জায়গা বদল

সন্ধ্যার ঠিক আগের সময়টায় ফুলার রোডে উদয়ন স্কুলের গেইটের কাছের জায়গাটায় ভীড় বাড়তে শুরু করে। যারা আসে তাদের বেশির ভাগই হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকা। স্বামী-স্ত্রীও থাকতে পারে তাদের মধ্যে কেউ কেউ। ভার্সিটির বাইরে থেকে আসা এই অনিয়মিত মানুষগুলোর সাথে ক্যাম্পাসের কিছু নিয়মিত মুখেরও দেখা হয় আমার। একটা ছেলেকে আমি চিনি ক্যাম্পাসের প্রথম দিন থেকেই। তার সাথে নিয়মিত এখানে আসা মেয়েটিকে আগে না চিনলেও এখন আর জোর করেও অচেনা থাকার উপায় নাই। সাথে দুইটা কুকুরকে চিনি। কুকুর দুইটা খুব পরিচিত না। কিন্তু দিনের পর দিন একই জায়গায় দেখলে কোন কিছুই তো আর অপরিচিত থাকে না। কুকুরের প্রতি অতিরিক্ত গদগদ আদরসুলভ স্বভাব আসলে আমার কোন কালেই ছিল না। তবে ভার্সিটিতে আসার প্রথম দিন সকালে যখন এ এফ রহমান হল থেকে  আতিক ভাই মলচত্বর হয়ে হল পাড়ায় ঘুরতে নিয়ে গেল তখন প্রথম একটা কুকুরকে দেখে থমকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। বলা যায় কুকুরটাকে দেখে ভালো লেগেছিল বেশ। আমার মন বুঝতে পেরেই হয়তো আতিক ভাই বলে উঠেছিল— “টাইগার, জসিমউদদীন হলের কুত্তা। খায় যেমন কুত্তার মত, হইছেও কুত্তা, আল্লায় দিলে।”

আমার সাথে থাকা আমার বন্ধু জসিম কুকুরের শরীরের সাথে নামের একটা মিল খুঁজে পেয়ে বোধহয় খানিকটা আমোদ পেয়েছিল। ওর ঠোঁটের মৃদু হাসিটা ছিল সেটারই প্রমাণ। জসিমউদদীন হলের টাইগার নামধারী কুকুরটাকে এরপরও আমি অনেক বার দেখেছি। ওই হলে গেলে অহেতুক খোঁজখবরও করেছি। কিন্তু কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে কখনও আদর যত্ন করা হয়ে ওঠেনি। ভিক্ষুকদের সর্দার যেমন ভিক্ষুক ছাড়া আর কিছুই না তেমনি টাইগার নাম হলেও কুকুর যে আসলেই একটা ‘কুত্তা’ সেইটাকে আর অস্বীকার করি কী করে?

 

ফুলার রোডের এই কুকুরজোড়াকে আমি অনেকদিন ধরে এক সাথেই দেখে এসেছি। ফুটপাতের সংসারে ওরা আসলে স্বামী-স্ত্রী নাকি প্রেমিক-প্রেমিকা তা ঠাওর করা সম্ভব হয়ে ওঠে নাই কখনও। সংসার যেহুতু বললাম সেহুতু স্বামী-স্ত্রী ধরে নেয়াই সুবিধাজনক বলে মনে হয়। গতকালও যখন এখানে এসেছিলাম, দেখলাম দুইজন সহবাসে লিপ্ত হয়ে আছে। মনে মনে হিসাব করতে চাইলাম কার্তিক মাস নাকি এখন? কিন্তু হিসাব বাহির করতে পারলাম না। দরকারের সময় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভুলে যাওয়ার মতই বাংলা মাসের হিসাব যে এপ্রিলের ১৪ তারিখ থেকে শুরু হয় সেটাও আমি মনে রাখতে পারি না কখনোই। মনে না থাকলেও সমস্যা নাই। কারণ কার্তিক মাস যে ‘কুত্তার মাস’ সেটা ছোটবেলায় আমি প্রচুর শুনেছি। কুকুরদুটোর মিলনে তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে পাশে বসে প্রেম করতে থাকা ছেলে-মেয়েগুলো মুখ টিপে টিপে হাসছে। কোন কোন মেয়ের অতিরিক্ত লজ্জাও চোখে পড়ে হয়তো একজন ওদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য উশখুশ করছিল বলে মনে হল। কিন্তু তার পাশে বসা মেয়েটি কিছু একটা বলায় সে আর এগিয়ে গেল না ওদিকে। কুকুরদুটোর সংসার সন্ধ্যার প্রশান্ত বাতাসের সাথে মধুর থেকে মধুর হয়ে হয়ে উঠছিল তখন।

 

সন্ধ্যা নেমে আসলো এসএম হলের হলের কড়ি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। কুকুরদুটোর মিলন এখনও শেষ হয় নাই। কতক্ষণ আগে শুরু করছে কে জানে। ছোটবেলায় কার্তিক মাসে এরকম কুকুরের দীর্ঘ সময়ের যৌন মিলন দেখে হৈ হুল্লোড় করে বলতাম ‘কুত্তা আটকায়া গেছে’। কিন্তু কুত্তা যে কেন আটকায়া যায় সেটা না বুঝেই বা না বুঝতে চেয়েই দল বেঁধে লাঠিশোটা নিয়ে মারতে যেতাম। মার খেয়ে সেই আটকানো অবস্থায় খুব কষ্টে দুইজন ঘেউ ঘেউ করতে করতে দৌঁড় দিত। মিলনঅবস্থায় খুব ভালো দৌঁড়াতে পারত পারত না যদিও। আবার বারির উপর বারি খেয়েও তারা একে অপরকে ছাড়ত না। সেটা দেখে আমাদের যেমন পাশবিক মজা হত আবার কি কারণে যেন কিছুটা লজ্জাও লাগতো পরেক্ষণেই সব কিছু হৈ হুল্লোড় আর হাসাহাসির ভাসতে ভাসতে একসময় তলিয়েই যেত। পরে অবশ্য স্কুলে একদিন বিএসসি স্যার কি একটা যেন বোঝাতে গিয়ে বলেছিল কুকুরের লিঙ্গের মাথায় একটা ব্লাডার থাকে। ওখানকার ছিদ্রটা এতই ক্ষুদ্র যে কুকুরের বীর্যপাত হওয়ার পর সেই ছিদ্র দিয়া বীর্য বাহির হতে অনেক সময় লেগে যায়। এই সময় কুকুরের লিঙ্গ নাকি অনেকটা ফুলে ভেতরে আটকে থাকে তাই আর বের করতে পারে না। ব্যাপারটার সত্য-মিথ্যা নিয়ে পরে আর কখনও ঘাঁটাঘাঁটি করা হয় নাই। তবে সেদিনের পর থেকে কুকুরের মিলনের সময় কাউকে অহেতুক বাধা দিতে দেখলে নিবৃত করার চেষ্টা করতাম। 

 

আজকের ফুলার রোডের চিত্র খানিকটা বদল হয়ে গেছে যেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের উত্তর পাশে অনেকটা জায়গায় ভাসমান মানুষ ও রিক্সাওয়ালাদের পেশাবে ভেসে যাওয়া  ফুটপাত পার হয়ে মাথার চুলে জট লাগা এক পাগলমত চেহারার লোক একা একা কি যেন বিড়বিড় করছিল। তাকে পার হয়ে গিয়ে দুইটার পরিবর্তে একটা কুকুর দেখা গেল আজকে। তাও সে সচারাচর যেখানে ঘুরঘুর করে সেখানে না থেকে রোডের বিপরীত দিকের ফুটপাত বসে আছে। কুকুরের কি মন খারাপ টারাপ হয় নাকি? মানুষের মন খারাপ থাকলে দেখতে যেমন লাগে সেরকম এই কুকুরটাকেও লাগছে যে আজকে! আমার পরিচিত জুটিটারও কোন খোঁজ নাই। স্কুলের গেটের ওখানটায় বসে পশ্চিমের ফুটপাতে কুকুরটার দুই পা মেলে কোমড়ের উপর বসে সামনের দুই পা সোজা করে একবার ডান দিকে একবার বাম দিকে তাকানো দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে কাউকে খুঁজছে। কাকে খুঁজবে আর, কার্তিক মাস তো। সাথী কুকুরটা এসে যাবে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই। পাশে বসে থাকা জুটিগুলো থেকে কেউ কেউ কুকুরটাকে একা দেখে আফসোস করতে থাকলো! একজনের সন্দেহ হল সিটি করপোরেশন থেকে মেরে টেরে ফেলল নাতো? ক্যাম্পাসে তো কুকুরের উৎপাতে অতিষ্টদের অনেক কথাবার্তা চলছে জোরেশোরেই। 

 

মাগরিবের আজান দিবে সেইসময় আমার পরিচিত জুটির ছেলেটা এসে সেই কুকুরটা থেকে হাত পাঁচ ছয়েক দক্ষিণে বসল। ফুলার রোডের ইতিহাস হয়তো এই জায়গাটায় তার প্রথমবার একা আসার কারণটা আমরা এখনও জানি না। অভ্যাসের দোষেও হয়তো আসতে হয়। হয়তো মেয়েটি অসুস্থ কিংবা এমনও হতে পারে কাল রাতেই তাদের প্রেমটা ভেঙে গেছে। এই ফুলার রোড কত প্রেমের সূচনার, ক্লাইম্যাক্সের এবং যাবনিকাপাতের সাক্ষী হয়ে আছে সেই হিসাব আমরা আর কতটাই বা জানি! শতবর্ষী কড়িগাছগুলোর হয়তো কিছু জানার কথা। জানে কি সে? কেমন করে একটা মানুষ অন্য একটা মানুষকে খুঁজে পেয়ে আবার একা হয়ে গেছে এর পরিপূর্ণ ইতিহাসের কিছুটা অংশ এই ফুলার রোডে একা একা বসে থাকা ঐ কুকুরটা আর ঐ যুবকটা হয়তো লিখছে এখন। আর একা একা এই ফুলার রোডে আসলেই যে কেবল নিয়মিত বসার যায়গাটি ছেঁড়ে বিপরীত পাশে নির্জনমত একটা জায়গায় গিয়ে বসতে হয় এই ব্যাপারটাকে আজই প্রথম একটা অলিখিত নিয়মের মত মনে হল। কুকুরটা, ঐ ছেলেটার দিকে যতবারই তাকালাম যেন মনে হল অনন্ত মহাবিশ্বের দুটি কক্ষচ্যুত গ্রহ প্রবল আকর্ষণে আমাকেও তাদের কাছেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মনে হল, যেখানে এ অবধি বসে ছিলাম সেখানে আর একমুহুর্তও বসে থাকা চলে না আমার। 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত