ঘর বউ

মাজ ‘ঘর জামাই’ শব্দ বানিয়েছে, ‘ঘর বউ’ শব্দ কিন্তু বানায়নি-
মাথা থেকে নামছেই না। অথচ সকাল সকাল অফিসে ইম্পোরটেন্ট কাস্টোমার ডেমো দিতে হবে। ফুলকোর্স ঘুম দরকার। রাত বারোটা থেকে সকাল সাতটা আমার স্বাভাবিক ফুলকোর্স ঘুম। মোবাইলে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম রাত ১ঃ১৫। এক ঘন্টা হয়ে গেছে রোমেলের ফোন রেখে দেয়ার পর। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সকালে অফিসের ডেমো এই অযুহাতে ফোনটা না রেখে বরং একটা সমাধানে আজই যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো।
কিন্তু আমিইতো এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু কতক্ষণ, কয়দিন এড়াবো। পরিবারের সম্মতিতে আমার আর রোমেলের পাঁচ বছরের সম্পর্ক একটা বিয়েতে গড়াতে যাচ্ছে । আগামী মাসে প্রথম শুক্রবার আমাদের বিয়ে ঠিক করেছে দুই পরিবার। একটা কমন অনুষ্ঠান হবে সেন্টারে, আমাদের দুজনেরই সে প্রস্তাবে  দু’পরিবার চমৎকারভাবে  মেনে নিয়েছে।
শুয়েই পড়েছিলাম। রোমেলও রোজকার মত ফোন দিয়ে বললো- ‘ বেস্ট উইশেস ফর টুমরোস প্রেজেন্টেশন ইনি’
আমার ডাক মাম ইনায়া, ওটাকেই ও ইনি করে নিয়েছে যেমন আমি করে নিয়েছি রোমি।
কাল ওকে বলতে চেয়েছিলাম সামনা সামনি, কি মনে করে যেন এক্মসাইটমেন্টে বলে ফেললাম, আমি  মোটামুটি খোঁজ নিয়েছি বান্দরবানে থানছিতে একটা  হলিডে রিসোর্টের। আমরা কিন্তু বিয়ের আয়োজন শেষে সেন্টার থেকেই সরাসরি বাস কাউন্টারে  চলে যাব, রাত সাড়ে দশটায় বাস।
রোমেল বললো, আমি তো এতদিন ভেবেছি তুমি মজা করে বলেছো, আর ইউ রিয়েলি সিরিয়াস ? বান্দরবানেই যাব, পাহাড়ই দেখবো তবে বিয়ের পরের উইকে যাব। ওকে?
আমি এত ছুটি পাবনা রোমি … পরের সপ্তাহেই আমাকে জয়েন করতে হবে।
– আরে দূর ! পরের সপ্তাহে অফিস মানে, তোমাকে যেতে দিলে তো। নতুন পরিবারে যাবে? সেখানে এডজাস্ট হতে হবে, পরিবারের রুল বুঝতে হবে, শিখতে হবে, এক মাস তো ছুটি তোমার নিতেই হবে।
তুমি নিয়েছো এক মাস ছুটি?
– আরে দূর আমারতো নিজেদের বিজনেস। আমি আর আমার কো ফাউন্ডার হাশিমই সব। ছুটি আবার কি। রোজই এক দু ঘন্টা যাব আর চলে আসবো।
বাহ! তাই নাকি ! আর আমি তোমাদের বাসায় গিয়ে এডজাস্ট হবো মানে কি? তারচেয়ে তুমি এখানে এসে একমাস থেকে যাও, তার পরের মাসে আমার অফিসে কাজের চাপ কম থাকবে , তখন না হয় আমি একমাস গিয়ে থেকে আসব তোমাদের ওখানে।
–  আমি ঘর জামাই থাকবো,  তুমি একটা সেন্সিবল এডুকেটেড মেয়ে হয়ে এটা কি বলছো?
তাহলে আমি ঘর বউ হয়ে থাকবো তোমাদের বাসায় , তুমি একজন সেন্সিবল এডুকেটেড ম্যান হয়ে এমন অসম কথা কেমনে বলছো ? তারোপর উইম্যান এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে না তোমার এনজিও কাজ করে !
– সমাজ ‘ঘর জামাই’ শব্দ বানিয়েছে, ‘ঘর বউ’ শব্দ কিন্তু বানায়নি। তুমি আমি তো সমাজের বাইরে কেউ নই। আমরা দুজনেই আধুনিক কিন্তু সমাজের বাইরে গিয়ে আধুনিক হওয়াটা কোন আধুনিকতা নয়, সেটা হঠকারিতা।
আচ্ছা, আর কি কি জিনিস তোমার মাথায় সমাজ ঢুকিয়ে রেখেছে যা আমাকে প্রদর্শন করো নি? বাই দ্যা ওয়ে তোমাদের এনজিওতে কোন মেয়ের বিয়ে হলে একমাস ছুটি দাও তো?
-রিসেন্টলি দুইজন ইন্টারনের বিয়ে হয়েছে, দুজনই জানিয়ে দিয়েছে বিয়ের পর চাকুরী করবে না আর, শ্বশুরবাড়িতে  চায় না। কিন্তু দেখো তোমার  চাকুরী করা নিয়ে আমার পরিবার তো তোমাকে কিছু বলছে না।
এই হলো তোমার উইম্যান এম্পাওয়ারমেন্ট?
– ওটা আমার বিজনেস। বিজনেস যে প্রডাক্ট ভালো সেল হয় সেটাই গুড প্রডাক্ট।
আচ্ছা কাল সন্ধ্যায় চল কোথাও বসে আলাপ করে সমাধানে আসা যাবে , আমি এখন ঘুমাই।
কিন্তু ঘুম এলোনা, মাথায়তো ঘুরছে … আসলেইতো ভেবে দেখেনি কতকিছুই । কেনো ভাববো? যে রোমেল রেস্টুরেন্টে খাবার বিলটাও সবসময় দু’জনে ভাগাভাগি করে দেয়া পছন্দ করেছে, যার ফেসবুক অন্ততঃ দুদিন পর একটা ফেমিনেস্ট স্ট্যাটাস থাকে, যে দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রেমের সময় একদিনও আমাকে ডোমিনেট করেনি, তাকে নিয়ে তো নিজের মত মুক্ত স্বাধীনচেতা মানুষই ভাববো।
অথচ নারীর ক্ষমতায়ন তার কাছে কেবলই প্রোডাক্ট, সমাজের ঘুনগুলো তার প্রিয় মেকআপ।
না ওকে এখনই কল দিতে হবে , এখনই … না হলে সকালের অফিসের কাজটাও ঠান্ডা মাথায় হবে না ..
– হ্যালো , ইনি .. ঘুমাও নি এখনও … ক’টা বাজে দেখেছো?
আমি কিন্তু রিসোর্ট হাফ কনফার্ম করে রেখেছি। আমার ডিরেক্টরের শেয়ার আছে রিসোর্টে। বেশ ডিসকাউন্টে পাবো আমরা । আর সত্যি তুমি যদি বিয়ের দিনই  যেতে না চাও, তাহলে আগামী একমাসের মধ্যে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া  করতে হবে যেটা তোমার আর আমার অফিসের মিডেল লোকেশন হবে। বিয়ের রাতে আমরা ওখানে উঠবো।  ইস্কাটন এলাকা কেমন হয়?
– কি বলছো ? ঘুমাও তো। বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর বাড়ী চলে আসে – এইটাই নিয়ম।
তোমার ছোট ভাই বিয়ে করেও তাই করবে। এইটাই সমতা।
বাহ! চমৎকার সমতা । তা তোমার তো বোন নেই, তোমারা দু ভাই তো দুটো বউ নিয়ে আসবে, তোমাদের  সমতা কেমনে হবে?
– ইনি, ডিয়ার … ট্রাই টু আন্ডারস্টান্ড। প্রেম তুমি আমি করেছি, কিন্তু বিয়েতে থাকে পরিবার, সমাজ । পরিবার সমাজের তৈরী করা  নিয়মতো মানতেই হবে …
আর যদি না মানি? এটা আমার তোমার সম্পর্ক, আমি একা কেবল বাবা মা ছেড়ে চলে যাব – এ অসম রুল পরিবর্তন হওয়া দরকার।
এজন্যই আমারা দুজন আলাদা সংসার পাতবো।
-আমার মা  কিন্তু  চাকুরী জীবি মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না কখনই । শুধু আমার কথায় আর তোমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রাজি না হয়ে পারেন নি॥ আসলে তোমার ঐ পাগলামি  প্রস্তাব সম্ভব না ইনি।
এখন ঘুমাও, বিয়েটা হোক না আগে, পরে ভাবা  যাবে । কাল সকালে আমারও একটা সরকারী পোগ্রামে স্পিচ দিতে  যেতে হবে – নারী দিবস উপলক্ষ্যে।
ফোনটা রাগে আমারই রাখা উচিৎ ছিলো কিন্তু কি আশ্চর্য ফোন রাখার বিষয়েও রাগ দেখানোয় রোমেল জিতে গেলো,  রোমেলই রেখে দিলো। আমি মোবাইলের স্ক্রীনে নিজের আবছা প্রতিবিম্বের দিকেই তাকিয়ে রইলাম ঘুমহীন চোখে পরাজিত মানুষ হয়ে না শুধুই পরাজিত নারী হয়ে বুঝেত পারছি না ⁉️

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত