আজ আবার সেই পথে

আমার সঙ্গে সবার প্রথমে দেখা হয় এমন একটা মানুষের, যার চাহনি শুরুর দিকে খানিকটা দ্বিধা ও অস্বস্তির এক দ্বৈত অনুভূতিতে ফেলে দেয়। কিন্তু এই লোকটার চাহনিটাই অত্র বাড়িশাট গ্রামে সবচেয়ে নিষ্পাপ, পাশের নবগঙ্গা নদীর চেয়ে স্বচ্ছ। সবাই তারে জীবন পাগলা নামে চেনে। তার কাঁধে ঝোলা ভর্তি  হরেক রকম গাছ গাছরার সবুজ, শুকনো পাতা আর এক কানে গুঁজে রাখা কয়েকটা বাংলা বিড়ি। এমন কিম্ভূত বেশভূষায়ও কি সুন্দর দেখায় তাকে ! সে হাতে মমতাজ কিংবা আকিজ বিড়ি, যখন যেটা পায় সেটা নিয়ে এই বাড়ি ওই বাড়ি ঘুড়ে বেড়ায় আর পাতা ছিঁড়ে। বিড়ি শেষ হয়ে গেলে দুইটা দুই জাতের পাতা বিড়ির মতো ভাঁজ করে আগুন ধরিয়ে টানতে থাকে। ক্ষুধা লাগলে কয়েক পদের পাতা ভাতের সঙ্গে ডলে মেখে খায়। সদ্য গজানো কচি লালচে আম পাতাকে তার প্রিয়তমা বলে মনে হতে পারে। অন্য সব পাতাগুলো বাচ বিছার ছাড়া ছিঁড়ে নিলেও, কচি লাল আমা পাতা আলগোছে গভীর মমতায় ছিঁড়ে নেয়, ওদের যেন ব্যথা না লাগে, যেন ভাতঘুম না ভেঙ্গে যায়। পাগল হিসিবে এই মানুষ কোনোভাবেই হাই প্রোফাইলের না। এলাকার পোলাপাইন চেতাইতে কিংবা উস্কানি দিতে গেলে হাসে আর কেবল হাসে, ছেলেপুলেদের জমে না একদমই। তাই এখন আর ঘটায় না আগের মতো। কিন্তু তবুও তাকে কেন যেন ভয়, বিশেষ করে গাঁয়ের মেয়েরা এড়িয়ে চলে স্বস্তি বোধ করে। একটা কারণ হতে পারে বিড়ি ধরাতে আগুনের জন্য  বেটা ছেলের কাছে না চেয়ে সবসময় বাড়ির গিন্নি কিংবা কোনো মেয়ের কাছে আগুন আবদার করে। দীর্ঘ বাইশ বছর পর এই জীবন পাগলাই আবার আমাকে প্রথমে দেখলো। সেই রাতের মতো। তা-ও ভরা পূর্ণিমার রাতেই। সে আমাকে চিনতে পেরেছে কিনা বুঝতে পারছি না। তার এই করুণ পরিণতির জন্য আমার নাম নিয়ে নানান রঙের কানাঘুষা এখনো শোনা যায় । জীবন পাগলার সার্টিফিকেট নাম শরাফ আহমেদ জীবন। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তো ইংরেজি বিভাগে। আপাদমস্তক কবিতা পাগল একটা মানুষ। প্রতি পূর্ণিমা আর অমাবস্যার ঘোর অমানিশায় মাঝরাতে বাড়ির পাশের খাল পারে বের হয়ে কবিতা আবৃত্তি করতো একা একা আর গাজা টানতো। গাজা টানা শেষে খালের পানিতে নগ্ন নেমে গোসল করতো অনেকক্ষন। আর চাঁদের সঙ্গে কি যেন কথা কইতো। অনেকেই তার এই পাগলামির কথা জানতো। ফিসফাস করতো, “পড়ালেখার চাপ সামলাইতে না পইরা জীবন উন্মাদ হইয়া গেছে, কেউ বলতো জিন পরীতে আছর করছে।” কখনোবা ভার্সিটির এক দুইজন বন্ধুও থাকতো তার এই কবিতার আছরে মানে আসরে। এমনই এক জল জোছনার রাতে একাকি আমাকে দেখতে পেয়েছিল। আমিও সেই পূর্ণিমার রাতে সাদা ফুল মাথায় বাঁধভাঙা এক লাজ-শরমহীন অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলাম মুক্তির আনন্দে। জীবন যখন হাত বাড়িয়ে দিল, আমার তখন না করার কোনো উপায় ছিল না। আমাদের এই গোপন অভিসার এইভাবে চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস ধরে। এরপর ধরা পরে যাই আমরা। জীবনের জীবনে নেমে আসে এক অভিশপ্ত সময়। আমাকে গ্রামছাড়া করা হয় চিরদিনের জন্য। 

সেই পাগলের সঙ্গে আবার দেখা। পাগলা বোধহয় আমাকে চিনতে পারেনি, সে ফুঁস করে বিড়ির একরাশ ধোঁয়া ছাড়লো। আমিও পরম মমতায় সেই বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নিলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাসে বিশুদ্ধ অক্সিজেন ছাড়লাম। এতক্ষণে আমার পরিচয় দেয়া উচিত বলে মনে করি। আমার কেতাবি নাম ধুতুরা। লোকে ধুতরা নামেই চিনে। জীবন পাগলা আমাকে খালের পারে যখন দেখেছিল প্রথমবার তখন থেকেই আমার পাতা ছিঁড়ে বিড়ি বানিয়ে টানতো, ভাং বানাত।  এইটা ওর মেঝ ভাই একদিন দেখে ফেলে। পরে ওর এই নেশা করার সুযোগ নিয়ে আমার কাছ থেকে ফল আর ফুল ছিঁড়ে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে পাগল করে দেয় জীবনকে আজীবনের জন্য। দখল করে নেয় সব সম্পত্তি। আর বেচারা জীবন ধুতুরার নেশা করতে করতে পাগল হয়ে গেছে, সারা গ্রামে এটা রটিয়ে দেয়। সবাই বিশ্বাসও করে। বিশ্বাস করার মতো কারণও যথেষ্ট ছিল গ্রামবাসীর। পরে আমাকে উপরে ফেলা হয় যেন আর কেউ আমার নেশায় পাগল না হয়। এরপর আর আমি ফিরে আসিনি, আসতে পারিনি। যাক সেটা অনেককাল আগের কথা। এবার একটা বসন্ত বাউড়ি পাখি দূরের কোনো গ্রাম থেকে এনে আমার ফল ফেলেছিল এই ছাড়াবাড়ির পিছনে। সেই আমি অনেক সংগ্রামের পর আবার এই গ্রামে নিজের শেকড় গেড়েছি। জানি না কার বা কাদের জীবনের সঙ্গে কিভাবে জড়িয়ে যাই আবার।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত