খুন -২

রোকেয়া রাহমান বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাড়িতে কেন সিসি ক্যামেরা এখন বসানো হয়নি তা নিয়ে ফোনে ছেলে বেশ কিছুক্ষন বকলো তার মা’কে। একমাত্র ছেলেকে জীবনের সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ ঢেলে বড় করেছেন।

বড় হয়েই ছেলের মনে হল এই দেশ বসবাস অযোগ্য। তার বন্ধুরা সবাই যে যার মতো বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। চেষ্টা তদ্বির করে সেও একদিন চলে গেলো। তাও প্রায় সাত বছর হবে। ওখানে ছেলের কাগজপত্র ও কর্মকাণ্ডের কিছু জটিলতায় পড়ে দেশে ফেরা সম্ভব হচ্ছে না।

এতো গুলো বছর একমাত্র ছেলেকে কাছে থেকে দেখতে পান না, ছুঁতে পারেন না। তার বুক ভেঙে যায়। রোকেয়া মন খারাপ করলে ছেলে কোনো কোনো দিন আদর করে মাকে বুঝায়। অধিকাংশ দিনই মা’কে রাগ করে, ধমকায়। কেন যে এতো রাগ তার! রোকেয়া বোঝে পুত্রের এই রাগ অসহায়তার আরেক রূপ। তাই তিনি মনে কষ্ট নেন না। ছেলের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করেন। এবং বিশ্বাস করেন তার দোয়াতেই ছেলে একদিন সব বিপদ পার হয়ে আসবে।

তবে ডালিমের মৃত্যুর পর ফোন করে বকাবকি করার হার খুব বেড়েছে। ডালিমকে ভাড়া দেয়াটাও তার অপছন্দ ছিল। বারবার নিষেধ করেছিল ব্যাচেলর কাউকে ভাড়া দিতে। ভাড়া যখন দিয়ে ফেললো তখন আরেক রকম বকাঝকা শুরু হলো, এতো খাতির কেন ওই ছেলের সাথে? ঢং করে আবার মা বলে কিসের জন্য? একদিন এ-ও বলেছিল, দেখ মা ওই ছেলে যেন আবার তোমাকে খুন না করে পালায়।

মায়ের জন্য কত ভাবনা। আর ডালিমের মা এখন কেমন করছে? ডালিম সব বলতে না পারলেও অল্প স্বল্প কিছু বলতো তাকে। ‘ বাড়ি থেকে বের হয়ে যা’ প্রথম বলেছিল তার মা। অপরাধ ঠিক কী ছিল তা খোলসা করে জানতে চাননি রোকেয়া। ডালিমও বলেনি। যে এনজিও তে চাকরি করে সেখানে নারী পুরুষ অনেকে তাকে নানা প্রলোভন দেখায়। নারীর প্রতি সে অনীহা বোধ করে তেমনি অধিকাংশ পুরুষের প্রতিও একই মনোভাব তার। আবার যার প্রতি আগ্রহ বোধ করে দেখা গেছে তারা ওর এই আকাঙ্ক্ষার, ভালোবাসার সঙ্গী হতে নারাজ। কিছুদিন আগে বলেছিল, মা টাকা জমাচ্ছি। এবার একটা একটা করে অপারেশন করাবো ঠিক করেছি।

রোকেয়া বলেছিলেন কেন রে হঠাৎ অপারেশন করার সিদ্ধান্ত কেন? শুনেছি তাতে অনেক খরচ আর অনেক ঝক্কিও। বিয়ে করার চিন্তা করছিস নাকি?

তখনই জলি এসে পড়ায় মুখে কিছু বলেনি ডালিম। তবে রোকয়া এবং জলি কারোরই চোখ এড়ায় না ডালিমের টকটকে ফর্সা মুখটা কেমন আরক্ত হয়েছিলো। হয়তো জলি তখনি উপস্থিত না হলে সে কিছু বলতো।

জলির যে ডালিমের প্রতি প্রবল আগ্রহ তা রোকেয়া কয়েকদিনের মধ্যেই ধরে ফেলেন। কিন্তু সেটা যে একেবারেই এক পাক্ষিক ব্যাপার তা রোকেয়া জানতেন বলেই জলির যখন তখন ছাদে যাবার উসিলাকে তিনি রোহিত করেননি। হয়তো করলেই ভালো করতেন।

দরজায় কলিং বেল বাজে। রোকেয়া শোয়া থেকে উঠে বসেন। জলি দরজা খুলে দেয়। রোকেয়ার ছোটো বোন রুমু এসেছে। রুমু শোবার ঘরে এলে জলিও তার পেছন পেছন আসে। রুমু বলেন, জলি আমার জন্য এক গ্লাস পানি আনো। বরফ দিয়ে আনবা।

জলি পানি আনতে যায়।

রোকেয়া বলেন, কীরে এমন করছিস কেন? কী হয়েছে তোর?

রুমু বলেন, আপা কথাটা আমি ফোনেও তোমাকে বলতে পারতাম। কিন্তু মনে হলো তোমার সাথে দেখা হওয়া জরুরি।

: আচ্ছা বল, কী হইছে?

: কী আর বলব আপা? আমাদের একমাত্র বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলের খবর শুনছ কিছু?

: কী শুনব? পল্লব তো নতুন চাকরিতে ভাসানচর জয়েন করছে। ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, ভালো পজিশন।

আরো কিছু বলছিলেন রোকেয়া। রুমু ওড়ানার নিচে তার বোনের হাতে হালকা চাপ দিলো। ইশারাটা বুঝলেন রোকেয়া। চুপ করে গেলেন। জলি পানি নিয়ে এসেছে।

খুব ছোটো ছোটো ঢোকে পানিটা খেলো রুমু। খেয়াল করল জলি এই ঘর থেকে যাবার নাম করছে না।

পানির গ্লাস জলির হাতে ফেরত দিতে দিতে রুমু বলল জলি খুব খিদে পেয়েছে, সিঙ্গারা বানাও আমার জন্য। অনেক দিন তোমার হাতের সিঙ্গারা খাই না। আর বেশি করে দুধ চিনি দিয়ে চা বানাও।

রোকেয়া অবাক হয়ে বলেন, তুই না ডায়েট করিস। এই অবেলায় সিঙ্গারা, দুধ চা খাবি?

রুমু বলে, আপা ডায়েটে কিছু দিন পর পর ব্রেক দেওয়া জায়েজ আছে।

যাও জলি তাড়াতাড়ি করে বানাও আমি আবার এখান থেকে মেয়ের কোচিং-এ যাব। মেয়েকে নিয়ে বাসায় যাব।

জলি নিতান্ত অনিচ্ছায় রান্নাঘরের দিকে গেলে রুমু উঠে গিয়ে ঘরের দরজায় লক দিয়ে বোনের দিকে ফিরল।

রোকেয়া বোনের এমন অদ্ভুত আচরণের কোনো অর্থ বুঝতে পারছেন না।

রুমু প্রায় ফিসফিস করে বললো, পল্লব যে ঢাকায় তুমি জানো?

রোকেয়া বিরক্ত হয়ে বলেন, কী বলিস এসব? ওর নতুন চাকরির শর্তই তো প্রথম তিন মাস কর্মস্থল ছেড়ে কোথাও যাওয়া যাবে না।

রুমু একটু ব্যাঙ্গ করেই বললো, যাবে যাবে। এবং যায়ও নিয়মিত।

: কী বলিস তুই? ওর বাবা অসুস্থ তবুও আসতে পারল না।

: ওসব কিছু বানোয়াট কথা।

: তুই কিভাবে জানলি?

: আমি কীভাবে জানলাম তা দিয়ে কী হবে? ও যে তোমার বাসায় নিয়মিত আসতো তা-ও তো তুমি টের পেতে না।

: কী টের পাবো? জলির সাথে কিছু হয়েছে?

: তোমার আসলেই বয়স হয়ে গেছে আপা। এতো সহজ নয় ব্যাপারটা। হয়েছিল ডালিমের সাথে। তোমার জ্ঞাতসারে, অজ্ঞাতসারে পল্লব ডালিমের কাছে আসতো। ডালিম যেতো ওর কাছে। কক্সবাজার মিট করতো, হোটেলে।

তারপর রুমু গলার স্বর আরও খাঁদে নামিয়ে বিড়বিড় করে যেন নিজেই নিজেকে বলে, ভাইয়ার ছেলেটা শেষ পর্যন্ত এমন একটা কাজ করতে পারলো? এর চেয়ে আমার মেয়ের সাথেও যদি প্রেম করতো এতো রাগ হতাম না মনেহয়, তুমি বুঝতেছ আমি কী বলতেছি?

রোকায়ার কানে কথা যায় না আর। পল্লব বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলে। এমন নম্র ভদ্র মেধাবী ছেলে লাখে মেলে কিনা সন্দেহ। দশাশই গড়ন। ব্যাক্তিত্ব ঠিকরে পড়ে ওর সমস্ত চলন বলন থেকে। রোকেয়া খুব আফসোস করতেন তার ছেলে যদি পল্লবের ছিটেফোঁটাও হতো। কিন্তু এসব কী শুনছেন তিনি। পল্লবের তাহলে ডালিমের সাথে কোনো সম্পর্ক হয়েছিল! ফুপুর খোঁজখবর নিতে আসার নাম করে সে একটা নাছেলে-নামেয়ের প্রতি প্রেমে মজেছিল? চাকরিতে ছুটি নাই বলে বাবার অসুস্থতায় আসতে পারে না যে ছেলে, সে চুরি করে ঢাকা আসতো নিয়মিত! এসব কী শুনছেন তিনি!

রুমু একটু ঝাকি দেয় রোকেয়ার হাত ধরে। বলে, এই আপা এমন ঝিম মেরে গেলা কেন? তুমি কিছু জানতা নাকি? পল্লব একটা ছেলের ছেলের সাথে প্রেম করত, সেই ছেলে তোমার ভাড়াটে, সেই ভাড়াটে আবার খুন হয়েছে!

রোকেয়া তখনও অবুঝের মতো তাকিয়ে থাকে বোনের মুখের দিকে। রুমু বলতে থাকে, পল্লব কে পুলিশ খবর দিয়ে ঢাকা এনেছে।

চমকে উঠে রোকেয়া জিজ্ঞেস করেন,
: ওকে গ্রেফতার করেছে?

: আরে দূর শুধু শুধু গ্রেফতার করবে কেন? ও কী আসামী? ডালিমের কল লিস্ট চেক করে পল্লব কে ঢাকা আসতে বলেছে পুলিশ, জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

(ক্রমশ)

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত