কে এই অভাগী?

 

কে এই অভাগী?

অনেক দিন আগের কথা। এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা রাতে জয়দেবপুরের রাজেন্দ্রপুর রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছিলাম একটি লোকাল ট্রেনের জন্য। তখন বাসের যোগাযোগ এত ভালো ছিল না। ঢাকা আসার জন্য ট্রেনই ছিল একমাত্র ভরসা। চারদিকে শালবন বেষ্টিত এই স্টেশনটি সেই বৃষ্টির সন্ধ্যা রাতে ছিল প্রায় জনমানবহীন। ডাউন ট্রেন তাই লোকজনের অতো সমাগম ছিল না। অল্প কজন যাত্রী এলমেল ভাবে ঘোরাফেরা করছিল।

স্টেশন মাস্টারের কাছে খবর নিলাম। ট্রেন আসতে অনেক দেরি হবে। ট্রেন নাকি তখনও গফরগাঁও অতিক্রম করেনি। স্টেশনটিতে আলোর তেমন ঔজ্জ্বলতা ছিল না। সব মিলে তিন চারটি বাল্ব টিমটিম করে জ্বলছিল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝরছিল। রাত আটটা বেজে যায়, সাতটার ট্রেনের তখনও খবর নেই।

প্লাটফর্মের পূর্ব পাশে ছোট্ট চার দোকানের বেঞ্চে বসে চা আর সিগারেট খেয়ে সময় পার করছিলাম। হঠাৎ দেখি, পশ্চিম পার্শ্বে বিশ্রামাগারের ভিতর থেকে একটি বিশ একুশ বছরের মেয়ে বের হয়ে রেল লাইন ক্রস করে চায়ের দোকানের কাছে চলে আসছে। সে কখন বিশ্রামাগারে এসে বসেছিল খেয়াল করিনি। তার পরনে ছিল সালোয়ার কামিজ। মেয়েটিকে দেখে মনে হলো সে নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে হবে । তার চোখ মুখ খুবই বিমর্ষ লাগছিল।

আমার একটি লাজুক স্বভাব, কোনও মেয়ের দিকে সরাসরি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। আরও একটি অভ্যাস কোনও অপরিচিত মেয়ের সাথে আগ বাড়িয়ে কোনও কথাও বলি না। দেখলাম — মেয়েটি চায়ের অর্ডার দিল। এবং চা খেতে খেতে মেয়েটি আমাকে বলছিল — কোথায় যাবেন আপনি?
আমি : তেজগাঁও, ঢাকা।
বললাম – আপনি কোথায় যাবেন?
মেয়েটি : পিয়ারপুর। ময়মনসিংহ। অথবা অন্য কোন স্টেশনে।
আমি : কখন আসবে আপনার ট্রেন?
মেয়েটি : এখন কোনও ট্রেন নেই। ভোর চারটায় ট্রেন ।
আমি : এতক্ষণ কী করবেন?
মেয়েটি : জানিনা, কি করব।
আমি : বাড়িতে ফিরে যান।
মেয়েটি : এখানে আমার বাড়ি নেই। এখানে কেউ নেই।

মেয়েটির অসহায়ত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে একটু চিন্তাই করছিলাম। ভাবছিলাম, এই বৃষ্টিঝঞ্ঝা রাতে মেয়েটি একাকী এই স্টেশনে বসে থাকবে? একটু পর এই স্টেশন আরও জনশূন্য হয়ে যাবে। চায়ের দোকানটাও বন্ধ হয়ে যাবে। একটু চিন্তাই লাগছিল। মেঘাচ্ছন্ন আলো আঁধারে স্টেশনের পূর্বপার্শ্ব ধরে আমি ও মেয়েটি হাঁটছিলাম। বলছিলাম — এখানে কোথায় এসেছিলেন?

মেয়েটি : আজই এখানে এসেছিলাম। যার কাছে এসেছিলাম সে এখানে নেই। এখানে সে থাকে না। সে কোনদিন এখানে ছিলও না। আমি ঘর ত্যাগ করে তার কাছে সারা জীবনের জন্য চলে এসেছিলাম। এসে বুঝতে পারলাম, আমি প্রতারিত হয়েছি।

আমি : যার কাছে এসেছিলেন উনি আপনার কী হয়?
মেয়েটি : কিছু হয়না। উনি আমার কেউ না।
আমি : এই যে বললেন, ওনার কাছে সারা জীবনের জন্য ঘর ছেড়ে চলে এসেছিলেন।
মেয়েটি : সে অনেক দুঃখের কথা।

স্টেশনের অদূরে দেখি, সবুজ সিগন্যাল বাতিটি জ্বলে উঠেছে। আমি মেয়েটিকে বললাম — ঢাকা যাবার ট্রেনটি বোধহয় চলে আসছে। আপনি এখানে খুব একা হয়ে যাবেন। ভোর চারটে হতে এখনও অনেক দেরি । একাকী এই স্টেশনে অপেক্ষা করতে ভয় পাবেন না তো?
মেয়েটি : আমাকে সাথে করে এক রাতের জন্য আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবেন? কাল সকালেই চলে আসব।

আমি ভিতরে ভিতরে একটু বিব্রত হলাম। নতুন বিবাহ করেছি। এই রাতদুপুরে একটি অপরিচিত যৌবনবতী মেয়েকে নিয়ে বাসায় হাজির হবো, আমার নব পরিনীতা স্ত্রী কী ভাববে? এই কথা ভেবে মেয়েটিকে বললাম — তা সম্ভব হবে না। আপনাকে সাথে নিয়ে গেলে আমার নতুন সংসারে অমঙ্গল হবে।

মেয়েটি বলল, ও আচ্ছা। ঠিক আছে। আমি একাই এখানে এই স্টেশনে থাকতে পারব। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না।

আমি মেয়েটিকে স্টেশনের এই পাশে রেখে ওপাশে টিকিট ঘরের দিকে এগিয়ে যাই। টিকিট কেটে এসে স্টেশনের এই পাশেই দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তখনও ট্রেনটি আসেনি।

তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছিল। আলো আঁধারে মনে হচ্ছিল রেল লাইনের ওপাশ থেকে মেয়েটি আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। কেন জানি মেয়েটির জন্য খুব মায়া হলো। মনে হলো এই মেয়ে যদি আমার প্রেয়সী হতো তাহলে ঠিকই তো আজ আমি ওকে আমার ঘরে নিয়ে যেতাম। ও আমার প্রেমিকা না হোক, পথের একটি অসহায় মেয়েকে আমার ঘরে এক রাতের জন্য স্থান দিলে কী এমন ক্ষতি হবে? আমার নব বধূকে না হয় ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলব।

দেখি ট্রেনটি স্টেশনের দিকে চলে আসছে। ওপাশে মেয়েটি তখনো আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এপাশ থেকে মেয়েটিকে ইশারায় বললাম — ‘তুমি এই ট্রেনেই উঠবে। আমার সাথে ঢাকা যাবে।’

ট্রেনটি স্টেশনে এসে থামে। ট্রেনের আড়াল হয়ে যায় মেয়েটি। আমি ট্রেনে উঠে পড়ি। ওপাশে তাকিয়ে দেখি, মেয়েটি দাঁড়ানো নেই। ভাবলাম, ট্রেনের কোনও কামরায় হয়ত সে উঠে পড়েছে। স্টেশনের বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একটু পরে ট্রেনটি বৃষ্টি আর রাতের অন্ধকার ভেদ করে ঢাকার দিকে চলে আসতে থাকে।

তেজগাঁও স্টেশনে নেমে আবারও খুঁজলাম মেয়েটিকে। কোনও কামরা থেকেই সে আর নামল না। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। ঢাকার রাতের আকাশে কোনও মেঘ নেই। নিয়ন আলোয় আলোকিত হয়ে আছে রাজপথ। স্টেশন থেকে একটি রিক্সা নিয়ে নাখাল পাড়ায় আমার বাসায় চলে আসি।

তারও একদিন পরে ইত্তেফাকের তৃতীয় পাতায় একটি নিউজ হেডিং দেখতে পাই — ” কে এই অভাগী? ” ভিতরে ছোট করে খবরে লেখা ছিল — ‘ গত পরশু রাত সাড়ে নয়টার দিকে রাজেন্দ্রপুর স্টেশনের কাছে ঢাকাগামী একটি লোকাল ট্রেনের নীচে কাটা পড়ে বিশ একুশ বছরের অজ্ঞাতনামা একটি মেয়ে মারা গিয়েছে। জিআরপি পুলিশ লাশটির ময়না তদন্তের জন্য জয়দেবপুর সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। ময়না তদন্তে জানা যায় মেয়েটি দুই মাসের অন্তসত্তা ছিল। এ ব্যাপারে জয়দেবপুর সদর থানায় একটি মামলা রজ্জু করা হয়েছে। ‘

তারপর কত বছর চলে গেছে। ঐ মেয়ের কথা কখনও মনে পড়ে, কখনও পড়ে না। কিন্তু এখনও কোনও ট্রেনের চাকার ঘস্ ঘস্ শব্দ শুনলে ঐ অভাগী মেয়েটির আর্তনাদ আমি শুনতে পাই। কানে বাজে একটি মিনতি — ‘আমাকে একটি রাতের জন্য সাথে করে নিয়ে যাবেন আপনার বাড়িতে? ‘

~ কোয়েল তালুকদার

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত