রূপকথা নয়

এক বন ছিলো। সাত সাগর,তের নদীর ওপারে। পরম শান্তি ছিল সেখানে। হঠাৎ বিপত্তি। বনের বাঘটা পাজি হয়ে গেলো। বলা নেই কওয়া নেই টপাটপ নিরীহ প্রাণী খাওয়া শুরু করলো। নালিশ গেলো সিংহের কাছে।
-’বেশ! দেখছি আমি’। সব শুনে সিংহ মহারাজ বললেন। সারা বনে ঢোল পিটিয়ে যুদ্ধের ঘোষণা হলো। মুখোমুখি লড়াইয়ে বাঘ-সিংহ। ময়দানের এক অংশে শিয়াল, কুমির, হাতিসহ স্বল্প সংখ্যক বাঘের সমর্থক, অন্য পাশে অগণিত সিংহ সমর্থক। তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। কি ভায়নক সেই যুদ্ধ! তারপর!
তারপরের গল্পটা আমিও জানতে চাই। এক অদ্ভুত মানুষের কাছে এই আধেক গল্প শুনেছি দিনের পর দিন। রাতে যখন বারান্দার বেখাপ্পা গ্রিলকে ফাঁকি দিয়ে সামনের রুমটা জোছনায় ভরে যেত, তখন গল্পটা জমতো খুব। কোনদিন বাঘ জিততো আবার কোনদিন সিংহ।
———
২০০৪ সালের রমজান মাস। কুমিল্লা, চৌদ্দগ্রামের চিওড়া রাস্তার মাথা। ফজরের নামাজের পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ধার ঘেঁষে হাঁটছিলো একদল নির্মাণ শ্রমিক। সবাই রোজাদার, একজন বাদে। কনকনে শীতের মধ্যে সিগারেটে টান মেরে ধুঁয়া উড়াচ্ছিল সে। টানটা পরিচিত। ইটের ভাঁজে মোলায়েম আস্তর দিয়ে টানটা দিতো। টাটকা সে দৃশ্য! আজো আমার চোখে ভাসে। আমাদের বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে সেই আস্তর।
প্রতিটানে ধুঁয়া ছাড়ছে, কুয়াশায় হারাচ্ছে তা। আচমকা কুয়াশা ভেদ করে পেছন থেকে ওর চৌখা মাথায় সজোরে আঘাত করে মিলিয়ে গেলো একটা ট্রাক। আছড়ে পরলো নুর ইসলাম ভাই। সিগারেটটা তখনো জ্বলছে। নিঃশ্বাস ও ফুরিয়ে যায়নি।
উপজেলার ডাক্তার বললো,
-জোর ছিল, ছেলেটার। এমন এক্সিডেন্টে এতোক্ষণ টিকে না কেও। বাঁচার জন্য বাঘের মতো লড়েছিলো।
ভুল পন্থা, নুর ইসলাম ভাই। আপনার আজকের লড়াইটা সিংহের মতো হওয়া উচিত ছিলো। জিতে যেতেন।
কাঁটাছেঁড়া হয়নি। অক্ষত মৃতদেহ স্থানান্তর করা হলো। দেখে বোঝার উপায় নেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু। শুধু নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। ডাক্তারের কথা সত্য। চোখে চোখ রেখে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়েছে। লাশের চোখ খোলা ছিলো।
গাইবান্ধার নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে নুর ইসলাম। অভিমান করে বাড়ি ছেড়েছিলো।আর ফেরেনি। কোনদিন ফিরবেও না। প্রতারণা করেছে সে। প্রতারককে দেখতে আসেনি মা,বাবা। ওর ছোট ভাইকে পাঠানো হয়েছে। নুর ইসলামদের বড় পরিবার। চারশ কিলোমিটার দূর থেকে এতো বড় পরিবারের কান্নার দায়িত্ব দিয়ে এতোটুকু ছেলেকে পাঠানো ঠিক হয়নি।
বড়ভাই অনন্ত কালের পথে পাড়ি জমিয়েছে। ভাইকে দেখতে ছোটভাই যে পথ পাড়ি দিচ্ছে সেটা অনন্ত কালের চেয়ে কম নয়। বাসে বসে একটা আবছা কাফনে মোড়ানো মুখ বারবার কল্পনা করার চেষ্টা করেছে, হয়তো।
প্রিয় পাঠক, ভাইয়ের লাশ দেখতে এমন সুদীর্ঘ অচেনা পথে যাত্রা করার অনুভুতি জানতে ইচ্ছে হয়। পত্রিকা পড়ে এই অনুভুতি সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায় না। সেখানে লেখা হয়, বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত। এই ৭ জনের একজন নুর ইসলাম, হতেও পারে নাও হতে পারে। এদের প্রত্যেকের অনেকগুলো গল্প থাকে। বিভিন্ন রকমের গল্প। মৃত্যু সেগুলকে একরকম করে দেয়। সবগুলোই হয়ে যায় ‘মন খারাপের গল্প’।
বাঘের ভাই, ঠিকমতো এসে পৌঁছাতে পেরেছিলো।
প্রথম দেখায় চমকে গেলো সবাই। অবিকল নুর ইসলাম। মাথার পিছনের অংশটাও একইরকম। চৌখা! মাথার আকৃতি নিয়ে মায়ের প্রতি অভিযোগ ছিলো নুর ইসলামের। আমার মা’কে বলতো
-চাচী, ছোটকালে মা’এ ভালো কইরা হাত বুলাইয়া দেয় নাই।
অভিযোগ ফুরিয়ে গেছে। মাথার চৌখা অংশটা থেতলে সমান করে দিয়ে গেছে ট্রাকটা।
———–
মৃত মানুষ লেনদেন ভুলে যায়। জীবিতরা পারে না। নুরু ইসলামের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আমার যত চিন্তা বাঘ-সিংহের বাকি গল্পটা নিয়ে। ওর ভাইটাকে জিজ্ঞেস করা যেত। আচ্ছা, ছেলেটা কি পুরো গল্পটা জানে? জানতেও পারে। কোন এক জোছনা রাতে বাড়ির উঠানে, ভাত খেতে খেতে বড়ভাইয়ের থেকে গল্পটা হয়তো শুনেছে।
গল্প শুনার ছলে ছেলেটাকে থামানো যেতো। কান্নার দায়িত্ব ভালোই পালন করছে ছেলেটা। কখনো মায়ের মতো মাটিতে গড়াচ্ছে, কখনো বাবার মতো মূর্ছা যাচ্ছে, আবার অভিমানী ভাইয়ের মতো স্থির হয়ে, একগাদা অভিযোগ নিয়ে আকাশে চেয়ে স্রস্টাকে খুঁজছে।
ভাইহারা ছেলেটাকে থামাবে কে? সবার ঘরেই যেন আগুন লেগেছে। কান্নার প্রতিযোগিতায় মেতেছে সবাই। প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারিণী বেলালের মা। এক দশক আগে বেলাল ঐ একই জায়াগায় প্রাণ দিয়েছিল। বাসের আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। ওর থেতলানো বীভৎস মুখ দেখে কয়েকজন জ্ঞান হারিয়েছিল। তাড়াহুড়ো করে দাফন করা হয়। বিদায় বেলায় নিজের সবচেয়ে আদরের সন্তানকে একটিবার ছুঁয়ে দেখতে পারেনি মা।
আজ বেলালের মায়ের সুবর্ণ সুযোগ। ঘরছাড়া নুর ইসলাম, মায়ের মতো ভক্তি করতো বেলালের মাকে। নুর ইসলামের লাশটাও অবিকৃত, তরতাজা। আর কি চাই! দশ বছরের জমিয়ে রাখা কান্না যেন পালনোর পথ খুঁজে পেলো। নুর ইসলামকে ধরে মন ভরে কাঁদলো সে। কখনো বেলালের নামে ডাকলো কখনো নুর ইসলামের।
——
অন্ধকারে গাইতে ভালোবাসতো নুর ইসলাম ভাই। আমাদের বাড়ির পিছনের রাস্তায় কবরস্থানের পাশে। যেখানটাতে এখন সে ঘুমিয়ে। ঘোর অন্ধকারে বসে কাঁদো গলায় গাইতো। সারা গ্রাম শুনতো,
‘ভাড়া কইরা আনবি মানুষ কান্দিতে মোর লাশের পাশে,
চারিদিকে রাখবি নজর, সে না যেন দেখতে আসে।’
লাশের পাশে অনেক মানুষ কেঁদেছিলো সেদিন। কাওকে ভাড়া দিতে হয়নি।
উঠানে পরে থাকা নিষ্প্রাণ নুর ইসলামকে দেখে, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কেও শাড়ীর আঁচলে সন্তর্পণে চোখের জল মুছেছিলো কি?
জানি না। সেদিকে নজর রাখার সুযোগ হয়নি।
-ঢাকা,
২৫ জুলাই, ২০১৭।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত