গ্লানি

কিম্মত আলীর সাইকেলটির বয়স কম করে হলেও তার বয়সের অর্ধেক হবে। বছর তিরিশেক আগে প্রথম পক্ষের সঙ্গে বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল মেয়ের জামাইয়ের যোগাযোগের সুবিধার জন্য। তবে একে ঠিক উপহার বলা ঠিক হবে না। ঘটক কনেপক্ষের সঙ্গে বেশ দরকষাকষি করে সাইকেলটি আদায় করেছিল। কালের প্রবাহে কিম্মত আলীর মতোই সাইকেলটিতে বয়সের ছাপ পড়েছে। ব্রেক ভালো কাজ করে না; চেইনের কভার কবে নাই হয়ে গেছে কেউ মনে রাখেনি। দাঁড় করানো জন্য স্ট্যান্ড না থাকলেও এর কাজ বন্ধ থাকে না—কোনো গাছ বা দেয়ালের পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেই হল। গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতেই বয়সকে সাথী করে নিয়েছে কিম্মত আলীর সাইকেল। তবে এই গল্প জংধরা জীর্ণ সাইকেল নিয়ে নয়, সাইকেলের বাম হাতলে ঝুলে থাকা ব্যাগটি নিয়ে।

ব্যাগের ভেতরে কিম্মত আলীর যন্ত্রপাতি—হাতুড়ি-বাটাল-রানদা, করাত, স্ক্র ড্রাইভার, পুরাতন একটি গজফিতা ইত্যাদি। কাঠমিস্ত্রি কিম্মত আলী জীবনে নানান কাজ করলেও কাঠের কাজেই তার সংসার চলে। তবে সংসার চলে বলা সহজ নয়। তার প্রথম স্ত্রী পাঁচ সন্তান নিয়ে দশবছর হল গ্রামের অন্যপ্রান্তে আলাদা থাকেন। সন্তানদের কারও আবার নিজের সংসার হয়েছে। কিম্মত আলীর নতুন সংসারে ছেলে-মেয়ে তিনজন। দুই পরিবার টানতে টানতে একসময় আগের পরিবারের সাথে যোগাযোগের সূত্রটি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দরিদ্রাবস্থা তার পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত। তিনি জেনেছিলেন বিয়ে করলে কপাল ফেরে। কিম্মত আলীর কেবল পরিবারটি বড় হয়েছে। রিকশাচালক প্রতিবেশি মন্নাফ মিয়ার পরামর্শে আরও একটি বিয়ে করেন। তাতেও কাজ হয়নি। কপাল তার ফেরেনি। যৌবনে গায়ের শক্তির সঙ্গে উপার্জনও তার কিছু বেশি ছিল। এখন দুটোই অনেক কমে এসেছে। কাঠের কাজের সুযোগও আর আগের মতো নেই। গ্রামে স’মিল এসেছে, কাঠখোদাই মেশিন এসেছে। তার বয়সী হাত আর দুর্বল পেশি এসবের সাথে পাল্লা দিয়ে পারে না। তবুও তার সংসার চলছে, অনেকটা বয়সী সাইকেলটির মতো।

ছোটোখাটো গড়নের কিম্মত আলী প্রতিদিন সকালে সাইকেল নিয়ে কাজে বের হন, ফিরে আসেন সন্ধ্যায়, কখনো সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। নতুন কাজে তার ডাক পড়ে কম। মূলত ঘরবাড়ির আসবাবপত্রের মেরামতের কাজেই তাকে প্রয়োজন পড়ে। একসময় তার নিজের একটি দোকান ছিল ল্যাংড়া মেস্তুর বাড়ির চৌরাস্তায়। তার ওস্তাদ ছিলেন ল্যাংড়া মেস্তুর। তিনি নেই। কিম্মত আলীর কাঠের কাজের দোকানও সময়ের প্রবাহে উঠে গেছে।

আজ সোমবার, হাতে কোনো কাজ নেই। পড়ন্ত বিকেলে কিম্মত আলী সাইকেল নিয়ে রওয়ানা হলেন। বাম হাতলে আছে তার ব্যাগটি। তবে এতে কাঠের যন্ত্রপাাতির বদলে রয়েছে কুকুরের পাঁচটি বাচ্চা। কু-কু করে শব্দ করছে, কাঁদছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। ডানে পিরফাতালির মাজার পার হয়ে দেওয়ান বাড়ির সামনের খেজুর গাছগুলোর ছায়া মাড়িয়ে অঘ্রান মাসের বিকেলে কিম্মত আলীর সাইকেল চলছে। প্রায় এক কি.মি. গেলে পাকা সড়ক, তারও কিছুদূর গেলে সোনাই গাঙ। গাঙের ওপারে বাচ্চগুলোকে ফেলে আসতে হবে। ফেলে আসতে হবে, না-বলে রেখে আসতে হবে ভাবলে হয়ত ভালো লাগে কিম্মত আলীর। কুকুর বিড়াল বেশি হয়ে গেলে নদী পার করে দিয়ে আসতে হয়, যাতে করে আর বাড়ি চিনে ফিরে আসতে না পারে—এইটাই নিয়ম। এই কাজ কিম্মত আলী আগেও করেছেন। বাচ্চাগুলোর বয়স তিনদিন। নদী পার করে দিয়ে এলে এই বাচ্চাগুলোর ভাগ্যে কী ঘটবে আন্দাজ করা যায়। তবে এটা ভাবনায় আনলে চলে না। এতোগুলো বাচ্চার খাবার কোথায় পাবেন কিম্মত আলী। ভাতের মাড় আর কতটুকু? কুকুর পালা তার জন্য বিলাসিতাই। তবুও একটা কুকুর ছোটো উঠানের কোনায় জাম গাছটির তলায় শুয়ে-বসে থাকে, ডাকলে কাছে এসে ল্যাজ নাড়ায়, রাতের বেলায় অচেনা কাউকে দেখলে শব্দ করে জানান দেয়—কিম্মত আলীর ভালোই লাগে। তবে এতগুলো বাচ্চার ব্যাপার ভিন্ন।

২.

কুকুরছানাগুলোকে ওপারে নির্বাসন দিয়ে কিম্মত আলী চরজাগা গাঙের পানিটুকু পার হতে গিয়ে লজ্জা এবং লুঙ্গি দুইটাকে সামলে যখন এপারে প্রায় পৌঁছে গেছেন তখন খেয়াল করলেন, তার ছেলে রমজান চলে এসেছে গাঙ্গের পাড়—হাঁপাতে হাঁপাতে প্রায় কান্নার মতো শব্দ করে বলল, ‘ইডা তুমি কিতা করছ, আব্বা!

রমজান বুঝে গেছে, বাচ্চাগুলো তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আক্ষেপ আর দুঃখে বসে পড়েছে মাটিতে, হাত-পা ছুড়ছে। তার গায়ে কোনো জামা নেই। মাঠে ছেলেদের সাথে হয়ত কোথাও খেলছিল, খবর পেয়ে ছুটে এসেছে।

রমজানের বয়স নয়, বাবার বয়সের তুলনায় তার বয়স একটু কমই বলা যায়।  ছেলেটি তার সন্তানদের মধ্যে ছোটো, আদরের। বাড়ির কুকুরটির প্রতি ছেলের বিশেষ মনোযোগ রয়েছে। ফলে বাচ্চাগুলোর প্রতিও তার স্নেহ সম্প্রসারিত হয়েছে। তিনদিন আগে রমজানই প্রথম বাচ্চগুলোর সন্ধান পায়।

ঘুম থেকে উঠে উঠানের একপাশে পরিত্যক্ত চুলার ভেতর থেকে গোঙানোর মতো অস্পষ্ট শব্দের কারণ সন্ধান করতে গিয়ে রমজান আবিষ্কার করে পাঁচটি বাচ্চা। আনন্দে চিৎকার করে ওঠে রমজান। তার বড় দুই বোন ছুটে আসে। যদিও তার মা-বাবা এই আনন্দে অংশগ্রহণ করেনি, তাতে কী! অল্পসময়ের মধ্যেই প্রতিবেশী সমবয়সী শিশুরা জেনে যায়, তাদের কুকুরটি নতুন বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। এরমধ্যে কুকুর সনাক্তকরণবিদ্যায় পারদর্শী দু’একজন কিশোর জুটে যায়। তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কুকুরছানার মাথার পেছন দিকে চামড়ায় ধরে উঁচু করা সনাক্তকরণের প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট। এর মাধ্যমেই এর প্রজাতি নির্ণয় হয়ে যায়। যদি এতে কুকুরছানা শব্দ না করে তবে এর প্রজাতি উন্নতমানের। যদি চিৎকার করে তবে এটি নিম্ন প্রজাতির—‘কেডিকুত্তা’। এই প্রজাতির কুকুর খুব ভালো হয় না, ঘেউ-ঘেউ করাই এদের কাজ। কাজের কাজ কিছু এরা করে না। শরীরে যদি যথেষ্ট পরিমাণে লোম থাকে এবং চুপচাপ স্বভাবের হয়, তবে সেটি হচ্ছে বিলাতি কুত্তা। হাত-পা লম্বাটে হলে সরাইল্যা কুত্তা। হাবশী কুত্তা নামে একটা প্রজাতি আছে, এ বিষয়ে তাদের ধারণাটা স্পষ্ট না হলেও একটিকে এই ভাগে ফেলা হয়েছে। কুকুরছানাগুলোকে সবাই ভাগাভাগি করে নিয়েছে। তবে যেহেতু সদ্য ভূমিষ্ঠ তাই কিছুদিন অপেক্ষার সিদ্ধান্ত হল। মাঝেমধ্যে সবাই মিলে ভাঙাচুলার মধ্যে বাচ্চাগুলোকে আদরযত্ন করে। তবে তা কেবল হাত বুলানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ; বাচ্চাগুলো তখনো অন্য খাবারে অভ্যস্থ হয়নি। প্রথমদিকে তাদের দেখে ছানাগুলোর মা দূরে সরে গেলেও অল্পসময় পরেই জেনে যায়, এরা কাছের মানুষ। আর ভালোবাসা কেই-বা না টের পায়! এরমধ্যে শিশুদের দল অপেক্ষা করে। অপেক্ষার তৃতীয় দিনেই ঘটল ঘটনাটি।

৩.

কিম্মত আলী ছেলেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন—কুকুরবিড়ালের বাচ্চা বেশি হলে নদী পার করে দিয়ে আসতে হয়। এতগুলো বাচ্চা পালনের সামর্থ্য তাদের নেই, বাচ্চাগুলো কেউ হয়ত পালার জন্য নিয়ে যাবে। কিন্তু রমজানের যুক্তি আরও বস্তুনিষ্ঠ—সন্ধ্যা হয়ে আসছে, কাছেই শিয়ালের বসবাস। একটু পরেই বাচ্চাগুলো তাদের খাদ্যে পরিণত হবে। এই ভাবনায় তার কান্না আরও বেড়ে যায়। কিম্মত আলী ছেলের দুঃখে দুঃখ পান। চেয়ে চেয়ে দুঃখ দেখেন। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার মতো করেই বলে উঠলেন, ‘মানুষ মানুষের লাইগ্যা কান্দে না রে ফুত, তুই পশুর বাচ্চার লাইগ্যা কান্দস। আয় বাড়িত যাই।’

ছেলের বুকটা তবু কান্নার দমকে ফুলে-ফুলে উঠছে। চোখ মুছতে মুছতে পিতার সাথে হাঁটছে—‘তুমি মায়ের উর খালি করছ, আব্বা!’ কিম্মত আলী ভাবছেন, কথা সত্যি। অন্তত একটা ছানা বাচ্চাগুলোর মায়ের কাছে রেখে আসা উচিত ছিল। কিন্তু কী আর করা। উচিত কাজ কি সবসময় করা যায়? সন্তান দূরে গেলে কেবল মায়ের ‘উর’ না, বাপের বুকও খালি হয়।

ছেলেকে পিঠে তুলে সাইকেলটিকে সাবধানে চালাতে গিয়ে কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে আছেন কিম্মত আলী। পিতাপুত্র দুজনেই নীরব। কিম্মত আলীর মনটা খারাপ হয়ে আছে ছেলের দুঃখে, বাচ্চাগুলোর মায়ের জন্য, না তার ফেলে আসা পরিবারের পাঁচটি সন্তানের জন্য বোঝা যাচ্ছে না।

কিম্মত আলীর সাইকেলটি চলছে গ্রামের পথ ধরে। বাম হাতলে ঝুলছে শূন্য ব্যাগটি।

 

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত