বদলি

এইরকম কোনোদিন ঘটে না বলে আমি প্রথমে ব্যাপারটা খেয়াল করি নাই। বাইরে থেকে এসে কিচেনে বাজারসদাই রেখে সোজা বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে ডাইনিং থেকে তাকায়ে দেখি সোফায় বসে রুবা ফোঁস ফোঁস করতেছে। ভাব দেখে মনে হইতেছে এখনি কেঁদে দেবে।

আমি কইলাম, কাহিনী কী? শাকিলরে দেখি না যে?

এই প্রশ্নটাতে মনে হয় বিস্ফোরণ ঘটে গেল। রুবার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করলো।

আমি রুবার পাশের সোফায় গিয়া বসলাম।

তুমি কেমন লোক বলো তো, রুম্মান। তোমারে আমি কতবার ফোন দিলাম। তুমি ধরলা কেন? ধরলা না ধরলা না, বাসায় ঢুকে আমার দিকে আমার দিকে তাকাইলাও না। কে দরজা খুলে দিল সেটা না দেইখা সোজা কিচেনে চলে গেলা। ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার দিকে তাকাইলা না। আর শাকিল যে আসে নাই এইটা তুমি এতক্ষণে বুঝলা। তোমার বাসায় হুটহাট করে এইভাবে আসি দেখে, সময়ে অসময়ে তোমারে বিরক্ত করি বলে আমার দাম তোমার কাছে এত কইমা গেছে? ঠিক আছে তোমার বাসায় আর আসবো না।

আমি রুবাকে বোঝানোর চেষ্টা করি, আসলে হইছে কি রুবা, করোনার পর থেকে এই একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। বাসায় ঢোকার পর সোজা বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে না ফেললে কেন জানি শান্তি পাই না।

রাখো তোমার শান্তি। এতবার কল দেওয়ার পরও তুমি ফোন ধরলা না কেন?

তুমি কতবার ফোন দিছো? দাঁড়াও তো দেখি। বলে আমি ডাইনিং টেবিলে রাখা ফোন হাতে নেই।

হায় হায়, দশবার মিস কল উইঠা আছে। এই দেখ, ফোন ভাইব্রেশনে ছিল। আর তুমি যখন ফোন দিতেছিলা তখন আমি কাঁচাবাজারে। সপ্তাহে এই একটা দিন ছুটি পাই। বাজার না করলে সারা সপ্তাহ খাবো কী। বিশ্বাস করো, এত শব্দ আর ভীড়ের মধ্যে বুঝি নাই যে তুমি ফোন দিতেছো। বাজার থেকে বের হয়েও ফোন হাতে নেই নাই। দুই হাতে বাজার। আমি আরো আসার সময় ভাবতেছিলাম, এখনই বাসায় ঢুকবো নাকি মোড়ের দোকান থেকে চা খেয়ে উঠবো। তোমরা এখনো বিজি কি না বুঝতেছিলাম না।

বাসায় ঢোকার সময় আমার মুখের দিকে তাকাইলা না পর্যন্ত। আমি তো তোমার বন্ধু নাকি? আমার মুখের দিকে তাকাইলে কী হইতো? তোমার কাছে আমার দাম এত কমে গেছে?

আমারে ভুল বুইঝো না, রুবা। আমি ভাবছি, শাকিল আসছে। তোমরা ঘনিষ্ট সময় কাটাইছো। দরজা খুলতেই আমি তোমার দিকে তাকাবো কেমনে? কী দেখার জন্য তাকাবো? তাকাইলে তো তুমি ভাবতে পারো রুম্মান কী দেখে আমার মুখে। মনে করো, ভদ্রতা করেই আমি তাকাই নাই। শাকিলরে না দেখে ভাবছি, ও মনে হয় ওই ওয়াশরুমে বা ওই ঘরে রেস্ট নিতেছে।

আমার কথায় রুবা একটু শান্ত হয়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সে আবার ফোঁস ফোঁস করতে শুরু করে।

আমি বলি, কী হইছে বলো তো?

কী হইছে তুমি বোঝো না? আমি আগেই বুঝছিলাম, বুঝছো, আমি আগেই বুঝছিলাম।

রুবা আগে কী বুঝছিল সেটা শোনার জন্য আমি ওর মুখের দিকে তাকায়ে থাকি। কিন্তু রুবা বলে না।

হঠাৎ সে আমার ওপর খেপে যায়।

তুমি আমার অবস্থাটা একবার বুঝতে চেষ্টা করছো? একলা বাসায় ৫ ঘণ্টা ধরে বইসা থাকতে কেমন লাগে, এইটা একবারও ভাবছো তুমি? বসে থাকতে থাকতে আমার মাথা গরম হয়ে গেছে। চাবিও নাই যে তালা দিয়ে বাইরে যাবো। কিন্তু আমি তালা দিয়ে বাইরে গেলে তুমি বাসায় ঢুকবাই বা কেমনে। তুমি ফোন ধরতেছো না। কতবার যে তোমারে কল দিলাম। একবার মনে হইতেছিল, বারান্দায় যে দড়িগুলা রাখছো ওইগুলা ফ্যানে ঝুলায়ে লটকে পড়ি। নিজেরে শেষ করে দেই।

আমি চুপ করে থাকি।

রুবা চোখ মুছতে মুছতে বলে, দেরি হয়ে যাইতেছে রুম্মান। আমি যাই।

আমি বুঝতে পারি, এই অবস্থায় রুবাকে এক ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তাই তাকে শান্ত করার জন্য প্রসঙ্গ ঘোরাই।

তুমি তো মনে হয় সন্ধ্যায় কিছু খাও-ও নাই। এক কাপ চা বানায়ে তো খাইতে পারতা। ফ্রিজে মিষ্টি ছিল। তাকের ওপর মুড়ি, বিস্কুট, চানাচুর সবই ছিল। কিচেনে গেলেই পাইতা। বসো আমি চা করে আনতেছি।

আমি রুবাকে বসায়ে রেখে চায়ের পানি ওঠাতে কিনেচে যাই। দুই কাপ পানি গরমে দিয়ে ধনে পাতা, পেঁয়াজ আর মরিচ কাটতে শুরু করি। বেশি ঝাল দিয়ে সরিষার তেলে মাখা মুড়ি খেলে হয়তো রুবার মন ভাল হয়ে যেতে পারে। রাগ, হতাশা, কষ্টে ঝাল ভাল কাজ করে।

কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকার পর রুবাও কিচেনে আসে। ততোক্ষণে আমি একটা বড় বাটিতে পেঁয়াজ, মরিচ, ধনে পাতা, লবণ, চানাচুর আর সরিষার তেল মাখাতে শুরু করেছি। এগুলো এক সাথে মাখানোর পর মুড়ি দেব।

রুবা বলে, চা পাতা কই রাখছো?

আমি বলি, তুমি গিয়ে সোফায় বসো। আমি দেখতেছি।

তবু রুবা যায় না। চা পাতা খুঁজতে থাকে।

শাকিল আসলো না কেন?

শাকিল আসলো না কেন, তুমি বোঝো না? ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝো না? তুমি একজন পুরুষ মানুষ হয়ে পুরুষ মানুষের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝতে পারো না? তোমার কি মনে হয় ও আমাকে ভালোবাসে? বাসে না। আগে তোমার বাসায় আসার জন্য কেমন অস্থির হয়ে থাকতো। প্রতি সপ্তাহে একবার তোমার এখানে আসতাম। আসতাম না? এখন মাসে একবার আসি? তোমার মনে কখনো এই প্রশ্ন আসেনি যে, রুবা আর শাকিল কেন এখন এত কম আসে? একবার তো আমাকে জিজ্ঞেসও করো নাই।

আমি মুড়ি মাখাতে মাখাতে বলি, এইগুলা তো ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি ব্যস্ত থাকতে পারো। শাকিলেরও ব্যস্ততা থাকতে পারে। হয় না এই রকম? কিছুদিন খুব ঝামেলা যায় না?

আমার সবকিছু তুমি জানো না? জানো তো। সব তোমার সাথে আমি শেয়ার করি। তুমি বন্ধু হিসেবে আমাকে জিজ্ঞেস করতেই পারতা। তুমি তো জানো শাকিলকে আমি কত ভালোবাসি। একটা সংসার থাকার পরও আমি ওর প্রেমে পড়ছি। কেন পড়ছি? কারণ, বহুদিন পর আমার মনে হইছিল, কেউ একজন আমাকে মন থেকে কেয়ার করতেছে। এমনকি সে যখন পাশে থাকে না তখনো খেয়াল করতেছে আমার সব যেন ঠিক থাকে। প্রথমবারের মতো কেউ আমাকে বুঝতে পারছে। শাকিলের চোখে সেই সময় আমি যে আকুতি দেখছি সেটা মনে হয় কোনোদিন কারো চোখে দেখি নাই। তুমি ভাবতে পারো, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য সে বৃষ্টির মধ্যে সারারাত ফুটপাথে কাটাইছে। একসময় আমার মনে হইছে শাকিল আমাকে সত্যি চায়, আমিও তাকে চাই। শেষে ও একদিন বললো, তোমাকে একান্তে পেতে চাই। আমি বললাম, গাজীপুরে চলো। কত রিসোর্ট হইছে। সারাদিন কাটায়ে আসি। সে কয়, রিসোর্ট হোটেল মোটলে সে কমফোর্ট ফিল করে না। শেষে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে আমি তোমারে বললাম। তুমি ব্যাচেলর, একা থাকো। এইটা আমার মাথায় ছিল। তাছাড়া তুমি কাছের, তোমাকে সব বলা যায়, নির্ভর করা যায়।

আমি তো না করি নাই। করছি?

না করো নাই। কিন্তু তোমার বাসায় শাকিলকে নিয়ে আসার পর থেকে তুমি কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছ। ভালমন্দটাও জিজ্ঞেস করো না। তোমার কখনো মনে হয় নাই যে রুবাকে জিগাই, ওর মনে কী চলতেছে। কেন একটা সুখী সংসার রেখে সে শাকিলের সঙ্গে প্রেম করে? শাকিলকে দেখেও তো তোমার অনেক কিছু বোঝার কথা। তোমার বাসায় এতদিন ধরে আসি। তুমি দেখতেছো, শাকিল আর আমার প্রতি অতো আগ্রহী না। তোমার মনে একবারও কোনো প্রশ্ন উঠলো না? তুমি আমাকে সাবধানও তো করতে পারতা। তুমি বললে, আমি এতদূর জড়াইতাম না। কসম, তুমি যদি একবার বলতা।

রুবার দিকে চা বাড়িয়ে দিতে দিতে আমি বলি, আসলে হইছে কী রুবা। তুমি আমার বন্ধু ঠিক আছে। তুমি আমার সাথে সব শেয়ার করো, সেটাও ঠিক আছে। তোমার সংসার আছে, স্বামী বাচ্চাদের নিয়ে তুমি ভাল আছো এটাও জানতাম। এর মধ্যে একটা প্রেমও তোমার হইতে পারে। তুমি প্রেম করতেছো। আমার বাসায় এসে প্রেমিকের সঙ্গে সময় কাটাইতেছো। বন্ধু না হলে তুমি সেফ ফিল করতা না। আমার বাসায় আসতা না। আমিও বাসা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম না। কিন্তু তোমার পার্সোনাল স্পেসে আমি ঢুকতে চাইনি। আমার মনে হইছে তোমার স্পেসটা তোমার থাকুক। বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি ডিসকম্ফোর্ট ফিল করতে পারতা। সেইটা আমি করতে চাই নাই। তুমি দেখছো না, তোমরা বাসায় আসলে আমি কোনো না কোনো ছুতায় বাইরে চলে যাই? তোমরা যাতে ব্যক্তিগত সময়টা ভালভাবে কাটাইতে পারো সেইটা আমি সবসময় চাইছি।

রুবা একটু লাজুক হাসে।

ইউ আর সো নাইস। তোমাকে কত ঝামেলার মধ্যে ফেলি এইভাবে এসে এসে। কোনো কাজ না থাকলেও তুমি বাইরে বাইরে ঘোরো। আমি কত করে বলি, বাসায় থাকো। বাসায় থাকলে সমস্যা কী? তুমি তোমার ঘরে বসে সিনেমা দেখবা, তোমার স্বাভাবিক কাজকর্ম করবা। অবশ্য এখন এইসব বলেই বা কী? আমি তো আর আসবো না। আজকেই ওর সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিলাম। আসলে কী জানো রুম্মান, শাকিল আসলে আমার টাইপ না। সত্যি কথা বলতে ও আর আশরাফ একই টাইপ। আশরাফ ও শাকিল দুইজনের কাছেই আমি টেকেন ফর গ্রান্টেড। হাসব্যান্ড হিসাবে আশরাফ আমাকে কোনোদিন বুঝতে চায়নি। আমি তার সন্তানের মা। তার স্ত্রী। আমাকে একটা জড়বস্তু হিসেবে দেখছে সে সবসময়। আমি ভাবছিলাম, শাকিল বোধহয় অন্যরকম হবে। ও আমার কলিগ ছিল, সেটা তো জানো। উত্তরা ব্রাঞ্চে আমার রিপোর্টিং বস ছিল। ওর চোখের মায়ায় পড়ে গেছিলাম। গায়ে গায়ে মনে মনে লেগে থাকতো একসময়। অফিসের কাজে খুব হেল্পফুল ছিল। অফিস থেকে বাসায় ফিরে এসএমএস না দেওয়া পর্যন্ত অস্থির হয়ে থাকতো। লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করতাম। অফিসের বসের সঙ্গে বাইরে কেউ দেখে ফেললে  সমস্যা। দূরে দূরে কফি খেতে যাইতাম।

রুবা কাঁদতে শুরু করলো আবার।

কিন্তু সে আসলে আমাকে ভালোবাসেনি। ওই হারামজাদা আসলে এক নম্বর লম্পট। সে চেয়েছে আমার শরীর। এক বছর তো হইছে প্রেমের। এখন তার শরীরের নেশা কেটে গেছে। আমাদের এক কলিগ সেদিন বললো, যাত্রাবাড়ি ব্রাঞ্চেও নাকি এক মেয়ে কলিগের সঙ্গে দূরদূরান্তে কফি খেতে যায় এখন। উত্তরা ব্রাঞ্চ থেকে বদলি হয়ে যাওয়ার পর থেকে ওর আচরণ চেঞ্জ হতে শুরু করেছে। বলে, নিকেতন থেকে যাত্রাবাড়ি যাতায়াত করতেই আমার দিন চলে যায়। অথচ শুরুর দিকে বেরাইদ গিয়ে কফি খেয়ে আসার কথা বললে সে সাভার থেকে ছুটে আসতে পারতো। এখন তার সেই উদ্দীপনা কাজ করে না। আজকে তোমার বাসায় আসবো এটা তো একদিন আগে ঠিক করি নাই। পনেরো দিন আগে থেকে ঠিক করা। কথা ছিল, আমি সাড়ে চারটার মধ্যে আসবো, সে আসবে ৫টার মধ্যে। ছুটির দিন ধরে নিয়েই কিন্তু সময় ঠিক করা। তোমাকেই তো মনে হয় ১০ দিন আগে বলে রাখছি। এই আসাটা প্লান করা। আগের মতো অফিস শেষ করে দুজন তোমার বাসায় আসতাম যেমন, তেমন কিন্তু না। ৫টায় এইখানে আসতে হলে তাকে তো থেকে ৪টায় রওয়ানা দিতে হবে। কিন্তু সে ৫টায় মেসেজ দিছে, জরুরি একটা কাজে আটকা পড়ছে।

কী জরুরি কাজ?

পরে বলতেছি।

৬টায় মেসেজ দিছে ওর খালাতো ভাই এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে। তারপর থেকে ফোন বন্ধ।

আমি একবার তোমার ফোনে ট্রাই করি তুমি ধরো না। শাকিলের ফোনে কল দেই, সুইচড অফ।

আমি রুবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলি, এক্সিডেন্ট তো হইতেই পারে।

তুমি ওরে চেনো? দেখা করার কথা বললেই এইগুলা করে। কোনোদিন খালাতো বোনের মেয়ের বিয়ে। কোনোদিন বাচ্চার স্কুলের প্রোগ্রাম। কোনোদিন শশুর বাড়িতে দাওয়াত। আজকের কথা আগে থেকে বলছি যাতে শেষ মুহূর্তে অজুহাত দেখাতে না পারে। বলো, বাসা থেকে আমার বের হওয়া কি অতো সহজ। আমার বাসায় কাজ থাকে না? বাচ্চাদের দেখতে হয় না? ছুটির দিনে সবাই মিলে বাইরে খেতে গেলেও বাচ্চারা খুশী হয়। কতদিক সামলায়ে এসে শুনবা এই, একটা জরুরি কাজ পড়ছে। তুমি তো প্রেম করো না, রুম্মান তুমি বুঝবা না। এটা হলো প্রায়োরিটির ব্যাপার। তোমার প্রায়োরিটি কতটুকু সেটা। এখন ওর কাছে আমার গুরুত্ব নাই। সব কিছু আমার ওপরে চলে গেছে। আমি এইখানে ৫টা ঘণ্টা একা বসে আছি এইটা সে বুঝতেও পারলো না। দুই মিনিট কথা বলার সময়ও বের করতে পারলো না। যা বোঝার আমি বুঝছি। একদিন দুইদিন তো না। তার এই আচরণের বয়সও ছয় মাস হয়ে গেছে। আমি ওর কাছে বার্ডেন হয়ে গেছি। আমিও সিদ্ধান্ত নিছি। আর টানবো না এই রিলেশন। ওকে এসএমএস দিয়ে দিছি- আজকেই তোমার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।

সে কী অ্যান্সার দিছে?

অ্যান্সার দেবে কী, ও তো ফোন বন্ধ করে রেখে দিছে। মানুষের খালাতো ভাই আর এক্সিডেন্ট করে না? কেউ এক্সিডেন্ট করলে ফোন বন্ধ করা লাগবে কেন? তুমি আমাকে বুঝাও তো, রুম্মান।

তবু আরেকটু ভাবো। ফাইনাল কোনো ডিসিশন নেওয়ার আগে ভাল করে ভেবে দেখো।

আর কী ভাববো দোস্ত। তুমি বলো। আমি শাকিলের মধ্যে আমার জন্য কোনো ফিলিং টের পাই না। কোনো প্যাশন নাই। আমার সঙ্গে দেখার করার জন্য কোনো আকুলতা নাই। এখন তো মনে হয়, ওর চেয়ে আশরাফ ফার বেটার। এই অবস্থায় আসতে আশরাফের ১৪ বছর লাগছে, শাকিলের লাগলো এক বছর। তাছাড়া ওর সাথে আমি সংসারও পাতি নাই যে এত চিন্তা করা লাগবে। বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ও যেমনে চায় সেভাবে মানিয়ে নিয়ে থাকতে হবে।

রুবা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।

একসময় আমি বলি, দোস্ত আজকে রাতে আমার এখানে খেয়ে যাও। তোমার জন্য রান্না ওঠাই।

রুবা বলে, তুমি আমার সাজটা দেখছো?

হা। খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।

তুমি বুঝতেছো না, রুম্মান। এইটা সুন্দর লাগার ব্যাপার না খালি। এর মধ্যে একটা স্পেশালিটি আছে। বাসায় আমি কী বলে বের হইছি, জানো? বলছি, বান্ধবীর বাসায় জন্মদিনের দাওয়াত। ইচ্ছা করে বলছি যাতে ভালমতো সাজতে পারি। কার জন্য এত সাজলাম বলো? আমি ভাবছিলাম, আমার এই সাজ দেখে শাকিলের মনটা ঘুরে যাবে। কিন্তু হারামজাদা আসলোই না, দেখা দূরের কথা।

রুবা আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো।

কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো- আচ্ছা বলো তো, আমি কি দেখতে এতই খারাপ? নতুন যে মেয়েটার সঙ্গে ও কফি খেতে যায় সে মেয়েটার ছবি আমি দেখছি। আমার পাশে দাঁড়াতে পারবে না। কোনো দিক থেকে আমার পাশে দাঁড়ানোর মতো মেয়ে সে না। তুমি আমাকে ভাল করে দেখ। আমি কোন দিক থেকে কম তুমি বলো। সে সোফা থেকে উঠে আমার সামনে দাঁড়ায়।

আমি রুবার দিকে তাকাই।

আসলেই রুবাকে খুব সুন্দর লাগছে আজ। মাথায় বড় খোঁপা করে তাতে বেলী ফুল গুঁজে দিয়েছে। গলায় বড় বড় মুক্তার মালা। নীল আর শাদায় চৌকা চৌকা ডিজাইনের জামদানি পরণে। শাদা ব্লাউজের ওপরে মুক্তার মালা জ্বলজ্বল করতেছে। ওর শরীর থেকে পারফিউমের মৃদু ঘ্রাণ আসতেছে। মনে হচ্ছে, বেলী ফুলের সৌরভে গোটা ঘর ভরে উঠেছে।

সবকিছু একদম পারফেক্ট। কিন্তু কেঁদে মুখের অবস্থা একদম কাহিল করে ফেলছো। চোখ ফুলে গেছে। এটা বাদ দিলে তোমাকে আজ পরীর মতো লাগতেছে। যাও মুখটা ধুয়ে আসো।

রুবা বেসিনে মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ মোছে। তারপর ব্যাগ থেকে মেকাপ কিট বের করে নিজেকে আবার সাজাতে থাকে।

আজকে তোমার না খেয়ে বাসায় যাওয়া ঠিক হবে না। বান্ধবীর জন্মদিনে কত কিছু খাইতা। সে সবের কিছুই আমি খাওয়াতে পারবো না। ফ্রিজে ইলিশ মাছ কেটে রাখছিলাম। বেগুন আছে। সঙ্গে ডাল। ইলিশ ফ্রাই, বেগুন ভাজি, ডাল, ভাত। চলবে?

রুবা কথা বলে না দেখে আমি তাকিয়ে দেখি সাজতে সাজতে আবার কাঁদছে সে।

আমি কাছে গিয়ে ওর হাত ধরি।

দোস্ত, কাইন্দো না তো আর এমন করে। তুমি যত কানতেছো আমার ততো গিল্ট ফিল হইতেছে।

রুবা বলে, মিথ্যা বলবা না। সত্যি করে বলো তো, আমি কি দেখতে খুব খারাপ? আমার মধ্যে একটা পুরুষ কি কোনো আকর্ষণ খুঁজে পাবে না? আমাকে ছেড়ে যেতে কোনো পুরুষ মানুষের কি কোনো কষ্ট হবে না?

কী বলো। তুমি অপূর্ব সুন্দর।

সত্যি করে বলো।

অসাধারণ। তুমি পৃথিবীর সেরা সুন্দরীদের মধ্যে একজন।

আমার মন ভাল করার জন্য বলতেছো? আমি সেরা সুন্দরী হইলে তুমি আগে বলো নাই কেন? তোমরা পুরুষরা আসলে মিথ্যুক। বর্ন লায়ার।

সত্যি বলতে রুবা, আমি তোমাকে নিয়ে ওইভাবে কখনো ভাবি নাই। একসঙ্গে বড় হইছি। তোমাকে দেখি তো ছোটবেলা থেকে। তুমি আমাদের রুবা। কখনো মনে হয় নাই তোমাকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবা যায়।

এখন ভাবো।

আঙ্গুলের ভেতর আঙ্গুল চালিয়ে দিয়ে রুবা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে।

তুমি কি শাকিলকে খুব মিস করতেছো? বলতে গিয়ে আমি থেমে যাই। আসলেই হয়তো সে শাকিলকে মিস করতেছে। কিন্তু কথাটা বললেই সে আবার কান্নাকাটি শুরু করবে। কথা না বলে আমি রুবার হাতে চাপ দেই। ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে পাশ ঘেঁষে বসি।

রুবা ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না।

রুবা আমার কাছ থেকে কী শুনতে চায় সেটা আমি ভাবি। ওকে ভালোবাসি বলা যায়। কিন্তু আজকের আগে ওর কথা আমি সত্যি ভাবি নাই। ফলে, এখন ভালোবাসি বলাটা খুব মিনিংফুল কিছু হবে না। তাৎক্ষণিক একটা কথা হবে সেটা। তাই আমি চুপ থাকি।

রুবা আমার অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসে। রুবার হাসি দেখে আমার মনে ভয় ধরে যায়। আমি ভাবি, রুবা কী চায় আসলে?

পরক্ষণেই দুই হাত উঁচু করে খোঁপা থেকে সাবধানে বেলী ফুলের মালা খুলতে খুলতে রুবা বলে, যাবার সময় মনে করবা, ফুলগুলো  খোঁপায় গুঁজে নিতে হবে।

আমার গলার স্বর জড়িয়ে আসে। কোনো রকমে বলি, আচ্ছা।

ভালোবাসা ছাড়া পুরুষরা কেমনে সেক্স করে বলো তো? আমি তো এরকম কিছু কল্পনাও করতে পারি না। কেমন ঘিনঘিনে ব্যাপার না?

আমি রুবাকে জড়িয়ে ধরি।

ওর খোলা ঘাড়ে চুমো খেতে খেতে বলি, কী ভাবতে পারো না?

সেক্স উইদাউট লাভ।

কী মনে হয়?

মনে হয় জন্তু।

নিজেকে?

পশু মনে হয়।

এখন আমাকে জন্তু ভাবতেছো?

রুবা খিলখিল করে হাসে।

বলে, জানোয়ার। তুমি একটা জানোয়ার।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত