ছফা বন্দনা


আহমদ ছফার প্রতি অনুরাগ কিংবা আকর্ষণ যাই বলিনা কেন, জন্মায় সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস পড়িবার পর। তখন আমি সদ্য ঢাকা ভার্সিটির উঠানে পা রাখিয়াছি। এর আগে, আমার চাটগাঁয় বাড়িয়া উঠিবার সময়, আহমদ ছফার নামের সহিত আমার পরিচয় ঘটে নাই। এই কারণে উত্তরকালে মনে মনে লজ্জিত এবং অনুতপ্ত হইয়াছি বহুবার। মনে আছে, আমাদের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা সাহিত্য অংশে একটা প্রশ্ন আসিয়াছিল — গাভী বিত্তান্ত কার লেখা? চারটে অপশনের মধ্যে আহমদ ছফার নাম আমি প্রথমেই খারিজ করিয়া দিয়াছিলাম!
ভার্সিটিতে আমার ঠাঁই হয় বঙ্গবন্ধু হলে, ৪১৩/ক নম্বর রুমে। বাংলা সাহিত্যের এক বড় ভাইয়ের বইয়ের গাদার মধ্যে খুঁজিয়া পাই ছফার গাভী বিত্তান্ত বইখানা। এক নাগাড়ে পড়িয়া ফেলিলাম। তারপর পড়িলাম অলাতচক্র। সেই থেকে একটা ঘোর লাগা ভাব শুরু, যা পরিপূর্ণতা পায় বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসে এসে। তারপর একের পর এক ছফার সবগুলো বই একে একে পাঠ করিতে লাগিলাম — সূর্য তুমি সাথীএকজন আলী কেনানের উত্থান পতনমরণ বিলাসবাঙালী মুসলমানের মন, … — আমার মনে যেন খুলিতে লাগিল একেকটি বৈচিত্র্যপূর্ণ নব নব জগৎ!
এছাড়াও, তখন এক বড় ভাইয়ের সুবাদে আমার পরিচয় হয় সলিমুল্লাহ খান সাহেবের বক্তৃতার সাথে। সুযোগ পেলেই খান সাহেবের সেমিনারে গিয়া বসতাম, মূল আকর্ষণ অবশ্যই ছিল ছফা সংক্রান্ত আলোচনা। মনে আছে, একদিন খান সাহেব আর সি মজুমদার অডিটোরিয়াম থেকে বক্তৃতা করিয়া বাইর হওনের কালে, আমি তাঁহার পিছ লইয়াছিলাম। বলিলাম, “আমি আহমদ ছফার প্রায় সবগুলো বই পড়ছি” ।
তিনি জিগাইলেন, “আপনার বাড়ি কোথায়?”
আমি বলিলাম, ”পটিয়া।”
তিনি বলিলেন, “ওহ, আপনি তো ছফার এলাকার লোক! তো, মাঝে-মধ্যে কনকর্ডে আসবেন। ওখানে আমি বসি। ছফার বন্ধু-বান্ধবরাও আসেন।”
তো ছফার বাড়ি যে আমার বাড়ির অনতিদূরেই, কিংবা আমার বাড়ি যে ছফার বাড়ির পাশেই, এবং সেই সূত্রে যে, আমরা এক প্রকার পড়শি, তাহা তো আমি ছফার বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক পরিচিতি পড়িয়াই জানিয়াছিলাম। কিন্তু খান সাহেবের বলা “আপনি তো ছফার এলাকার লোক!” শুনিবার আগ পর্যন্ত তাহা আমার অনুভূতিকে আন্দোলিত করে নাই। তো, খান সাহেবের এই কথা শুনিয়া মনে সিদ্ধান্ত লইলাম, আমি ছফার জন্মস্থান, তাঁর গ্রামের বাড়িতে যাইব। শেষমেশ ২০১৬ সালে রোজার ঈদের ঠিক পরের দিন আমরা ছফার বাড়িতে গেলাম।
ছফার বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়ার সাতবাড়িয়া গ্রামে। পটিয়ায় আমার নিজ বাড়ি হইতে রওনা হইয়া আমরা চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে গাছবাড়িয়া পেট্রোল পাম্পের পাশে নামিলাম। তারপর ডান পাশের রাস্তাটায় নামিয়া একটা দোকানে ঢুকলাম। দোকানে বসা এক বর্ষীয়ান মুরুব্বিরে কইলাম, “আমরা আহমদ ছফার বাড়িতে যেতে চাই, কিভাবে যাব?”
মুরুব্বি জিগাইলেন, “কোন আহমদ ছফা? কবি আহমদ ছফা?”
আমি বলিলাম, “জ্বি, জ্বি”।
আহমদ ছফারে যে তাঁর গ্রামের লোকজন ‘কবি আহমদ ছফা’ নামে চেনেন, তাহা আমি ঢাকায় থাকিতে নানামুখে শুনিয়াছিলাম, সেইদিন প্রমাণ পাইলাম। মুরুব্বি পথ বাতলাইয়া দিলে আমরা সেই মতে আগাইতে থাকিলাম।
রাস্তা মাপিতে মাপিতে আমরা এক সময় বরগুইনি খালের কাছে পৌঁছিয়া গেলাম! বরগুইনি খাল, যার দুই কূলের জনজীবনকে কেন্দ্র করিয়া ছফা তাঁর প্রথম উপন্যাস সূর্য তুমি সাথী লিখিয়াছিলেন। খালের পাড়ের রাস্তা ধরিয়া টানা হাঁটিতে হাঁটিতে আমরা ছফার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। বাড়ির নাম ‘সাহিত্যিক পাড়া’। জানিলাম, এই নামকরণ খুব আগের নয়। তবে এলাকার তরুণদের মধ্যে ছফাকে ঘিরিয়া আগ্রহ ও চর্চা উভয়ই সঞ্চার হইয়াছে। তাঁহারাই উৎসাহী হইয়া বাড়ির নাম রাখিয়াছেন ‘সাহিত্যিক পাড়া’।
Sofa 2
আহমদ ছফার বাড়িতে। ডানে ছফার ভাইপো সিরাজুল আনোয়ার। বাঁয়ে লেখক।
আহমদ ছফার বাড়িতে গিয়া আমরা তাঁহার বড় ভাতিজা সিরাজুল আনোয়ারের আতিথেয়তা গ্রহণ করিলাম। তিনি আমাদেরকে তাঁহার বাবার কবর, দাদার কবর দেখাইলেন। তারপর আমাদেরকে ঘরে লইয়া গেলেন। তিনি আমাদেরকে নুডলস ও দুধ দিয়া আপ্যায়ন করিলেন।
আহমদ ছফার সময়কালীন ঘরের কেবল একটা মাটির দেয়াল এখনও ছফার স্মৃতিস্বরূপ রাখা হইয়াছে। শরিকদের এখন আলাদা আলাদা ঘর উঠিয়াছে।

তো, সিরাজ সাহেবের সহিত অনেক আলাপ হইল। তাতে, ছফা, তাঁহাদের চাচা-ভাতিজার সম্পর্ক, তাঁহাদের বর্তমান হাল-হক্বিকত ইত্যাদি নানা বিষয় উঠিয়া আসিল। অতঃপর আমরা বিদায় লইয়া চলিয়া আসিলাম।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত