বা রাস্তার মাথায় বাগানবাড়ি। গাছপালায় ঘেরা সুশীতল জায়গা। নানা রঙের আলো জ্বলছে। একটা কৃত্রিম লেক। তার মধ্যে ছোট বৈঠকখানা। লেকের একদিকে ফোয়ারা দিয়ে পানি উঠছে। লেক ঘিরে নানা ফুল আর ফলের বাগান। বাগানের মধ্যে মধ্যে চিড়িয়াখানা। বানর, ঘুঘু, হরিণ, কবুতর, বনমোরগ, একটা খোপে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। একদিকে নরম ঘাসের ওপর কার্পেট পেতে সামনে মঞ্চ বসানো হয়েছে। ব্যানারে তন্ময় ইকতিয়ারে ছবি ও পঞ্চাশতম জন্মদিনে শুভেচ্ছা। সবার জন্য বিকালের খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু আসতে দেরি হওয়ায় এখন বিকালের খাবারের সঙ্গে রাতের খাবারও রেডি। মৌজমাস্তির সব আয়োজন রেডি। চিড়িয়াখানার পেছনে ছোট ছোট কটেজে রাতে থাকার সুব্যবস্থা। মুগ্ধ হয়ে পুরো জায়গাটা চক্কর দিয়ে ইকতিয়ারকে খুঁজতে গিয়ে দেখি সে কোথাও নাই। ফোনও বন্ধ। যারে জিগাই সেই বলে, দেখি নাই। শেষে অরুণের শরণাপন্ন হলাম। যথারীতি অরুণ ইমতিয়াজ লেকের মধ্যে বৈঠকখানায় সব কয়টা বোতল নিয়ে গাঁট মেরে বসেছে। যেই যাচ্ছে তাকেই নিখুঁত এক পেগ করে মাল ঢেলে দিচ্ছে। আমি বললাম, ইকতিয়াররে দেখছো নাকি? অরুণ কাছে ডাকে। কানে কানে বলে, তটিনী নাকি কী সারপ্রাইজ দেবে। তুমি খাইবা? যত পেগ পারো খাও।

আমরা কয়জন মদ নিয়ে বসছি অমনি হায় হায় রব উঠলো। চৌধুরী সাহেব আসছেন। চৌধুরী সাহেবের কারখানা ও বাগানবাড়ি এটা। চৌধুরী সাহেব রেসপেক্টেড অতিথিদের তদারক করতে এলেন। অমায়িক ভদ্রলোক। ইকতিয়ারের কালেকশন।

বললেন, জলসা কখন। আপনারা কিন্তু খেয়ে নিয়েন। বুফে সিস্টেম করে দিয়েছি। লোকজন তো কম আসছেন। আমাকে ইকতিয়ার ভাই বলছিল একশজন আসবেন।

আমরা অনুরোধ করে তাকে মাল খেতে বসালাম। গ্লাসে একটা চুমুক পড়েছে কি পড়ে নাই, এর মধ্যে মাইকে আসিফউদ্দিন ঠাকুরের ধারাবিবরণী শুরু হলো। ইকতিয়ার সহ সবাইকে মঞ্চে আহবান করছে। কিন্তু ইকতিয়ার কোথাও নাই। সবাই এদিক সেদিক ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে। কেউ খাচ্ছে, কেউ ঘুরছে। রয়েল বেঙ্গলের সামনে বেশিরভাগ লোক। মঞ্চের সামনে শুধু তনিমা, তাকে পাহারা দিতে বাশার। মাইকে আসিফউদ্দিন। অনেক সময় ধরে ডাকাডাকির পর তনিমা গান শুরু করলো। বিনাশ্রোতায়। আমার এই দেহখানি তুলে ধরো…। বিমুগ্ধ শ্রোতা আসিফউদ্দিন। গানের পর বক্তৃতা। আবারও সবাইকে মঞ্চে ডাকা হলো। কিন্তু কেউ নেই। শেষে নিরুপায় আসিফউদ্দিন তন্ময় ইকতিয়ারের কবিতায় কসমোলজি শীর্ষক বক্তৃতা শুরু করলো। শ্রোতা বাশার ও তনিমা।

আমরা এক পেগ শেষ করার আগে তরুণ কবি মির্জা ও মুকুল বললো, সচেতন ভাই কখন আসবে?

আমি বললাম, সচেতন কে?

আরে সচেতন পঙ্কজ। বিখ্যাত গায়ক।

আমি তো সচেতন পঙ্কজের নাম আগে শুনি নাই।

অরুণ ইমতিয়াজ বললো, তুমি সচেতনরে চেনো না, মিয়া কী লেখালেখি করো। ঢাকার আন্ডারগ্রাউন্ড ব্রান্ডের ক্রেজ এখন।

আমি কইলাম, তুমি বাটলারের কাম করতেছো করো। সচেতনরে চিনতে হবে কে আমার।

চৌধুরী সাহেব বললেন, আমি তাহলে উঠি ভাই, আপনারা এনজয় করেন। তবে একটা অনুরোধ, মাল এইখানে খান। কারখানা থেকে মঞ্চের জায়গাটা দেখা যায়। ওইখানে মাল খাওয়া ভাল দেখায় না।

অরুণ বললো, এই দায়িত্ব আমার। একটা গ্লাস এই রুমের বাইরে যাবে না।

চৌধুরী সাহেব বের হতে হতেই আবার হৈ হৈ রব। কে, না সচেতন ভাই এসেছে। সচেতন পঙ্কজ। সচেতনের নাম শুনেই তরুণ কবি মির্জা ও মুকুল মদ রেখে দৌড় দিল। তাদের পিছু নিলো কথাসাহিত্যিক জাহাঙ্গীর আকবর। আমি আর অরুণ শুধু বৈঠকখানায়।

আমি বললাম, তুমি জানতা সচেতন আসতেছে? চিফ গেস্ট তো মনে হয় সচেতনই। ইকতিয়ার হালায় তো বলে নাই।

অরুণ বলে, আমারে বলছিল সচেতন সারারাত গান করবে।

আমি বললাম, ইকতিয়ার তো আচ্ছা হারামি। গেল কই বেটা। তোমার বৈঠকখানায় তো মেয়েগুলোও ভেড়ে না।

বলতে বলতে তনিমা, বাশার আর আসিফউদ্দিন হাজির।

এখানে এই অপসংস্কৃতি হবে জানলে আমি আসতাম না, রাশেদ ভাই। আমাকে ডেকেছেন আবার সচেতনকেও ডেকেছেন, এটা কী হলো। তনিমাকে সমর্থন জানালো বাশার ও আসিফ। বললো, দেখেন গিয়ে কী করছে। সচেতন আর তার এক চেলা এসেছে উবারে। পুরো রাস্তা মদ খেতে খেতে এসেছে। এখনও বোতল থেকে খাচ্ছে। তার কাণ্ড দেখতে এখন সবাই তার কাছে ভিড় করেছে। রীতিমতো সার্কাস। কী যে কেলেঙ্কারি।

অরুণ বললো, আমি দেখছি। আপনারা বসেন। পান করেন। আমি সামলাচ্ছি।

অরুণ স্থানীয় একজনকে বললো, আপনি গিয়ে বলেন তো মঞ্চের ওখানে মদ খাওয়া যাবে না। ওখানে কে মদ খাচ্ছে দেখেন।

বলতে বলতেই ইলিয়াস দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির। বললো, ওই দিকে কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে। সচেতন তো সবার সামনে মদ খাচ্ছে। চৌধুরী সাহেবের লোকেরা অনুরোধ করছে, শুনছে না। এই দিকে তন্ময় ভাইয়ের ফোন বন্ধ। আপনাদের যেতে হবে। আমরা সামলাতে পারছি না।

অরুণ বলে, আমি এতগুলা বোতল রেখে যাবো কেমনে। রাশেদ দোস্ত দেখো তো। বুঝায়ে এইখানে নিয়ে আসো সচেতনরে।

আসিফউদ্দিন বললো, এইসব ঝামেলা আবার এখানে টানছেন কেন।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি উঠলাম। গিয়ে দেখি লঙ্কাকাণ্ড। চৌধুরী সাহেবের লোকেরা সচেতনের হাতপা ধরছে। সচেতন বলছে, তোরা চিনোস আমি কে? আমি সচেতন, সচেতন পঙ্কজ। আর্টিস্ট। এই পৃথিবীর কোনো শক্তিকে আমি চুদি না। তোরা আমাকে মদ খেতে দিচ্ছিস না। দাওয়াত করে এনে অপমান করছিস। তন্ময়দা কোথায়? তাকে ডাক এখানে। তোরা কি মনে করেছিস। এইসব লুটেরাদের আমি চুদি। আমি শিল্পী। আমি স্বাধীন। আমার যেখানে খুশী আমি মদ খাবো। পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাকে বাধা দিতে পারবে না।

সচেতনের পক্ষে তরুণ কবি মির্জা ও মুকুল, কথাসাহিত্যিক জাহাঙ্গীর আকবর, শৈলিনী, মায়াবিনী দাঁড়িয়ে গেছে। আর বিপক্ষে চৌধুরী সাহেবের লোকেরা।

আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, সচেতন আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি আগে কখনো। আমার নাম রাশেদ। আসলে হইছে কী? পাশেই কারখানা তো। ওই যে দেখেন শ্রমিকরা কাজ করছে। রাতভর কাজ হয় এখানে। ওনারা যদি দেখে এখানে আমরা মদ খাচ্ছি, তাহলে একটু সমস্যাই তো হয়। আমাদের পশ্চাৎপদ সমাজ, বোঝেনই তো। তাই চৌধুরী সাহেব অনুরোধ করেছেন যেন বৈঠকখানায় গিয়ে আমরা মদ খাই। লেকের মাঝে চমৎকার বৈঠকখানা আছে। আপনি চলেন। সবাই মিলে মদ খাই। অন্যদের উদ্দেশেও বললাম, আপনারাও চলেন।

সচেতন একটু শান্ত হলেও ওর চেলা চেতে উঠলো। বললো, কিন্তু ওরা তো সচেতনদারে অপমান করছে। এত বড় শিল্পীর নাম জানে না। বলে, এখানে মদ খাওয়া যাবে না।

তার কথায় সচেতন আবার চেতে উঠলো। বললো, চৌধুরী সাহেব কে? হু ইজ চৌধুরী। লুটেরা চৌধুরী এখানে শ্রমিকদের রক্ত চুষে বাগানবাড়িতে মাস্তি করে। এরা শ্রেণীশত্রু। সচেতন কোনো চৌধুরীকে চোদে না।

কারখানার লোকেরা সচেতনের কথায় খেপে গেল। বললো, স্যারের নামে এইসব কী বলেন। থামেন।

সচেতন বলে, আপনার স্যাররে আমি চুদি না।

আমি বললাম, সবাই সরে যান। সচেতন একটু রেগে আছে। ওকে একা থাকতে দেন। সবাইকে ইশারায় সরে যেতে বললে সচেতন আর তার চেলা আলাদা হয়ে গেল।

চৌধুরী সাহেবের লোকদের বোঝালাম আসলে মাতাল অবস্থায় আছে তো। আমি ওর পক্ষ থেকে সরি বলছি। ভেরি সরি ভাই। আমরা লজ্জিত।

ওরা বললো, আপনারা রেসপেক্টেড অতিথি বলে কিছু বলছি না আমরা। নইলে এতক্ষণে ওনাকে বের করে দিতাম।

এর মধ্যে কোথা থেকে ইকতিয়ার এসে হাজির। তাকে ঘটনা বলার জন্য যখন সবাই প্রস্তুত হচ্ছে এর মধ্যে আবার সে আসতেছি বলে একদিকে হাঁটা দিলো।

ভিড়ের মধ্যে তটিনী এসে আমাকে বললো, রাশেদ ভাই, একটু এদিকে আসেন তো। জরুরি কথা আছে। অনুমান করলাম ইকতিয়ার আর তটিনী ঝগড়া করেছে।

একটু দূরে সরে যেতেই তটিনী বললো, আপনার বন্ধু যে আমারে ভোগ করলো, তো সে কি আমাকে বিয়ে করবে? বলেন, এই সম্পর্ক আমি কীভাবে কন্টিনিউ করবো। দেখলাম, তটিনীও মাল খেয়ে টাল হয়ে আছে। সম্ভবত ইকতিয়ারেরও একই অবস্থা। তটিনী বলে, শুধু আজকের জন্য না। রাশেদ ভাই, সে আমাকে রেখেছে দিনের পর দিন ভোগ করার জন্য। কিন্তু বিয়ের কথা বললে খেপে যায়।

তটিনীর কথা শুনতে শুনতে আবার ইকতিয়ার হাজির। তুমি ওর কথা শুইনো না তো। দেখো ওই দিকে আবার ঝামেলা লাগছে। সামলাও।

সচেতন যেহেতু চৌধুরী সাহেবের নাম ধরে গালি দিয়েছে তাই কারখানার লোকেরা চায় সচেতনকে বের করে দিতে। বলপ্রয়োগ করে তারা সচেতন আর তার চেলাকে টানছে। গেটের বাইরে বের করে দেবে। সচেতনের ভক্তরা এবার তার পাশে নেই। আমরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওদের দুজনকে নিয়ে গেটের বাইরে নিয়ে গেল চৌধুরী সাহেবের লোকেরা।

মনটা খারাপ হলো, ভাবলাম মাল খেলে একটু ভাল লাগলেও লাগতে পারে।

অরুণের আসরে পৌঁছাতে তনিমা বললো, আপদ কি বিদায় হয়েছে?

তটিনী ওইখানে আবার হাজির। ইকতিয়ারকে কাটিয়ে আমার আমাকে খুঁজছে।

রাশেদ ভাই, আপনি আমার জরুরি কথাটা না শুনে কোথায় গেলেন?

আমি তটিনীর ডাকে আবার উঠে পড়লাম। লেকের ধারে হাঁটতে হাঁটতে সে বলতে থাকলো, রাশেদ ভাই, এই জীবন তো ভাল লাগে না। ইকতিয়ার শুধু আমাকে ভোগ করতে চায়। বিয়ে করবে না। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়…

আমি বলি, কিন্তু ইকতিয়ার তো বিবাহিত। এইটা তো আপনি জানতেন।

তটিনী বলে, প্রেম করার আগে ওর মনে ছিল না ও বিবাহিত? এখন তো আমি এইসব শুনবো না। লেক ধরে অর্ধেক পথ যেতে না যেতেই আবার ইকতিয়ার এসে হাজির। বলে রাশেদ, তুমি ওরে তাল দিও না তো।

আবার তটিনীকে নিয়ে একদিকে হাঁটা দেয় ইকতিয়ার। বৈঠকখানায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, দ্বিতীয় পেগেই কেন কুফা লাগলো আজ সকালে কার মুখ দেখেছিলাম। অরুণের বৈঠকে ফিরতে ফিরতে দেখলাম চৌধুরী সাহেবের কয়েকজন লোক দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে।

তারা বললো, আপনাদের লোক আমাদের কারখানায় হামলা করছে।

সচেতন আর তার চেলা কোথা থেকে আরও দুজনকে জুটিয়ে কারখানার সামনে ইটের টুকরা জড়ো করেছে। এখন ইট ছুড়ে মারছে। আমি ইলিয়াস, বকুল, বাশার মিলে গিয়ে দেখি, ঘটনা সত্যি।

গার্ডরা তাদের সামলাতে পারছে না। কাজ বন্ধ করে শ্রমিকরাও জড়ো হয়েছে। কিন্তু কেউ গেটের কাছে যেতে পারছে না সচেতনদের আক্রমণের দাপটে।

আমি চিৎকার করে বললাম, আক্রমণ বন্ধ করেন, সচেতন। আমি কথা বলতে চাই। সাময়িক যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলো সচেতন। ইলিয়াস ও বকুলকে নিয়ে আমি বাইরে গিয়ে বললাম, এগুলো কি ঠিক বলেন, সচেতন? আমরা তো একটু শুভ কাজে আসছি।

সচেতন বললো, দাওয়াত দিয়ে ডেকে এনে অপমান সহ্য করবো না। এই লুটেরা পুঁজিপতিদের ধ্বংস করেই ছাড়বো।

বকুল বললো, চলেন, আমরাও আর না ঢুকি। সচেতনের সাথে আমরা সবাই ঢাকা চলে যাই।

সচেতন বললো, আপোষ আমি করি না।

আবারও আক্রমণ শুরু করলো সচেতন ও তার তিন চেলা। স্থানীয় দুজনের উৎসাহ আরও বেশি। নতুন আক্রমণের পর কারখানার ভেতর থেকে প্রতিউত্তর এলো। তারাও ঢিল ছুঁড়তে শুরু করলো। লোকজন হৈ হৈ করে উঠলো।

ইলিয়াস বললো, দোস্ত পালাতে হবে। আমি ইলিয়াস ও বকুল রাস্তা ধরে দ্রুত বেগে হাঁটা দিলাম। কিছুদূর আগানোর পর অরুণ ফোন দিলো, দোস্ত তোমরা কোথায়?

আমি বললাম, আমি বাইরে। তোমরা কোথায়?

কারখানার লোকেরা খেপে গেছে। আমাদের কাউকে থাকতে দেবে না। আমরা মাইক্রোতে।

ইকতিয়াররে পাইছো?

ইকতিয়ার আছে।

মাল?

আরে দোস্ত মাল কি আমি ছাড়ি? সময় মতো পার্টি হবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে দুটো মাইক্রোবাস তীব্র গতিতে আমাদের ক্রস করে গেল। আমরা পেছন থেকে মাইক্রোর পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ডাকতে থাকলাম। কিন্তু কাজ হলো না। ফোন নিয়ে কল দিতে ওরা বললো, সামনের বাজারে গিয়ে দাঁড়াবে। মেয়েরা খুব ভয় পেয়েছে, পেছনে ফিরতে চায় না।

আমরা দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করলাম।

একবার ভাবলাম ফিরে যাই, প্রতিবাদী শিল্পী সচেতন পঙ্কজকে নিয়ে আসি। গিয়ে দেখি, চৌধুরী সাহেবের লোকদের আক্রমণ সামাল দিয়ে তারা কী পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যেতে পারছে এখনও?

পরে ভাবলাম, থাক। এ জগতে যার যার লড়াই, তার তার।

ভোরে যখন ঢাকা পৌঁছালাম তখন শরীর অবসন্ন।

পরদিন একটার পর একটা ফোন আসতে থাকলো। সবার প্রশ্ন সচেতন পঙ্কজ  গুরুতর আহত হলো কীভাবে? তন্ময় ইকতিয়ারের জন্মদিনে আসলে কী ঘটেছিল?

আমি বললাম, সে অনেক কাহিনী। সংক্ষেপে বলা কঠিন। গল্পের মতো করে না লিখলে বুঝবেন না- আসলে কী ঘটেছিল। সব মিলিয়ে ২৬৫০ শব্দের গল্প হয় এটা।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত