টেনেটুনে অনার্স শেষ করে আসা ছেলেটি আজ বড্ড বেশি ক্লান্ত। মাস্টার্সে পড়ার মতো পুষ্টি তাঁর শরীরে নেই, পড়ার এনার্জি না থাকলেও এ বয়সে চাকরির করার এনার্জি থাকতে হবে এবং সেটা বয়সের বাধ্যতামূলক চাহিদা। এদিকে আবার টেনেটুনে অনার্স শেষ করা ছেলের কপালে ভালো জব মেলা ভারি দায়,এদের কপালে কর্পোরেট দুনিয়ার বিলাসী জব মেলে না।
নিস্তব্ধ নিরব পল্লীতে আধুনিক রেনেসাঁসের ধাক্কাও লাগেনি বলে, এখানে নেই কোনো বিশাল অট্টালিকা দালানকোঠার ভিতরে গড়ে উঠা চাকচিক্যময় বুনিয়াদি কর্পোরেট অফিস। গ্রামের এমন মাঝারি শিক্ষিত বেকারের ছেলের শেষ ভরষা শহরের কর্পোরেট ভবন থেকে আসা গ্রামের প্রতিষ্ঠিত এনজিও।
ওয়ালেটের অভাব আর কাছের, দূরের মানুষের ঘ্যানঘ্যান শব্দে অবকাশ জীবন যাপিত করার সুযোগ নেই,চাকরির জন্যে দৌড়ানো লাগবে এখনি।
এদিকে অনার্স জীবন কাঠখোট্টাময় হলেও এসএসসি -এইচএসসি দুই সুন্দরীর গুণের সাথে সঙ্গী ভাইয়ের ম্যানেজার বন্ধুর সুপারিশ পত্র,তাই এমন কাঠখোট্টা ছেলের চাকরি পেতে তেমন বেগ পেতে হয় নি শৈশবের অবাধ্য ডানপিটে ছেলেটার।
একসপ্তাহ, তিনসপ্তাহ যায় যায় করে চাকরির বয়স একমাস কেটে গেলো সুখের উত্তাপে। এমন সুখময় জীবন আরো দ্বিগুণ হয়ে গেলো মাস শেষের হ্যান্ডসাম স্যালারি হাতে পেয়ে। এদিকে স্যালারি পেয়ে মন আমার উড়নচণ্ডী, ঘুরনচণ্ডি,পূরণচণ্ডীতে পরিণত হইসে।
চাকরি পাওয়ার পরবর্তী জীবনে ক্লান্ত দেহে ভালো ঘুম হচ্ছে। এই ভালো ঘুমের বদৌলতে ইদানিং মন আমার আয়েশী, বিলাসী ঘুম আর রুম খুঁজে, সাথে শহরের বুনিয়াদি অফিসে বসে থাকা ভাইয়ের চাকরি জীবনের পদোন্নতির চবক নিয়ে ভালো যাচ্ছে জীবন আমার। এদিকে গ্রামে থাকা কাছের মানুষদের দুই-একটা করে পাত্রীর সন্ধান নিয়ে আসা জীবনকে আরো চাঞ্চল্যময় করে তুলেছে। প্রেমহীন ফেলে আসা অর্ধেক যৌবনের শেষে নারীর ছোঁয়া পাওয়ার আকাঙ্খা অতীব আনন্দের, সুখের।
আনন্দময় মাস শেষে দ্বিতীয় মাসে পদার্পণ করলাম। সকাল আটটায় মায়ের হাতে বানানো ফ্রেশ নাস্তা সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে যাত্র।অফিসে উপস্থিতি জানান দিয়ে সাড়ে দশটায় বের হওয়া লোন বিতরণ আর টাকা আহরণের উদ্দেশ্যে।
উত্তপ্ত সোনা মাখা সূর্যের আলো দেখে একসময় রোমাঞ্চকর কথাবার্তা বের হলেও এখন আর বের হয় না,এখন হাত দিয়ে শরীরের দুর্গন্ধ ঘাম মুছতে মুছতে রহিম কাকারে খুঁজে পাওয়ার তাড়না মাথাভর্তি। সোনালী রৌদের উত্তাপ মাথায় নিয়ে এ – বাড়ি ও – বাড়ি ঘুরে মস্তিষ্ক ভর্তি রহিম কাকার তুই তোকারি সহ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ভারি শব্দ সাথে শেফালী ভাবির তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সঙ্গে দু-চারটে মিষ্টি কথা, হাসি এবং ব্যাগভর্তি লোনের টাকা নিয়ে বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ে অফিসে ফেরা।
অফিসেই ফিরলাম দেহ নিয়ে কিন্তু শান্তি নিয়ে তো আর ফিরতে পারলাম না। জীবনের এই অধ্যায় থেকে শান্তি তখন বিয়োগান্তের অন্তিম যাত্রায়। ম্যানেজার স্যারের একেকটা শব্দ তখন নিজের কাছে পারমাণবিক বোমার মতোই লাগছে, মনে হচ্ছে এখনি জীবনের ইতি টানি।
স্যারের ভারি শব্দে দেহমন উভয়ই বেশ ক্লান্ত, ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফেরা হয় ঠিকই কিন্তু মন আর বাড়ি ফেরে না। পঁচাশির দেহ নিয়ে অফিস শুরু করা ছেলেটা বাড়ি ফেরে সত্তরের দেহ নিয়ে। দেহ বেশ ক্লান্ত ইচ্ছে করছে এখনি ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু এই অসময়ে খাটে দেহ লাগানো তে মায়ের হিটলারিয় নিষেধ।
শহুরে লাইফের কেনা ট্রাউজার পরিধান করে বাড়ির শেষ প্রান্তের টঙে গিয়ে বসলাম এক কাপ ধোঁয়া উড়তে থাকা চা হাতে। চুমুক দিতে দিতে ফ্ল্যাশব্যাকে চলে আসলাম,এ-চায়ের কাপ হাত রাজনৈতিক বিপ্লবের ঝড় উঠাতাম বন্ধুদের সাথে, কমিউনিজম তত্ব নিয়ে কতশত বিতর্ক ঝড়িয়ে পড়তাম,চে, লেলিন থেকে শুরু করে মুজিববাদে থামতাম,রোমান্টিকতার কত-শত গল্পে মেতে উঠতাম পল্লবীদের ঘিরে। কত আফসোস করতাম জীবনানন্দের জীবন যাপন নিয়ে!
জীবন নামের দৌড় প্রতিযোগিতায় বন্ধুদের সাথে পেরে উঠতে চরম ব্যর্থ হয়ে, আমি হয়তো বন্ধুদের ভাবছি যখন; তখন হয়তো বন্ধুরা কেউ রেনেসাঁসের আদিভূমি ইউরোপের বিলাসী জীবনে ব্যস্ত, কেউ সরকারের কোনো এক মন্ত্রণালয় সামলাতে ব্যস্ত।
জীবনের ব্যর্থতা আজকাল বন্ধুত্বের কোনো গভীরতা থাকে না, নতুন কোনো রূপরেখা তৈরি হয় না। বন্ধুত্ব চলে নির্দিষ্ট গন্ডির ভিতর যার মাঝে থাকে অসংখ্য সীমাবদ্ধতা। ব্যক্তি জীবনের ব্যর্থতা বন্ধুদের সব অতীত একপাক্ষিক, এককেন্দ্রিক করে তুলে দ্বিপাক্ষিক অনন্তকাল ধরে রাখে না।আজকাল বন্ধুদের পরিবর্তে পাশে বসে চা খেতে বসি এলাকার উঠতি বয়সের ছেলে আর বয়সের চাপে ডুবন্ত দাদারা, কাকাদের নিয়ে।
এসব যখন ভাবছি তখন আবার দীর্ঘদিন পর জীবনানন্দের কবিতায় নিজেরে খুঁজে পেলাম, জীবনানন্দ ঠিক এভাবেই হয়তো আমার মতো ছেলেদের মূল্যায়ন করেছিলো
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ;
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে—
নক্ষত্রের নিচে।
কবিতার মাঝ লাইনে আসতেই ডাক আসলো বাড়ি যাবার,আজ রাত আটটায় একটা মেয়ে দেখতে যেতে হবে পাশের গ্রামে।
বিমর্ষ দার্শনিকের মতো চেহারা আর বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘরের পথে রওনা দিতে দিতে একবার নিজের কাছে প্রশ্ন করলাম; “আচ্ছা মেয়েটা কি আমার শহুরে পল্লবীর মতো হবে”?