তবুও জীবন

রোহান কে দুই হাজার টাকা ধার দিছিলাম পরের সপ্তাহে ফেরত দেবার কথা দিলেও দুই মাস চলছে ফেরত দেয়ার খবর নাই। চাইতে পারি না চক্ষুলজ্জায়। ভুলেই গেলো কিনা তাও বুঝি না।

বিরাট ব্যবসায়ীর ছেলে, ওর দুই হাজার টাকা মনে থাকার কথাও না। কিন্তু আমার রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় মনে পড়ে। গলা শুকায় আসে।

দুইটা টিউশানি করি, দুই বড়লোকের মেয়েকে পড়াই। ক্লাস সিক্স আর ক্লাস এইট। দুইটাই রোহান যোগাড় করে দিছে। রোহানের কেমন আত্মীয় হয়। মামাতো বোন একজন আরেকজন ফুফাতো বোন। বা এরকম কোনো সম্পর্ক। এসব আমার তেমন মনে থাকে না।

দুই বাসাতেই প্রথম দিকে খুব আদর আপ্যায়ন করত তারা। খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার। বড়লোকদের বাড়ির কোনো খাবারে আমি কেন যেন স্বাদ পাই না। যে কোনো খাবার প্রথম দুবার মুখে দেবার পর বিস্বাদ লাগতে শুরু করে। তারপর ঘাম দিতে শুরু হয়। অথচ এমন হবার কথা না। সম্ভবত খাবার খেতে দিয়ে ছাত্রী অথবা ছাত্রীর মা কিংবা অনেক সময় বাবাও সামনে বসে থাকেন। টুকটাক কথা বলতে শুরু করেন, আমার ধারণা এই কারণে যত ভালো খাবার হোক আমার গলায় আটকে যায়।

অথবা আরো একটা কারণে হয় সেটা পরে বুঝেছি। তা হল মুখে দেয়ার পর পর আমার ছোটো দুই ভাইয়ের মুখ মনে পড়ে, মায়ের মুখ মনে পড়ে। পাস্তা, স্যান্ডউইচ মাঝেমাঝে বিরিয়ানি এমনকি আঙুরও গলায় বেঁধে! তাই একদিন বলে দিলাম, প্লিজ আমাকে কিছু খেতে দেবেন না। এতে পড়ার সময়টা নষ্ট হয়। এমন কথা তারা শুনতে অভ্যস্ত না হয়তো। দুই বাসাতেই খেয়াল করলাম কেমন সরু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আমার দিকে। কিন্তু কোনো টু শব্দ করে নাই। রোহান একদিন বলছিলো কিরে তুমি নাকি নাস্তা রিফিউজ করছ দুই স্টুডেন্ট এর বাসায়? এই কথাটাও তাদের কেন ওকে বলতে হলো বুঝি নাই।

প্রথম মাসের বেতন পেয়ে এক কেজি আঙুর কিনে নিয়ে গেছিলাম বাড়ি। তার মধ্যে ছটাক কতক পচা ধরায় দিল দোকানি। কখন এমন কাজ করল কে জানে? মা খুব বিরক্ত হইছিলো এতো গুলো টাকা আঙুরের পিছনে খরচ করাতে। যাদের ভাত ডালের অভাব থাকে, মাছ পাতে পড়ে না, একবেলার খাবার টেনেটুনে অন্যবেলার কাছে নেয়া হয় যাতে নাস্তার খরচ কমে তাদের জন্য এক কেজি আঙুর অপচয় নিশ্চিত। কিন্তু আঙুর আমার পছন্দ। একা একা কিনে খেতে ইচ্ছা করে না কখনো। ভাই দুইটা খুব খুশি হয়ে খেতে খেতে বলছিল, এর পরের বার আপেল আইনো আপা।

রোহান আমার টাকা ফেরত না দিয়ে উল্টা সেদিন আমাকে বলে, তোমাদের বাড়ি নিয়ে চলো একদিন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের বাড়িতে কেন?

রোহান বলে, কেন যেতে পারি না আমি?

বললাম, না পারো না।

রোহান, কেন?

আমি, কারণ আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড না।

কথাটা বলে নিজেরই নিজেকে গাধা মনে হলো।

রোহান হাসতে হাসতে বলে, এটা একটা কথা হল!

আমি বললাম, মা অন্য কিছু মনে করতে পারে।

রোহন বলে, এই আধুনিক যুগে তোমার মা নিশ্চয়ই এমন ভাববেন না।

আমি হাসি আর মাথা উপর নিচ করি।

তারপর হঠাৎ রোহান বলে, আচ্ছা তুমি কখনো তোমার বাবার গল্প করো নি।

চুপ করে ছিলাম।

ঢাকায় আছি এক বছর তিন মাস। প্রতিদিন ঘুম ভাঙলে নিজেকে আদেশ করি যত যাই হোক বাবার ব্যাপারে কারো সাথে কোনো কথা হবে না।

আমার বাবা নেই। নেই মানে মারা যায়নি। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। মা’কে রেখে আরেক জনকে বিয়ে করেছে। এখন তার সাথেই থাকে। মাঝে মাঝে আসতো আগে। ছোটো ভাইটাকে নিয়ে যাবার ধান্দা করতো। ছোটোটা মায়ের ন্যাওটা। তাই বড়টাকে খুব পটাতে চেষ্টা করছিল বাবা। কিন্তু এগারো-বারো বছরের একটা ছেলেকে ভুলানো কোনো সহজ কাজ না।

আমাকে কখনও নিতে চায়নি বাবা। কেন চাইলো না এই অভিমানে অনেক রাত আমার ঘুমাতে কষ্ট হতো। অবশ্য চাইলেই আমি যেতাম তা-ও না। তখন পনেরো বছরের কিশোরী আমি।

নিজেকে বাবার আদরের ভাবতে ভালো লাগতো । তিন ভাইবোনকেই আদর করতো। কিন্তু আমি মনে মনে বাবার রাজকন্যা হিসেবে কল্পনা করতাম নিজেকে। আর্থিক টানাপোড়েন তখন তেমন ছিলো না। অবস্থা খারাপ ছিলো না,ভালোও না, চলে যেতো।

বাবা একটা কোম্পানির ড্রাইভার ছিলো তখন। ওই কোম্পানির একজন মেয়ে ড্রাইভার এর সাথে বাবার খাতির হয়। তারা বিয়ে করে।

অদ্ভুত একটা অবস্থা তখন আমাদের সংসারে। সেই দিন গুলি আমি মনে করতে চাই না। পিছনে তাকাতে নারাজ। মাকে তখন কী কী যে করতে হইছে! কিছুদিন মানুষের বাসায় বুয়ার কাজও করছে গোপনে। রান্নার কাজ করছে। পরে এক মামা নিয়া গার্মেন্টসে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলো। নদীর এপার মায়ের কারখানা। তবুও বাড়ির ঝি চাকরের কাজের থেকে ভালো। ভাই বড়টা ইলেকট্রনিকস দোকানে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে। এইটে বৃত্তি পাওয়ার পর স্কুলের স্যাররা ওর পড়ার খরচ নেন না।

বাড়ি যাই মাসে দুই বার নিয়ম করে। নদীর ওই পার বাড়ি। প্রায় মরা নদী। নদীর নাম সিংহ নদী। খেয়ায় উঠি যতবার নিজেকে সিংহী মনে হয়। বাবার রাজকন্যা এখন জীবন যুদ্ধের সিংহী।

রিক্সা নেই না দুই কিলোমিটার হাঁটা আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। রোহান দুই হাজার টাকা ফেরত দিলে বাসার জন্য কিছু বাজার করতাম। কিন্তু দিলো না। তার বান্ধবির রাগ ভাঙানোর জন্য ফুল কিনতে নিছিলো টাকাটা। সেই রোহানকে দেড় রুমে বাসায় আনার কোনো যুক্তি নাই কারণও নাই। ভাই দুইটার জন্য বাসার কাছের মুদি দোকান থেকে কিছু নিয়ে নেবো। আমার কেবলই মনে হয় দিন এমন থাকবে না। কেন মনেহয় সেটা মনই জানে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত