রিজাইন

রিকশা থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করে কলেজের গেটের ভেতরে প্রবেশ করে অধ্যাপক রশিদ হায়দার হাতে ফাইলব্যাগটির অস্তিত্ব টের পেলেন; এবং সাথে-সাথেই তার মনে পড়ল, সঙ্গে বিছানাপত্রও ছিল। সেটি কোথায়? ফিরে গেলেন গেটের বাইরে, রিকশাটি তখনো দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে বাঁধানো বিছানার মতো কিছু দেখতে না পেয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবেন কি না–এই দ্বিধা দূর করলেন রিকশাচালক, ‘খুস্তা খুস্তাচইন?’ রশিদ হায়দার সঙ্গের বিছানাপত্রের কথা বললেন। রিকশাচালক জানিয়ে দিলেন, বাসস্ট্যান্ড থেকে বিছানাপত্র ছাড়াই তিনি রিকশায় উঠেছেন। রশিদ হায়দার মনে করার চেষ্টা করলেন, তিনি বাস থেকে নামার সময় বিছানাপত্র নামিয়েছেন কি না। তবে পদ্মার তীর থেকে সিলেটের একটি জেলা শহরে আসার সময় তিনি দুইবার বাস পরিবর্তন করেছেন। ফলে কিছু মনে পড়ার ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে গেল।
রশিদ হায়দার হাঁটতে লাগলেন কলেজের ভেতরের পরিচ্ছন্ন রাস্তা ধরে। তিনি পায়ের দিকে তাকিয়ে হাঁটছেন না, বলা যায় ভাবছেন। বিছানার যদি পা থাকত তাহলে নিশ্চয়ই বাস থেকে হেঁটে নেমে যেতো। সমস্যা হচ্ছে বিছানাপত্রের হাত-পা থাকে না; এমনকি মুখও না। মুখের কথা মনে পড়তেই তার ঠোঁটের কথা মনে পড়ল। তিনি অনুভব করলেন, তার নিচের ঠোঁটটি একটু ঝুলে আছে এবং ভ্রুজোড়া কুঁচকানো। চশমাটি নাকের ডগার দিকে একটু এগিয়ে আসায় তাকে তাকাতে হচ্ছে চশমার উপর দিয়ে। তিনি হাঁটছেন নিচের দিকে তাকিয়ে। তার মনে হচ্ছে, তিনি হাঁটার মেশিনের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। রাস্তা চলে যাচ্ছে পেছন দিকে, রাস্তাই তাকে ঠেলে দিচ্ছে সামনের দিকে। সামনের দিকে তাকালে রশিদ হায়দার দেখতে পেতেনে সুন্দর একটি রাস্তা সোজা চলে গেছে, দুপাশে সতেজ ফুলের গাছ। গতরাতে বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে, সবকিছু কেমন পরিচ্ছন্নতা ছড়াচ্ছে। গ্রীষ্মের প্রায় দুপুরে কোট গায়ে তার গরম লাগছে কি না রশিদ হায়দার ঠিক বুঝতে পারছেন না। ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পেতেন, জুতো থেকে গায়ের কোট, কিংবা মাথার চুল–সবজায়গায় যত্নের অভাব। একটা কারণ হতে পারে, তিনি অধ্যাপনা জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে উপনীত হয়েছেন, পোশাক-আশাকের দিকে নজর দেওয়ার মতো সময় বা গুরুত্ব দিয়ে উঠতে পারেন না।
সবুজ হরিতকি গাছটির নিচে পৌঁছাতেই একজন সালাম দিয়ে জানতে চাইল, ‘আপনি হায়দার স্যার?’ অধ্যাপক অবাক হলেন, ‘আপনি আমাকে কীভাবে চিনলেন, আগে দেখা হয়েছিল?’ কথা বলতে বলতে তারা চললেন অধ্যক্ষের কার্যালয়ে, অধ্যাপক রশিদ হায়দার প্রমোশন পেয়ে আজ যোগদান করতে এসেছেন। অধ্যক্ষ তাকে স্বাগত জানালেন, এবং বললেন, আটাশ বছর আগে তারা একসাথে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করেছিলেন। মনে আছে কি না জিজ্ঞেস করাতে রশিদ হায়দার স্মৃতির পাতা উল্টে আটাশ বছর পেছনে যেতে লাগলেন, কিন্তু এতো পেছনের পাতায় পৌঁছাতে না পেরে মুখে প্রসন্নতার হাসি ঝুলিয়ে উচ্চারণ করলেন, ‘মনে থাকবে না কেন!’
তরুণ প্রভাষকের মতো অধ্যক্ষ মহোদয়ও অধ্যাপক হায়দার সম্বন্ধে কিছুটা জেনে নিয়েছিলেন আগেই। ফলে তিনি যখন বললেন, ‘রিজাইন’ করতে এসেছেন, তখন হয় অধ্যক্ষ মহোদয় কথাটি শুনতে পাননি, নতুবা তার কথায় গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। রশিদ হায়দার দর্শনের অধ্যাপক পদে যোগদান করলেন। তার থাকার জায়গা হল কলেজ থেকে এক কিলোমিটার দূরে, শহরের মাঝখানে অধ্যক্ষের বাসভবনে। অধ্যক্ষ একা থাকেন, সঙ্গী হলেন তিনি।
২.
নতুন কর্মস্থলে রশিদ হায়দার ভালোই আছেন বলা যায়। পুরোনো মডেলের জিপ গাড়িতে অধ্যক্ষের সাথে সবুজবাগ থেকে বামদিকের রাস্তা ধরে কলাপাতা রেস্তোরাঁ ডানে ফেলে জেলা প্রশাসকের ভবনের পাশের সারিবাঁধা নিমগাছের ছায়া পেছনে ফেলে কলেজের গেটে এসে দাঁড়ান। দারোয়ান সালাম দিয়ে গেট খুলে দেয়। গাড়ি থেকে নামার সময় তার নিজেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। সেটা বোঝা যায় তার হাঁটার ভঙ্গি ও গতির মধ্যে। প্রায়শই তাকে এক কদম সামনে হাঁটতে দেখা যায়। তিনি সাধারণ কেউ নন, তার বন্ধু এডিশনাল সেক্রেটারি টাইপের কেউ একজন, চাইলে তিনি অনেক কিছু করে ফেলতে পারেন, এই তথ্য প্রচার করেন। তার অনেক ক্ষমতা, তবে তিনি দেখান খুব কম। একটু টের পেয়েছেন দর্শনের প্রভাষক আফসার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, গাড়ি থেকে নামার সময় তিনি অধ্যক্ষ মহোদয়কে সালাম দিয়েছেন, তাকে দেননি। কয়েকদিন পর আবারও তার ক্ষমতাকে অবহেলার অভিযোগ উঠল আফসারের বিরুদ্ধে, তাকে বিভাগে যথাযথ সম্মান দিচ্ছেন না আফসার। যদিও এই অভিযোগ বরাবরই নানা যুক্তিপ্রমাণসহ খণ্ডন করা হয়েছে। রশিদ হায়দার তাতে শান্ত হওয়ার পাত্র নন। তিনি বিভাগের পিয়ন এবং প্রভাষক আফসারকে বেতন বন্ধ করে দেওয়ার, এমনকি চাকরি পর্যন্ত খেয়ে ফেলার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। তার ক্ষমতার কথা সহকর্মীদের অনেকেই জেনে গেল, তবে কেউ দেখতে পেল না। রশিদ হায়দার নিজে কেবল একজনের ক্ষমতাকে একটু ভয় পান। একটু না, বেশিই ভয় পান, তিনি কলেজের অধ্যক্ষ। একসাথে কাঁচাবাজারে যান, একসাথে খাবারের টেবিলে বসেন, একসাথে কলেজে যাতায়াত করেন, তবু ভয় তার পিছু ছাড়ে না। কলেজে অধ্যক্ষ মহোদয়কে যে ভঙ্গিতে সালাম প্রদান করেন, তাতে মনে হতে পারে তিনি জাপান থেকে আদব-কায়দা বিষয়ে সদ্য প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন।
এরমধ্যে কেতাদুরস্ত থাকার প্রতীক বহন করা প্রিয় কোটটি হারিয়ে যায়। শীত-গ্রীষ্মে তাকে আগলে রাখা পুরাতন পোশাকটির জন্য তার মায়া হল। অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনের লনে রোদে দিয়েছিলেন, না কি বিভাগের শিক্ষাসফরে নিয়েছিলেন–মনে করতে পারছেন না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যথারীতি তার এই বোধ জাগে যে, যে চলে যায় তার জন্য আক্ষেপ করা বৃথা।
ভয় আর ক্ষমতার মধ্যে তার সময় খারাপ যাচ্ছে, বলা যাবে না। তবে অধ্যক্ষের নীরব-শান্ত বাসভবনে প্রথম রাত থেকেই তার ঘুমের সমস্যা হচ্ছিল। এর মূল কারণ তার নিদ্রাহীনতা, বা ঘুমের ওষুধের অভাব নয়, তার প্রিয় বালিশ এবং কাঁথাটির অনুপস্থিতি। প্রতিদিন ঘুমের সমস্যা হতে থাকল এবং তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। অধ্যাপক হায়দারের মনে পড়ল, তিনি চাকরি থেকে রিজাইন দিতে এসেছেন।
৩.
রশিদ হায়দারের গায়ে আজ কোনো কোট নেই। সাদা ফুলহাতা শার্ট গায়ে দিয়েছেন। জামাকাপড় ইস্ত্রির অভাব বোধ করছে। জুতাজোড়া পরিষ্কার করা হয়েছে মনে হল। আজ বিশেষ দিন, রশিদ হায়দার চাকরি থেকে ইস্তফা দেবেন। তার চাকরি আরও বছরখানেক আছে। তবে সে পর্যন্ত তিনি পৌঁছাতে পারবেন, এই বিশ্বাস তার আর অবশিষ্ট নেই। শিক্ষক পরিষদ মিলনায়তনে ষাটজন সহকর্মীর অনেকেই উপস্থিতি। যে দু-একজন অনুপস্থিত তারা হয়ত কথাটি বিশ্বাস করেননি, কিংবা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে ব্যস্ত। সাধারণত কোনো অনুষ্ঠানে বক্তব্যের জন্য সঞ্চালক নাম উচ্চারণ করলে রশিদ হায়দার রাজনীতিবিদের মতো হাত নেড়ে উপস্থিত জনতার প্রতি অভিবাদন জানিয়ে ডায়াসের দিকে এগিয়ে যান। যদিও শিক্ষকদের অনুষ্ঠানে উপস্থিতি কখনোই শতকের ঘর অতিক্রম করে না। আজ কী কারণে ব্যতিক্রম হল। তিনি কথা বলা শুরু করলেন একেবারে শান্তভাবে, যেন দীর্ঘ ঘুমের পর প্রশান্ত ভঙ্গিতে জেগে উঠলেন।

‘গত সাত বছর ধরে আমি কোনো ক্লাস করি না, করতে পারি না। আমার কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারি না। কথা প্রসঙ্গ হারিয়ে ফেলে। আমি…। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন আঠারো বছর আগে। মেয়েটা থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। বড়ো ছেলেটা বুয়েটে স্থাপত্যে প্রথম হয়েছিল। শিক্ষক হতে চেয়েছিল, পারেনি। অভিমানে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। ছোটো ছেলেটা এবছর ডাক্তার হল। আমাকে বলে না, কিন্তু আমি জানি, সেও আমাকে ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমার কেবল হারিয়ে যায়। কিছুই ধরে রাখতে পারি না। জীবন থেকে, বই থেকে যা আমি সঞ্চয় করেছিলাম, আমার থেকে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাকে নিয়ে লোকজন হাসি-তামাশা করে, আমি টের পাই। এভাবে আর কতদিন! যে আমি আমি না, তাকে আমি আর বহন করতে পারছি না। আমি শূন্য হাতে জীবন শুরু করেছিলাম, আবার শূন্য হতে চাই। আমি ফিরে যাচ্ছি।’
কথা শেষ করেও তিনি হাত নাড়লেন না। বিদায় অনুষ্ঠান শেষ হল। দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলেন। কলেজের বটতলা, শহিদ মিনার পার হয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার শূন্যতার গল্প বললে, আজহার। অথচ একদিন আমি বুকভরে পূর্ণ হয়ে উঠেছিলাম।’
জেলা শহরের কলেজটির গেটে রশিদ হায়দার রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত