পৃথিবী – The earth

  1. পৃথিবী : The Earth

    ‘যে ভালোবাসা দূরের, যার ব‍্যপ্তি বিশ্বলোক ছাড়িয়ে অপার্থিব অন‍্য কোনো ভূবনে বিরাজ করে। সেই ভালোবাসার জন‍্য বৈরাগ্য জীবনই শ্রেয়। পার্থিব অন‍্য আর কোনো মায়ায় জড়িয়ে যেতে নেই।’ এই কথা গুলো বলছিল আয়ান হায়দার। আয়ান এসেছিল লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে বাংলাদেশে। যাযাবরীয় জীবন তার। এখানে সে এসেছিল কোনো সুশৃঙ্খল জীবনের সাথে নিজেকে শৃঙ্খলে জড়াতে। কিন্তু করেনি। এলমেল জীবন যেমন ছিল তেমনই নিয়ে সে আবার ফিরে যাচ্ছে।

    আয়ান চলে যাচ্ছে। আমি জানি, ওর এলমেল জীবন আরও বেশি অগোছালো হয়ে যাবে। দুই দিন কর্মে থাকবে তো, তিন দিন ঘুরবে ভবঘুরের মতো। বড়ফ পড়া শীতের রাত্রিতে কোনো পর্বতের পাশে তাঁবু টানিয়ে ক‍্যাম্প ফায়ার জ্বেলে উত্তাপ নিবে। ওর নিরুত্তাপ জীবনের উষ্ণতা খুঁজবে, তুষার পড়া রাত্রি দুপুরে।

    ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল এমনি এক শীতের রাত্রিতে লস এ্যাঞ্জেলসের ডাউন টাউনে একটি কফিশপের দোতলায়। আমি ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, পদ্মা যমুনা মেঘনা পাড়ের কেউ একজন হবে। আগ বাড়িয়ে আমিই পরিচিত হয়েছিলাম। বয়সে আমার তিন চার বছরের ছোট হবে। কিন্তু আমি ওর ক্ষণিক বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম আমার সেই ক্ষণকালের প্রবাস জীবনে।

    আমার সেই ক্ষণকালের প্রবাস জীবনে ওর সাথে কয়েকটি বিকেল কাটিয়েছিলাম প‍্যাসিফিকের তীরের লং বীচ, মালিবু ও সান্তা মনিকায়। এক রাত কাটিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। আর একদিন দুজনে সারারাত কাটিয়েছিলাম ডাউন টাউনের গ্রান্ড পার্কের বেঞ্চের উপরে।

    মালিবু বিচের বালুকাবেলায় একদিন দুজন হাঁটছিলাম। আমাদের পিছনে ছিল পাহাড়। সামনে প‍্যাসফিকের বিশাল জলরাশি। একদিকে নাম না জানা কতো লতাগুল্ম আর থোকা থোকা ফুলের ঝাড়, আর অন‍্যদিকে বিকালের লাল মেঘের আভা মিশ্রিত রুপালি জলের ঢেউ। কথা বলছিলাম আমরা সাগরের দিকে মুখ চেয়ে। কেন যেন মনে হলো, আয়ানের মুখ বিষণ্ণ! মুখ ফিরে চেয়ে দেখি — আয়ানের চোখের নীচে যেন প‍্যাসিফিকের লোনা জল। দেখলাম, মলিন হতশ্রী মুখচ্ছবি ওর। বিকালের রক্তিম সূর্যের রশ্মি সেই মুখকে একটুও রোশনি ছড়াতে পারেনি।

    আমি আয়ানের পিঠে হাত রেখে বলেছিলাম, ‘তুমি এমন একলা কেন? এখানে এই পরবাসে তোমার কেউ কী নেই? কদিনের দেখায় মনে হয়েছে, কোথায় কোন্ গভীরে, প‍্যাসিফিকের ঐ অতলান্তে তুমি তোমার অসীম কোনো দুঃখকে লুকিয়ে রেখেছ।’ সেদিনের সেই নিমগ্ন সাগর বিকালে দূর হতে দমকা বাতাস বয়ে এসেছিল। আয়ানের এলমেল খুসকো চুল হাওয়া লেগে উড়ছিল। কিছুই বলতে চায়নি আয়ান, আবার বলতেও চেয়েছিল কী যেন কথা।

    সেদিন মালিবু বীচের অপ্রসন্ন সেই বিকালে কিছুই বলেনি আয়ান। বলেছিল আর একদিন ওর বাড়িতে। ওয়েল ডান কার্ণ কান্ট্রি এরিয়াতে নিরিবিলি ছোট্ট একটি রেন্ট বাড়িতে ও একাই থাকত। গ্রামীণ ছিমছাম একতলা বাড়ি। ঐদিন ঐ বাড়িতে আমি রাত্রিবাস করেছিলাম। বাড়ির পিছনে ছোট্ট একটি বারান্দা ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা সেই বারান্দায় বসে কথা বলেছিলাম। অনেক কথাই সেদিন হয়েছিল।

    আয়ানের বাড়ির বারান্দায় বসে সন্ধ্যায় দেখেছিলাম পিছনে একপাশে টিউলিপ ফুলের প্রান্তর, আরেক পাশে লিলি। মাঝখানে মেঠো পথের দুপাশে কার্ণেশনের ঝাড়। আমরা বসে যখন কথা বলছিলাম, তখন পিছনের প্রান্তর থেকে এইসব ফুলের গন্ধ আসছিল। রাত বেড়েই চলছিল। আয়ান আমাকে ওয়াইনের ওফার করেছিল। আমি বললাম, না। শুধু সিগারেট। এ‍্যাস্ট্রেতে এক এক করে পোড়া সিগারেটের ছাই দিয়ে ভরে উঠছিল।

    তখন ভালো লাগছিল ওয়েল ডান কান্ট্রির আকাশ। মনে হয়েছিল এ যেন বাংলাদেশের আকাশ! এ যেন আমাদের কুসুমপুরের তারাভরা রাত্রি। মাঝে মাঝে হিম প্রবাহ বয়ে আসছিল দূরের সান গাব্রিয়েল মাউন্টেন থেকে। সেদিন তারার আকাশে কোনো কথা ছিল না। টিউলিপ ঝাড়ে কোনো জোনাকির গান নেই। বাতাসের কোনো শব্দ নেই। নিশ্চুপ ছিল নির্জন বিজন রাত। কী এক বিষাদ ছড়িয়ে সেদিন সেই রাতে আয়ান হায়দার বলেছিল তার কথা।

    খুব সংক্ষেপিত করে আয়ানের মুখ থেকেই সে কথা শুনি:

    মেয়েটির নাম ক‍্যাথেরিন রিচি। আমি ওকে ডাকতাম রিচি বলে। ও এসেছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো থেকে। রিচি ছিল একজন স্ট্রিপ গার্ল। প‍্যাসাডোনার নাইট ক্লাব ক্রেইক এ‍্যাভিনে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। নীল ঝলমলে আলোর নীচে আমি ওর বাঙালি মেয়েদের মতো কালো চোখ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। ওর ঐ চোখ দেখেই আমার ভাল লেগেছিল। প্রথম কথা ছিল, ‘তুমি কে? কোথা থেকে তুমি এসেছ। তোমার নাম কী?’ তারপর বলেছিলাম, ‘তোমার কথা কিছু বলো।’ রিচি বলেছিল — I am Katherine Ricci , came from Reo de Jenerio, Brazil. I am no bird, and no net ensnares me, I am a free human being with an independent will.’

    রিচির কোনো ঘর ছিল না। পাখির বাসার মতো আশ্রম ছিল না। কিন্তু, সেই মেয়ে পাখির মতো নীল আকাশে উড়ত। রিচি বলেছিল — ‘আমি ধূসর কালো মেঘ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির জলে ভিজি। রঙিন জলসায় পিয়ানো’র সুরে আমার অন্তর বীণা বাজে। আমার দুঃখ নেই। আমার সমস্ত বেদনা সুখ হয়ে যায় মূহুর্তে এই সব নৈশ ক্লাবের আনন্দে।’

    আয়ান একের পর এক সিগারেট শেষ করছিল। আমি বললাম, ‘তারপর কী হলো? ঐ মেয়েকে তুমি কী ভালোবেসে ফেলেছিলে?’

    আয়ান : জীবনের দুঃখতম নিয়তি ঈশ্বর মনে হয় নির্ধারিত করে রেখেছিল আমার জন্য। যে পাখির বাসা নেই। তার বাসা পৃথিবী জুড়ে নীল আকাশ। আমি রিচিকে এই ঘরে এনেছিলাম, বলেছিলাম– এই ঘর তোমার। এখানেই তুমি তোমার সংসার বাঁধো। তোমাকে সন্তান দিব।

    রিচির চোখ সত্যি বাঙালি। শাড়ি পরিয়েছিলাম ওকে বিয়ের রাত্রিতে। কী সৌভাগ্য! বাসর শয‍্যায় ওর ভ্রূণ তৈরি হলো। এক অনাগতের স্পন্দন ধ্বনি সেই রাতেই শোনা গেল।

    আয়ান একের পর এক সিগারেট টেনেই যাচ্ছিল। কথা বলতে যেয়ে থেমে থেমে যাচ্ছিল বার বার। আমি বললাম — তারপর ?

    আয়ান : আমাদের সেই সন্তানটির পৃথিবীতে চলে আসবার দিন ক্ষণ খুব কাছাকাছি চলে আসতে থাকে। উইলশেয়ার বেলেভার্ডের সামারিতান হসপিটালে রিচির একটি চেক আপ ছিল। ডাঃ লী জয়নার ওকে হসপিটালে ভর্তি করে নেয়।

    আয়ান আমাকে বলছিল, তুমি কী গান গাইতে পারো রঞ্জন? আমি বলেছিলাম — ভালো পারি না।
    — তবুও শোনাও।
    — কী গান গাইব, বলো?
    — রবীন্দ্রনাথের গান।
    — কোন্ গানটি গাইব?
    — জীবন যখন শুকায়ে যায়।
    — আচ্ছা, গাইছি।

    অন্তরা পর্যন্ত গানটি আমি সেই দিন আয়ানকে গেয়ে শোনায়েছিলাম। শেষটুকু আর গাওয়া হয়নি। রাত তখন অনেক হয়ে গিয়েছিল। হিম বাতাস বয়ে আসছিল প্রবলবেগে। মনে হচ্ছিল, কার্নেশন, আর টিউলিপ ঝাড়ে জলের মতো বিন্দু বিন্দু করে তুষার ঝরে পড়ছে।

    আমি আয়ান হায়দারকে বলি — তারপর?
    আয়ান : একদিন হসপিটাল বেডে শুয়ে থেকে রিচি আমাকে বলেছিল — যদি দূরে চলে যাই। জীবনের ওপাড়ে যদি অন‍্য কোনো ভূবন থাকে, সেই ভূবনেও তুমি এসো।

    পোড়ামুখী একটি প্রাণহীন সন্তান জন্ম দিয়ে চলে গেল জীবন নদীর ওপারে….অন্য এক ভূবনে।

    তারপর, কতো প্রহর, কতো ক্লান্তিতে পথ ধরে হাঁটছি। আকুল হয়ে অপেক্ষায় আছি ওর ভুবনে পৌঁছার। কিন্তু ওর সেই ভুবন ওর সেই পৃথিবী যে অনেক দূর!

    ~ কোয়েল তালুকদার

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত