স্বপ্নবিত্তান্ত

– নাহ, এইভাবে আর কত! ধুশ শালার!

এই জীবনের প্রতি বিরক্তি এসে গেছে কালুর। ছেলেবেলায় কোনো কিছু বোঝার আগেই মায়ের কাঁধে তাকে তুলে দিয়ে বাপের অন্তিম যাত্রা। বাবার মুখ কেমন হয় জানা নেই ওর। অন্যদের বাবার মুখে নিঃশব্দে অনাথ কালু ওই মুখ খোঁজে। এখনো।

একগাদা গোবরখাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মাথার উপর চিড়বিড় করা রোদে মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে যায় কালুর। নিজের জমিজমা বলতে কিছু নেই তার। বাবা তার দাদার কাছ থেকে কিছু পায়নি, নিজেও জায়গাজমি করার সুযোগ করে ওঠতে পারেনি। তার আগেই কিনা…

রউফ তালুকদার বলেছিলেন, শনিবার সকাল থেকেই গোবর নামাতে হবে ক্ষেতে। টমেটো, বরবটি, লাউ, শীমের ক্ষেত রয়েছে তালুকদারের। ধানী ক্ষেতের তো অভাবই নেই। বলতে গেলে সারাবছর তার ক্ষেতেই কাজ করে কালু। ক্ষেতে বীজধান ছড়ানো থেকে শুরু করে সেই ফসল তোলা পর্যন্ত সবধরনের কাজ। জালা রোয়া, আগাছা বাছা, নিড়ানি দেওয়া, সেই ধান কাটা, তারপর মাড়া দেওয়া। সব, সব।
কালুর মা-ও তখন কাজ করে তালুকদারের বাড়িতে।

গোবরখাদে দাঁড়িয়ে কালু অপেক্ষা করে গাজীর। গাজী, কালু আর পশ্চিমপাড়ার রহিম- এই তিনজন ছাড়া এই বিস্তীর্ণ জমিতে একা এত গোবর নামানো সম্ভব না। রহিম শালা গেছে আবার শ্বশুরবাড়ি!

খাদের পাড়ে এসে একটা বিড়ি ধরায় সে। শীতের এই সময়টাতে বিড়ির উৎকট গন্ধটা মাথার মধ্যে একটা অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি দেয় কালুর। এমন সময় কারো পায়ের শব্দে সচকিত হয় সে। খাদ ঘেঁষে মেঠোপথটার দিকে তাকায় কালু। তালুকদারের মেয়ে জোনাকি। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীটা পাল্টে যায়। ঝলমল করে ওঠে চারদিক। গোবর থেকে ভেসে আসে অচেনা কোনো সৌরভ। আনমনেই সে গেয়ে ওঠে-

সাজাবো তোমাকে আমার মনের মত করে
সাথী হয়ে আসো যদি আমারি ঘরে…

কিন্তু সেই ভালোলাগা বোধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। রহিমের পাঁজুনের গুঁতোয় বন্ধ হয়ে যায় কালুর গান। শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসেছে বুঝি। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ি পড়ে থাকলে খাবার আসবে কোত্থেকে!

রহিমের গুঁতোয় হোক কিংবা সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রমের কারণেই হোক মেজাজটা আবার খিঁচড়ে যায় কালুর। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে মনে মনে খোদার প্রতি বিরূপ হয় সে। আচ্ছা, খোদা ইচ্ছা করলে কী না হয়! তার জীবনটা কি অন্যরকম হতে পারতো না! জীবনে সে সুখী হলে কার কী এসে যায়! কার কী এমন ক্ষতি জোনাকিকে বউ হিসেবে পেলে!

ভাবতে ভাবতে চিৎকার করে ওঠে তালুকদার বাড়ির কাজের মানুষ, জোনাকিদের বাড়ির চাকরতূল্য কালু-

– নাহ, এইভাবে আর কত! ধুশ শালার!

.

সেই চিৎকারে-

ঘুম ভেঙে যায় মন্ত্রীর
ঘুম ভেঙে যায় উজিরের
ঘুম ভেঙে যায় নাজিরের।

সন্ত্রস্ত পায়ে প্রাসাদে দৌড়ে আসে পাইক-পেয়াদা, সৈন্য-সামন্ত আর রাজ্যের জনগণ।

মখমলের বিছানা থেকে ধড়ফড় করে ওঠে বসেন সম্রাট কালমীর। তাঁর সেবায় নিয়োজিত তখন জনাবিশেক পাইক-পেয়াদা। পাশে উৎকন্ঠিত সম্রাজ্ঞী। সেদিকে চোখ পড়তেই হতভম্ব কালমীর। এ যে অবিকল জোনাকি!

অবাক হয়ে কালমীর ভাবতে থাকেন-

এটা কি স্বপ্নভঙ্গ না স্বপ্নপূরণ!

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত