শাড়ি

রিভলভিং চেয়ারটা দু’বার দুলিয়ে নিয়ে আয়েশ করে বসলেন নীলিমা। নীলিমা হক। ঘড়ির হীরেগুলোতে আলো পড়ে চোখধাঁধানো বিচ্ছুরণ হল। ডিকটেশন নিতে থাকা ছেলেটিকে আরেকবার দেখে নিলেন আড়চোখে।

বিমান-ক্রুদের মতো দেখতে। ফর্সা গোলাপি গালে শেভ করা দাড়ির নীলচে আভা। এরকম অতি সুদর্শন ছেলেদের কেন যেন কখনোই ভালো লাগে না নীলিমার। অনেকটা সময় আটকে রেখেছেন ওকে। স্মার্ট এবং নিজের সৌন্দর্যের উপর যথেষ্ট আস্থাশীল ছেলেটি। কোনোরকম অস্বস্তি ছাড়া বোল্ডলি দাঁড়িয়ে আছে। যেন বা নীলিমা হক যদি তাকে অন্যভাবেও পছন্দ করেন তাতে আপত্তি নেই কোনো। বরং আগ্রহ আছে। নীলিমার মতো সুন্দরী, ব্যক্তিত্বময়ী, প্রখ্যাত বসের কাছ থেকে সুযোগসুবিধা পেতে কতজন মুখিয়ে থাকে। সে আর এমন কী! ধৈর্য পরীক্ষা নিতে ভালোই লাগে নীলিমার। আত্মতুষ্টিতে ভোগে। তাঁর নিজের স্মার্টনেস আরও অনেক বেশি। ভালো করেই জানেন, বড়শির মাছ কী করে খেলাতে হয়। যত্রতত্র যারতার সাথে নিজের ওজন হারানোর অভ্যেস থাকলে আজকের অবস্থানে আসতে পারতেন না।
মনের মিল হলে এসব ব্যাপারে আপত্তি থাকার কিছু নেই বলেই ভাবেন। তবে হ্যাঁ, মেয়েদের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করা, আজেবাজে মন্তব্য করা লোক দু’চোখে দেখতে পারেন না। পুরুষদের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার প্রধান ও একমাত্র শর্ত-মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তারপর অন্যান্য গুণাগুণ বিবেচনায় নেবার প্রশ্ন।

একটু সতর্ক হলেন নীলিমা। ছেলেটা আসলে একটু বেশিই সুন্দর। বুক চিরে বেরুতে চাওয়া দীর্ঘশ্বাসটা কায়দা করে বুকেই ভরে নিলেন নীলিমা। ওকে বিদেয় দিয়ে চেয়ার ছেড়ে জানালার পাশে দাঁড়ালেন। এদিকটায় বন্দর এলাকা। সমুদ্র দেখা যায়। এভাবেই ডিজাইন করিয়েছেন রুমের। রোজ একবার অন্তত যাতে সমুদ্র দেখতে দেখতে উদাস হতে পারেন।

রুমের বাইরের লাল সংকেত-বাতিটি জ্বালিয়ে আঙুলের ফাঁকে ধরা বেনসন সুইচটি ধরালেন। জেটিতে মাল ওঠানামা দেখতে দেখতে মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়লেন। গত কয়েকদিন হলো, বেশ বড়সড় একটি শিপ ভিড়েছে বন্দরে। মালামাল খালাস চলছে ট্রেলারে করে। এ দৃশ্য দেখা এখন রোজকার অভ্যেস হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের সৌন্দর্যে চিরকালই মোহিত নীলিমা। সমুদ্র আর পাহাড়ের মোহ কাটে না কিছুতে। বকের পালকের মতো শুভ্র আকাশে নীল নীল মেঘের ছোপ। যেন জলরঙে আঁকা কোনো ক্যানভাস। পশ্চিম দিকটাতে লালচে বেগুনি আভা ফুটে আছে। বাতাসের ধাক্কায় উড়ে চলেছে সারিসারি মেঘ, চঞ্চল প্রজাপতি যেন বা।

বিশাল বড় প্রতিষ্ঠান জে কে সার্ভিসের চেয়ারম্যান নীলিমা হক। কিন্তু কোথায় যেন শূন্যতা। কী যেন নেই তার! শুরুর জীবন ছিল অপমান আর গ্লানির। বেদনা আর সংগ্রামের। জিরো থেকে নয়, বলা যায় মাইনাস থেকে উঠে এসেছেন আজকের অবস্থানে। হাজবেন্ডও এখানকারই ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
কিছু মানুষ থাকে যাদের কোনো ক্ষেত্রেই উল্লেখ করবার মতো কিছু থাকে না। সেটা তারা জানেও না বা জানার চেষ্টাও করে না। আরও মজার ব্যাপার হলো, জানানো হলেও নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনার বা নিজেকে উন্নত করার কোনো চেষ্টা বা তাগিদও তাদের মধ্যে দেখা যায় না। বরং মনে করে তারাই সঠিক। এইরকম একজন মানুষ নীলিমা হকের স্বামী।
এ শহরের অত্যন্ত স্টাইলিশ একজন নারীর একেবারে স্টাইললেস একজন স্বামী। এ নিয়ে কানাঘুষাও বিস্তর। বাজারে, অফিসে, শহরে সর্বত্র। সবাই যেন তক্কেতক্কে থাকে কখন শুনবে, তাঁদের সংসার ভেঙে গেছে। শত্রুদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে প্রতিদিনই সংসার টিকে যায় নীলিমা হকের। সবই বোঝেন নীলিমা। কিন্তু কিছুই করার নেই। এ দেশে এখনও পর্যন্ত সেপারেটেড বা ডিভোর্সি মেয়েদের কোথাও কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। সংসার টিকে থাকলে সবক্ষেত্রে বাড়তি কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। লোকজনের বেহায়াপনা থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা যায়। ক্যারিয়ার গতিশীল করা যায়। নীলিমা হক উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ তাঁর চরম অপছন্দের। উত্তরোত্তর নিজেকে সমৃদ্ধ করার পক্ষে তিনি। যেকোনো মুল্যে সফলতা তার চাই-ই চাই।
সফল হতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে ঠকিয়েছেন নীলিমা হক। স্বামীকে কখনই ভালবাসতে পারেন নি। সামাজিক প্রয়োজনের অনুসঙ্গ ভেবে মেনে নিয়েছেন তাকে। এখান থেকে বের হবার সব রকমের সুযোগ ছিল তাঁর। কিন্তু বের হন নি। আশ্চর্য মানুষের মন। অভ্যাসেই যেন বেশি নিরাপদ বোধ করে। কোনো সুখী, সমর্থ দম্পতিকে আনন্দ-ফূর্তিরত অবস্থায় দেখলে মন বিষিয়ে ওঠে তাঁর। সহ্য করতে পারেন না কিছুতেই।

সমুদ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে বামে তাকালে রুমের দেয়াল জুড়ে মস্ত বড় আয়না। রোজকার মতো নিজেকে দেখেন নীলিমা। তেমনই যৌবনবতী রয়েছেন। এতটুকু ক্ষয় হয় নি। কমেনি সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র। বরং কিছু কিছু জায়গা ভরাট হয়ে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। নিজেকে, নিজের সৌন্দর্যকে, নিজের শরীরকে খুব বেশি ভালোবাসেন নীলিমা। সবসময় সচেতন থেকেছেন। আর যাই হোক সৌন্দর্য নষ্ট করা চলবে না।

একফালি ছায়া এসে পড়েছে বিকেলের। আকাশেও দ্রুত আনাগোনা বেড়েছে ছাইরঙা মেঘেদের। রাতে হয়ত বৃষ্টি হতে পারে। স্বচ্ছ কাচের ভেতর দিয়েও টের পেলেন বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে।
নীলিমা হকের নেই শুধু প্রশান্তিটুকু। কোথাও যেন স্থির হতে পারেন না। কিছুতেই যেন শান্তি পান না। কী যেন নেই, কী যেন নেই- উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কত রাত যে ভোর হয়েছে। কখনো কখনো মনে হয়েছে, কিছু ব্যাপার বোধহয় স্বামী-স্ত্রীতে ঠিক হয়ে ওঠে না। পারস্পরিক প্রকাশ সম্ভবত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সবচে’ কম। এই সম্পর্কে তৃপ্তির চেয়ে অতৃপ্তির রেশই বেশি জেঁকে ধরে। প্রকৃতপক্ষে নিজেও কখনও প্রকাশিত হন নি সেই অর্থে। ব্যর্থ মনে হয়, নিঃস্ব মনে হয়, একান্ত একা মনে হয় নিজেকে। তবু তা মন্দের ভালো। অভিনয় করা যায়। ছদ্মবেশ দেখানো যায়। সুখের মুখোশ পড়ে থাকা যায়। হোক না ভান। তবু তো পৃথিবীকে দেখানো যায়-আমি সুখী।

তবে মাঝেমাঝে উচ্ছৃঙ্খল হতে ইচ্ছে হয়। প্রতিটি সৌন্দর্য উন্মুখ হয়ে থাকে সোহাগে সোহাগে প্রশংসিত হতে। উন্মত্ত শিহরণগুলো ঢেউ তোলে। বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিদ্রোহ করতে চায়। উন্মাদনা জাগায় শিরায় শিরায়।

পরক্ষণেই আবার ভয় হয়। অপবাদের আশঙ্কা তাঁকে মিইয়ে দেয় মুহূর্তেই। অনেক কষ্টে পাওয়া আজকের অবস্থান, সাফল্য, স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে ফেলবার আশঙ্কা জাগে। ভয় হয়। প্রচণ্ড ভয়।
অথচ একটা সময় কে কী ভাবল, তা থোড়াই কেয়ার করতেন। দুর্নামও জমেছিল তখন অনেক। মূল কারণ ছিল- তাঁর মাতাল করা রূপ, অসামান্য বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতা।

যেকোনো পুরুষের চোখে এখনও মোহনীয় নীলিমা। সারাজীবন পুরুষের চোখে দেখে এসেছেন চমকে ওঠার মতো হাতছানি। লোলুপ ইশারা। আজও তা অটুট আছে, জানেন নীলিমা। তাঁর মিষ্টি কণ্ঠ, আবেদনময়ী দেহভঙ্গি, ঋজু চালচলন আর মোহনীয় হাসি এখনও পাগল করে তোলে পুরুষদের।

একদম বিপরীত মেরুর দুজন মানুষ এক ছাদের নিচে কাটিয়ে দিল সারাটি জীবন। নীলিমার ধারণা, তাঁর স্বামীর জীবনও খুব একটা সুখকর হয় নি নীলিমার সাথে। দাম্পত্যজীবনে স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তিই ছিল বেশি। নীলিমার পাশে বেমানান তিনি। সন্দেহ, অনিশ্চয়তা আর মনোব্যথায় কেটেছে তাঁর। অন্যদিকে নীলিমার কেটেছে মন থেকে, শরীর থেকে গ্রহণ করতে না পারার অতৃপ্তি নিয়ে। তারপরেও ওরা সংসারী। এক সন্তানের বাবা-মা। সমাজ-সংসার তাই জানে। এতে তাঁদের সুবিধা হয়।

আয়নার দিকে আবার চোখ পড়ল নীলিমার। নেভি ব্লু অর্গ্যাঞ্জা জমিনে রূপোলী জরির কাজ করা শাড়িতে দারুণ ব্যক্তিত্বময় লাগছে ওকে। ড্রেস- আপ, গেট- আপ, চালচলনে নীলিমার উপস্থাপনের কোনো তুলনা নেই। রূপের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের ঝলক তাকে অপরূপা করেছে। বিজনেস সেক্টরে এক নামে সবাই চিনে নীলিমাকে। রূপ আর গুণের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়েছে। মানুষকে মুগ্ধ করে, মুগ্ধতায় ভরে দিয়ে অনির্বচনীয় সুখ, তৃপ্তি আর আনন্দ পায় সে। শুধু নির্দিষ্ট করে কারো কাছে ধরা দিতেই যত আতঙ্ক। এতদিনের সাধনা যদি ভেঙে পড়ে, তলিয়ে যায়।

দারিদ্র, অভাব, অনিশ্চয়তাকে ভীষণ ভয় নীলিমার। শারীরিক বা মানসিক তৃপ্তির বিনিময়েও কোনো ধরণের অনিশ্চয়তা চান না। এর চেয়ে নিজেকে দমন করে রাখা, অপ্রকাশিত থাকা অনেক সহজ। রাজ্যপাটের চাবি হারাতে চান না তবু কিছুতে।

পোশাক হিসেবে নিজের জন্য শাড়ি পছন্দ করলেও, মহিলা কলিগদের জন্য অফিসে শাড়ি পরা নিষিদ্ধ করেছেন। চাকুরীর শুরুতেই বেশকিছু শর্তের মধ্যে এটি অন্যতম। শাড়ি পরে উচ্ছাস, উচ্ছলতা একদম সহ্য করতে পারেন না। শুধুমাত্র এই একটি কারণেই গিফট পাঠিয়ে দিয়েও বিয়ের অনুষ্ঠানে যান না। শাড়ি, গয়নাপরা বউয়ের ন্যাকা ন্যাকা হাসি দেখলে গা জ্বালা করে নীলিমার।
আয়নার ভেতর তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ এক বিয়ে বাড়ি দেখতে পান নীলিমা হক। যে দুঃস্বপ্নটি তাকে এখনও প্রতিনিয়ত তাড়া করে।

বিয়েবাড়ির বউটির বয়স উনিশ-বিশ হবে বড়জোর। কৈশোরের ছাপ এখনও মুছে যায় নি পুরোপুরি। উঠতে বয়সের আবেগে ভেসে করা ভুল। আর সেই ভুলের মাসুল-এই বিয়ে। জীবনের জটিল হিসেবনিকেশের কিছুই জানা ছিল না ভুল করা টিন-এইজ মেয়েটির।

টুকটুকে লাল শাড়ি পরানো হবে আজ কচিমুখের বউটিকে। বরের বাড়ি থেকে আসা স্যুটকেসটি খোলা হলো। খালা-ফুপুগোত্রের আত্মীয়েরা ঘিরে আছে তাকে। শাড়ির ভাঁজ খুলতেই বেরিয়ে এল লন্ড্রির ট্যাগ আর নিউজপ্রিন্টের কাগজ। কে যেন বউটিকে চিমটি কেটে কানে কানে কী সব বলল। কিছুই শুনতে পেল না, বুঝতে পেল না হতবিহবল বউটি। বাবার বাড়িতে আদরের মেয়ে ছিল সে। ছোট্ট এই জীবনে কোনো অপমান কিংবা গ্লানির মুখ তো দেখে নি! পরিচয়ও নেই সেসবের সাথে।
বহুদূর থেকে যেন ট্রেনের হুইসেলের মতো ধ্বনি ভেসে আসতে থাকে। শৈশবে চলে যায় মেয়েটি। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে সবাই মিলে নানুবাড়ি যাচ্ছে। জানালার পাশে বসা নিয়ে পিঠেপিঠি দুই বোনের মিষ্টিমধুর ঝগড়া। কাজিনরা সবাই মিলে ঈদের চাঁদ দেখার উল্লাস! ঈদের কাপড় লুকিয়ে রাখার আনন্দ-কেউ যেন দেখতে না পায়।

যান্ত্রিক ধ্বনির তীব্রতায় দু’হাতে কান চেপে ধরে। চারপাশের সমস্ত তীক্ষ্ণ, অস্পষ্ট শব্দ পেছনে ফেলে পালাতে চাইল ছোট্ট বউটি। শাড়িটি পরতে চায় না। সায়া আর ব্লাউজ পরেই দৌড়ুচ্ছে পরির মতো অপরূপ সুন্দরী সে মেয়েটি। ছুটছে তো ছুটছেই। ছুটছে তো ছুটছেই। বিয়ের আসর থেকে পালাতে। লন্ড্রীর ট্যাগ থেকে পালাতে। নিউজপ্রিন্টের কাগজ থেকে পালাতে। ব্যাঙ্গাত্বক ভ্রুকুটি থেকে পালাতে। অপমান আর গ্লানিকর চাহনি থেকে পালাতে। কানাকানি, ফিসফাস থেকে পালাতে। বদনাম থেকে পালাতে। সর্বোপরি জীবন থেকে পালাতে। দৌড়ুতে দৌড়ুতে হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে মেয়েটি। সর্বশক্তিতে চেপে ধরে নিচের পেটটি। জীবনের ভ্রুণ নিজের ভেতর ধারণ করে জীবন থেকে পালানো যায় কি?

পায়ে পায়ে ফিরে আসে মেয়েটি। সবকিছু মেনে নেয়ার মানসিকতা নিয়ে ফিরে আসে। পরাজিতের বেশে ফিরে আসে। জীবনের ভেতর জীবনকে বাঁচিয়ে দিতে ফিরে আসে। পরাজিত মানুষই পারে জীবনকে জিতিয়ে দিতে!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত