গঙ্গোত্রী গোমুখ

গঙ্গোত্রী গোমুখ

দুই হাজার এগারো সালে একবার ভারতের উত্তরাখণ্ডে গঙ্গোত্রীতে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি ওখানে একটা গুহায় থাকতেন। মা গঙ্গা মন্দিরে তিনি পূজা দিতেন। আমার সঙ্গে তার কথা হয় প্রথমে গঙ্গা ভাগিরথীর উৎপত্তি স্থলের এক পার্বত্য রাস্তার উপরে। তারপর তার গুহায় বসে । শুনেছিলাম তার কাছ থেকে অনেক কথা। সেও এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। মাথার চুলে তার জট ছিল, সারা মুখমণ্ডল মোছ আর দাড়িতে ঢাকা ছিল। পরনে ছিল তেল চিটচিটে পুরানো ছেঁড়া পোশাক।

এই সন্ন্যাসীর সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি অবাক হই তার কণ্ঠ শুনে, তার চোখের চাহনি দেখে। আমার কাছে মনে হয়েছিল, এই সন্ন্যাসীকে আমি কোথায় যেন দেখেছিলাম। এই কণ্ঠ আমার চেনা। এই চোখ আমার দেখা। তবে সন্ন্যাসী রূপে নয়, অন্য কোনো রূপে।

ফ্ল্যাস ব্যাক : ১৯৭১ সাল।

তখন মার্চের উত্তাল সময়। সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দলোন চলছে। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা শুরু করেছে। মানুষ উৎকন্ঠায় আছে, কী হবে, কী হবে না। এই রকমই এক অস্থির সময়ে নিখিলেশ ঘোষ নামে একজন লোক আমাদের গ্রামে ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। তার আত্মীয়টি ছিল আমার একজন সিনিয়র বন্ধু। আমার সাথে ছিল তার হৃদিক সম্পর্ক। আমাদের গ্রামে উনি কয়েকদিন ছিলেন। আমি তাকে দাদা ডাকতাম। বাড়ি বগুড়ার মহাস্থান গড় এলাকায়। তিনি খুব বিনয়ী ও ভদ্র ছিলেন। খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। বয়সে দশ বারো বৎসরের বড়ো হলেও বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিলাম মাত্র কয়েকদিনেই। অল্প কদিনেই ওনার অনেক কাছাকাছি আমি যেতে পেরেছিলাম।

ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। নিখিলেশ’দাও চলে যায় তাদের গ্রামে । উনি চলে যাবার পর ওনার সাথে আর কোনোসময় দেখা হয়নাই। কিন্তু তার সাথে আমার ক্ষণসময়ের সম্পর্কটি আমার কিশোর মনে ভীষণরকম দাগ কেটে গিয়েছিল। জীবনে কখনই ভুলতে পারিনি তার সাথে আমার খণ্ডখণ্ড স্মৃতিগুলো।

শুনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিখিলেশ দা’দের পুরো পরিবার শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। নিখিলেশ দা তখন তেইশ চব্বিশ বৎসরের একজন টগবগে তরুণ। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর পড়াশুনা করে নাই। নিজেদের পারিবারিক মিষ্টি দধির ব্যবসায় দেখভাল করত । নিখিলেশ দা ভাল গান গাইতে পারত। স্থানীয়ভাবে তার একটি সুনাম ছিল।

বগুড়া শহর পাক সেনারা দখল করলে সেখানে তারা জ্বালাও পোড়াও শুরু করতে থাকে। স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকসেনারা বেছে বেছে হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালাতে পোড়াতে থাকলে একাত্তরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝির দিকে নিখিলেশ’দাদের পুরো পরিবার ভারতের পশ্চিম বঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুরের বালুর ঘাট এরিয়াতে চলে যায়। ওখানে পতিরাম নামক এক গ্রামের স্কুল মাঠে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরে তারা আশ্রয় নেয়।

আজ প্রায় চল্লিশ বছর পর সেই নিখিলেশ দাকে আমি দেখলাম সন্ন্যাসী রূপে এই গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখে ভাগিরথী ও গঙ্গার উৎপত্তি স্থলের প্রায় ১৩২০০ ফুট উচুতে তীর্থস্থানে এক পর্বত গুহার পাশে। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম তাকে। তাকে বলি : ‘দাদা, আপনি কী নিখিলেশ ঘোষ? ‘ সন্ন্যাসী আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। মনে হল সে আমাকে চিনতে পারে নাই। বললাম — ‘ আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ, ছোনগাছা হাটে। সত্যেন দা আমার সিনিয়র বন্ধু। ‘ আমার পরিচয় শুনে সন্ন্যাসীর দুচোখ ক্ষণিকের জন্য কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সেও হয়তো তাকিয়ে দেখছিল আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের এক কিশোর মুখকে। সন্ন্যাসী আমাকে চিনতে পারে। বলে — তুমি এত বড় হয়ে গেছ? চেনাই যায় না। সত্যেন কেমন আছে?
আমি : জ্বি, বড়ই হয়ে গেছি। সত্যেন দা ভাল আছে। আপনার এ অবস্থা কেন? এমন সন্ন্যাস রূপ?
নিখিলেশ দা : সে অনেক কথা । তা তুমি এই গোমুখে কয়দিন আছ? কোথায় উঠেছ?
আমি : ভাগিরথী তীরে ‘সাগর গঙ্গা ‘ হোটেলে। আমি এখানে দুই দিন থাকব।

নিখিলেশ দা : তুমি আমার ডেরায় যাবে ?
আমি : চলেন, যাব।

উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীতে অবস্থিত শহর গঙ্গোত্রী। সেখানে রয়েছে মা গঙ্গার মন্দির। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত সেই মন্দির হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে অন্যতম তীর্থস্থান। হিমালয় পর্বতশ্রেণির ৩,১০০ মিটার উচ্চতায় রয়েছে গঙ্গা মাতার মন্দির। প্রত্যেক বছর অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য তিথিতে শুরু হয় চারধাম যাত্রা – গঙ্গোত্রী, যমুনেত্রী, বদ্রীনাথ ও কেদারনাথ। খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের দ্বার।

যাহোক, আমি নিখিলেশ দার গুহায় চলে যাই। সে এক বিস্ময়কর দৃশ্য ! কেমন যেন ভূতরে পরিবেশ। কেমন যেন মাটির গন্ধ পাচ্ছিলাম। দেখছিলাম সংসার বৈরাগ্য এক নিঃসঙ্গ মানুষকে। চাল নেই। চুলা নেই। আমার এসব দেখে ভালও লাগছিল খুব। এ এক দুঃশ্চিন্তাহীন সুখের জীবন। একসময় কত ইচ্ছা হতো সন্ন্যাস জীবন যাপনে। আজ নিজ চোখে দেখছি, এই সন্ন্যাসব্রত জীবন।

আমি যে দুইদিন এখানে ছিলাম, সে দুইদিন নিখিলেশ’দার গুহায় বসে সময় কাটিয়েছি। কখনো পার্বত্য রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি। কখনও ভাগিরথীর তীরে বসে নিখিলেশ দার জীবনের কথা শুনেছি। আমার জানার খুব ইচ্ছা ছিল, কেনই তিনি বেছে নিলেন তার এই সন্ন্যাস জীবন?

আমার কৌতুহলী মন উদ্গ্রীব ছিল নিখিলেশ’দার কাছ থেকে তার সন্ত্রাস জীবন ধারণের কথা জানবার। তাকে বলেছিলাম, আপনারা যখন শরনার্থী হয়ে এসেছিলেন, সেই সময়ে আপনার তো বয়স ছিল মুক্তিযুদ্ধে যাবার। তা আপনি কেন যাননি মুক্তিযুদ্ধে? আমার এই কথা শুনে তিনি খুব বিমর্ষ হলেন। একটি বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিখিলেশ দা একটি গাঁজার চুরুট ধরালেন। জানালা দিয়ে দেখছিলেন দূরের পাহাড় । কী যেন ভাবছিলেন তিনি। তারপরের কথাগুলো নিখিলেশ দা ‘র মুখ থেকেই শোনা যাক :

বালুরঘাটের অন্তর্গত গঙ্গারাম বাজারে একটি মিষ্টির দোকানে আমি কাজ নেই। আমার কাজ ছিল আশেপাশের গ্রাম থেকে যারা দুধ বিক্রয় করতে আসত, তাদের কাছ থেকে সে দুধগুলো সংগ্রহ করে রাখা এবং কারখানায় কারিগরের সহকারী হিসাবে কাজ করা। এই মিষ্টি দোকানটির মালিক ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ একজন বিধবা মহিলা। নাম ছিল বেনুকা দেবী। আমি ওনাকে মাসী ডাকতাম। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। অল্প কদিনেই আমি এই কারখানায় বেশ সুনাম করে ফেলি।

একদিন কারখানায় গিয়ে শুনলাম আজ বালুরঘাটে কলিকাতা থেকে স্বাধীন বাংলা শিল্পী সমিতি আসবে গান গাইতে। আমি মালিকানের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বালুরঘাটে চলে যাই । তখন বিকেল হয়েছে। বালুরঘাট স্টেশনের কাছে রাস্তায় খোলা ট্রাকের উপরে দশ বারো জনের একদল ছেলেমেয়ে উদ্দীপনামূলক মুক্তির গান গাইছে। আমি খুব উচ্ছসিত হই গান শুনে। গান শেষ হলে আমি এগিয়ে যাই খোলা ট্রাকটির দিকে। যিনি ঐ দলের নেতা ছিলেন, তাকে বলি : আমি গান গাইতে পারি। আমি আপনাদের গানের দলে যোগ দেবো। উনি বলেছিলেন ‘তুমি কলিকাতায় এসো। অবশ্যই তোমাকে আমরা গানের দলে নিয়ে নেব। ‘ শুনেছিলাম ঐ দলের নেতা ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেণু। অন্য সদস্যরা ছিলেন, শাহিন মাহমুদ, শারমিন মুরশিদ, নায়লা জামান, বিপুল ভট্টাচার্য, তারিক আলী, লুবনা মরিয়ম, স্বপন চৌধুরী সহ অনেকে।

কিন্তু আমার আর গানের দলে যোগ দেওয়া হয়নি। আমার মালিকান বলেছিল : তুমি চলে গেলে আমি উপোস নেব। আর একটিও অন্ন গ্রহণ করব না। তুমি আর কোনদিন তোমার এই মাসীমাকে দেখতে পাবে না। আরও একজন সেদিন খুব মন খারাপ করেছিল — সে হচ্ছে ফুলমনি সরেন। একজন সাঁওতাল রমণী। বয়স মধ্য তিরিশ। বিবাহিতা, কোনো সন্তান নেই । এই মেয়েটি এখানে মাঝে মাঝে দুধ বিক্রি করার জন্য আসত। খুব বেশি কথা হতো না ওর সাথে। ফুলমনির স্বামী রাঁচিতে থাকত। ওখানে রেলওয়ে স্টেশনের একজন কুলি। এক দুই মাস পর বাড়ি আসত। এসে যে কদিন থাকত সে নাকি রীতিমতো ফুলমনিকে ধর্ষণ করত। আর মারধর করত।

এই ফুলমনিকে বলেছিলাম– ‘আমি কলিকাতা চলে যাব। গানের দলে যোগ দেব। মুক্তির গান গাইব। অথবা যুদ্ধে যাব। ‘
ফুলমনি : আপনি যাবেন না। আপনি চলে গেলে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাব।
আমি : কোথায় নিরুদ্দেশ হবে তুমি?
ফুলমনি : কত জায়গা আছে। কাশি, গয়া, বৃন্দাবন, না হলে গঙ্গোত্রী গোমুখ। সন্ন্যাসিনী হয়ে ঘুরব মঠে মঠে, মন্দিরে মন্দিরে।
আমি : আমাকে কী তুমি ভালবাসো?
ফুলমনি : জ্বি।

আমি থাকতাম বেনুকা মাসীর কারখানার পিছনে একটি ঘরে। এই ঘরের পিছনে অদূরেই ছিল পুনর্ভবা নদী। যেদিন কোনও কাজ থাকত না, যেদিন কোনও কারণে আমার মন খারাপ লাগত, সেদিন একাকী চলে যেতাম পুনর্ভবা নদীর তীরে। এই নদীর জল বয়ে গেছে আমাদের দেশেও। এপারে পুনর্ভবা, ওপারেও পুনর্ভবা। আজ ফুলমনির কথাগুলো শুনে চিত্ত আমার কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। চলে যাই পুনর্ভবা নদীর তীরে। নির্জন ছাতিম গাছের তলে বসে দেখছিলাম নদীর জলের কুলকুল ধ্বনি। ভাবছিলাম — ফুলমনিকে কখনও ভালবাসলাম না। প্রাণ খুলে কথা বলিনি কোনদিন। তারপরেও এই সাঁওতাল রমণীটি আমার জন্য কেন নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে? কেন সে আমাকে ভালবাসলো?

মনটা আরও ভাল করার জন্য সন্ধ্যার পরে আমার ছোট্ট রেডিওটি কানের কাছে নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র শুনি। উনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। চরমপত্রে তাঁর দৃপ্ত উচ্চারণ —– ‘ঘেটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট। কি হইলো? কি হইলো? অংপুরের ভুরুঙ্গামারীতে ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়ারা হালাক হইলো। কেইসটা কি?…..”

আমারও যে কী হয়েছিল একদিন কিংবা দুই তিন দিন ফুলমনি না এলে ভাল লাগত না। আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড় এই কালো সাঁওতাল মেয়েটির জন্য এমন লাগে কেন? আমি জানি আমার এই ভাললাগা আমার অন্তরের মধ্যেই ঢেকে থাকবে । প্রকাশিত হবে না কোনোদিন। পুনর্ভবা নদীতে সাঁওতাল পুরুষদের দেখেছি পানকৌড়ি শিকার করতে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো না ধনুকের তীর। আমি জানি, যদি বলি — ‘ফুলমনি, আমি তোমাকে ভালবাসি। ‘ শত শত তীর এসে বিদ্ধ হবে আমার শরীরে। রক্তাক্ত হবে পুনর্ভবার জল।’

আমার প্রায়দিনই খুব মন খারাপ লাগত। বেনুকা মাসী বলত ‘তোমার কী হয়েছে নিখিল? ‘ আমি মিথ্যা করে বলতাম, ‘কিছু হয়নি। ভাল আছি।’ আমার অনেক গ্লানি আছে, আমি যুদ্ধে যাইনি। আমার অনেক কষ্ট হয়, আমি গাইনি দেশের জন্য মুক্তির গান। ‘ আমিও গোপনে গোপনে ফুলমনিকে অনেক ভালবাসি। কিন্তু, কখনও ওকে বলিনি —– ভালবাসি।

সেদিন ছিল কার্তিকের অমাবশ্যার রাত। একটু আগে আগেই আটটার মধ্যেই দোকান বন্ধ করে খেয়ে শুয়ে পড়ি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিল। কেমন যেন গা ছমছম করছিল। ঘুম আসছিল না চোখে। রাত বেড়েই চলছিল। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাই। সারা ঘরময় অন্ধকার। শিখা ধরাব কিন্তু দিয়াশলাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আস্তে আস্তে দরজার কাছে যেয়ে বলি —- কে? ওপাশ থেকে উত্তর আসে — আমি ফুলমনি।

তারপরের কিছু কথা নিখিলেশ দা ব্লাকআউট করলেন। আমাকে বললেন না। হয়তো তার চেয়ে বয়সে আমি অনেক ছোট, হয়তো দ্বিধায়, হয়তো লজ্জায়। আমি বুঝতে পারলাম কেন তিনি বললেন না সেইরাতের অনেক কথা। হয়ত অন্ধকার ছিল। হয়তো শিখা জ্বলে উঠেছিল। হয়তো কার্তিকের অমানিশার সমস্ত আঁধার ঢেকে দিয়েছিল নিখিলেশ’দাকে আর ফুলমনিকে। দূরে পুনর্ভবা নদীর জল নিস্তব্ধ ভাবে বয়ে যাচ্ছিল হয়তো গঙ্গা পদ্মা অববাহিকার দিকে।

সেদিন রাতে যে ফুলমনি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল, এটি জেনে গিয়েছিল ফুলমনির পরিবার। সে যখন ঘরে ফিরে গিয়েছিল তা দেখে ফেলেছিল ওর নন্দিনী। আর ওর নন্দিনী বলে দিয়েছিল, ফুলমনির স্বামীকে। ফুলমনির গোয়ার স্বামী এই ব্যাপারটির জন্য তাকে অনেক মারপিট করেছিল। কিন্তু ফুলমনি স্বীকার করেনি , সে রাতে সে কোথায় গিয়েছিল। এরপর ফুলমনি আর ঘরের বাহির হয় নাই।

এরপর একবারই ফুলমনি আমার ঘরে এসেছিল। সেও একদিন সন্ধ্যা রাতে। খুব হন্যে হয়ে এসে বলেছিল — তোমাকে খুন করে ফেলার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তুমি এই এলাকা ছেড়ে চলে যাও। আমি ফুলমনিকে বলি – তুমি আমার সাথে চলো, বল্লা মা কালী মন্দিরে। মা দেবীকে স্বাক্ষী রেখে তোমাকে বিয়ে করব। আমরা মন্দিরে চলে যাই। ফুলমনি ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে। এবং ওকে বিয়ে করি। ফুলমনি বলেছিল- আমি এখন ধর্মত তোমার বউ। আমি তোমার কাছেই থাকিব। আমি আর ফিরিয়া যাইব না।
আমি : তা কি করে সম্ভব? তুমি আজ চলে যাও। পরে কোনও একদিন চলে আসিও। ‘
ফুলমনি আর কোনও কথা বললো না। সোজা মন্দির থেকে বের হয়ে চলে গেল।

আমি প্রত্যুষেই পতিরাম শরণার্থী শিবিরে চলে যাই। কাকতালীয় কিনা জানিনা, সেদিন ছিল ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে খবর পাই, আমাদের বিজয় হয়েছে। গান বাজছে বেতারে —-
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল
জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।।
বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল,
হয়েছে কাল, হয়েছে কাল, হয়েছে কাল।’

আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। আতিশয্যে ভুলে যাই ফুলমনিকে। স্বাধীন দেশ, বিজয়ের দেশ দেখার জন্য মনপ্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। শিবিরে শিবিরে সেকি আনন্দ উৎসব সেদিন। সারি সারি নৌকায় পাল তুলে পুনর্ভবা নদী দিয়ে আমরা পরের দিনই হলুদ মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশে চলে আসি।

আমি নিখিলেশ’দাকে বলি — ফুলমনি র কী হলো? আর আপনি কেন এখানে, এই গঙ্গোত্রী গোমুখে? কেনই এই সন্ন্যাস রূপ? নিখিলেশ দা ৰলেছিল —‘ আমি পতিরামে গিয়ে একবার ফুলমনির খোঁজ নিয়েছিলাম। শুনেছি সে নিরুদ্দেশ হয়ে কোথায় চলে গেছে। ‘ফুলমনি একদিন বলেছিল — ‘কত জায়গা আছে। কাশী, গয়া, বৃন্দাবন, না হলে গঙ্গোত্রী গোমুখ। সন্ন্যাসিনী হয়ে ঘুরব মঠে মঠে, মন্দিরে মন্দিরে। ‘

সেই কতকাল ধরে আমিও কাশী, গয়া, বৃন্দাবন, এই গঙ্গোত্রী গোমুখে সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরছি। খুঁজছি হতভাগী ফুলমনি’কে। এখনও কোথাও ওর দেখা পাইনি।’

মানুষের জীবন যে কতো রকমের হয়! কত দুঃখজরা। কত বিমুগ্ধ স্বপ্ন দেখে মানুষ। কত স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় , কত জপ তপ সাধনা। সন্নাসীর অনেক কথার গূঢ়ার্থ নিয়ে ভেবেছি আমি। অনেক কথা বলতে গিয়ে তাঁর দীর্ঘশ্বাস পড়েছে বারেবার। দীর্ঘশ্বাসের সেই তপ্ত বাতাস গঙ্গার হিমবাহের ছায়ান্ধকারে মিলিয়ে গেছে। নিরুদ্দিষ্ট নিঃসঙ্গচারী এই সন্ন্যাসীর জীবনরূপ দেখে একটি কথাই মনে হয়েছিল — প্রেম কখনোই পরাজিত হতে পারেনা।

 

~ কোয়েল তালুকদার

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত