গুনগুনান্তি চৈনাক

এক মেঘমেদুর দিনে, যখন ধোঁয়া ওঠা আগ্নেয়গিরির মতো ধূসর ছাইরঙ , মেখে দিয়েছিল নব্দীপুরের আকাশ, তখন মেজাজ গরম করে রইতন বসে ছিল নিঃসঙ্গে । রইতনের চোখে ছিল বরবটির শাক, নারকেলের ঝুরি, কলাইয়ের ঝুন । রইতন চেয়েছিল আজ দুপুরে ভরপেট খেয়ে ঘুম দিতে, যে ঘুমে দেখা যায় ছয় বছর আগে চলে যাওয়া খুমতিকে । রইতনের মনে হয়েছিল, বিয়ানবেলায় সাদা সাদা আকাশ ঝাপ খুললে মানুষের মনে বুঝিবা স্বপ্ন আসে ! হয়ত এক ফাঁক দিয়ে চকচক করবে , ভুলে যাওয়া কোনদিন দেখে ফেলা আশা ।

ওদিকে ভাগ্য আড়ালে পিঁড়ির উপর বসে নিশ্চয়ই খই খাচ্ছিল আর হো হো হাসছিল – নয়তো এই এদিকে ঝুরঝুরে ঘাসের জমিনে বসে রইতন কেন দেখল – ও সবই ঝুট – মিছা কথা । বরং সত্য এই , কিছু কিছু দলছুট ঘোড়া থাকে , জন্ম থেকে দৌড়ায় মৃত্যুর রশি পাতা আছে জেনে । বাস্তবিক স্বস্তি-মোহ-অর্থ-সুখ-প্রেম , এই দলছুট অহেতুক ঘোড়াদের তারা কোনোদিন দানদক্ষিনা করেনি ।

বাজারের বড়ঘরে টিভিতে মারদাঙ্গা কিরকেটের ম্যাচ হয় – হল্লা কানে আসে । রইতনের ঢিলাঢালা প্যান্টের পকেটে একশ তিরাশি টাকা । কিরকেটের বাজিতে গতকাল খুইয়েছে সাতশ । আজকাল টানাটানি – অতএব রইতন মাটিতে কাত হয়ে পিলপিল পিঁপড়ার সারি দেখে । মাঠের গর্তে তারা জড়ো করে আসন্ন শীতের খোরাক – তারা সুখে আছে । রইতনের মনে পড়ে , একদিন শেষরাতে খুমতির জন্য রঙ্গিন কাগজ কেটে বানিয়েছিল , চারকোনা চিঠিরাখা খাম । খুমতি হারিয়ে গেছে – যেমন হারায় সকাল হলে, রাতে মেশা ফুল । অথচ পিঁপড়াও জমা করে তার জুতি । রইতন হেঁটে হেঁটে বাজার পেরিয়ে যায় নদীঘাট চারমনি বন ।

একটা ডালঅলা ঝোপালো দেখে কড়াইয়ের তলে বসে রইতন আপন মনে বলে, যাঃ শালা , যাক সব বরবাদ হয়ে । হু হা হা-এ কি নাট্যশালা !
কে যেন বলে ওঠে, ‘ ঠিক তাই রইতন । এ নাটকের জনরা খোঁজো দেখি -‘
রইতন বিহ্বল হয় । কে কে ? কে কথা কয় –
আওয়াজ আসে, ‘আমি কড়াই । ‘
রইতন চোখ পিটপিট করে । কিছুক্ষণ থেমে বলে, হবেও বা ! তা যা বলছিলে- এ নাটকের অঙ্ক কী তাইতো ?
কড়াই ঝনঝন করে নিঃশ্বাস ফেলে, নড়ে ওঠে সবগুলো পাতা । বলে, ‘ পারবে বলতে? ‘
রইতন ভেবে ভেবে গম্ভীর মুখে বলে, পারব না তো কি ছাই – এ নাটক হলো ট্রাজেডি ঘরানার । শালা এরিস্টটলের বাচ্চা ঐ যে দিয়ে গেছে ভাগ করে । জানো নাকি ?
কড়াই ডালগুলো নিচু করে ধরে ।রইতনের মনে হলো, বিশাল এক প্রাণীর মতো গাছটা যেন বসে পড়ল । আড্ডা দেবে বুঝি ! কড়াই বলে,
‘এইযে ভুল করলে ! ট্রাজেডিতে কি এত দীর্ঘ ভোগান্তি থাকে ? ‘
তাহলে কী ? কমেডি ?
‘না না , কমেডির মতো স্নিগ্ধ তো নয় । ভুল করে হাসা যায় – এমন মধুর গোটা ব্রক্ষান্ডে তুমি পাবে না । ‘
রইতন ঠোঁট উল্টে বলে , মেলোড্রামা ?
কড়াই তার বিরাট ডাল এদিক ওদিক নাড়ে । রইতন বুঝল, না বুঝাচ্ছে । বলল, মেলোড্রামাই ত হবে বোধহয় । কড়াই বলে, ‘কেউ ত অমন খেয়ালি নয় । সকলেই বড্ড সেয়ানা । ‘
ফার্স ? ট্রাজিকমেডি ?
কড়াই চুপ করে থাকে । রইতন মাথা চেপে ধরে । বলে, তাহলে ? তাহলে ?
কড়াই বলে , ‘ রইতন, এই নাটকের নাম গুণগুনান্তি চইনাক । ‘

রইতন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । বলে, ধাপ্পা মারছো শালা তুমি !
কড়াই বলে চলে , ‘ গুনগুনান্তি চইনাক- হাঁ ঠিক তাই – গুনগুনান্তি চইনাক – যার অর্থ হলো, তোমার সামনে একটা রাস্তা আছে, তুমি সেই রাস্তায় চলতি পথে হঠাৎ দেখবে, এই রাস্তায় সুয্য ডুবে গেছে । এরপর তোমার ভেতর থেকে বলা হবে, চান্দের আলোয় রাস্তা হাঁটো । যখন উঠে দাঁড়াবে, তখন দেখবে চান্দ ঢেকে গেছে মেঘের ভেতর । তখন ভাববে, তাতে কি ! আকাশজোড়া তারাগুলোকে মহাকারিগর কি এমনি এমনি বসিয়ে দিয়েছেন ! আমি ওর আলোতেই যাবো । যেই না পা বাড়াবে,ধপ করে দেখবে সুয্য উঠে গেছে । কিন্ত, কিন্ত, ভালোমত চোখ রগড়ে দেখলে, সেই রাস্তাটাই হারিয়ে ফেলেছো তুমি । – এরই নাম গুণগুনান্তি চইনাক । ‘

রইতন হা করে তাকিয়ে ছিল । শেষ হতেই ত্যাক্তবিরক্ত মুখে বলে, ওরে বাপরে -এ তো মহা ফ্যাসাদ দেখছি !
কড়াই বলে, ‘ খুব খুব । বড্ড প্যাঁচ । ‘
রইতন হাত ঝেড়ে সোজা হয়ে বলে, হে গাছ, হে বৃক্ষ , এইসব ঝুটঝামেলায় আমি নাই , এইযে কসম করে বসে থেকে বলছি শোনো, অবশেষে আমি রইতন, অদ্য দ্বিপ্রহরে এই চারমনি বনের কড়াইয়ের নিচে নিজেকে আজ দেউলিয়া ঘোষণা করলাম ।

কড়াই চুপ করে রইলো । রইতন আবার চোখ পিটপিট করে । হে গাছ, কিছু তো বলো –

কড়াইয়ের ডালে ডালে শিরশির বাতাস পড়ে । শনশন শনশন । ভ্রিম ভ্রিম দুটো ডাল মটমট করে আড়মোড়া ভাঙ্গে বুঝি ! তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে হেলেদুলে বলে,
‘ রইতন , তুমি কবে দেউলিয়া ছিলে না বলতে পারো ? ‘
মানে ?
কড়াইয়ের হাসি শোনা যায় নদীর ওপার থেকে । শোঁ শোঁ ঝড়ই ওঠে বা ! কড়াই হাসতে হাসতে কাশতে কাশতে বলে,
‘ রইতন, তোমরা সকলে দেউলিয়া । শুধু জুতমত একদিন টের পাওয়া বাকি । ‘

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত