পদ্মাপাড়ের উপাখ্যান

পদ্মা পাড়ের উপাখ্যান

স্কুল ছুটির সময়ে মেয়েকে আনতে সেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম। আমার অফিস ও নানা ব্যস্ততার কারণে সাধারণত মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়া করা সম্ভব হয় না। এই কাজটি তাই মেয়ের মা-ই করে।

তখনও ছুটির ঘন্টা বাজেনি। দেখি — মাদার্স কর্ণারে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। ওনাকে দেখে চিনতে পারলাম । ওনার সাথে কথা বলব কী বলব না, ভাবতেই তার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। সে মাদার্স কর্ণার থেকে লবিতে চলে আসে। কাছে এসে প্রথম কথা সেই বলে–

— কেমন আছ তুমি? চিনতে পারছ আমাকে?

— খুব ভালো চিনতে পারছি। তুমি রুনু। প্রায় দশ বছর পর তোমাকে দেখলাম। কী জন্য এখানে?

— আমার মেয়ে এখানে পড়ে । ওকে নিতে এসেছি।

– আমারও মেয়ে পড়ে। আমিও ওকে নিতে এসেছি। তা তোমার মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে?

— ক্লাস থ্রি।

– আমার মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে।

রুনু বলে — তোমাকে তো এর আগে কখনও দেখিনি স্কুলে।

— ওর মা-ই মেয়েকে আনা নেওয়া করে। তবে হঠাৎ হঠাৎ আমারও আসা হয়, কিন্তু তোমার সাথে দেখা হয়নি।

রুনুকে দেখে একটু মনখারাপ হলো। ওর চেহেরা কেমন যেন নিরাভরণ লাগল। কোনও সাজসজ্জা নেই। সিম্পল একটি শাড়ি পরেছে। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই। হাতের নোখে নেইলপালিশ মাখা নেই। চোখে কাজল নেই। চুল পরিপাটি করে বাঁধা নেই। খুব সাধারণ করে চুল খোঁপা করে রেখেছে।

আমি রুনুকে বললাম — এই শহরেই তুমি থাকো, অথচ জানতাম না তা। দেখাও পাইনি কোথাও। তা তুমি কেমন আছ? কোথায় থাকো?

স্কুলের ছুটির বেল বাজতে থাকে। বেলের শব্দটা খুব জোরে কর্কশ করে বাজছিল। কিছুক্ষণ চুপ থাকে রুনু।
তারপর বলছিল — আমি কেমন আছি সে কথা পরে বলব একদিন। কয়েকদিন পর এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি ভেড়ামারাতে। বাকি জীবন ওখানেই থাকব। যদি ইচ্ছে হয়, একবার বাসায় এসো। বাসার ঠিকানা– ৩৬ দলিপাড়া, উত্তরা। বাসায় এলে সব বলব।

একটি সাত আট বছরের ফুটফুটে মেয়ে দৌড়ে এসে রুনুকে জড়িয়ে ধরে। ওর কাঁধে বইয়ের ব্যাগ। রুনু মেয়েটির কাছে থেকে ব্যাগটি নিয়ে রিকশায় উঠে। যাবার বেলায় বিষাদমাখা হাসি দিয়ে বলে — বাসায় এসো তুমি।

দশ বছর আগে –

রুনু পদ্মা পাড়ের মেয়ে। পদ্মার তীর ঘেঁষে একটি গ্রাম, নাম তার চাঁদগ্রাম। সেখানেই কেটেছে ওর শৈশব। কৈশোরেই বাবা মাকে হারিয়ে ফেলে। গ্রাম ছেড়ে চলে আসে মামার কাছে থানা শহর ভেড়ামারায়। ওখানেই পড়াশোনা করে। রুনু যখন কলেজে পড়ে, ঠিক সেইসময় এক ছুটির দিনে আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম ভেড়ামারা। ওখানে গঙ্গা-কপোতক্ষ প্রজেক্টে আমার ভগ্নিপতি চাকুরি করত। কয়েকদিন আমার বোনের বাসায় ছিলাম। রুনু আমার ছোট্ট একটি ভাগ্নীকে পড়াতে আসতো প্রতিদিন। সেই ছলেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়।

আমি তখন ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র। উচ্ছল প্রাণের এক তরুণ বয়স আমার। সুন্দর লাগে পৃথিবীর সব রূপ। নদী ভালো লাগে। বৃক্ষ ভালো লাগে। পাতা ঝরা দেখতে ভালো লাগে। রোদ্দুরে হাঁটতে ভালো লাগে। বৃষ্টির মেঘ দেখতে ভালো লাগে। গীতবিতান খুলে গান পড়তে ভালে লাগে। ভালো লাগলো এই রুনু নামের মেয়েটাকেও।

মেয়েটা সালোয়ার কামিজ পরে, চপ্পল পায়ে হেঁটে হেঁটে আসতো। চোখ দুটোতে মায়া জড়িয়ে থাকত। কেমন স্বপ্নময়ী দৃষ্টি তার! আমার সাথে কথা বলত না। আমিও কোনও কথা বলতাম না। যেন সব কথা লুকিয়ে থাকে কণ্ঠের নীচে। কিন্তু খুব ইচ্ছে হতো ওর সাথে কথা বলতে।

কয়েকদিন এইভাবে কথা না বলেই কেটে গেল। বলি বলি করে কোনো কথাই বলা হলো না। আমারও ওখানে থাকবার দিনগুলো শেষ হয়ে যেতে লাগলো। কী করব? ভাবলাম, থাক। ওকে কিছুই বলব না। আমার ভালোলাগা আমার মাঝেই গোপন থাক। এখান থেকে যখন চলে যাব। তখন সব ভুলে যাব। এই জীবনকালে এইরকম কত মেয়ের দেখা পাবো, দেখতে পাবো মায়াবী চোখের কত মায়াবতীকে! এদের ভিতর থেকেই ভালোলাগার কোনও মেয়েকে ভালোবেসে ফেলব। কেউ না কেউ আমার জীবনে এসে যুক্ত হবে। এত দূরের পদ্মাপাড়ের এই মেয়ে আমার জীবনে কিছু না-ই বা হলো।

ভেড়ামারা থেকে চলে আসবাব দুইদিন আগে কেন জানি কী মনে করে মেয়েটিকে ছোট্ট একটি চিরকুট দিয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল —

” হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে তোমাকে নিয়ে খুব পদ্মার জল দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি কাল বিকালে ব্রিজের কাছে পদ্মা পাড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। এসো। ”

রুনু সেদিন এসেছিল পদ্মাপাড়ে। আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম পদ্মার জল। খোলা হাওয়ায় উড়ছিল রুনুর চুল। আমরা দেখেছিলাম ছোট ছোট ঢেউ। স্রোতে ভেসে যেতে দেখলাম কত খড়কুটো। কী স্নিগ্ধ শীতল বাতাস নদীর জল ছুঁয়ে এসে লাগছিল গায়ে। কী কথা বলব আমি রুনুর সাথে? কত কথা অন্তরে বাজে। রূপকথার মতো যত কথা। ভেবে পাচ্ছিলাম না কিছুই। তবুও বলেছিলাম কম্পিত স্বরে — ‘তোমাকে আমার ভালো লাগে রুনু।’

রুনু বলেছিল — ‘তোমার এই ভালোলাগাটুকু আমার জন্য চিরকালের করে রেখে দিও। ভালোবেসো না। আমি যে বাগদত্তা। মামা আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন।’ দেখলাম, রুনু আমার চোখের দিকে স্থির শান্ত তাকিয়ে আছে। তখন পদ্মার জল ছলাৎ ছলাৎ করছিল। রুনুর চোখ জলে ছলছল করছে। নদীর উপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাস কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। ব্রিজের উপর থেকে জলের দিকে চেয়ে দেখি — ঢেউগুলো জলের নিবিড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

পদ্মা পাড়ের রুনু উপাখ্যান সেদিনের সেই অলৌকিক সূর্য অস্তকালেই শেষ হয়ে গিয়েছে।

তারপর, এই পৃথিবীর পথে প্রান্তরে কত বনঝাড়ে কত ফুল ফুটে থাকতে দেখেছি। কত নাম না জানা ফুল। সব ফুলের সৌরভ কী আর নেওয়া হয়? স্পর্শহীন, মায়াহীন হয়ে কত ফুল নীরবে ঝরে গেছে। আবার পথ চলতে চলতেই সেখান থেকেই রাজকুমারীর মতো সৌন্দর্যের একটি ফুল ছিড়ে এনে ফুলদানিতে রেখেছি। শোভিত হয়েছে ঘর। সুবাস ঝরিয়েছে সারা ঘরময় । প্রতিদিন সেই ফুলে জল দেই। পরিচর্যা করি। ভালই লাগে। ভালোবাসি।
দশ বছর পর সেই রুনুকে আজ দেখলাম। মেয়েটিকে দেখে কেমন নির্জীব স্পন্দনহীন ঝরা ফুলের মতো মনে হলো। ও কী খুব দুঃখে আছে? ওর কোনও পরিস্ফুটন নেই। জীবন থেকে একদম বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এই মেয়েটির জন্য কেমন যেন মায়া লাগছিল।

রুনুর ওখানে যাব কী যাব না একটু দ্বিধা করছিলাম।
ভাবছিলাম পুরনো কোনও মায়াকে মায়া করতে নেই। তারপরও নিজের কাছে হেরে গেলাম। ক’দিন পর এক সন্ধ্যায় চলে যাই দলিপাড়া রুনুর বাড়িতে। বাড়ির গেটে নক্ করি। একজন মধ্যেবয়সী রমণী বের হন। আমি ওনাকে বলি — এখানে রেহেনা জোয়ার্দার রুনু নামে কোনও মেয়ে থাকে? মহিলা বললেন — বাসা ছেড়ে দিয়ে উনি আজ সকালেই চলে গেছেন। তা, আপনার নাম কী? বললাম — রঞ্জন।

মহিলা বললেন, আপনার একটি চিঠি আছে। এই কথা বলে ঘরের ভিতর থেকে একটি ইনভিলাপ এনে আমার হাতে দিলেন।

পথের উপর দাঁড়িয়ে চিঠিটি পড়ছিলাম —

“রঞ্জন,
দীর্ঘ রোগভোগের পর দেড়মাস আগে আমার স্বামী চলে গেছেন। ওকে ধরে রাখার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই শহরে নিজেকে কেমন নিরাপত্তাহীন ও একা মনে হচ্ছিল। তাই চলে গেলাম আমার ছোট্ট শহর ভেড়ামারাতে। জানি, ওখানেও ভালো লাগবে না। মন ছুটে চলে যেতে চাইবে অপার্থিব কোনও ছায়াপথ ধরে দূরে কোথাও। একটি স্কুলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াব। ওদের মাঝেই ভুলে থাকব আমার স্বামীর কথা। প্রতিদিন ঘরে সন্ধ্যায় আলো জ্বালাতে গিয়ে ওর কথা মনে করে দম বন্ধ হয়ে আসবে।

মনটাকে ভালো করার জন্য কোনও কোনদিন হয়তো একাকী হেঁটে চলে যাব পদ্মা পাড়ে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখব পদ্মার জল। পদ্মায় এত জল! কী যে ভালো লাগবে আমার! সেই জলে ছায়ার মতো দেখতে পাবো তোমার মুখ। ”
— রুনু।

~ কোয়েল তালুকদার

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত