ব্যক্তিগত জার্নালঃ ০১

 

আমি আজন্ম লোনার৷ জীবনে জীবন জড়ায়ে যাবতীয় মানুষের যেই সব গল্পেরা থাকে, সেই সব গল্পে চরিত্র হয়ে ঢুকতে পারি না কখনো। গভীর রাতে একলা শুয়ে নেটফ্লিক্স দেখতেছি, ওই সিনেমায় যেনো জীবন। হেডফোনে ডার্ক মেটাল, নর্ডিক, ভাইকিং বা প্যাগান ফোক— বাজতেছে সে সুর জীবনের।

জীবনটারে সবসময় আমি দেখতেছি,ফীল করতেছি এইভাবে। খুব একটা পরিচয় হয় না কারো সাথে, যাও বা হয় দুয়েকজন — দীর্ঘ আলাপ-পরিচয়ে তা আগায়না কখনো। কার্যত আমার কাছে জীবনের দৈর্ঘ্য বড়জোর আইজি স্টোরি। ওটুকুই জীবন। ওখান থেকেই মাখন তোলার মতো করে তুলে নিই গল্প। না হোক লেখা। জমা না হোক তা অক্ষরে। তবু ক্লিক। ক্লিক। শাটার ঘোরে। দুই,চার,পাঁচ…। কয়েকটা স্ন্যাপশট।আর গল্প নেই। সব গল্প ফুরালো।নটে গাছটি মুড়ালো। এইটুকুই জীবন। এত্তো ছোট্ট। হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাসে কীভাবে জীবনকে টেনে টেনে লম্বা করে মানুষ!

কালো আমার প্রিয় রং।আমি বিষণ্ণতা লিখি। তবু দুয়েকটা গল্প এমন হেসে ওঠে!

সে কবেকার কথা! স্কুল থেকে হলে ফিরতেছিলাম গ্রীষ্মের মাঝদুপুরে। দেড়টা/দুইটা হয়তো সময়।ঠিক মনে নাই। ঘড়ি দেখি নাই। জ্যামে পড়ে ক্লাস নিতে গিয়ে নিজের ক্লাস মিস করছি বলে মেজাজ খারাপ। মাথার উপ্রে ঠা ঠা রোদ। সেই ঠা ঠা রোদ মাথায় নিয়ে আকাশের দিকে হঠাৎ তাকালাম। এতো নীল! আমার মুগ্ধতায় যেনো বা উচ্ছ্বসিত হয়ে বাতাস বয়ে গেলো এক ঝলক।কী এক ভালোলাগা এসে যে ভর করলো! আমি জেনে গেলাম এই ক্ষণটা আমি ভুলবো না কোনদিন। এই যে একটা স্ন্যাপশট। মেয়েটি আকাশের নীলে ডুবে গেছে।আকাশ নাকি সমুদ্র? নাকি আকাশ-সমুদ্র? চমকাচ্ছে দুপুর। জীবন হয় নীল। এটুকুই গল্প।এটুকুতে গল্প।

চাকরির পরীক্ষা দিতে গেছি বিকেলে। শ্যামলীর ওদিকে। পরীক্ষার হল থেকে বেরোতে বেরোতে সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে হেঁটে বাসায় ফিরবো। সোজা পথে হেঁটে যেতেও কমপক্ষে ঘন্টা দেড়েক লাগবে। হাঁটছি।

এই হাঁটাহাঁটির পর্ব শুরু হয় কলেজে ভর্তির পর। চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে প্রাইভেট পড়তে যাই। জায়গাটা আসলে চুয়াডাঙ্গাও না।বাসস্ট্যান্ড ও না।তবু এই নাম কেন কে জানে! ওইখানে সব প্রাইভেট টিচাররা ব্যাচ পড়ান। তখন কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি প্রায়। বেছে বেছে হয়তো দুয়েকটা ক্লাস করি। প্রাইভেট পড়তে যাইতে হয়, তাই যাই।টিচার বদলাইতে বদলাইতে শহরের সব টিচারের কাছে পড়ে ফেলছি। কিন্তু আমি তো আসলে পড়তেছি না।তাহলে এইখানে এসে ক্যান বসে থাকতেছি! এইটা মনে হইলো একদিন যাওয়া বা আসার পথে। পরদিন থেকে যাওয়া ছেড়ে দিলাম। রিকশা ভাড়ার টাকা দিয়ে বই কিনি। আর ওই সময়টা… ওই দু’,তিন ঘন্টা আমি হেঁটে বেড়াতাম। যেহেতু ফেরার ঠিকানা ছাড়া আর কোন লক্ষ্য নেই ; আমি খালি হাঁটতেছি।খোলা চোখে দেখতেছি ক্যানভাসে ক্যানভাসে আঁকা হইতেছে জীবন।

তো শ্যামলী থেকে হাঁটতে হাঁটতে পান্থপথ সিগন্যাল পার হয়ে একটু পরে হঠাৎ চাপা স্বরে বিড়ালের ভয়ার্ত ডাক শুনতে পেলাম। এদিক ওদিক তার উৎস খুঁজতে লাগলাম। খানিক বাদে উনি দৃষ্টিসীমায় ধরা দিলেন। সাদা ধবধবে একটা বিড়াল। কিশোর বয়সের। ওইদিন মার্কেট বন্ধ ছিলো সম্ভবত। দোকানের শাটার আর গ্রীলের ফাঁকে উনি ক্যামনে যানি আটকায়ে গেছেন। বেরোনোর চেষ্টায় তিনি আরো উপরে উঠছেন। কিছুতেই আর নামতে পারতেছেন না। পনেরো -বিশ মিনিটের চেষ্টায় উনারে বের করতে পারলাম। বিড়ালটা বের হয়ে চলে গেলো না। আমার পায়ের কাছে বসলো। যেনো উনি বলতে চাইতেছেন, নিয়া যান আমারে…। আমি জানি আমি ওরে নিতে পারব না। আমার মনের মধ্যে এমন করে উঠলো! আমি উনারে রাইখা পেছন দিকে তাকাইতে তাকাইতে হাঁটতে শুরু করলাম আবার।উনি বইসা আছেন। যাচ্ছেন না কোথাও। ফুটপাথে মানুষের পাগুলো দ্রুত চলতেছে বা ধীরে। তারই এক কোণে দোকানের বন্ধ শাটার ঘেঁষে উনি বইসা আছেন।এই গল্প বিষাদের। হাহাকার! তখনই আমি জেনে গেলাম, এই বিড়াল সারাজীবনের জন্য আমার মনের কোণে বিষণ্ণতা হয়ে বসে থাকবে চুপটি করে।

এই যে ছোট্ট সাদা বিড়াল। এই যে শীতকালের বিকেলে হেঁটে যাওয়া মেয়েটা। এক টুকরো বিষণ্ণতার গল্প পড়ে আছে ওইখানে। ওই পান্থপথে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত