অন্য রকম দিন

অন্য রকম দিন

একটি অন্তীম ইচ্ছে – জীবনের শেষ দু’একটা বছর যেন কুসুমপুরে কাটাতে পারি। সেই ইচ্ছেরই আর একটি কথা – মৃত্যুর আগের দিনটা ঠিক কেমন হবে আমার !

দু’একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া মানুষ ঠিক কবে কখন কোন্ দিন মারা যাবে, বেশির ভাগ মানুষই তা জানে না। আমিও জানতে পারব না, ঠিক কোন্ দিনটিতে মারা যাব। আর মৃত্যুর আগের দিনটাই বা কেমন হবে, কেমন করে কাটবে সেই দিনটি।

ধরুন – আমার মৃত্যুর আগের দিনটা যদি এমন করে কাটে —

আগের রাতে শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙে তখন শুনতে পাই – আজান হচ্ছে। পাখির ডাকও শুনতে পাচ্ছিলাম।

ফজর নামাজ পড়ে আর ঘুমাই নি। টেবিলে গিয়ে বসি। ল্যাপটপ অন্ করি। উপন্যাসের কয়েকটি পরিচ্ছদ লেখা বাকি। লিখে ফেলি আরও দু’একটা পরিচ্ছদ। কেন জানি, একটি কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছিল। কয়েকটি পংক্তি কাল থেকেই মাথায় ঘুরঘুর করছিল। কথাগুলো লিখছিলাম কীবোর্ডে আঙুল চেপে। তবে কবিতায় নয় গদ্যে।

কত লোভের জিনিস আছে এই পৃথিবীতে। কত দামী বস্তকে পেতে প্রবল আকাঙ্খা করেছি। কত পথ চলেছি উদাস সঙ্গীত শুনে শুনে। শত পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মতো কত আলো দেখে পথ চলেছি, খুঁজেছি কত জ্যোৎস্নাবরণী অনিন্দ্য তরুণী! শেষে কোথায় গিয়ে দেখে ফেললাম এক অর্বাচিনীকে! তাকে চিনিনা। দেখিও নাই কোনদিন। কেমন করে যেন ছুঁয়ে ফেলি সেই অপরিচিতার কৃষ্ণ কেশদাম, কী অপূর্ব ছিল তার গ্রীবাভঙ্গি! কী মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছিল সেই মায়াবতী।

এই মেয়ে যখন কাছে আসে তখন কোনও কিছু লেখা হয় না। না কবিতা, না গদ্য। সে কাছে এসে বলে – ‘চলো হেঁটে আসি তোমার প্রিয় মেঠো পথ দিয়ে। যেথায় দুপাশে ফুটে আছে তোমার অনঙ্গ ভাঁটফুলের প্রেয়সীরা।’

বহু বছর আগের বাবার তৈরি টিনের চালের ঘর। জীর্ণ হয়ে গেছে চাল। বৃষ্টিতে জায়গায় জায়গায় জল পড়ে। শুয়েছিলাম বাবার পালঙ্কে। ঘরের পূর্ব দিকে দরজা আছে, আবার পশ্চিম দিকেও দরজা। পূর্ব দিকের দরজাটা খুলি। কী উজ্জ্বল রোদ্রে ছেয়ে আছে বাইরের আঙিনা!

আমরা দুজন ঘর থেকে নেমে বাইরে আসি । আমগাছ আর কাঁঠাল গাছের ছায়াতল দিয়ে হেঁটে গিয়ে পুকুরপাড়ে চলে যাই। সকালবেলার জল দেখে মনে পড়ে – সেই ছেলেবেলার কথা। জলের উপরে সকালবেলায় দেখেছি সূর্যের ছায়া। জলে ভাসত আরও একটি সূর্য! রোদ্রের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ত সারা জলে। আজও দেখলাম সেই দৃশ্য! পার্থক্য এইটুকু, ঢিল ছুঁড়ে দিয়ে জলকে আজ আর আলোড়িত করলাম না।

পুকুরের কিনারে ঢোল কলমি লতাগুলো নেতিয়ে পড়ে আছে জলে। এই কার্তিকে ফুল ফোটেনি একটিও । মনটাকে খারাপ হতে দিলাম না। পুকুরপাড় থেকে হেঁটে চলে যাই মাঠের দিকে। যেতেই রাস্তার দু’ধারে দেখা পেলাম ভাঁটফুলের। সাদা ফুল ফুটে আছে থরে থরে। স্পর্শ করি রেণু। বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে সরিষার ক্ষেত ৷ হলুদ ফুলে ফুলে শুয়ে আছে গালিচার মতো। অবারিত পাগল করা গন্ধ চারদিকে। আমরা মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে চলে যাই বহুদূর পর্যন্ত। আবার হেঁটে হেঁটে ফিরে আসি বাড়ির দিকে।

দুজনের সংসার। পাশের বাড়ির নয়নী এসে মায়াবতীকে কাজে সাহায্য করে। মাটির চুলোয় পাট সোলা দিয়ে সে রান্না করছে। আমি এসে বলি – কী রান্না করছ আজ।

– ধনিদহ বিলের ছোট আইর মাছ। ময়নাল চাচাকে দিয়ে কিনে এনেছি আজ।

– কলমীর শাক রেখ। সাথে মাসের ডাল। মা থাকলে সাথে একটি মুরগীও রান্না করত।

– ময়নাল চাচাকে দিয়ে এক সের দুধও কিনে এনেছি ছোনগাছা বাজার থেকে। সাথে সরবি কলা।

– আমি ঢাকা থেকে বাড়ি আসলে মা দুধ ভাত খাওয়াতো।

– আমি জানি, তাই তো দুধ কিনে এনেছি।

– হুম, তুমি আমার মায়ের মতো, মায়ের অভাব বুঝতে দাও না।

– যাও, পুকুর থেকে স্নান করে এস।

আমি একাকী গিয়ে পুকুরে নামি। কী স্বচ্ছ টলটলে জল৷ কেমন যেন অন্য রকম শীতল মনে হচ্ছে আজ। অদ্ভুত ঠাণ্ডায় দেহখানি হিম হয়ে আসছিল। বারবার ডুব দিচ্ছিলাম জলে। দু’হাতের আজলায় জল তুলে নিয়ে চোখে মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছিলাম।

স্নান সেরে বাড়ির ভিতর চলে আসি।

মেঝের উপর শীতল পাটিতে বসে দুপুরে ভাত খাচ্ছিলাম। মায়াবতীকে বলি – তুমিও আমার সাথে বসে খাও। সে খেলো না। বলল, তুমি খাও।আমি বেড়ে দিচ্ছি।

সে যেন মায়ের ভূমিকা পালন করছে। মা’ও এমন করে সামনে বসে বেড়ে খাওয়াতো আমাকে।

বিকালবেলা পিয়ারা গাছতলায় বাবার পুরনো হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারটাতে বসে ছিলাম। মায়াবতী নলিন গুড় দিয়ে মুড়ি মেখে নিয়ে আসে বেতের ডালায় করে৷ আমিও খাচ্ছিলাম, মায়াবতীও খাচ্ছিল।

দুজন বসে আছি দুজনের মুখোমুখি চেয়ে। কখনও কথা বলছি, কখনও না। উঠোনে আর কেউ নেই। নিম গাছের ডালে একটি বুলবুলি এই ডালে ঐ ডালে উড়াউড়ি করছিল। ঘরের চালের কার্নিশে কবুতর বাকুম বাকুম করে ডাকছে। মায়াবতীকে বলি – আজ উঠোনটা এত পরিপাটি লাগছে যে! সে স্মিত হেসে বলে – আজ আমি নিজ হাতে উঠোন ঝাড়ু দিয়েছি। নয়নীকে ঝাড়ু দিতে দিই নি।

পরিপাটি উঠোনের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম – ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।’

আমাদের বাড়ির উঠোন থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায় না। অস্তাচলের আকাশ ঢেকে থাকে বৃক্ষরাজিতে। যখন সন্ধ্যা নামে তখন পিছনের বাঁশ ঝাড়ের পাতায় এসে পড়ে অস্ত সূর্যের লাল আভা। আঁধার ঘনিয়ে আসতে থাকে ধীরে কাজল চোখের মতো কালো করে। আগে সন্ধ্যা হলে প্রতি ঘরে পিতলের কেরোসিন দীপশীখা জ্বলে উঠত। মুখর হয়ে থাকত সারা বাড়ি। আজ সব নিঝুম। কেউ নেই। একে একে কতজন পরপারে চলে গেছে। কতজন চলে গেছে কত দূরে। ভাই বোন যারা আছে – তারা কেউ কাছে নেই। কেন জানি, চোখটা জলে ভরে ওঠে। মায়াবতী বলছিল – ‘তুমি যে কেমন শিশু এখনও! চলো, পুকুরপাড়ে। আজ আকাশে অনেক বড়ো চাঁদ উঠেছে। সারা চরাচর বিগলিত জোছনায় ভাসছে। আশ্চর্য সুন্দর এই পৃথিবী। চলো, দুজনে মিলে দেখব এই পৃথিবী ।

রাতে বাবার পুরনো পালঙ্কে দুজন পাশাপাশি বিছানার শুয়ে আছি। পূবের জানালাটা খোলা। আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঠিকরে চাঁদের আলো পড়ছিল বিছানায়। নীরব রাতে মুখর করছিল ঝিঁঝি পোকার গান। মায়াবতী বলছিল – জানালাটা কী বন্ধ করে দেবো? বললাম, বন্ধ কোরো না। খোলা থাক্। কোথাও থেকে কুন্দ ফুলের গন্ধ আসছে। আসছে দূর থেকে যমুনার হিম বাতাস। দেখলাম, চাঁদের আলো ওর মুখের উপর এসে পড়ছে। নির্মল আরক্ত সুন্দর মুখশ্রী ওর! কেমন মায়ামলিন করে চেয়ে আছে আমার দিকে। ওকে বলি – আমার হাতটা একটু বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাও। ঘুম ঘোরেও ছেড়ে নিও না হাত। যদি দূরে চলে যাই!

আর কোনও কথা নেই। কত মায়া করেছি দুজন দুজনের জন্য । জীবনের অনেক কিছুই মিছে হয় নাই। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত বাতাস বেগ পাচ্ছিল নিবিড় আঁধারে। মনে হচ্ছিল মায়াবতী বুকের উপর মাথা রেখে আকুল নয়নে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।

~ *** ~

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত