মোহ

জ্যৈষ্ঠের শেষাশেষি। গাছে গাছে জারুল, সোনালু ফুলের হাসি ফুটতে শুরু করেছে। জাদিদের  মাথা বরাবর বেহায়ার মতন তাপ বিলিয়ে হাসছে চিরযৌবনা সূর্যটা! সে তাপেরই একটু ঝলক এসে চুমো দিচ্ছে ওর চাপদাড়িতে ভরা খসখসে গালে। এটাকে অন্যদিন হলে তার প্রেয়সী রুবির খানিক উষ্ণতার চুম্বন ‘মনে করা যেত’; যেহেতু সেটা মনে করা যাচ্ছে না, তাই এটাকে সূর্যের নির্লজ্জতা মেনে নিয়ে শান্ত হতে হচ্ছে। তবে বুকে কামনার ঈশ্বর চেপে বসেছে জাদিদের। প্রেয়সী রুবির সাক্ষাত জরুরী হয়েছে পড়েছে। অথচ দেশ জুড়ে লকডাউন। ‘কোভিড নাইন্টিন’ বাসা বেঁধেছে দেশে। 

‘গেল ২৪ঘন্টায় রংপুরে নতুন করে ১৪জন আক্রান্ত’

গতকাল টিভিতে এ ব্রেকিং নিউজে জাদিদের চোখ পড়তে খেই হারিয়ে ফেলছিল সে। ১৪জন, তেমন ভয়ানক সংখ্যা নয়; তবে সে সংখ্যাটা যে আশপাশের এলাকায় এসে পড়বে- এটা ভাবতেই জাদিদের ভেতরটা ‘ভয়ের শীতে’ জড়সড় হয়ে আসছিল বারবার। কুকরুলে ১জনকে করোনা চেপে ধরেছে। জাদিদের বাড়ি থেকে সেখানকার দূরত্বটা দুই গ্রামের। 

করোনায় অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষাটা আটকে আছে ওর। অন্যান্য বছর জাদিদের জন্য ঈদ ঈদ লাগে এই সময়ে। কাঁঠাল, জাম, আম, লিচুর মন মাতানো ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে থাকে সে। পুকুরপারে বসানো টঙে বসে পুবালী বাতাস লাগায় গায়ে। আর মাঝেমাঝে গতিহীন বাতাস লুঙ্গীর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে প্রবাহের গতি খোঁজে। ব্যাপারটা কি রকম ঘেন্নার কথা ঠেকে জাদিদের কাছে! অথচ রকিব ভাইয়ের আঠারো বছরের বউ বানিছা আধখোলা বুকে এ বাতাসের পরশ মেখে যেন পরম শান্তি পায়! জাদিদের বন্ধুদের মধ্যে দুই-একজন বান্দর প্রকৃতির ছোকড়া আছে। ওরা মাঝেসাঝে উঁকি মেরে বানিছা ভাবির বুকের আকার বোঝার চেষ্টা করে। 

কুকরুলে মামাবাড়ি জাদিদের। ওখানে ছোট হতেই বেশি গতায়াত। নানা-নানীর অভাবটা মামা-মামী পূরণ করার সাধ্যমত চেষ্টা করেন সচরাচর। দুই বছর আগে জ্যৈষ্ঠমাসে হলো কি- কলেজ বন্ধ বলে মামাবাড়ি গেছে জাদিদ। গিয়ে তো সারপ্রাইজট! মামাতো বোনটাকে সেই ছোটকালে তার মামার বাড়িতে মামীর সন্তানহীনতার দুঃখ ঘোচাতে দত্তক নিয়েছিলেন জাদিদের মামা। সে খবর অজানা ছিল। তবে এইসব কথার  চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে- এখানে একটা গল্প তৈরি হয়ে যায়।

মামাতো বোন অসাধারণ সুন্দরী! ১৪বছরের উঠতি যুবতী। মুখের মায়াবী হাসির ছোবলে যেন মরে যাচ্ছিল জাদিদ, সেদিন! সে মরণে যেন অপার্থিব সুখ হলহলিয়ে পৃথিবীকে কাব্যময় করে তোলে!

সময় আর সুযোগের হিসাব করে জাদিদ তাই তার ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিল সাহস করে। প্রচন্ড ত্রাসে ছিল। সেই ত্রাসকে পরিহাস করে ও প্রেমগন্ধীর মতন হেসেছিল সেদিন। 

 রুবি ওদের বাড়িতে বিশেষ আসে না ছুটিছাটা ছাড়া। জাদিদও তেমন যায় না এখন, কোনো উপলক্ষ ব্যতীত। 

তবে ওর সাথে জাদিদের প্রেম জমে পউষে, তারচে’ এমন জ্যৈষ্ঠের গরমকালে কিংবা আষাঢ়ের দিনে। কারণ, মামা এ সময়গুলোতে ব্যস্ত থাকেন। আম-কাঁঠালের মৌসুম এলে আম-কাঁঠালের ব্যবসায় করেন। ফলতঃ বাড়িতে কম সময়ই তার দেখা মেলে। জাদিদ  আর রুবির প্রেমটাকে মামী বোধহয় সহজ ভাবেই নেন, আজ অবধি কিছু বলেন নি। আবার উল্টোও হতে পারে- দেখা গেল উনি কিছুই খেয়াল করেন না ওদের এসবের। আম-কাঁঠালের মৌসুম পেরুলে মামা পাইকারী দরে ধান কেনা-বেচার ব্যবসায় ধরেন। মূলত টাকার সাগরে থাকেন মামা। এই ভাসেন, এই ডোবেন! ভাসা-ডোবাই যেন তার কাজ। 

কোনো একদিন পাটক্ষেত অথবা ভুট্টাক্ষেতের আড়ালে রুবিকে যদি জাদিদ ডাকে, তবে ওর ভেতরের মানুষটার নিষেধ না শুনে বাহিরের মানুষটা ছুটে যায়। আহা! মোহনীয় ঘ্রাণ তার শরীরময়। এভাবেই জমে ওদের জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় কিংবা পউষ প্রেম। 

এখন আসল কথা হচ্ছে: গতকালের ব্রেকিং নিউজটাতে আলবত শঙ্কাবনে যাওয়ার কথা সবার। এবং তাই হয়েছে। এলাকা লকডাউন করেছে পুলিশ। তবে জাদিদের আবার জ্যৈষ্ঠপ্রেম জেগে উঠছে আজ! এখন রাক্ষুসে সূর্যের তাপে খানিকটা ভাটা পড়েছে। হেলে পড়া সূর্যের আধমরা আলো মাঝেমধ্যে নেচে নেচে উঠছে পুকুরের জলে। আজ বানিছা ভাবিকে দেখা যাচ্ছে না। মরণ রে যে বাঙালি আজকাল ডরাচ্ছে না, এটা এই ভাবি ভুল প্রমাণ করে বাড়িতে দিব্যি ঘাপটি মেরে বসে থাকে। অথচ, জাদিদের মাথায় চেপে বসেছে জ্যৈষ্ঠদেবী রুবি। সাক্ষাতটা আজ করাই চাই।

লকডাউন এরিয়া খুব কষ্টে ক্রস করে বাইসাইকেলে চেপে মামার বাড়ির পথে যাচ্ছে জাদিদ, অনেকক্ষণ ধরে। রাস্তার দুধারে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতে ধানকাটার পর নাড়া পড়ে আছে শুধু। কোথাও কোথাও পাটক্ষেত, ভুট্টাক্ষেত। দারুণ বাতাসে কামনার ঘ্রাণ, মনে চটকদার সময়! আহা!

বেলা গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেল ডেকে এনেছে। মামাবাড়ি সামনে, এ রাস্তা দিয়েই একটু মোড় ঘুরলেই। সে মোড়েই বাঁশ দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করা হয়েছে। জাদিদের কেন জানি পিলে চমকে গেল! মামাবাড়ির কেউ…!

না -হ্যাঁ এসব ভাবতে ভাবতে অনেক সময় নষ্ট করছিল সে। বিশ্রী একটা ঘোরে পড়েছে যেন! হঠাৎ, জাদিদকে উদ্দেশ্য করে মুখের মাস্ক নামিয়ে খানিক দূর থেকেই কবির কাকার গলা হতে ভেসে আসে: ‘ওরে মিয়ার ব্যাটা! কোনঠে যাইস? আইজ বিয়ানবেলা একটা এম্বুলেনচ আসি রুবিক নিয়া গেল হাসপাতালোত। চেঙরিটাক বোলে ভাইরাস ধরছে! টিবিত দেখাইচে কাইল উয়ারে খবর বোলে! রেপোটত নাকি ভাইরাস পাইচে!’

জাদিদ  তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কি বলে এসব কবির কাকা! 

একটা এলো-হাওয়া বয়ে গেল ওকে ছুঁয়ে। জাদিদের চোখের সামনে যেন ভাসছে- একটা পাটক্ষেত। রুবি তাকে ডাকছে। তার ভেতরের মানুষটা বরাবরের মতন নিষেধ করছে কাছে যেতে। বাহিরের মানুষটাও আজ মোহগ্রস্ত হয়ে রুবির কাছে যেতে চেয়েও যাচ্ছে না! 

এই পাশটায় পটিয়া গ্রাম ওপাশে কুকরুল, মাঝখানে যোগাযোগ বিছিন্নের এ দেয়াল! এই গ্রামের বাতাস ওই গ্রামের বাতাসে মেশে। ওই গ্রামের বাতাস মেশে এই গ্রামের বাতাসের শরীরে। নিত্যকার এ সহজ ব্যাপারটাকে জটিল করেছে, বাতাসে আতঙ্কের বীজ ছিটিয়েছে ‘কোভিড নাইন্টিন’। 

জাদিদের চোখ হঠাৎ স্থির হয় এলাকায় বহিরাগত ঠেকাতে রাস্তার মোড়ে দেয়া বাঁশের বেড়ার দিকে। আজ এ বাঁধা ডিঙে মামাবাড়ি যাবার সাধ্য যেন নেই তার! নিজের এ অপারগতার কথা ভেবে চোখ ভিজে আসছে জাদিদের! এটা স্রেফ ভাবনাজালের বুদবুদ। সত্যি নয়; সত্যি হলেও আজ রুবির সে আবদার মেটানোর ক্ষমতা যে নেই!

মুখে মাস্কটা ঠিক মতন পড়ে নিয়ে নিজের বাড়ির পথে হাঁটছে জাদিদ। সাইকেলে চেপে যাবার শক্তিটা তেমন পাচ্ছে না। পরিচিত রাস্তা ধরেই যাচ্ছে। স্মৃতির-ঈশ্বর রুবির সাথে পার করা সময়ের নানা স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে। হরেক রঙে, নানান ঢঙের সেই সব স্মৃতি।  দূরে নয়, অদূরেই একটা পরিচিত স্বর; ফিসফিসিয়ে কানে যেন ভেসে আসছে: একটা চুমু দাও না! কতদিন আদর করো না মনে আছে?

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত