সানোয়ার’নামা

আজ সকালে সানোয়ার মারা গেছে। বয়স সতের কি আঠারো। বৈদ্যুতিক তারের অমনোযোগী সংস্পর্শ ওর প্রাণ কেঁড়ে নিয়েছে।

কে এই সানোয়ার?

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে বৈদ্যুতিক প্রহসনের খেলায় প্রতিনিয়ত মরছে যারা। ওদের একজন সে। এটাই ওর পরিচয়।

ওর আরেকটা পরিচয় আছে। ও নিঃসন্তান চাচার একমাত্র অবলম্বন। মা-বাবার শেষ আশ্রয়স্থল। অসুস্থ, ভাইয়ের একমাত্র খেলার সাথী। বাড়ির চৌকাঠে অপেক্ষমান বোনদের, আদরের রাজপুত্র।

নিভু নিভু করা বংশের একমাত্র উজ্জ্বল বাতি।

আমরা এমন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বাস করি যেখানে সানোয়ারের এই নীরব হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেও কথা বলবে না। এ তো এক্সিডেন্ট! ইশ সানোয়ারের মা যদি সময়মত মেইন সুইচ বন্ধ করতো! বোনটার মাথায় যদি আরেকটু বুদ্ধি থাকতো?

ছেলেটাকে কীভাবে বাঁচানো যেত, এই আলোচনা সর্বত্র।

এ মৃত্যু সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। পাড়া পড়শির হয়তো দুই দিন খেতে কষ্ট হবে, বন্ধুদের মুখ দিনকয়েক মলিন থাকবে। চারদিনের মাথায় ঐ মরা বাড়িতে আসর বসবে। মাংসের বাটি নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে। বাহার বাবুর্চি সেরা নাকি শেখ আহমদ বাবুর্চি, এ নিয়ে দলাদলি হবে।

সানোয়ারদের বাড়ি কবরস্থানের পাশে। আজ থেকে ঐ বাড়িটাও কবরস্থানের অংশ। বাড়ির ছেলে বাড়ির বুকেই ঘুমাবে। শুধু একটা অংশে কিছু জীবিত লাশ আনাগোনা করবে। আদরের ছেলের খাওয়া নিয়ে মা-চাচী উতলা হবে না। ছোট্ট ভাইটি আর খেলার বায়না করবে না। বোনেরা চৌকাঠে আর প্রতীক্ষার প্রহর গুনবে না। ও বাড়িতে প্রহর বলে কিছু থাকবেই না। এই নবনির্মিত মৃত্যু উপত্যকায় সময় চিরতরে থমকে যাবে।

মানুষ কি সত্যিই তার প্রস্থান আঁচ করতে পারে? সানোয়ারের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো ঈদের দিন।

তবে কি সেদিন আমার পা ছুঁয়ে সালাম করতে চেয়ে এক জনমের দায়িত্ব শেষ করতে চেয়েছিলি?

স্পষ্ট মনে পরে, পিছনে সরে গিয়ে রেগে তোকে বেকুব বলে ধমকে দিয়েছিলাম।

বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে, ঐ মৃত্যুমাখা তারে হাত দিয়ে তুই নিজেকে আবারো মহাবেকুব প্রমাণ করেছিস। মরন ই তোর প্রাপ্য। এই মহাপ্রবঞ্চক সময়ের মিথ্যা সমাজে তোর মতো বেকুবের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

আমরা সাফল্য আর অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসি, একটা বিদ্যুতের খুঁটি নাড়িয়ে। এই মৃত্যু কি আমাদের বিবেক নাড়াতে পেড়েছে?

সেবককে আমরা যারা সমালোচনার অনেক উপরে উঠিয়ে দিয়েছি। সেখান থেকে একটু টেনে নামিয়ে, সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন করার সৎসাহস কি দেখাতে পারবো?

যেই রাষ্ট্রের এতো সক্ষমতা, সেই রাষ্ট্রের কি বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিশ্চয়নের সক্ষমতা হয়নি?

যে রাষ্ট্রে গাছের ডালে ডালে নেতার ব্যানার ঝুলে, সেখানে কেন একটা তাজাপ্রাণ নিজ ঘরে ঝুলে যাবে?

যেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সম্ভাবনার খাত উন্মোচন হচ্ছে, সে একই রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতায় কেন একটা সুখী পরিবারের কবর রচিত হচ্ছে?

এমন আরও অনেক প্রশ্ন আছে, কোথাও কোন সদুত্তর নেই। গরম গরম লাশ আর ইস্যু দাফনে সংশ্লিষ্ট দুর্জনদের ছলের অভাব হয় না।

——————-

সময় বড়ই প্রবঞ্চক। সময়ের এই আজব খেলায় আজকে আমরা যারা অতিচালাক। যারা এই অন্যায়ের নীরব সমর্থক। আমাদের হিসাবও একদিন হবে। যিনি সময়ের স্রষ্টা। প্রতিবিন্দু সময়ের হিসেব তিনি সুদে আসলে নিবেন।

সকালে সানোয়ার যখন ঐ তারে ঝুলে ছিল। মেঘের গর্জনে ওর মায়ের গগনবিদারী আর্তনাদ কেও শুনতে পায়নি। যিনি এই বিশাল আকাশের স্রষ্টা তিনি ঠিকই শুনতে পেয়েছেন। বৃষ্টির পানি, আজ ওর মায়ের চোখের পানি হয়তো ধুয়ে দিয়েছে। কিন্তু কতদিন? সানোয়ারের মায়ের চোখের পানি ঠিকই একদিন বজ্র হবে।

একটা বংশের একজনমের চোখের পানির হিসাব আমাদের একদিন দিতেই হবে।

আমাদের এতো অর্থ, এতো সফলতা, এতো প্রভাব কি সেদিনের হিসাব মেলাতে কাজে আসবে?

আমাদের অতিবুদ্ধি দিয়ে গড়া পরিকল্পনা কি পারবে আলিমুল গায়েবকে মোকাবেলা করতে?

নিশ্চয়ই তিনি মহাপরিকল্পনাকারী।

 

বাসাবো, ঢাকা

১৫ ই আগস্ট, ২০১৭

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত