লতিফ বন্ডের গলায় মালা পরিয়ে দেয়া হলো

১.

আমি এই ওয়ার্ডে থাাকি আজকে প্রায় দুই বছর। এই ওয়ার্ডের মানুষের জীবন যাপন আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি। একটা হাইস্কুল, দুটো সরকারী প্রাইমারী স্কুল, একটা ডিগ্রী কলেজকে ঘিরে এখানে প্রচুর দোকানপাট, চা দোকান, টং দোকান গড়ে উঠেছে। এটা একটা দ্বিতীয় শ্রেণীর পৌরসভা। গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াইফাই আছে। শুনেছি, দশ বছর আগে এটা একটা ইউনিয়ন ছিল। কথা হচ্ছে, এই এলাকার মানুষ একজনকে খুব ভয় করে তিনি হচ্ছেন এখানকার ওয়ার্ড কমিশনার। এই ওয়ার্ড কমিশনারের নামে অনেক কিছুই শুনি আমি। আমার কাছে কখনো কখনো সেগুলো মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত মনে হয়। কথাগুলো অনেকটা ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। যেমন ওয়ার্ড কমিশনার নাকি অনেকগুলো মার্ডার করেছে। ব্যাপারটা আমাকে বিস্মিত করে। তাই আমি শিউর হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করেছিলাম এখানকার একজন টং দোকানিকে। কারণ এরা এখানকার পরিস্থতি সম্পর্কে ভালো জানে। এই টং দোকানে আমি আড্ডা মারি। চা খাই। একটা ছিমছাম টিনের চা দোকান। দুটো টুল। কয়েকটা চায়ের কাপ। কিছু কলা আর পাউরুটি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। লোকজন পালাক্রমে এসে চা খেয়ে যায়। টং দোকানের মালিকের বয়স খু্ব একটা বেশি না। বাইশ বা তেইশ হবে। ছেলেটাকে আমি ভালো পাই। তাই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
‘আচ্ছা রবিন, কমিশনার কয়টা মার্ডার করেছে জানো?’
‘ধরেন, চার পাঁচটার কম হইব না।’
‘তুমি কেমনে জানো, এতগুলো মার্ডার করেছে যে!’
‘এগিন তো বেকে জানে। কিন্তু কেউ সামনা সামনি কয় না।’
এলাকার লোক কিছু বলে না?
আরে না, কে কি কইব? মাইরা এক্কেরে ভর্তা বানাই লাই তো ন।
তোমার কি মনে হয় তার কাছে অস্ত্র আছে?
আছে মানে! তার পতিডা পোলার কাছে অসরো আছে?

এই ওয়ার্ড কমিশনারের ফেসবুক নাম লতিফ বন্ড। পুরো নাম লতিফ উদ্দিন। আমার সাথে লতিফ বন্ডের ফেসবুকে এড নাই। এড হওয়ার ইচ্ছেও রাখি না। তবে মাঝে মাঝ তার আইডিতে ঢুকে তার কার্যক্রম দেখি। কিছুদিন আগে তার জন্মদিনে প্রায় এক হাজার লোক তার ওয়ালে উইশ করেছে, আমি দেখেছি। আর আমার জন্মদিনে উইশ করে মাত্র দুই তিন জন। লতিফ বন্ডকে নিয়ে তার অনুসারীরা নানা রকম পোস্ট দেয়। সেসব পোস্ট পড়ে আমি কখনো কখনো কখনো হাসি। আর বেশিরভাগই থাকে বানান ভুল। কখনো কখনো তার অনুসারীরা তাকে পরিবারের চেয়েও আপন অভিভাবক হিসেবে দাবি করে।


আরিফ বলে, ‘এই স্কুলের জেরিন ম্যাডামরে তো লতিফ বন্ড তুইলা নিয়া বিয়া করছে।’
‘কি কস?’
‘হ। কথা সত্য।’
‘জেরিন ম্যাডামের লগে নাকি প্রেম ছিল। ম্যাডাম পছন্দ করত লতিফ বন্ডরে কিন্তু ম্যাডামের পরিবার লতিফ বন্ডের লগে জেরিন ম্যাডামের বিয়া দিতে রাজি ছিল না।’
‘তো, পরে কি হইল?’
‘ম্যাডামের বাপ যখন রাজি হয় নাই তখন লতিফ বন্ড ম্যাডামরে তুলে নিয়ে আসছে।’
‘ও তাইলে এই ঘটনা।’
‘হ। দেখ, ম্যাডাম কি সুন্দর, স্লিম ফিগার। এখনও পোলাপান ক্রাশ খায় উনার উপর। অথচ তিনি কি না এক গুন্ডাকে বিয়ে করে বসে আছে।’
‘হ, কপাল। বন্ধু’
আরিফ আরো বলে, ‘ওই যে বাজারের উত্তর পাশের হাসপাতালটা, ওইটা তো লতিফ বন্ড দখল দখল কইরা ফালাইছে।’
‘কি কস! চার তলা একটা হাসপাতাল দখল কইরা ফালাইলো?’
‘হাসপাতালটা যে লোকের ছিল সে লোকরে নাকি মারার হুমকি দিছিল বন্ডে, হাসপাতাল যাতে ছাইড়া দেয়। সেজন্য সে হাসপাতালের মালিকানা ছেড়ে দিছে।’
‘বন্ডের অনেক পাওয়ার।’
‘ওই যে হাই স্কুলের পিছনে যে দুইটা পাঁচতলা বিল্ডিং দেখতাছস ওগুলোও বন্ডের। ওগুলোও ওর নিজের না। দখল করে নিছে।’
‘শালা বন্ড।’
‘বন্ডের কাছে কম হইলেও পঞ্চাশ কোটি টাকা আছে।’
‘তো তা দেখেই বুঝা যায়।’
‘এত টকা কই পায় সে?’
‘আরে সব দুই নাম্বারি ইনকাম।’
‘দুই নাম্বারি ইনকাম না হইলে এই দেশে কেউ এত টাকা পয়সার মালিক হয় নাকি!’
‘তার অনেক জায়গা জমি জমা আছে শুনছি ।’
‘থাকতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু না।’
‘শুনলাম, জেরিন ম্যাডামের লগে বন্ডের ইদানীং একটু ঝগড়াঝাটি হচ্ছে।’
‘কি নিয়ে রে?’
‘বন্ড নাকি বলছে, বউরে আর মাস্টারি করতে দিবে না। কিন্তু ম্যাডাম তো মাস্টারি করতে চায়। বন্ড কয় তোমার টাকার দরকার হইলে আমার থেকে নিও।’
‘তো ম্যাডাম কি কয়?’
‘ম্যাডাম কয়, মাস্টারি করা আমার শখ। আমি এটা চালিয়ে যেতে চাই।’
‘তোরে এসব কে বলল?’
‘আরে ওদের কাজের ছেলে আছে না! তার সাথে ওই দিন বাজারে দেখা হইল। সে কইল।’
‘তোরে আবার ওদের কাজের ছেলেও তথ্য দেয়। বাহ! ইন্টারেস্টিং তো।’


কয়দিন পর। চা দোকানে বসে আছি। এসময় হন্ত দন্ত হয়ে আরিফ এসে বলে, ‘কমিশনার তো আরেকটা মার্ডার করছে। কাজের পোলাটারে মাইরাই ফেলল।’
‘ওই যে কাজের পোলাটা যার সাথে তোর টুকটাক কথা হয়, ওরে?’
‘হ, পোলাটা ভালো ছিল। ওরে আমি ভালো পাইতাম।’
‘কেন মারল? ঘটনা কী?’
‘পোলাটা নাকি এক লোকের মোবাইল চুরি করছিল। যার মোবাইল চুরি করছে, সে বন্ডরে অভিযোগ দিছে বিচার করার জন্য।’
‘তো বিচার করতে যাইয়া মাইরা ফেলল?’
‘হ। লাঠি দিয়ে নাকি মাথায় চারটা বাডি দিছে। যারা সামনে ছিল তারা বলছে, প্রথম দু্ই বাডিতেই নাকি পোলাটা মরে গেছে। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। হাসাপাতালে যাওয়ার আগেই তো ডেড।’
‘একটা মোবাইলের জন্য মাইরা ফেলতে হবে? দেশে কি বিচার আচার নাই! কি জুলুমের দেশ।’
দুই দিন পর শুনি লতিফ বন্ডকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারের খবরটা আরিফই দিলো আমাকে। সে এসব গ্রেফতারকে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘আরে এগুলো আইওয়াশ। কিছুদিন পর আবার বের হয়ে যাবে দেখিস।’
‘আরে ঘটনা হইসে কি জানোস, কাজের পোলাটার সৎ মা—ও আবার লতিফ বন্ডের বাসায় কাজ করে। সে নাকি কোর্টে সাক্ষী দিছে, লতিফ বন্ড কাজের ছেলেটারে মারে নাই। গণপিটুনিতে লোকজন মেরে ফেলছে মোবাইল চুরি করার অপরাধে।’
‘ওইটা তো আসল মা না। সৎ মা । এজন্যই সে এই কথা বলছে। এই কথা বলতে তার বুক একটুও কাঁপল না! তাহলে তো কেইস হালকা হয়ে যাবে।’
‘হ। তাই তো মনে হয়।’
‘কিন্তু বাপ ঠিক আছে। বাপে বিচার চায়। আর পোলাটার দেশের বাড়ী তো এখানে না। অন্য ডিস্ট্রিক্টে। এজন্য মনে হয় এলাকার লোকের তেমন চাপ নাই।’
লতিফ বন্ড এর আগে অনেকগুলো মার্ডার করেছে সে ব্যাপার এই এলাকার মানুষ শুনেছে কিন্তু দেখেনি। তবে এইবারের মার্ডারটা অনেকেই দেখেছে। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কীভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে মেরে ফেলে সেটা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে। এই ঘটনার পর আমার এক সপ্তাহ ঘুম আাসেনি। আমি দেখতাম, লতিফ বন্ড কি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলত। অবশ্য আমি জানতাম, এসব মিষ্টি কথার আড়ালে সে একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। কারণ আমার কাছে মনে হয়, যারা প্রকৃতি অর্থেই সন্ত্রাসী হয় বা মার্ডার করতে অভ্যস্ত তারা এরকইম হয়। দেখতে খুবই শান্ত ভদ্র। মানুষের সাথে হেসে কথা বলে। কিন্তু এরা এক হাতে ভাত খায় আরেক হাতে মানুষ হত্যা করে।
লতিফ বন্ড জেলে যাওয়ার পর জেরিন ম্যাডামের খোঁজ নিতে ইচ্ছে হলো। জেরিন ম্যাডাম কি এখন স্কুলে যায়! নাকি লজ্জায় তিনি স্কুলে যাওযা বন্ধ করে বন্ধ করে দিলেন। এলাকার সবাই, স্কুলের টিচার স্টুডেন্টস সবাই তো জানে, লতিফ বন্ড যে জেরিন ম্যাডাম স্বামী। যারা জানে না তারাও এই ঘটনায় জেনে গেল। স্কুলের পাশে চা দোকানদার রবিনকে তাই জিজ্ঞাসা করি, ‘জেরিন ম্যাডাম কি স্কুলে যায়?’
‘না। এই কয়দিন তো দেখলাম না।’
জেরিন ম্যাডামকে স্কুলে যেতে হলে এই চা দোকানের সামনে দিয়েই যেতে হয়। আমার সময় থাকে না জেরিন ম্যাডাম স্কুলে গেল কি গেল না সেটা দেখার। তবে চা দোকানদার ছেলেটা যেহেতেু বলেছে তিনি এই কয়েকদিন স্কুলে যাননি সুতরাং তার কথা আমি বিশ্বাস করি।
আমি ভাবছি, জেরিন ম্যাডাম কি লতিফ বন্ডের বাসায় আছে নাকি বাপের বাড়ি চলে গেছে। উনার স্বামী যে কাজের ছেলেটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলল উনার আসলে প্রতিক্রিয়া কি! উনি কি এই মেরে ফেলাটাকে সমর্থন করেন! নাকি তিনি তার স্বামী যাকে তিনি পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলেন তার উপযুক্ত শাস্তি চান। আমার মন বলে, জেরিন ম্যাডাম ফাঁদে পড়ে গেছেন। একটা সন্ত্রাসীকে বিয়ে করে এখন হয়তো বুঝতেছেন । আমার ইচ্ছে হয় জেরিন ম্যাডামকে আমি বলি, ম্যাডাম আপনি এই লোককে বাদ দিয়ে অন্য লোককে বিয়ে করুন। একটা সন্ত্রাসীর সাথে একই বিছনায় শোয়া আপনার মানায় না। কিন্ত জেরিন ম্যাডামের সাথে তো আমার পরিচয় নাই। আমি উনাকে চিনি উনি এই এলাকার কমিশনারের বউ হিসেবে। এলাকার হাই স্কুলে আরো টিচার আছে তাদেরকে তো আমি চিনি না। আমি জানি, উনাকে অনেকেই পেতে চায়, অনেকের মনের কুঠারিতে তিনি বাস করেন। কিন্তু লতিফ বন্ডের ভয়ে কেউ সাহস করে কিছু বলতে পারে না। লতিফ বন্ড যদিও জেলে গেছে কিন্তু তিনি খুব সহসাই ফিরে আসবেন।

৪.
চা দোকানে আজও বসে আছি। আরিফ বলল, লতিফ বন্ডকে তো নাকি তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে গেছে।
‘তিন দিনের ?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার মনে হয় সে বেশি দিন জেলে থাকবে না। ধর, দুই তিন মাসের বেশি থাকবে না। এর মধ্যেই ছেলের বাপের লগে একটা মীমাংসা করে ফেলবে।’
‘এরকমই হবে।’
‘ধর, দশ লাখ টাকা দিল ছেলের বাবাকে। আর বলল, ভুলে একটু বেশি মারা হইয়া গেছে। আমি হয়তো মারতে চাই নাই। আরো বলবে, ধরেন এই টাকাটা দিয়া যদি আপনাগো উপকার হয়।’
‘হ হ এটাই বলবে। কারণ এরা তো ধর গরীব মানুষ। মামলা চালানোর মত ক্ষমতা নাই। না আছে টাকা, না আছে পলিটিক্যাল সাপোর্ট। আর দশ লাখ টাকা পাইলে কাজের পোলার বাপ এমনিতেই খুশি হয়ে যাবে। আর মামলা লড়তে যাবে কোন দু:খে।
‘হ্যাঁ এরকমই হবে। আরে বন্ডদের মত লোক বেশিদিন জেলে থাকে না। মামলা ম্যানেজ করে চলে আসবে।’
আরিফের সাথে আমি এসব বিষযে কথা বলি। ও এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। অবসরে চা দোকানে আমি ওর সাথে আড্ডা দেই। কারণ ওকে আমার বিশ^স্ত মনে হয়। কথা পাচার করে না। আমার কাছে সে মানুষটাই ভালো যার সাথে মন খুলে কথা বলা যায়। এই ওয়ার্ডে আসার পর থেকে আমি আরিফের সাথে বিভিন্ন বিষযে কথা বলেছি। সে আমাকে এলাকার বিভিন্ন মানুষ সম্পর্কে ইন্টারেস্টিং তথ্য দেয়। ওর সেসব তথ্য কখনো কখনো আমাকে কৌতূহলী করে তোলে।
একবার নাকি আরিফকে বন্ড ইয়াবা বিক্রির জন্য অফার করছিল। বন্ড এলাকায় ইয়াবার ব্যবসা করে এটা ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। আরিফ সরাসরি না করে দিয়েছিল। তাকে হুমকিও দেয়া হইছিল। আরিফ সরাসরি নাকি বলেছিলও, ‘এসব বন্ড টন্ড আমি গুনিও না। আমার মামা এসপিকে লাগায় দিব।’ অবশ্য সেটা আপন মামা না। দূর সম্পর্কের মামা। যা—ই হোক কোনো রকম মামা হওয়ায় সে অন্তত উঁচু গলায় কথা বলতে পারে। বাকিদের তো বন্ডের দলে ভিড়তে হয়।


দুই মাস পর। স্কুলের মাঠে ছোটো খাটো একটা সভা হচ্ছে। মানুষ আছে মোটামুটি। খুব কমও না বেশিও না। দূর থেকে আমি দেখতে পাই লতিফ বন্ডের গলায় একে একে কিছু ছেলে মালা পরিয়ে দিচ্ছে। আর মাইকে একজন ঘোষণা দিচ্ছে, ‘কারা নির্যাতিত সংগ্রামী নেতা লতিফ ভাইকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।’ মিথ্যা মামলার কথা শোনার পর আমার হাসি পায়। তারা আরো বলে, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা যতই ষড়যন্ত্র করুক, দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ দিনে দুপুরে একটা ছেলেকে মার্ডার করা হলো আর সেটা ষড়যন্ত্র হয়ে গেল! সেলুকাস। তারপর একের পর এক মালা পরিয়ে লতিফ বন্ডের গলা উঁচু করে ফেলা হয়।

আমি সেখানে আর থাকতে পারলাম না। বাসায় চলে এলাম।

ছোটগল্প

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত